যে হৃদাকাশে নবীন মেঘের আনাগোনা এত নক্ষত্রের জরি চুমকি সরল বিষুব আবার অনিবার্য উল্কার দাপট সে আকাশে কবিতার বসত অবসম্ভাবি । স্নিগ্ধ হাওয়ার সরল দিগন্ত ভেসে উঠল চেতনা-মগ্ন জলের ছায়ায়।পাহাড়ের ঝর্ণা কিংবা শিশিরের কয়েকটি দানা হয়ে অনায়াসে অন্তর-মর্মে শুনিয়ে যায় অমলভোরের ভৈরবী তান। নিজস্ব অতলের আশ্চর্য শৈল্পিক স্রোত সাড়া জাগায় পাঠক হৃদয়ে ! বিশিষ্ট কবি তৈমুর খানের কবিতার সারাৎসার মানুষের ওপরে কেউ নেই মূলত এই বার্তা তাঁর কবিতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মধ্যযুগীয় কবি চণ্ডীদাস বলেছেন “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”। অবারিত এক জলভেজা চিরবসন্তের দৃশ্যপট দুচোখে ধারন করে সহজ বিশ্বাসে মোক্ষের দিকে হেঁটে যাওয়া একজন প্রকৃত কবির ভাবনা। উদ্দেশ্য বা ভাবনা যাই বলি না কেন তা কিন্তু কার্যত বিকৃত হয়ে পড়ে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণেই পরোক্ষ বা প্রতক্ষ্য ভাবে তার জন্য আমরাই দায়ী। প্রতিনিয়ত প্রতিহিংসার কাঁটা কবির নম্র হৃদয়কে ফালা ফালা করে তীব্র যন্ত্রণা দেয় আর কবি রচনা করেন সেই মহার্ঘ্যকাল। পুনর্বার ফিরে ফিরে আসার বাহানা এই সুজলা সুফলা মাটিজন্মে। অনন্য একটি কবিতা-
আমার পুরুষজন্মের ভিতর এত হাওয়া
এত দ্বন্দ্বময় রাস্তা!
যদিও স্বয়ংক্রিয় আমি
চলাচলে বিনম্র স্তব্ধতা…
পাক খাই
ডুবে যাই
আবার ভাসমান
দৃপ্ত অথবা প্রদীপ্ত নিজেকে মেলে দিতে দিতে
সপ্রতিভ আলোকসাম্যে যা কিছু কথিত
আমি তার উপমা হই, ব্যতিহার হই
ব্যাকরণ জুড়ে সব ব্যাকরণ ভাঙি
ছন্দে বন্দিত হই, অথবা নিন্দিত
পথে পথে সমীহ ছায়ায়
নিবিড় স্মৃতির বাঁক মন্থনে ডাকে
পারি নাকো যেতে
যদিও অমৃতকুম্ভ এখনও অপেক্ষায় আছে
(কবিতা- পুরুষজন্ম)
চলতি পথ বড্ড ভয়ঙ্কর। হাজার ওয়াট আলোর মধ্যেও ভয়ঙ্কর কালো। ঠোঁটের বাঁকে আটকে যায় জবা কুসুম সংকাশং। অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসে অমাবস্যার বিকট দাঁত নখ।দুইপাশে মরচেধরা প্রাণী—ক্ষুধার্ত—ভঙ্গুর—তৃষ্ণার্ত—হাহাকার…. দুইপাশে কসাইয়ের দোকান আমাদের ভ্রূ নাচে। কবি তৈমুর খান এর কথায় “কবিতা এক নিবিড় আত্মযাপনের অভিব্যক্তি। জীবনের শূন্যতায় যে বোধ ভাষা খুঁজে ফেরে, যে সামাজিক টানাপোড়েনে নিজের অবস্থানটিও বারবার টাল খায় , যে কথা বলা হয়ে ওঠে না — কবিতা সেই প্রয়াসকেই তুলে আনে। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে হাহাকার, বস্তুতান্ত্রিক চাহিদার ঊর্ধ্বে হৃদয়ের মর্মকে উপলব্ধি করার এক মানবিক দায় থাকে কবির। সেই দায় থেকেই সত্যের অন্বেষণ চলতে থাকে। অবশ্যই সুন্দর একটা পৃথিবী, জীবনের সারল্য রূপমুগ্ধতা, আর বিস্ময়ের দরোজায় করাঘাত করাই কবিতার উদ্দেশ্য। আত্মার পীড়িত করুণ সংলাপে ও সংকেতে, রূপকে ও রূপান্তরে গতিময় ক্রিয়ায় কবিতার সিদ্ধি খুঁজতে হয়। বলেই লিখতে হয়…”
পড়ে নেব কবির তেমনই একটি কবিতা-
আমরা স্বর্গের দিকে যেতে যেতে দুইপাশে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম
আমরা সবাই দেবতা—চারিপাশে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল
চারিপাশে সবাই আমাদের দেখছিল আর ফুল ছুঁড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল
আমাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না সেদিকে
হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলাম স্বর্গযানে
দুইপাশে মরচেধরা প্রাণী—ক্ষুধার্ত—ভঙ্গুর—তৃষ্ণার্ত—হাহাকারপ্রিয়…
দুইপাশে কসাইয়ের দোকান—
নিরন্তর ছুরি শান দেওয়ার শব্দ
নিরন্তর দুর্বোধ্য ভাষার চিৎকার…
আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা
স্বর্গে যেতে যেতে দেখছি এসব;
আমাদের গাড়ির চালক জানাল:
এরা সবাই বিভিন্ন জাতের প্রাণী—
পৃথিবীতে এদের জানোয়ার নামে ডাকা হয়!
(কবিতা/ জানোয়ার )
শ্রীমদ্ভগবত গীতা বলেছেন-
যদ্ যদাচরিত শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে।। ২১।।
অনুবাদ : শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন , সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন , সমগ্র পৃথিবী তারই অনুসরণ করে। কিন্তু কোথায় দেখা পাব তার? এ বেলাভূমি যেন অস্তগামী রাগে বিভোর। চতুর্দিকে মরিচীকার ন্যায় ছড়িয়ে ধূম্রজাল।শ্রেষ্ঠকাব্যের রসায়ন উপলব্ধির মাধ্যমে পাঠক আনন্দ লাভ করেন আর শ্রেষ্ঠ শিল্প সৃজনের মাধ্যমে শিল্পী মনকে নিষ্কাম আনন্দ প্রদান করে পাশ্চাত্যের হাবার্ট রীড Art এর সংজ্ঞায় বলেছেন ” to create pleasing form’s ” কথাটি যা শিল্পীর শিল্পকে রূপান্তরিত করে শৈল্পিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।অস্কার ওয়াইল্ড এর কথায় “The artist is the creator of beautiful things.” আমরা সেই সৌন্দর্য সন্ধানী এখন পড়ে
কবি তৈমুর খানের এই কয়েকচরণের অসাধারণ পংক্তি ভীষণ প্রাসঙ্গিক –
তপস্যাও ক্লান্ত হয়
বৃষ্টিস্নাত করে
শরীর যদিও বল্মীকের ঘর
ক’জন বাল্মীকি হই?
তীর্থে তীর্থে আমরা সবাই দস্যু রত্নাকর
(আমরা কবিতাগুচ্ছ)
যেমনটি শিল্পে মানবিক আবেগ থাকে। সৃষ্টিতে স্রষ্টা থাকেন। সেই আবেগ, সেই ইচ্ছা তাঁরও আছে। সেই সংবেদনার ঢেউ আবহমান মানবহৃদয়ে তিনি জাগাতে পারেন। অন্তহীন এই যাত্রার ভাবিত মগ্ন হাওয়া আকাশের সীমাহীন বিশ্বাস সমুদ্রের অগণিত ঢেউয়ের গাণিতিক উচ্ছাসে বুকের পাঁজরে গেঁথে আত্মবিশ্বাসী কবি ডুবে যেতে চান অক্ষর বিতানে।
অজস্র অভিঘাতের পর ও কবির একমাত্র আশ্রয় কালো কালো অক্ষর দানায় গাঁথা তাঁর একান্ত সৃজন সম্ভার। প্রকৃতি প্রচ্ছদে আবৃত পৃথিবীর মায়াচরে তরঙ্গের ভৈরবী যেন ভেসে আসে অচীনলোক থেকে., সত্য সুন্দর প্রেমময় রুদ্রবীণা খানি বাজিয়ে চলেছেন শিব, সেই গুরুগম্ভীর স্বর। আকাশ বাতাস, জল স্থলের আত্মা ভেদ করে সেই স্বরবিতান হিরেকুচির মতো ছড়িয়ে পড়ছে ঋতু সমগ্রের বাহির ভিতর। যে সুর নিয়ত মিলিত হয় প্রকৃতির ছন্দে। তার কবোষ্ণ পরশে জাগ্রত মহাকালের প্রতিচ্ছবি । কবি লেখেন-
“আমি যখন আদি মানব”
এক একটা আপেলে কামড় দিতে দিতে
আমি আরও তীব্র হয়ে উঠছিলাম
নুয়ে পড়া ডালগুলির শিহরন
আমার আসক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছিল
চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়
পাহাড় চিরে বেরিয়ে আসছিল ঝরনার স্রোত
এক পাশে আপেল বৃক্ষ আর আমি
দূরে কোথাও কলরব হচ্ছিল
অথবা পাখি উড়ছিল
ঝরনার জলে মুখ দেখতে দেখতে
আকাশের মেঘ ভেসে যাচ্ছিল
আমার শরীরের ভেতর বহু শরীর টের পাচ্ছিলাম
আমার স্বপ্নের ভেতর বহু স্বপ্ন উঁকি মারছিল
আমার ইচ্ছার ভেতর বহু অস্ফুট ইচ্ছা জেগে উঠছিল
আমার ইন্দ্রিয়ের পেশীগুলি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করছিল
আমি আকাশ নদী বৃক্ষলতা পাহাড় দিগন্ত
সবকিছুকেই জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম
আমি মাটির উপর দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করতে চাইছিলাম
সমস্ত পৃথিবীকেই এক নারী বলে মনে হচ্ছিল আমার।
হঠাৎ ভূমিকম্পে ওলটপালট পৃথিবী তোলপাড় হৃদযন্ত্র। সমস্ত বেদনার কাঁটা দলা পাকাচ্ছে বুকের ভেতর। মনে হচ্ছে আজ আমরা সত্যিই অনাথ হয়েছি। আমাদের মাথার ওপর কোথাও দেশের ছাউনি নেই রিফিউজির মত একটু অধিকারের জন্য রাজ্য থেকে আর এক রাজ্য ছুটে যাচ্ছি রাষ্ট্রের চৌকাঠ পর্যন্ত। আমাদের ভুল রাস্তা দেখিয়ে দিব্যি গাছের ডালে দোল খাচ্ছে ভূত পেত্নি আর বিশ্রী দাঁত বের করে হাসছে । চারিদিকে উদ্ধত লিঙ্গগর্জন।
রক্তচক্ষু মৃত্যুভয় আর বিকৃত পৌরুষাচার। ক্রমে ক্রমে থেঁতলে দিল জীবন। দহন জর্জর কবির কলমে খসে পড়ল তিস্তার কান্না
একটা কুমারী বিকেল সর্বনাশের দিকে চলে গেল
ওর রক্ত গড়িয়ে পড়ল মাটিতে
ওর বুকের পাপড়ি ঝরে পড়ল রোদ্দুরে
এত উদ্ধত লিঙ্গগর্জন কী করে সামাল দেবে?
রক্তচক্ষু মৃত্যুভয় আর বিকৃত পৌরুষাচার
ক্রমে ক্রমে থেঁতলে দিল জীবন
শিউলির শিহরন , কাশবনের হাওয়া
হারিয়ে গেল মোটরের টায়ারের নীচে
দুর্গন্ধ ধোঁয়ায় পোড়া রাত এল
কান্নাভেজা চাঁদ সারারাত ডেকে ডেকে
ফিরে গেল একা
অন্ধকারের কোনো আদিম গুহায়…
(কুমারী বিকেল)
“নিজের শরীর রক্ষার কাজে আমাদের শক্তির একটা অংশ ব্যয়িত হয় বাকী শক্তির প্রতিটি বিন্দুই দিনরাত ব্যয়িত হইতেছে অপরকে প্রভাবাণ্বিত করার কাজে । আমাদের শরীর আমাদের গুণ আমাদের বুদ্ধি এবং আমাদের আধ্যাত্মিকতা এ সবই সর্বক্ষণ অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া চলিয়াছে । অপরদিকে আবার ঠিক এইভাবে আমরাও অপরের দ্বারা প্রভাবিত হইতেছি । আমাদের চারিদিকে এই কাণ্ড ঘটিতেছে ।” (স্বামী বিবেকানন্দ রচিত ” “মনের শক্তি” থেকে গৃহীত )।
এই অমৃত কথামালার যথোপযুক্ত ব্যবহার মানুষ শিখল না আর এটাই মানবজন্মের চরম ব্যর্থতা।
আজ আমরা প্রেম ভালোবাসা হারিয়ে খুইয়ে ফেলেছি মনের শক্তি। মানুষ আর মানুষের কান্নায় কর্ণপাত করে না কেবল মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ায় না সাম্যের গান ভুলে কাঁধে তুলে নিয়েছে সাম্প্রদায়িক ঝান্ডা। ছেঁড়া সম্পর্কের যন্ত্রণা নিয়ে কবি রচনা করলেন অমোঘ সত্য-
মানবীর গর্ভে জন্ম দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক সন্তান
আমরা পরিচয় হারাচ্ছি
সভ্যতা দেখছে আমাদের
আজ আমাদের ভাঙা দেশ, ছেঁড়া সম্পর্ক
আর ভাগাড়ের উল্লাস
২.
এইখানে মৃত্যুর বাড়ি
রোজ এসে আমরা জীবন প্রার্থনা করি
রাঙা মেঘ হয়ে ভাসে জীবনের আবেগ
আবেগ তো যুক্তিহীন, সত্যহীন নিসর্গ মরীচিকা
ঝড়ের তাণ্ডবে লুটোপুটি খায়
চূর্ণবিচূর্ণ দিন ক্ষয় হতে থাকে
চাঁদ ডেকে ডেকে ফিরে চায়
আমাদের ঘুমহীন বারান্দা একা
প্রার্থনা দীর্ঘ হয় কলঙ্কিত রা
ত্রির কাছে
(আমরাগুচ্ছ)
অনুবাদ: হে মহাবাহো! জড়া প্রকৃতি থেকে জাত সত্ত্ব রজ ও তম- এই তিনটি গুণ এই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় জীবকে আবদ্ধ করে । তাই জীব এই তিনটি গুণের দ্বারা কবলিত হয়ে যার যা কর্ম করছেন । নানান রকম সুখ দুঃখের কারণ সেটাই কবির কাছে কবিতা তারই বহিঃপ্রকাশ । এই লালসা লিবিডোর টোপ প্রতিনিয়ত আমাদের ব্ল্যাকহোলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।
এখানে রাখলাম কবির অনবদ্য সৃজন-
রাতদিন সোনার হরিণ শিকার করি
আর হরিণের মাংস আনি ঘরে
ফুল্লরা রান্না করে দেয়
আমি ও আমার সন্তান মিলে খাই
সোনার সংসারে আমরাও সোনার মানুষ
রোদ্দুরে চিকচিক করে শরীর আমাদের
অরণ্য প্রত্যহ হরিণ প্রসব করে
সোনার তির-ধনুক হাতে যখন দাঁড়াই
আমাদের গল্পগুলি পাখা মেলে ওড়ে
গল্পগুলি খুঁজে ফেরে মুকুন্দরামের ঘর
কত যুগ পার হচ্ছে, সোনার হরিণ হচ্ছে মায়া
আমরাও বদলে যাচ্ছি লোহায় পেতলে
ফুল্লরাও পাল্টে হচ্ছে ফেলু-ফেলানিতে
তীর-ধনুকগুলি এখন বন্দুক-পিস্তল
অরণ্য নগর-রাষ্ট্র সমূহ শিকারভূমি এই সভ্যতার
সন্তান-সন্ততি মিলে আমরা সব মরীচিকা খাই
(সোনার মঙ্গলকাব্য)
কবিতাকে শুধু পাঠে নয় অনুভবের হৃদপতাকায় ধারণ করতে হয়। আসলে মানুষের অন্তর্জগতে যে অভিঘাত যে ভাঙন যে বিচূর্ণতার চোরা স্রোতের ঘুর্ণিবত্ম্য সৃষ্টি হয়েছে তা মানুষের মনোজগতকে ক্রমশ এক শূন্যের দিকে টেনে নিয়ে যায় সৃষ্টির উৎস যেখানেই থাকুক না কেন নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য থাকে না । তাকে বাঁধা যায় না নিয়মের ব্যকরণে কোন বন্ধনে ।এখানে লেখক তৈরি করেন রূপকের বিভ্রম সেই বিভ্রমজলে স্নান করিয়ে সেজে ওঠে কবির মানস প্রতিমা । গূঢ়ার্থের সন্ধান পেয়ে পাঠক নিশ্চিন্তে ভেসে থাকতে পারেন আনন্দ সরোবরে।
কবি তৈমুর খান তাঁর সন্ন্যাস কবিতায় তার আশ্চর্য মায়াটান রেখেছেন-
প্রতিরাতে ওর সিঁথিতে সিঁদুর দিই
ঢেউ খেলানো চুলের অন্ধকারে
হেঁটে যাই নিহত স্বপ্নের দিকে
চাঁদ চেয়ে থাকে ওর জানালায়
এখনও নক্ষত্ররা জ্বলে,
হাওয়া বয় দীর্ঘ ক্লান্তির রাতে
নৈঃশব্দের ডাকে জেগে উঠি
জাগরণ বাঁশি হয়ে বাজে,
উদাসীন শিহরনের স্পর্শ দেয়
ওর নরম মুখের ঘ্রাণ চুম্বন পাঠায়
ভেজা ঠোঁটের মতো জলবায়ু
আমাকে আজন্ম সন্ন্যাস করে রাখে
(সন্ন্যাস)
হৃদয়ের চিরস্থায়ী হিরণ্য চক্র অস্বীকার করতে পারেন না কবি চিরকালের অন্তর্নিহিত স্রোত
বয়ে যায় ফল্গুধারায়। অন্য পাঁচ জনের মত কবিও একজন সামাজিক এবং রক্ত মাংসের মানুষ । তাই চলতি পথের পাথর কাঁকর পায়ে যেমন বাজে তেমনই পথের দুধারে ফোটা ফুল গুল্মলতার মনোরম মাধুরী হৃদয়ে হিল্লোল জাগায় ভ্রমরের মাধুকরী। মানুষের অন্তর্জগতে নিয়ত রকমারি চোরাস্রোতের আবহে তৈরী করা জলভ্রম বিচিত্র ধারায় বিচূর্ণ হয় সৃষ্টি করে নিরন্তর ভালোবাসা, মিলন বিরহের শূন্যতা, সেই কবিকে আঙ্গুল ধরে টেনে নিয়ে যায় স্রোতের কাছে নদীর অতল গহ্বরে, উথলে ওঠে শব্দতরঙ্গ তাতে ঝাঁপ দিয়ে কবি তুলে আনেন নিগূঢ় সত্যের ন্যায় একের পর এক আলোর কবিতা বিন্দু । সমাজের বিভৎস চেহারা যখন রক্তাক্ত করে কবির হৃদয় তখন কলম বলে-
হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে
তবুও নিরন্তর হাঁটা এই পথে
প্রত্ন পরিযায়ী শ্রমিক বাঁচার প্রয়াসে
এ প্রান্ত ও প্রান্ত কতদূর সভ্যতার পথ?
নিজেই নিজের লাশ বয়ে নিয়ে যাই
একে একে সব ঠিকানা হারিয়ে গেলে
অন্ধকারে ঠিকানা খুঁজে পাই
ছিটকে গেছে সব আলো, সন্তানের মুখ
মোহিনী বিশ্বাসেরও গভীর অসুখ
মানবিক রাষ্ট্রের খোঁজে আমাদের দীর্ঘশ্বাস যায়
কে কাকে বোঝাবে আজ দীর্ঘশ্বাস শুধু হাওয়া নয়
চারিদিকে কলঙ্কিত জ্যোৎস্নায়
রক্তমাখা রুটি
পড়ে আছে
আর ঘামে ভেজা টুকরো বসনগুলি
আব্রু নেই, আব্রু নেই— মানব ফসিল
সমস্ত সভ্যতা আজ লাশকাটা ঘর…
(কলঙ্কিত জ্যোৎস্নায়)
শুঁয়োপোকার গুটি ভেদ করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাতিতে প্রবেশ এই যে জার্নি এর জন্য তারা নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটায় তবেই তার প্রজাপতি রূপ পাওয়া এবং টিকে থাকার গান।
এই গান আমরা বিসর্জন দিচ্ছি ধর্মের ষাঁড়ের দোহাই দিয়ে। আমাদের চৈতন্য ডুবে মরছে অগাধ অতলে। মুনি ঋষিদের মুখ নিঃসৃত বাণী কে হেয় প্রতিপন্ন করে কাল ষাঁড়ের অনুগামী। টুকরো টুকরো সম্পর্ক নিয়ে চলে যাচ্ছি এগুলো সেলাই হবে না, ইতিহাস হবে না রাষ্ট্রনেতারা তীব্র শ্লেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রান্তরের শিরা উপশিরায়। কবি লিখলেন অসামান্য কয়েক লাইন…
সব রাস্তাগুলো কোন্ দিকে গেছে?
আমাদের ধারণার উত্তরগুলো ধর্মপুস্তকে উঠে এসেছে
আমরা জীবনকে দোলাতে থাকি ধর্মের কাছে
সব ধর্ম Nothing can be made from nothing.
শুধু এক বৃহৎ শূন্যের হাতে নিজেকে তুলে দিই
জীবন দাঁড়িয়ে থাকে ধর্মের ধারণার কাছে
ধর্মের ষাঁড়েরা এসে যদিও শিং নাড়ে
আমরা ভিরু, আলো জ্বেলে অন্ধকার দেখি
(আমরাগুচ্ছ)
পরিশেষে বলি এখানে কবি’র কয়েকটি কবিতা পাঠের চেষ্টা করলাম শুধুমাত্র । কবি তৈমুর খানের কবিতার আলোচনা করার ধৃষ্টতা অথবা জ্ঞান কোনোটাই আমার নেই কবির সৃজনের কাছে কেবল নতজানু হলাম। কবি এগিয়ে চলুন নিজস্ব ছন্দে তাঁর নিত্য নতুন সৃজন পাঠককে আনন্দ দান করবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ।
কবি তৈমুর খানের এ যাবৎ সৃজন সম্ভার; কাব্যগ্রন্থ
১। কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), দৌড় প্রকাশনী
২। বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), দৌড় প্রকাশনী
৩। খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী
৪। আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী
৫। বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), কপোতাক্ষ প্রকাশনী
৬। একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), তবু অভিমান প্রকাশনী
৭। জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), তরুণাস্থি প্রকাশনী (বর্তমানে আলকাপ)
৮। তরঙ্গের লীলায় দেখি মাধুর্যের বসতি (২০০৮), বর্ধমান খবর প্রকাশনী
৯। প্রত্নচরিত (২০১১), দৌড় প্রকাশনী
১০। এই ভোর দগ্ধ জানালায় (২০১০) সহযাত্রী প্রকাশনী
১১। জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭), বার্ণিক প্রকাশন
১২। নির্বাচিত কবিতা (২০১৭), আবিষ্কার প্রকাশনী
১৩। স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি (২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, ত্রিপুরা
১৪। উন্মাদ বিকেলের জংশন (২০১৮), প্রিয়শিল্প প্রকাশন
১৫। নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি (২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ ।
১৬। ইচ্ছারা সব সহমরণে যায় (২০১৮) তাবিক প্রকাশন, এক ফর্মা সিরিজ, কলকাতা।
১৭। আত্মসমাহিত পিরামিড (২০১৮), বোধ প্রকাশন, এক ফর্মা সিরিজ, কলকাতা।
১৮। স্বয়ংক্রিয় বিষাদের পর (৩০ ডিসেম্বর ২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, নন্দীগ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর।
১৯। আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা (২০১৯, বইমেলা), বইতরণী, কলকাতা ।
২০। বৃত্তের ভেতরে জল (২০২২), আগন্তুক প্রকাশনা।
২১। সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে (২০২২), বার্ণিক প্রকাশন।
২২। কাহার অদৃশ্য হাতে (২০২৩), স্রোত প্রকাশনী, ত্রিপুরা।
২৩। কবিতা সমগ্র (১ম খণ্ড ২০২৩), বার্ণিক প্রকাশন।
২৪। সর্বনাশের ডায়েরি (২০২৪), উদার আকাশ প্রকাশনী।
২৫। কবিতা সমগ্র (২য় খণ্ড ২০২৪), বার্ণিক প্রকাশন।
গদ্যগ্রন্থ
১। কবির ভাঁড়ারের চাবি (২০০৬), দ্বিতীয় সংস্করণ (২০১৮), বার্ণিক প্রকাশন
২। মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা (২০১০ সহযাত্রী প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ বার্ণিক প্রকাশন ২০২১)
৩। আত্মসংগ্রহ (১ম সংস্করণ তবু অভিমান ২০০০৭, ২য় সংস্করণ ২০১০ দে পাবলিকেশন, ৩য় সংস্করণ বার্ণিক প্রকাশন ২০১৮),
৪। আত্মক্ষরণ (২০১৬), আবিষ্কার প্রকাশনী
৫। কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা (২০২০), বার্ণিক প্রকাশন।
৬। আত্মস্বর (২০২১), বার্ণিক প্রকাশন।
৭। এই কবিতাজীবন (২০২৩), বার্ণিক প্রকাশন।
৮। নয়দিগন্তের অন্বীক্ষা (২০২১), কচিপাতা প্রকাশন, পানাগড় বাজার, পশ্চিম বর্ধমান।
৯। বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক ধারা (২০২৩) বোধিসত্ত্ব প্রকাশন, কলকাতা।
গল্পগ্রন্থ
১। জীবনের অংশ (২০১৯), আবিষ্কার প্রকাশনী।
উপন্যাস
১। জারজ (২০১৯), বার্ণিক প্রকাশন।