গ্রাম সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক (শেষ পর্ব)

শায়েস্তা খানের শাসনকাল বাংলার স্থাপত্য শিল্পের জন্য সবিশেষ উলে- যোগ্য। বিচিত্র সৌধমালা, মনোরম সাজেখ সজ্জিত তৎকালীন ঢাকা নগরী স্থাপত্য শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে।স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলায় মুঘলদের ‘স্বর্ণযুগ’ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তাঁর আমলে নির্মাণ করা স্থাপত্য কার্যের মধ্যে ছোট কাটরা, লালবাগ কেল্লি, বিবি পরীর সমাধি-সৌধ, হোসেনি দালান, সফী খানের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার মসজিদ, চকা মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, অন্য কোনো সুবাদার বা শাসনকর্তা ঢাকায় শায়েস্তা খানের ন্যায় নিজেরখ স্মৃতিকে এত বেশি জ্বলন্ত রেখে যেতে পারেননি। বস’ত, ঢাকা ছিল শায়েস্তা খানের নগরী।

দক্ষ সুবাদার হিসাবে এবার বাংলার ক্ষমতায় আসেন মুর্শিদ কুলি খান(১৭০০-১৭২৭ খ্রিঃ)। প্রথমে তাঁকে বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।দেওয়ানের কাজ ছিল সুবার রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। সম্রাট ফখরুখ শিয়ারের রাজত্বকালে মুর্শিদ কুলি খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। মুর্শিদ কুলি খান যখন এলেন তখন, বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। এ পরিস্থিতির মুখে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বাংলায় মুঘল শাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। স্বীয় ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তিনি বাংলার ইতিহাসের গতিকে পরিবর্তিত করেছিলেন।

সম্রাট আওঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দুর্বল মুঘল সম্রাটগণ দূরবর্তী সুবাগুলোর দিকে তেমন দৃষ্টি দিতে না পারায়, এসব অঞ্চলের সুবাদারগণ অনেকটা স্বাধীনভাবে নিজেদের অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদ কুলি খানও অনেকটা স্বাধীন হয়ে পড়েন। তিনি নামমাত্র সম্রাটের আনুগত্য প্রকাশ করতেন এবং বার্ষিক ১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব পাঠাতেন। মুর্শিদ কুলি খানের পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার সিংহাসনে বসেন। এভাবে বাংলার সুবেদারি বংশগত হয়ে পড়ে। আর এরই পথ ধরে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার স্বাধীন শাসন।

এসময় সুবাকে বলা হতো ‘নিজামত’ আর সুবাদারের বদলে পদবী হয় ‘নাজিম’। নাজিম পদটি হয়ে পড়ে বংশগত। সুবাদার বা নাজিমরা বাংলার সিংহাসনে বসে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে শুধু একটি অনুমোদন নিয়ে নিতেন। তাই আঠারো শতকের বাংলায় মুঘল শাসনের ইতিহাস নিজামত বা নবাবি আমলরূপে পরিচিত। আর প্রায় স্বাধীন শাসকগণ পরিচিত হন ‘নবাব’ হিসেবে।রাজস্ব সংস্কার মুর্শিদ কুলি খানের সর্বাধিক স্মরণীয় কীর্তি।
এক।তিনি ভূমি জরিপ করে রায়তদের সামর্থ্য অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন।

দুই: তিনি কর্মচারীদের সাহায্যে ভূমির প্রকৃত উৎপাদিকা শক্তি ও বাণিজ্য করের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতেন। এ পদ্ধতিতে মধ্যসত্ত্ব ব্যক্তিদের দ্বারা প্রজাদের হয়রানির কোনো সুযোগ ছিল না।

তিন: মুর্শিদ কুলি খান দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।

চার। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ইংরেজ, ফরাসি ও পারসিক ব্যবসায়ীদেরকে তিনি উৎসাহ প্রদান করতেন।ব্যবসায়ীরা যাতে নির্দিষ্ট প্রচলিত কর প্রদান করে এবং তাদের প্রতি যাতে কোনো অবিচার করা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

চার: তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল। কলকাতা, চুঁচুড়া ও চন্দননগর বিভিন্ন বিদেশি বণিকদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।

মুর্শিদ কুলি খানের কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। তাই তাঁর কন্যা জিনাত-উন-নিসার স্বামী সুজাউদ্দিন খানকে (১৭২৭- ১৭৩৯ খ্রিঃ) সম্রাট ফররুখ শিয়ার বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন।

সুজাউদ্দিন একজন স্বাধীন নবাবের মর্যাদা নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনিও ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- তিন প্রদেশেরই নবাব হয়েছিলেন তিনি। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বাসভাজনদের উচ্চপদ দান করেন। জমিদারদের সাথেও একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হলেও তাঁর অযোগ্যতার কারণে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।বিহারের নায়েব-ই-নাজিম আলীবর্দি খান সরফরাজকে আক্রমণ করেন ও মুঘল সম্রাটের অনুমোদনে নয়, বাহুবলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন আলীবর্দি খান। আলীবর্দির শাসনকালে(১৭৪০-১৭৫৬ খ্রি:) বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

অনেকদিন থেকেই বর্গী নামে পরিচিত মারাঠি দস্যুরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

ক. আলীবর্দি খান ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছর প্রতিরোধ করে বর্গিদের দেশ ছাড়া করতে সক্ষম হন।
খ.তাঁর শাসনকালে আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করলে তিনি শক্ত হাতে তা দমন করেন।
গ.আলীবর্দির সময়ে ইংরেজসহ অনেক ইউরোপীয় বণিকের বাণিজ্যিক তৎপরতা বাংলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
ঘ. একই সাথে এরা সামরিক শক্তিও সঞ্চয় করতে থাকে।আলীবর্দি খান শক্ত হাতে বণিকদের তৎপরতা রোধ করেন।

আলীবর্দি খান তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।আলীবর্দির প্রথম কন্যা ঘষেটি বেগমের ইচ্ছে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ভগ্নির পুত্র শওকত জঙ্গ নবাব হবেন। ফলে তিনি সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।কয়েকজন অভিজাতের সমর্থন লাভ করেন ঘষেটি বেগম।এদের মধ্যে রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর, উমিচাঁদ, রাজবল্লি প্রমুখের নাম করা যায়। প্রাসাদের ভেতর এ ষড়যন্ত্রকে কাজে লাগায় বাংলায়ভ বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুচতুর ইংরেজ বণিকরা।ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তারা হাত মেলায়।অবশেষে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ বাধে নবাবের। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন।অসহায়ভাবে পরাজয় ঘটে সিরাজদ্দৌলার।

মুসলমান শাসনের এই দীর্ঘ ইতিহাস একটা কথা উঠে এসেছে ইংরেজদের থেকে বেশিদিন এই মুসলমান শাসকদের আমলে বাংলাতে নানান বৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে।যা আসলে চেপে রাখা ইতিহাস।ইংরেজদের বড়ো করতে গিয়ে এই ইতিহাস অজানা থেকে গেছে।

রাজার ধর্মে প্রভাবিত হয় প্রজা।গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সংহতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নজরে আসে। চৈতন্য, যবন হরিদাস কোলে তুলে নিয়েছিলেন।লালন সাঁই এসেছেন আরও পরে- যিনি সম্প্রীতির এক নজির।

অধুনা একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে, সিপাহি বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলমান কার্ড খেলা তীব্র করে। ইংরেজরা হিন্দু-মুসলমান বারুদ উসকেছে তার ফলশ্রুতি ঘটেছে নানান আন্দোলনের সময়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন ততখানি সফল হয়নি তাই।রবীন্দ্রনাথ ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মাটির পরে ঘটি ঠুকিলেই হইবে না। যাদের দূরে রাখা হয়েছে তারা ডাকলেই আসবে না।

বস্তুত বঙ্গভঙ্গের সময় মুসলিম সাড়া না দিলে একদলের নিন্দার জবাব ছিল রবীন্দ্রনাথের এই বাক্য।বঙ্গভঙ্গের সময় মুসলমানদের দাওয়ায় উঠতে না দেবার প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।পদ্মাপর্বে মুসলমানদের প্রতি ছুৎমার্গিতা লক্ষ্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই জন্য তিনি মেলার কথা লেখেন। যেখানে গ্রাম বাংলার মানুষের মেলা সম্ভব হবে।

বাংলায় ব্রিটিশদের লুণ্ঠনক্রিয়া তৎকালীন ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া পুঁজি ব্রিটেনের বিভিন্ন শিল্পে, বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পে বিনিয়োগ করে, ব্রিটিশরা প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছিল।একই সাথে, এই লুণ্ঠনের ফলে বাংলায় শিল্পায়ন ব্যাহত হয় এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৪৭ এর আগে ভারতভাগ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে আরও চিড় ধরিয়েছিল।

ইংরেজ চলে গেলেও ভারতে দিয়ে গেল হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে চিড় ধরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কায়েম রাখা। সাধারণভাবে হিন্দু-মুসলমান মেলামেশা থাকলেও গরু ইস্যুতে বর্তমানে প্রায় উস্কে দিয়ে, রাষ্ট্র থাকছে নিজে নির্বিকার। অথচ উপরোক্ত উদাহরণ ছাড়াও বর্ধমানের আউশাড়া গ্রামে ওলাইচন্ডি ছিল দুই সম্প্রদায়ের মেলার জায়গা।

আসলে অর্থনৈতিক বৈষম্য আনে ভেদ।আর ভেদকে না দূর করে রাষ্ট্র ও লোভীগণ বিভেদকে উস্কানি দিয়ে চলেছে। তখন ঘটে সর্বনাশ।বাংলাদেশের গ্রামে সেই এক ঘটনা।এখানে স্বার্থপর একদল গুরু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আর ওখানেও গুরু সম্প্রদায়ের লঘু মানুষ তাতেই আছে।কারণ দাঙ্গা হলে লুঠ করা সহজ।আর সরল মানুষ এ সত্য বোঝেনা- বোঝেনা অর্থনৈতিক সংকট মুক্তির আসল কারণ ঠিক এসব নয়।

যে ঘটনা দিয়ে এই নিবন্ধের শুরু, তার মধ্যেই ফিরে আসি।ভারতের গুজরাতে মুসলমান গ্রামের নাম বদলে হিন্দু করা আছে।আবার সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই মিল বড় আকারে আছে।সেই উদাহরণ সত্য।
মানুষ বুঝতে পেরে গেছে: ধর্ম নয় কর্ম / জাত নয় ভাত-। কর্ম ও ভাত সমাধানের পথ।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!