সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাশের বাড়ির ঘোষগিন্নির চিৎকার কানে গেল: “বলি, বুড়ো হয়ে তো মরতে গেলে, তোমাকে কতদিন বলেছি যে সকাল বেলার বাজারটা তুমি আগে সেরে আসবে ৷ খবরের কাগজটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, সারাদিন পড়ে রয়েছে ৷ জানো তুমি, মন্টু আর বৌমা অফিসে বেরিয়ে যাবে৷ তোমার দেখছি বোধবুদ্ধি দিন দিন লোপ পাচ্ছে ৷ বুড়ো হলে কি এমনি ভীমরতি হয়?”
শুনে খুব কষ্ট হল৷ বয়স আর রোজগারের অসামর্থ্য একটা মানুষকে কীভাবে অসহায় আর প্রীতিহীন করে তুলেছে তা অনুভব করে বুকে একটা যেন চোট লাগল৷ বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে আউড়ে গেলাম — ‘হে পুরুষপুঙ্গব ! ইহা দেখো, তুমি যাহা হইবে ৷’ অনুমানে মনে হল, এই কারণেই জীবনে ধিক্কার জন্মায়, উত্তপ্ত যৌবনের স্বপ্নসুন্দরী হাওয়ায় মিশে গিয়ে সত্যের হাড় বের করা রণরঙ্গিণী নেমে আসেন জীবনের সায়াহ্নবেলায়, মধুময় পৃথিবী চকিতে শ্মশান বলে মনে হয় মানুষের ৷ অথচ একটা সময় এই বাজখাঁই মহিলার চোখে হয়তো ঘোষ মহাশয় পুরুষশ্রেষ্ঠ ছিলেন, বিগলিত ছিলেন নারীসুলভ ভালোবাসার ব্যাকুলতায়, আর আজ তাঁর বোধ সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করা হচ্ছে, শারীরিক অপটুতা বৃদ্ধের ‘ভীমরতি’ বলে মনে হচ্ছে ৷ আচ্ছা, মানুষের দাম কি দিন দিন কমছে? অথচ ভেবে দেখুন তো, বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্য কীরকম উর্ধ্বগতিসম্পন্ন৷ কাল যে পটল কিনলেন তিরিশ টাকায় আজ সেটা বেড়ে হয়েছে পঞ্চাশ, যে মাছ ছিল দুশো আজ সে বেড়ে হয়েছে আড়াইশো৷ যেকোনো তেলের দাম তো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ জীবনধারণের অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম যদি এমনি জ্যামিতিক প্রগতিতে বাড়ে, তাহলে যার জন্যে এত কিছু সেই জীবনবাবাজির মূল্য এত কেন কমছে বলুন তো? ঠিকই ধরেছেন, দ্রব্যের উৎপাদন তো দিন দিন কমছে, আর মানুষের পয়দা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত৷ পাকা অর্থনীতিবিদ হয়তো যোগ করে দেবেন এর সঙ্গে ম্যালথাসের তত্ত্ব৷ আমরা শুধু সার বুঝব মানুষের দাম কানাকড়ি ৷
একটু তলিয়ে দেখলে মানুষ হল গিয়ে আপনার fuel বা জ্বালানির মতো, জ্বলবে ও জ্বালাবে ৷ তার সারা জীবনটা জুড়ে কি-ই না ঝকমারি! দশ মাস দশ দিন মাতৃগর্ভে লাফালাফি করে তো মহাপুরুষের আনন্দময় আবির্ভাব ৷ তারপর এটা কর রে, ওটা করাও রে, সেটা গেলাও রে এই নিয়ে আপনি মশাই প্রাণান্ত৷ অবশেষে ছোকরা তো একদিন সেয়ানা হয়ে উঠল ৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ছুটি মিলবে না আপনার৷ আজকাল আবার কঠিন প্রতিযোগিতার বাজারে বিদ্যেধর করে তোলার জন্য কতই না ঝঞ্ঝাট ৷ স্কুলে ভর্তির জন্য আপনাকে আর আপনার গিন্নিকে দিতে হচ্ছে গভীর জটিলতর পারিবারিক পরীক্ষা৷ (বর্তমান পাঠক্রমে এটা কম্পালসারি সাবজেক্ট হিসেবে ঢুকিয়ে রাখা উচিত৷) সেখানে আপনার বেতন থেকে আপনার গিন্নির কোন পত্রিকায় বেশি অনুরাগ সেটা জানা নাকি তাঁদের পক্ষে খুবই জরুরি৷ দিলেন হয়তো ভর্তি করে কোনো খাতিরে, কিন্তু এবার শুরু হল আরো নতুনতর জ্বালা৷ কিনে দিন আজ তিন সেট ইউনিফর্ম, কাল এনে দিন তেরোখানা ওয়ার্কবুক, স্কুলের দিদিমনির ফরমায়েশ মতো একগাদা টাকা খরচ করে আধখানা বই দোকানই খুলে ফেলতে হল হয়তো আপনাকে৷ তারপর পরিবেশের সাথে মেশার সঙ্গে সঙ্গে যাতে কুসঙ্গে না পড়ে সৎসঙ্গে বিহার করে তার জন্য কড়া নজর ; যাতে ডাণ্ডা-গুলি না ধরে বইপত্তর কামড়ে ধরে তার জন্যে স্পেশাল প্রশিক্ষণ, কিংবা বদভ্যাস না শিখে যাতে মহাপুরুষোচিত আচরণ রপ্ত করে সেজন্য আপনার মাথাব্যথারও অন্ত থাকে না৷ হয়তো আপনি বন্ধু-নির্বাচনের একটা আদর্শ লিস্ট বানালেন, ছেলে সেটাকে তুড়ি মেরে ভিড়ে গেল মদ আর হেরোইনের আড্ডায়৷ যে-বয়সে আপনি আপনার পরম শ্রদ্ধাস্পদ পিতার সামনে দাঁড়িয়ে বাক্যালাপ করতে ইতস্তত করতেন, হয়তো দেখবেন আপনারই পরম স্নেহাস্পদটি আপনাকেই সে স্থান পরিত্যাগের জন্য ইতস্তত করাচ্ছে৷ পুত্রের ও নিজের সম্মান রক্ষার জন্য আপনাকে একটিবার অন্তত পিছন ফিরে দাঁড়াতেই হবে৷ ‘কালে কালে হল কী’ এমন একটি স্বগতোক্তি যখন মৃদু দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে আপনার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন হয়তো দেখলেন গুণধর পুত্রটি সাইকেল নিয়ে প্রাত্যহিক আড্ডাটি দিতে রোডের চা-পানের আসরে চলেছে ৷ যখন তার মমতাময়ী গর্ভধারিণী বললেন, “এক কাজ করিস বাবা, আসার সময় যদুর দোকান থেকে রেশনটা আনিস”, তখন আপনি ঠায় দাঁড়িয়ে রাজকার্যে নিযুক্ত পুত্রের জবাব শুনলেন, “কেন, বাবা কি করতে রয়েছে বাড়িতে, শুধু গিলতে?” আপনার হাতটা চকিতে উঠে আসছিল তার গাল বরাবর, হঠাৎ একটা হারিয়ে যাওয়া দেবশিশুর মুখের ছবি আপনাকে মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়৷ ছেলে আপনার দিকে তীব্র একটা জ্বালাময় কটাক্ষ হেনে সাইকেলের ঘণ্টি দিতে দিতে বেরিয়ে যায় তখনই৷ আপনি অন্তরে বুঝলেন, সন্তান প্রতিপালনের জন্য এতদিনের পরিশ্রম ও খরচ উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো বৃথা হল এবং আপনি না খেয়ে যে দুধ-কলা ছেলেটাকে খাইয়েছিলেন (বৃদ্ধ বয়সে নিজে খাওয়ার জন্য অবশ্য), সে এখন রীতিমতো কালসাপ হয়ে উঠেছে৷ অস্যার্থ: ছেলের ব্যবসায় আপনি প্রথমে ফেল মেরে বসলেন৷ অপদার্থ ছেলেটা এখন আপনার জ্বলবার পক্ষে যথেষ্ট দাহ্যোপকরণ৷
আরও একটা মোক্ষম জ্বলনশীল দাহ্য পদার্থ হল আপনার স্নেহময়ী কন্যা৷ যতবারই আপনি বইপত্র খাতা-পেন্সিল কিনে দিয়ে তার বিবাহ-বৈতরণী পারের ব্যবস্থা করতে চাইবেন দেখবেন সেগুলো অতি দ্রুত ঘুচিয়ে দিয়ে পুতুলের সংসার পাততে সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে৷ এ থেকেই সে ক্ষীণ আভাসে জানিয়ে দিতে চাইছে — ‘দেশে দেশে মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর লব খুঁজিয়া৷’ বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার মা যখন গৃহকর্মে সাহায্যের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান, আপনার রূপবতী কন্যা তখন স্নো-পাউডার-লিপস্টিক-রুজের শ্রাদ্ধ করে আরো বেশি রূপসী হয়ে ওঠার অঘোষিত প্রতিযোগিতায় খানিকটা warm up করে নিতে ব্যস্ত৷ ‘ঘর খোঁজা’ মানে তেমন তেমন তাকাতাকি আঁচাআঁচির ব্যাপার না হলে গৃহিণীর পুনঃ পুনঃ তাগিদে একদিন আপনাকে বের হতেই হবে যোগ্য জামাতাবাবাজির সন্ধানে এবং নির্ঘাত পাত্রের পিতার মিষ্টি হাসির ধারালো ছুরিতে আপনি জবাই হয়ে যাবেন অজান্তেই৷ তারপরেও রয়েছে বিবাহোত্তর এডজাস্টমেন্টের প্রশ্ন ৷ না হলে তো সারাটা জীবন কন্যা আপনার জ্বললই, সেই সঙ্গে আপনিও৷ পতিগৃহ-প্রত্যাগত নন্দিনীর খোরপোষের দায়িত্ব অগত্যা এসে পড়বে আপনার মতো অধম পিতার ওপর৷
আবার ছেলে-ব্যবসায় আপনার মূলধন যদি ঠিকমতো লগ্নি হয়ে থাকে তো সে আর এক নতুন হ্যাপা৷ ভালো শিক্ষায়তনে ভর্তি, অর্থকরী বিষয়ে শিক্ষাদান, উচ্চতর ডিগ্রির জন্য দরকার পড়লে হিল্লি দিল্লি কিংবা বিদেশযাত্রার পাই-পয়সাটি গুনে দিতে হবে আপনাকে৷ আপনি হয়তো ছাপোষা মধ্যবিত্ত, এতসব ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয়নি কখনো, ছেলের দৌলতেই করছেন শেষমেশ একটা কিছু পাওয়ার আশায়৷ অবশেষে দেখলেন আপনার সে গুড়ে বালি দিয়ে কোথাকার কোন অজ্ঞাতকুলশীলার পাণিগ্রহণ করে সুবোধ বালকটি বাড়িতে এসে উঠেছে৷ জানেন বোধহয়, নয়া জমানার এটা একটা কৌশল — ‘জেনারেশন গ্যাপ’-এর ধুয়ো তুলে প্রাচীনদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা৷ জীবনে আপনি কম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেননি মশাই, অথচ সেগুলো পুত্রের মতো যোগ্য পাত্র ঢালতে না পারার দুঃখ আপনাকে তখন পেয়ে বসবে৷ আর তারই জ্বালা মেটাবেন পার্কের প্রৌঢ়বৈঠকে আপনারই সমব্যথীদের কাছে নিজেরই অসফল জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়ে৷ কয়েকদিন বাদেই আপনার রসবতী অর্ধাঙ্গিনী জানাবেন নানা অপমান ও তিরস্কারের কাহিনি৷ ছেলের সংসারে আপনারা যে ধীরে ধীরে পরান্নভোজী হয়ে পড়ছেন সেটা অনুভব করবেন একদিন৷ আপনার অনেক আচরণ নবদম্পতির কাছে কখনো কখনো ভীমরতি বলে মনে হবে, অতিরিক্ত বাহুল্য বলে মনে হবে যখন আপনার নাতি-নাতনি ছুটোছুটি করে স্কুলের গাড়িতে উঠে যাবে, অথচ আপনি তাদের কোনো সাহায্যই করতে পারছেন না৷ আপনার ভিতরে এতদিন হারানো মূল্যবোধকে ফিরে পাওয়ার জন্য যে-লড়াই চলছিল সেটা হঠাৎ থেমে গিয়ে কুরুক্ষেত্রের শরশয্যায় ভীষ্মের মতো ‘ন ভূতো ন ভবিষ্যতি’-র ধারণায় এসে লটকে যাবেন অদ্ভুতভাবেই৷
আপনি তখনো মরেননি এবং কেন মরেননি এ নিয়ে জল্পনা শুনতে পাবেন আপনার গুণধর পুত্র ও খঞ্জননয়না পুত্রবধূর বিশ্রম্ভ আলাপে, এবং তখনই এটা মনে হওয়াটা অসঙ্গত হবে না যে, ঝুলি-কাঁথা নিয়ে এবার বেরিয়ে পড়া যায় যেদিকে ইচ্ছা নিশ্চিন্তে৷ মানুষ মনে হয় সবচেয়ে ভয় পায় আরাম আর সুখের প্রাসাদ ছেড়ে দিয়ে অ-নিরাপদ জীবনের পথে চলতে৷ দেখবেন, আপনিও ভাবছেন, মনে মনে খুব প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু প্রাক্টিক্যালি ব্যাপারটাকে রূপ দিতে পারছেন না৷ ভাবতে-ভাবতে একদিন করে বয়স বাড়তে বাড়তে আপনি বুড়োর দলে পড়ে যাবেন৷ এবার তো আর কথাই নেই, আপনার দ্বিতীয় শৈশবাবস্থা শুরু হল৷ আপনিও এখন কম জ্বালাচ্ছেন না কিন্তু! প্রতিমুহূর্তের অসুস্থতা, নিত্যকর্মগুলি সম্পাদনের অক্ষমতা, ট্যাবলেট-ক্যাপসুল-মিক্সচারের পৌনঃপুনিকতায় বাড়ির সকলকেই অতিষ্ঠ করে তুলেছেন মশাই৷ কেননা ব্যবহারিক দিক থেকে অপদার্থ, শারীরিক দিক থেকে অপটু, অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যয়সাধ্য মানুষ চিরকালই হিসেবি উত্তরপুরুষের কাছে গলগ্রহ৷ আপনি তো রোগে জ্বলছেনই সারা সংসারকেও জ্বালিয়ে যাচ্ছেন৷ অবশেষে একদিন ডাক এসে পৌঁছায় আর আপনি তিন হাত কাপড় সম্বল করে ঝাঁপ দেন অজানা অন্ধকারের বুকে৷
না, শেষ কিন্তু এখানেই হল না৷ মরেও মানুষকে শান্তি দিলেন না৷ ধুরন্ধর পারলৌকিক শাস্ত্র আপনার পুত্রের গোটা কতক নগদ পয়সা খসিয়ে তবে ছাড়ল৷ কেননা আপনার অনন্ত স্বর্গবাসে ও স্বর্গসুখের ব্যবস্থা করা চাই তো! ভয় নেই, ততদিনে আপনার বংশধরটিও জ্বলতে শুরু করেছে তারই পুত্র-কন্যাদের যন্ত্রণায়৷ আর এমনিভাবেই চক্রবৎ আবর্ততে…