গারো পাহাড়ের চিঠি: মনসা পুজা

কাল মনসা ভাসান। শ্রাবণ সংক্রান্তি তিথীতে পুজো। কোথাও একট্টা সমরূপে নেই। গল্পের কাঠামো স্থানের রঙে রঙিন। নানা রূপে পুজিতা। কোথাও ঘট কোথাও পট আবার কোথাও কাঠের কাঠামোতে মনসা মূর্তিমতী—মেলানো সহস্র সাপের ফনার আকার। আবার কোথায় মাটির সরায় তুলির আঁচড়ে শিব পার্বতী ও নালসহ গোলাপী পদ্মের ছড়া।গত শতকের আটের দশকে আমি যখন খালভাঙা গ্রামে যেতাম ভোগাই নদী পেরিয়ে। এই মাটির সরাই আনতাম বাড়ির পুজার জন্য।

আর দাঁড়িয়ে দেখতাম চৌচালা টিনের ঘরে সারি সারি প্রতিমা। অসমাপ্ত।তবুও প্রতি মূর্তিতে মা আর্বিভূতা হচ্ছেন। সন্তাপ পালের তুলির আঁচড় এখনো শেষ হয়নি।আরো কয়েকজন সহকারিগর নিয়ে সন্তাপ গত সাতদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। কালোর আঁচড়ে এখনো চোখ ফুটিয়ে তোলা বাকি। কোন প্রতিমা মাটির শাড়ি পরিহিতা–সাদা রঙে লাল পাড়।কোনটা কাপড় কেটে কেটে আঠায় লাগানো শাড়ীর আঁচল ছড়ানো কুচি। আর জড়ির পাড়।মাটির বা শোলার গয়না হাতে নাকে গলায় কিংবা পাটের শন কালো করা মাথায় চুলের খোঁপায় পরানো তখনো বাকী। আজকাল এসব বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।নানা কাঠামোতে নানা কাজে সারারাত লেগে যাবে। ভোর হলেই গেরস্থ স্বামী কাঁধে করে নিয়ে যাবে দেবী।

মূলত মৃন্ময়ী দেবী যাবেন রক্ত মাংসের নারীর কাছে। তিনিই সংসারের মঙ্গল কামনায় তাকে তন্ময়ী করে তুলেন প্রেমের ছোঁয়ায়;চালবাটা গোলায় আল্পনা এঁকে; ফুলে ফলে নৈবেদ্য আর উলুধ্বনি ও শঙ্খের গর্জনে সাত পাড়ার মানুষকে জানিয়ে জাগিয়ে উল্লাসের আহ্বানে। এখানে নারীর কৃতি। নারীর প্রীতি। নারীর সাধর্ম।

মাটির সরায় যারা রঙ তুলিতে আঁকতেন তারা কেউ আর্ট স্কুলে শেখা শিল্পী ছিলেন না। কী নিখুঁত ফুটিয়ে তুলতেন শিব–শিবের জটা ত্রিশূল আর পার্বতী আর ফুটন্ত লাল পদ্মা। তারা ছিলেন ‘বিশ্বাসের শিল্পী’ পারিবারিক আবহে পরম্পরা জ্ঞান। দেখতে দেখতে করতে করতে সবাই বাড়ির সবাই আঁকিয়ে হয়ে উঠতেন। সাকারের কারিগরে কর্মের ভেতর দিয়ে দুই-ই সেরে দিতেন–একদিকে পেটের রোজগার আর অন্যদিকে খড় মাটি রঙ মনের মিশ্রনে দেবীর প্রতি নির্মাণের শ্রদ্ধার্ঘ্য–কর্মই ধর্ম।

যাপনের ভেতর থেকেই চিন্তা চাগিয়ে উঠে।যাপনের পরতে পরতে থাকে ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার নানা অনুপল। সেই চিন্তার মূর্ত রূপ আকার পায় মৌখিকতায়–গল্পে ব্রতে কবিতায় গানে পালাগানে দর্শনে আর মূর্তিতে। নানা জনের নানা কৃতি।

অধিকারী ভেদে চিন্তা নানা আকার পায়। কারো ব্রত কথা কারো গানে কারো মৃন্ময়ী মূর্তিতে অথবা কারো বা দর্শনে। যে যেমন অধিকার তেমনি তার স্ফুর্তির ধরন।তেমন তার বয়ন ও বয়ান।

এই তল্লাটের নানা কথা লিখতে গিয়ে নানা স্মৃতি মনের পর্দায় ভাসছে। তবে একথা বলতেই হবে তুমি যত্নশীল পাঠক শুধু নও প্রশ্নকর্তাও বটে। এমন এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দাও যে নানা স্মৃতি ও শ্রুতি চোখের সামনে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

আমার মায়ের পরিসর ছিল ব্রতের ‘কথা’। হোক সে দৌল্লা ব্রত বা বিপদনাশিনী বা বস্তু পুঁজা অথবা মনসা আরাধনার। পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ নৈবেদ্যসহ নানা উপাচারে পুজা সমাপনই শেষ কথা ছিল না। পুজার পরই মা মনসা ব্রতের ‘কথা’ বলতেন।

সকল এয়োতিরা হাতে ধান দূর্বা নিয়ে গোল হয়ে বসতেন দেবীকে ঘিরে। মা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলে যাচ্ছেন “কথা”। মাথায় আধখানা শাড়ির আঁচল দিয়ে এয়োতিরা শুনছেন আর জোগাড় দিচ্ছে চারদিক কাঁপিয়ে। সমস্বরে যে কোন ধ্বনিই উচ্চকিত ও মাঙ্গলিক।

গেরস্থ বিপদাপন্ন নির্দন নিঃসন্তান নানা যাতাকলে দিনানিপাত করছেন। এই দেবীর আসন পেতে আরাধনায় করলেই নির্ধনের ধন হয় নিঃসন্তানের ঘর আলো করে সন্তান হয়ে ঘর ভরে। ঘর হয় জন হয়। প্রতাপ হয়। সুখি হয়। এমনই ছিল ‘কথা’র আকার।

বর্ষায় সাপের প্রার্দুভাব, মনসার পূজিতা হবার সাধ, গেরস্তের মঙ্গল কামনা আর চাঁদ সওদাগরের উত্থান পতনের দুর্দশার গল্পই থাকত মায়ের ব্রত ‘কথা’র বয়ানে। প্রতি বছর গল্পের কাঠামো ঠিকঠাক রাখতে পারলেও বয়সের চাপে কথার হেরফর হতো প্রচুর। অনেক কথা ভুলে যেতেন আবার কিছু নতুন অনুষঙ্গ যোগ দিতেন। মায়ের গল্প বলার ঢঙের কারণেই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন এয়োতিরা। শ্রোতৃ যারা ফি বছর শুনতেন তারা ঠিকঠিক বুঝতেন তাদের মাসিমা কথার এই প্রসঙ্গ ভুলে গেছেন ঐটুকুন নতুন করে জুড়ে দিয়েছেন। মা আমার দাঁত পড়ে যাওয়া মুখে হাসতে হাসতে হাতে রাখা ফুল বেলপাতা মৃন্ময়ী মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গড় করে প্রনাম সেরে নিতেন। সাথে সাথে সবাই।

গৃহকর্ত্রী তাই দেবীর দিকে ঝুঁকেন। সংসারের ক্ষমতার সাথেই তার ক্ষমতায়ন। আঁচলে চাবির গোছা। কর্তা ভাবের আকার নেয় নারী সত্তার ভেতর। নারীর ক্ষমতায়ন তাই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে ক্ষমতায়ন। নিজে নিজে বিচ্ছিন্ন কোন নারীবাদী হবার সাধনা তার ভেতর নেই।

দেবীর আরাধনায় তাই অনার্য কুল নারী উন্মুখ।মাটিতে দাগ দিয়ে এদিকে সাকার আর ওদিকে নিরাকার এমন বিরোধাভাষ সে ভাবে না। সে ভেবেছে “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাঁজাও আপন সুর।”

সেই সুরেই তার ঘট প্রতিষ্ঠা। সরায় অংকন। ব্রতকথা। মনসা ভাসান। চাঁদ সওদাগর। যার যেমন ভাবের তল তার তেমন আকার সাকার নিরাকার। কোথাও বিরোধ নেই। বরং সৌন্দর্যের স্ফূরণ। ভিন্নতার স্বাদ আর সাধ।বহুর সাধনা। একম্ সদ্ বিপ্র বদন্তি। সেই অদ্বয়কে নানা রূপে নানা ভাবের বিভাব।

খুব ভারি ভারি কথা হয়ে গেলো কি না জানি না। তুমি তোমার নারী সত্তায় মর্ম দিয়ে বুঝে নিও কিংবা বলা ভালো অনুভব করে নিও। অনুভবের ব্যাপ্তি গভীরতায় যেমন তেমন প্রসরাতায়। তবুও জানো মনের ভেতর যে দুঃখ বাজে সেটি হলো মায়ের নানা পর্বে পার্বনে যে ব্রতকথাগুলো বলতেন তা সংরক্ষণের কথা কখনোই আমি ভাবিনি। মা চলে গেছেন আজ বছর পনেরো হলো, নানা পার্বনে মাকে যেমন মনে পড়ে তেমনি সেই ব্রতকথাগুলো। মৌখিক মাঙ্গলিক কথাগুলো।#

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: সনাতন বিশ্বাস ও উৎসব 

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!