গারো পাহাড়ের চিঠি: পাতিল হাঁটি ও জ্যোতি’র শৈশব

এখনো কি বিক্রি হয় হাঁড়ি, পাতিল, সরা কিংবা লালরঙে কাজ করা মাটির ব্যাংক? পথের পাশে মাটি পসরা দেখেই দাঁড়ালাম। মফস্বলের শেষ বিকালের হাটে পসরা সাজিয়ে বসেছে। আছে হরেক রঙের মাটির পুতুল- পাঁচ আঙুলে গড়ে ওঠা টেপা পুতুল; সালংকারা পুতুল স্থির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাট বাজার দেখছে।

দেখছে স্থানিক হাট বাজার কেবলই পড়তির দিকে। আমাকেও কি তিনি দেখছেন? একেকজন একেক ভাবে দেখে বলেই নানা মত নানা পথ- নানা পথের পথিক।

শেষ বিকেলের আলো পথের পাশেই যেন স্থির আসন গেড়েছে। গায়ে সয়া রোদের সাথে মেটে সিঁদূরে মাখামাখিতে সারি সারি যুদ্ধের মাটির ঘোড়া মাটির ঘর মাটির গরু আর ছোট ছোট মুছির পসরা নিয়ে বসা জায়গাটি কেমন যেন এক মায়াবী আবিরে রঙিন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

মেটে সিঁদুরে আলোর ভেতর উঁকিঝুঁকি মারছে আমার শৈশব। বাবার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরান জ্যোতি’র শৈশব। তখন একটিই পসরা ছিল না- ছিল সারি সারি পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দোকানও- ছিল কাঁচা বাজারের ভিড়ের মতো ত্রস্ত বেচেকিনি। হল্লা। ব্যস্ততা। গা ঘেষে ঘেষে দর কষাকষি।

নামাঙ্কিত হয়েছিল ‘পাতিল হাঁটি’ নামে। দোকানের ভেতর থেকে রাস্তার পাড় ঘেষেই ছিল এক একটি দোকানের বিস্তার। মেটে রঙের নানা মাটির জিনিস। এখন যেমন এইগুলো কেবলই শৌখিন- শো কেসে থাকে কাঁচের আড়ালে; সেদিন পর্যন্ত দেখেছি মাটির হাড়ি পাতিল সরা মুছি কলসি কিংবা মুড়ি ভাজার জন্য ঝাঁঝরা বড় পাতিল- গেরস্তের নিত্য ব্যবহৃত সামগ্রী। বিলাসের চেয়ে প্রয়োজনের পাল্লা ভারি ছিল গেরস্তের গিন্নীর কাছে।

আমার আবদার ছিল লাল রঙে কাজ করা মাটির ঘোড়ার দিকে। পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার পিঠে ঘোড়সওয়ার। কোমরে বেল্ট। বেল্টের পাশে মাটির তলোয়ারের মোটা দাগ। জিনে পা দিয়ে ঘোড়সওয়ার বসে আছে নিথর হয়ে- অস্পষ্ট চোখে। এমন ঘোড়ার প্রতি আমার ছিল দূর্বার টান। পড়ার টেবিলের উপরে বাঁশের আড়ে দড়ি আর তক্তা দিয়ে যে তাক বানিয়েছিলাম- তার সবটুকু জুড়েই ছিল নানা রঙের নানা সাইজের ঘোড়া-হাতিও ছিল একটা; শুড় তোলা সাদা রঙে রঙিন দাঁতাল হাতি- কোনটা অষ্টমীর মেলা থেকে কোনটা ‘পাতিল হাঁটি’ থেকে বাবার সাথে কেনা।

আরও পড়ুন: প্রেতপুরী থেকে মরণদোল: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী ২

এই ঘোড়া নিয়ে আমার বাতিকগ্রস্ততা বাবাকে বিরক্ত করত নিশ্চয়ই। আবদারের সাথে পা দাপিয়ে কান্নাকাটি করার ভেতর হয়ত বুঝিনি কেন বাবা মানা করতেন। মঙ্গল আর শুক্রবারের হাটে একটু ব্যতিক্রম ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ার দেখলেই চঞ্চল হয়ে উঠত চোখ। বাড়িতে ফিরে দাপাদাপি। স্কুল থেকে ফেরার পথেই ছিল পাতিল হাঁটি। কাজে কাজে সহজই ছিল নানা দোকানের পসরা দেখা।

আমাদের ছিল নিন্মবিত্তের পরিশ্রমের সংসার। নিত্য ঘোড়া কেনা কিছুটা বিলাসিতাও বটে। সেই কারণেই হয়তো বাবার বিরক্তিটা ছিল। পেছনের কারণ সে সময় দেখতে পাইনি।

আমার ছেলেদের মাটির ঘোড়া টোড়ার প্রতি কোন আর্কষণ নেই। হয়তো এখানে সেখানে মেলায় রঙকরা ঘোড়া দেখিয়ে বললাম, দেখো কী সুন্দর! একটু তাকিয়েই, ‘ও আচ্ছা, সুন্দর মাটির ঘোড়া’।

ব্যস এই পর্যন্তই! চোখে কোন চঞ্চলতা নেই; হাত বাড়িয়ে দেখবার কোন তৃষ্ণার্ত আগ্রহ নেই। যত আগ্রহ আকুলতা মোবাইলে গেম খেলা আর দুই হাতের দশ আঙুলের ভেতর ঘুরছে রুবিক্স। মেলাবার কসরত। কখনো তিন পার্টের কখনো পাঁচ বা বার পার্টের রুবিক্স নিয়েই চলছে বড় ছেলের শৈশব কাল।

অটো রিক্সার হর্নে চমকে উঠলাম। একটু মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালাম হাড়ি পাতিলের দোকানের ভেতর। দূর্জয় পাল পসরা সাজিয়ে জলচৌকিতে বসে আছে। সালংকারা পুতুল হাট বাজার দেখছে। মানুষের ত্রস্ত চলাচলে ধুলা উড়ে উড়ে জুড়ে বসছে মেটে সিঁদুর রঙা হাড়ি-পাতিল-সরার শরীরে।

মেটে রঙা শেষ বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে এসেছে। কালো রঙ ধরতে শুরু করেছে। ভোগাই ব্রীজের ল্যাম্প পোস্টের আলোও জ্বলল এবার।দূর্জয় পাল বসে আছে। পঞ্চমে পড়া দূর্জয় পাল পসরা সাজিয়ে বসে আছে…

যদি গাহেক আসে!
যদি গাহেক আসে!

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!