গারো পাহাড়ের চিঠি: সনাতন বিশ্বাস ও উৎসব

সনাতন পরিবারের ইচ্ছা আকাঙ্খা বা নানা বিভাবের কল্পগুলো নির্মিত হয় নানা গল্পে নানা আখ্যানে নানা রূপকে নানা প্রতীকে– বিমূর্ত থেকে মূর্তে; নিরাকার থেকে সাকারে। জীবনের সাধর্মই এমন যে সেই কল্পগুলোই চর্চিত হয় নানা রিচুয়ালে নানা ভাবে লোকাচারে কিংবা দেশাচারে। কোথাও একই ফর্মায় তৈরি একরূপে নাই। স্থানে স্থানে নানা লৌকিকতার মোড়কে চির্চত এই গল্প। একেক পরিবারে একেক ভাবে গৃহের এয়োতি নারীর প্রযত্নে চর্চিত হয় ব্রত কথা। নক্ষত্র তিথী মাহেন্দ্রক্ষণ কালবেলা বারবেলার সূচীর সূত্রায়নে। বারো মাসে তের পার্বণের চর্চিত কথকতায়।

লক্ষ্য কল্পের গল্প দিয়ে মাঙ্গলিক করুণা যাঞ্জা করা। ষাট ষাট বালাই ষাটের বেষ্টনিতে পরিবার পরিজন কিংবা প্রতিবেশির সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি আকুল প্রার্থনা জানানো নিত্য পুজায় অদেখা ইষ্ট দেবতাকে।

এমন কী জীব ও অজীবের যে একে অপরের সামগ্রিক জীবন কাঠামো তার সমৃদ্ধি বিস্তারের প্রার্থনা করা তার অদেখা পরমের কাছে। অদেখাও তার কাছে অদেখা থাকে না–ভাষার ভেতর থেকে ভাষা দিয়ে তাঁর নাম আঁকে নাম ধরে ডাকে নাম ধরে রাখে নানা প্রাত্যহিকতায়।

সনাতন পরিবার নক্ষত্র দ্বারা শাসিত। পঞ্জিকা তার নিত্য সঙ্গি–নানা পালা পার্বণ পালন করার বার ও সময় সূচী। এই যেমন তুলসীব্রত। বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখের প্রথম দিন থেকে বৈশাখের শেষ দিন পর্যন্ত ব্রত কথকতার ব্যপ্তি। পরিবারের বাইরে আরেক যে গল্প সেখানে পহেলা বৈশাখ একদিন আগে হোক–তাতে তার অংশ দিতে আপত্তি নাই। কিন্ত তার পারিবারিক যাপনের নানা পালা পার্বণ নক্ষত্র মেনেই পঞ্জিকার সময় সূচীকে মান্যতা দিয়েই সনাতন গল্পের সে কথক সে অংশীজন।

তুলসী মঞ্চ প্রতিটি সনাতন পরিবারে অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা ভাবে কাজ করা খাঁজকাটা থাক থাক ইটেরবেদীতে তুলসী ছোট ছোট ডালাপালা ছড়িয়ে বাতাসে দুলে। পাশেই পুড়া সলতের পিতলের প্রদীপ আর নারকেলের ছোবায় ধোয়াওঠা ধুপদানী–সেও পিতলের; চকচক করছে রোদের ছোঁয়ায়।

সকাল সন্ধ্যে এয়োতি কর্ত্রী তুলসী তলায় ধূপধুনো আর প্রদীপের আলো ছড়িয়ে প্রণতি দিয়ে তার সংসারের কাজকারবার শুরু। তার নিত্যকর্মে নিত্য কথন। মা আমার সকাল সন্ধ্যে সারাবাড়ি ধূপগন্ধী আর আলোর শিখা ছড়াতে ছড়াতে গাইতেন–

“নমো নমো তুলসী কৃষ্ণ প্রেয়সী
রাধা কৃষ্ণের চরণ পাবো এই অভিলাষী।
নমো নমো
যে তোমার শরণ লয় তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়
নমো নমো তুলসী কৃষ্ণ প্রেয়সী।”

আর ঠিক সন্ধ্যায় দিনের আলো নিভু নিভু করতে করতে যে অন্ধকার দ্রূত লেপ্টে দেয় সারাবাড়ি সারা উঠান তখন দুই হাতে প্রদীপ আর ধূপদানী নিয়ে গাইতেন —

“সন্ধ্যাকালে ঘরে আওরে কানাইয়া
ননী হাতে লয়ে কাঁদছে যশোদা মায়া।”

তুলসী তলায় গড়করে প্রণতি দিয়েই দিনের প্রাত্যহিকতা সম্পন্ন করতেন তিনি। আর সাঁজের বেলায় একঢালা শাড়িতে গলায় আঁচলের অংশটুকু ঝুলিয়েই ঝুঁকে পড়ে সন্ধ্যার প্রণতি জানাতে তিনি। সমস্ত বাড়ি নারকেল ছোবার গন্ধে ভরপুর একহাতে ধুপদানি অন্যহাতে পেতলের প্রদীপের মুখে কমলা রঙের আলোর শিখা।

তুলসী বৃক্ষে তার প্রণতি তার বিশ্বাসের গল্প। তার যাপনের গল্প। তার সেই আকাঙ্খার গল্প। তার কল্পের গল্প। কৃষ্ণপ্রিয়া তুলশীকে উপলক্ষ করে অদেখা আপাতত নামাঙ্কিত পরমের সাথে সমর্পিত হবার গল্প। সেই গল্পে আমি ও আমরা যৌথতার একক একেক জন। দুইহাত কপালে ঠেকিয়ে আমি শৈশবে গল্পের সঙ্গী হতাম। যাপনের সঙ্গী হতেন পরিবারের সকলেই।

বৈশাখের প্রথম দিনের যে ব্রত সেটি হলো তুলসী জলদান উৎসব। সৌর বৈশাখের রুদ্রতাপে তাপিত যখন ধরাতল, একফোটা জলের জন্য তৃষ্ণায় ওষ্টাগত প্রাণ– যখন চৌচির বনতল তখনই এই উৎসব শুরু। তুলসী হলো সনাতনীদের গল্পের “সর্বকামপ্রদা শুদ্ধা বৈষ্ণবী বিষ্ণুসুপ্রিয়া।” তিনি “সমস্ত পত্র ও পুষ্পের মধ্যে তুলসী হচ্ছেন শ্রেষ্ঠা। তুলসী সর্বকামপ্রদা, মঙ্গলময়ী, শুদ্ধা, মুখ্যা, বৈষ্ণবী, বিষ্ণুর প্রেয়সী এবং সর্বলোকে পরম শুভা।”

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: কোচপাড়া 

তুলসী ব্রত হলো তুলসী গাছে গাছের তলায় জল দানের উৎসব। বৈশাখ মাসব্যাপী উৎসব।বৃহত্তের মঙ্গলার্থে একটি ছোট্ট পারিবারিক উৎসব।সেটি আজকাল ভুলে গেছে সবাই। নিজস্ব যাপনে এই উৎসব পালনের কোন পরিসর রাখেনি। কিছুটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা চালে আর কিছুটা নাগরিকের ফ্লাট বাড়ির যাপনে। শুধু নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচার তাড়নায়। এই তো তোমার নাগরিক যাপনের এই সব দিনরাত্রি।

তুলসীতলায় বাঁশের দুই খুঁটির উপর আড়াআড়ি বাঁশের উপর নিক্তির মতো তিনটি দড়ি ঝুলিয়ে তাতে একটি ছোট ছিদ্র করা ঘট ঝুলিয়ে দেয়। ঘটের ছিদ্রপথে ছনের গুটলি পাকিয়ে দেয় আলতো করে। সেখানেই জল ঢালে এয়োতি গিন্নী। স্রোতবাহী নদীর জল সেই ঘটে ঢেলে দেয়। আর ঘটের ছিদ্রপথে ছনচট ছুঁয়ে ছুঁয়ে টুপটাপ জল পড়ে তুলসী গায়ে তুলসীর পাতায় তুলসীর সবে মুখতোলা মঞ্জুরিতে আর তুলসীর তলায় খরখর মাটি ভিজে ছপছপ করে। গাছ বাড়ে। ফুলবতী হয়। প্রসূতি হয়।

মা বাড়ির পাশে ভোগাই নদী থেকে স্নান সেরে জল আনতেন ভেজা শরীরে কাঁখে করে পিতলের কলসী ভরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম মা কী পরম শ্রদ্ধায় ঝরাঘটে জল ঢালছেন। ঘট উপচানো জলে স্নাত হয়ে উঠছে তুলসীর বেদী।

বাড়িতে যখন ভাইদের বৌরা এলো মা এই গল্পের নতুন কথক করে তুললেন তাদের। তারা তখন নদী পেলে না। তীর ঘিরে তখন বসতি আর বসতি। ঘাট সরে গেছে। পাশের বাড়ির পুকুর থেকে ঘড়ায় করে জল তুলে এনে নতমুখে নতুন কথক বৌদি ঘটে জল ঢেলে ঢেলে সম্পন্ন করতেন বৈশাখের তুলসী জলদান উৎসব।

আমার গিন্নী যখন তুলসীব্রতী তখন তিনি না পেলেন নদী না পুকুর বা জলাশয়। তার আশ্রয় পাম্পে তোলা গাজীর ট্যাঙ্কির নলবাহিত জল। সকালে তিনি যখন ঘটে জল ঢালছিলেন ফুল ফুলে সাজিয়ে ধূপগন্ধী আর আলোর শিখা জ্বেলে আমি তখনও গল্পের শ্রোতা– দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম খুব আস্তে আস্তে টুপটুপ করে করে পড়ছে জল রোগীর শরীরে পুশ করা স্যালাইনের মতো করে।

নানা বিভাব নানা ভাবে একের সাথে জড়িয়ে রয়েছি আমরা। কোন গল্পই বিচ্ছিন্ন নয়। তার সুতা নানা ভাবে জড়িয়ে ছড়িয়ে থাকে। এই ব্রত গল্পের তুলশীর সাথে রুদ্র বৈশাখ আর ঘট ঘাট ও জলের সম্পর্ক নিয়ে জড়িয়ে আছে আমার গিন্নী কথক। আমি গল্পের শ্রোতা। আউট সাইডার–আমি কি জড়িয় আছি? নিশ্চয়ই জড়িয়ে আছি সম্পর্কের গল্পে। কল্পের গল্পে। যাপনের গল্পে।

যে তুমি কর্পোরেট নির্বাহী উলম্ব ঘরের বাসিন্দা। ইংরেজি হরপ আর গাণিতিক চিহ্ন দিয়ে চিনতে হয় কোন লিফটে ওঠে কোন ফ্লোরে নেমে খুঁজতে হবে তোমার নেম প্লেট সে- তুমিও কী এই গল্পের সাথে কানেক্টেড নও?
ভালো থেকো—

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!