কিছু মানুষ আছেন পাহাড় ভালোবাসেন কিন্তু একটু নিরিবিলি পাহাড়ের কোলে কিছুদিন নিজের মতো করে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে এমন একটা নিরিবিলি পাহাড়ের সন্ধানে থাকেন যেখানে প্রকৃতির সাথেই ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে থাকা যায়। দার্জিলিংয়ের খুব কাছের ছোট্ট একটি গ্রাম চটকপুর। সিঞ্চল অভয়ারণ্যে ৭৭৮৮ ফুট উচ্চতায় চটকপুরের অবস্থান। যতদূর চোখ যায় এই গ্রামে দেখতে পাওয়া যায় সারি সারি পাইন গাছ৷ স্নিগ্ধ বাতাস আর পাখির কলরবে মনোরম পরিবেশ৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে হাতে কলমে উপভোগ করতে হলে চটকপুরের বিকল্প হতে পারে না। দার্জিলিং থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার এবং সোনাদা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রাম ঘুম, সোনাদা হয়ে যেতে হয় চটকপুরে। সমস্যা একটাই, চটকপুর যাওয়ার রাস্তা মোটেই সুখকর নয়, বেশ কাঠখড় পুড়িয়েই পৌঁছাতে হয় এই গ্রামে। কিন্তু তাতে কী? খারাপ রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের কোলের এই ছোট্ট গ্রামটিতে পৌঁছানোর পর রাস্তা খারাপের সমস্ত বিরক্তি ভুলে যেতে বাধ্য। জঙ্গল, পাখি, প্রকৃতি অনুভব করতে চাইলে এই চটকপুরের বিকল্প আর কিছুতে নেই। আর পাঁচটা তথাকথিত পর্যটনকেন্দ্রের মতো সুসজ্জিত নয় এই গ্রাম। তবে, কালাপোখড়ি, লাভার্স পয়েন্ট এবং সানরাইজ পয়েন্টের মতো জায়গাগুলি রোজকার একঘেয়েমি কাটিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে, সবই পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কালাপোখড়ি হল ছোট একটা জলাশয়ের মধ্যে বড় একটা পাথর। পুজো করা হয় ওই পাথরটিকে। জঙ্গলের প্রাণীরা এখানে জল খেতে আসে। তাই পশু দেখার জন্য কালাপোখড়ি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অল্প হাঁটলেই লাভার্স পয়েন্ট এবং সানরাইজ পয়েন্ট। তবে চটকপুরের আসল মজা ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার দিকে। পাইনের জঙ্গলের নীরবতার মধ্যে পাখির কলতান মনকে একেবারে ভরিয়ে দেয়। ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলে অনেক অচেনা পাখিরও দেখা মিলতে পারে৷
জায়গাটির প্রাথমিক আকর্ষণ হল এর দুর্দান্ত পর্বতমালার দৃশ্য এবং একটি শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। মাত্র ১৯ টি পরিবার নিয়ে এই গ্রাম। জনসংখ্যা ৯০ এর কাছাকাছি। ছোট্ট এই গ্রামটির চারপাশে যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। মাথায় বরফের মুকুট, দিগন্তজোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। এছাড়াও হিমালয়ের আরও কতগুলো বিখ্যাত শৃঙ্গ দেখা যায়। যদিও সবকিছুই নির্ভর করে মেঘমুক্ত আকাশের উপর। ঘন জঙ্গলে অপার নৈঃশব্দ্য। মাঝে মাঝে তা ভেঙে যায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাকে। পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকালে দেখা যায় শহরের ছবি, যেন ক্যানভাসে আঁকা। চটকপুরে দেখা যায় স্যালামান্ডার নামক প্রাণীটিকে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঠের সুন্দর বাড়িগুলো। প্রত্যেক বাড়ির সংলগ্ন সবজি ও ফুলের বাগান ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। রাস্তা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যায় লোকাল হাটে। কিছু মানুষ তাদের সবজি ফল নিয়ে বসে আছে, প্রায় সমসংখ্যক ক্রেতা। এই হাটে বিক্রেতারাই ক্রেতা। অনেকটা আদান-প্রদান সম্পর্ক। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় স্থানীয় সিংচল স্যাংচুয়ারি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে। পাইন, বার্চ, জুনিপারে ভরা এই স্যাংচুয়ারী। ৭৮০০ ফুট উচ্চতায় এখানে নানা ধরনের পাখি, ময়ূর, হরিণ, কালো ভাল্লুক, চিতা, বনবিড়াল, ইত্যাদি দেখা যায়। প্রায় ঘন্টাখানেক পথ হেটেই পৌঁছতে হবে। এখানে বিভিন্ন সময়ে জল খেতে আসে। তাই অপেক্ষায় থাকলে বলগা হরিণ সহ বেশকিছু বনের প্রাণীর দেখা মিলতে পারে।
আরও পড়ুন: লেপচাজগৎ
চটকপুর থেকে কাছাকাছির মধ্যে দার্জিলিং দেড় ঘণ্টার পথ। এখানে থাকাকালীন লেপচাজগৎ, লামাহাটা ঘুরে আসা যায়। চটকপুর যাওয়ার তিনটি আলাদা রাস্তা রয়েছে। একটি পেশক রোডের তৃতীয় মাইল হয়ে, দ্বিতীয়টি হিলকার্ট রোডের সাথে সংযোগকারী শিলিগুড়ি দার্জিলিংয়ের দিলারামে নামে এবং তৃতীয়টি দার্জিলিং এর কাছে সোনাদা থেকে ডানদিকে পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে যে কোন পথ অনুসরণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে বনভূমি এবং বন দপ্তরে অনুমতি ছাড়া বনে প্রবেশ করা অপরাধ। যদি কোন ব্যক্তি বনে যান, বা একটি রাত কাটানোর জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিতে যান, তার জন্য ১০০ টাকা লাগবে জন প্রতি এবং গাড়ি প্রতি।
নিউ জলপাইগুড়ি কিংবা শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে ঘুম বা জোড়বালো বা সোনাদা হয়ে চটকপুর পৌঁছনো যাবে। এন জে পি থেকে ৭৭ কিলোমিটার দূরে চটকপুর এর অবস্থান। এছাড়া লেপচাজগৎ থেকে চটকপুরের দূরত্ব ২২কিলোমিটার। আর দার্জিলিং থেকে ঘুম বা জোরবাংলা হয়ে গেলে ১১ কিলোমিটার রাস্তায় পৌঁছতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট।
কোথায় থাকবেন: নিরিবিলিতে চটকপুরে থাকার জায়গা হল চটকপুর ইকো রিসর্ট। চটকপুরে আছে ছবির মতো হোম স্টে। তাছাড়া গ্রামবাসীর বাড়িতে হোম স্টে পদ্ধতিতেও থাকা যায়। আন্তরিক আতিথেয়তায় কিছু গ্রামবাসীদের ঘরে এখন থাকার ব্যবস্থা। কার্পেটে মোড়া ছিমছাম সুন্দর সব কটেজ। থাকা খাওয়ারও সুন্দর ব্যবস্থা আছে। আপার চটকপুরে হোম স্টে হলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হবে বেশ কিছুটা চড়াই রাস্তা।