ট্র্যাজিক-নায়ক শ্রীমধুসূদন

কোনো কোনো মানুষের ভৌম জীবনের ঘটনা এতই অভাবিত-পূর্ব ও চমকপ্রদ যে, তার কাছে সহজেই হার মেনে যায় দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ নানাবিধ জটিলতাযুক্ত নাটকের কাহিনি। নাট্য-ঘটনার ক্ষেত্রে তাও একটা সান্ত্বনা থাকে যে সে-গল্প বানিয়ে-বলা গল্প; কিন্তু জীবনের গল্প সত্য বলেই তাতে সান্ত্বনা ও ভরসার কোনো স্থান থাকে না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ৪৯ বছরের জীবন ও তাঁর শোচনীয় পরিণাম আমাদের টেনে নিয়ে চলে তেমনি নিরাশার এক কূলে। কিন্তু কেন? তিনি তো দরিদ্রের সন্তান ছিলেন না, এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরেও জন্মাননি। অথচ তাঁর জীবনের অর্ধেকের বেশি অংশ কেটেছে দারিদ্র্যে, অনাহারে; মৃত্যু হয়েছে সরকারি দাতব্য হাসপাতালের ক্লিন্ন শয্যায়, পুরোপুরি নির্বান্ধব অবস্থায়। তাঁর জীবনের এই করুণ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বারবার মনে হয় তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অমিতব্যয়িতা ও ভোগ-বিলাসের সুগভীর ইচ্ছার সঙ্গে তাল রক্ষা করতে পারেনি তাঁর স্বল্পায়তনের অর্থোপার্জন। গৌরব লাভের সমস্ত সম্ভাবনা ও শক্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ভাগ্যের হাতে তাঁকে চরম নির্যাতিত হতে হয়েছে।

মধুসূদনের জন্ম হয়েছিল ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী সাগরদাঁড়ি গ্রামে। তাঁর পিতা রাজনারায়ণ অতি সম্ভ্রান্ত মানুষ ছিলেন। স্বগ্রামে উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি ভোগ করলেও তিনি পেশায় ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। পিতার বিদ্যানুরাগ, সহৃদয়তা, বুদ্ধিমত্তা ও বাকপটুতা মধুসূদনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তাঁর মা জাহ্নবী দেবী ছিলেন ভক্তিমতী ও শিক্ষিতা। বালক মধুসূদন যতদিন স্বগ্রামে ছিলেন ততদিন মায়ের কাছে থেকে পড়াশোনা করতেন এবং অবসর সময়ে তাঁর মুখে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতেন। এই দুই মহাকাব্যের রসে মধুসূদনের কিশোর মন এতই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও কথাবার্তায়, চিঠিপত্রে, সাহিত্যের বিষয় হিসেবে এগুলি বেশি মাত্রায় ব্যবহার করেছেন।

মধুসূদনের ছাত্রজীবন শুরু হয় খিদিরপুরের একটি ইংরেজি স্কুলে। পরে ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। হিন্দু কলেজ ছিল তখনকার সময়ের ইউরোপীয় বিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন। এই কলেজে মধুসূদনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। এখানে তাঁর গুরু ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক ক্যাপ্টেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। তিনিই মধুকে উৎসাহিত করেন ইংরেজিতে কবিতা লিখতে। কিশোর মধুর ধারণা ছিল ইংল্যান্ডে উপনীত হতে পারলেই প্রিয় কবি মিলটনের মতো বিখ্যাত হয়ে উঠবেন তিনি। অল্প বয়সে একাধিক ইংরেজি কবিতা লিখে ও দেশের বিদ্বজ্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাই পাঠিয়েছিলেন বিদেশের নামী দামি সব পত্রিকায়। তবে বালখিল্য কবিত্বের কারণে সেসব লেখা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

১৮৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওল্ড মিশন চার্চে টমাস ডিয়ালট্রির নেতৃত্বে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন মধুসূদন, যা তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এরপর তাঁর পিতার স্নেহ-দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি। হিন্দু কলেজ ছাড়তে হল তাঁকে। তিনি ভর্তি হলেন হাওড়া শিবপুরের বিশপস্ কলেজে। ১৮৪৬ সালে মাদ্রাজের বিশপের তরফ থেকে চাকরির প্রস্তাব আসে তাঁর কাছে। তারপর তিনি ১৮৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষে পাড়ি জমালেন মাদ্রাজের দিকে। এখানে একটি অ্যাসাইলাম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি। আর এখানেই তিনি বিবাহ করেন তাঁর এক ছাত্রী রেবেকা টমসন ম্যাক্টাভিসকে। মাদ্রাজে শিক্ষকতা ছাড়া মধুসূদনের উপার্জনের অন্য উৎস ছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা কিংবা প্রবন্ধ রচনা করে প্রকাশ করা। যদিও স্বনামে এই সময় তিনি লিখতেন না, লিখতেন Timothy Penpoem ছদ্মনামে। মাদ্রাজে বসেই তিনি লিখেছিলেন ইংরেজিতে একটি দীর্ঘায়তনের কাব্য ‘Captive Ladie’ এবং সেই সঙ্গে ‘Vision of the Past’। এছাড়া লেখেন একটি কাব্যনাট্য ‘Rizia : Empress of Inde’। কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী জি. ই. ডি. বেথুন মধুসূদনের ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি পাঠ করে সহৃদয়তার সঙ্গে কবিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষা ছেড়ে মাতৃভাষায় কিছু রচনা করতে। একই অনুরোধ ছিল বন্ধু গৌরদাস বসাকেরও। কিন্তু কবি সে পরামর্শ তখন অগ্রাহ্য করেছিলেন। এখানেই রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্যে চার-চারটি সন্তান হয়ে যাওয়ার পরেও মধুসূদন ভালোবাসলেন আরো একজন নারীকে। তিনি হেনরিয়েটা। অবশেষে কলকাতায় ফিরে এলেন ১৮৫৬-র জানুয়ারিতে। পরে তাঁর সঙ্গে এসে বসবাস করতে শুরু করেন হেনরিয়েটা।

মধুসূদনের নতুন কর্মজীবনের সূত্রপাত হল কলকাতার পুলিশ কোর্টে দোভাষীর চাকরি দিয়ে। বেতন মাসে ১২৫ টাকা। একই সঙ্গে তাঁর সাহিত্য-জীবনের ঘটল জন্মান্তর। পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহবাবুদের বাড়িতে একটি বাংলা নাটকের অনুবাদের অভিনয় দেখতে গিয়ে তিনি নাট্য রচনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে রচনা করলেন তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। মহাভারত থেকে কাহিনি ধার নেওয়া এই নাটকে সর্বজন-পরিচিত পৌরাণিক চরিত্রগুলির মধ্যে মাইকেল কম-বেশি আধুনিক জীবনবোধকে ফুটিয়ে তুললেন। মঞ্চসফল হল এ নাটক। উৎসাহিত হয়ে ১৮৫৯-এর মার্চে হাত দিলেন আরেকটি পৌরাণিক নাটক রচনায়। নাম ‘পদ্মাবতী’। বোধহয় তারই ফাঁকে দুটি স্বল্পায়তন প্রহসন রচনাও সেরে ফেললেন : ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ আর ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। যাই হোক, ‘পদ্মাবতী’তে গ্রিক পুরাণের ধাঁচে সাজিয়ে নিলেন ভারতীয় পুরাণের গল্প। সবচেয়ে বড়ো কথা এ নাটকে বিদুষকের সংলাপে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম প্রয়োগ করলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। সাফল্য পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনায়। অমিত্রাক্ষর নিয়ে যতটুকু সন্দেহ ছিল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মনে, কাব্য প্রকাশের পর সেটুকু আর রইল না। এই বছরের শেষ দিকটায় ‘ব্রজাঙ্গনা’র কয়েকটি কবিতা রচনা করেছিলেন বলে মনে হয়। এর পদরূপ সংগঠনে পুরোনো বৈষ্ণব পদাবলির মডেল কাজ করলেও ছন্দে ইতালীয় Ottava Rimaকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সর্বোপরি নায়িকা ‘শ্রীমতি রাধা’কে কবি করে তুললেন আধুনিক চেতনাদীপ্ত এক রক্ত-মাংসের মানবী। কেবল এ কাব্যেই মিত্রাক্ষরের বন্ধন স্বীকার করেছেন কবি। এরপর ১৮৬০-এ ফেব্রুয়ারিতে শুরু করলেন অমর কাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর প্রথম সর্গ। পুরো গ্রন্থটি লিখতে বছরখানেকের বেশি সময় নিয়েছিলেন মধুসূদন। ১৮৬১ সালের জানুয়ারিতে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর প্রথম চারটি সর্গ প্রকাশিত হয়ে যায়। কাব্য পড়ে পাঠকসমাজে দেখা দিল দারুণ চাঞ্চল্য। কবিকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা হল কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে। কবি এরপর পড়তে শুরু করলেন জেমস টডের লেখা রাজস্থানের ইতিহাস; যাকে আশ্রয় করে লিখবেন বাংলা ভাষার প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’। নিষ্পাপ সরল হৃদয়া মেবার রাজকন্যা কৃষ্ণার জীবন কীভাবে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে পড়ে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মবলিদানে নিঃশেষিত হল তারই ব্যথাভরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক রোমান্টিক ট্রাজেডি হল এ নাটক। উল্লেখ্য যে, মধুসূদনের সমস্ত নাটকের এটিই মধ্যমণি। ১৮৬১ সালের আগস্টের শেষাশেষি বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে পত্র লেখেন লিরিক কবিতা এবং সনেট লেখার ইচ্ছা জানিয়ে। সেপ্টেম্বরে শুরু হল ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ইতালীয় কবি ওভিদের ‘হেরোইদেস’-এর আদর্শে। তবে মূলকে ছাপিয়ে স্বতন্ত্র মাত্রা আনতে সক্ষম হয়েছেন বাণীর বিদ্রোহী সন্তান মধুসূদন। ‘আত্মবিলাপ’-এ বিনা দোষে ধর্মপত্নী সহ চার পুত্র-কন্যা ত্যাগের জন্যে যে অনুশোচনা তিনি প্রকাশ করেছেন, ‘বীরাঙ্গনা’র অনুযোগ পত্রগুলিতে কি সেই অপরাধবোধেরই ভিন্ন সাহিত্যরূপ দেখা গেল? এ প্রশ্নের উত্তর ওই কাব্যে ঝাপসা হলেও অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অমিত্রাক্ষরের ত্রুটিমুক্ত রূপ। এটি বাংলা ভাষায় রচিত একমাত্র পত্রকাব্য। কবির ইচ্ছে ছিল মহরম বিষয়ে কিছু লেখবার, কিন্তু নানা কারণে সে আর হয়ে ওঠেনি। ১৮৬২র জুন মাসে তিনি একাই বিলেতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন, উদ্দেশ্য আইন পড়ে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরবেন। একটু মোটা উপার্জন করে সংসারটাকে নিজের মতো সামান্য গুছিয়ে নেবেন। কিন্তু হল কি তা?

মধুসূদনের বিলাতবাসের জীবন নানা কারণেই বিড়ম্বিত। প্রথম যৌবনে যে দেশটিকে স্বপ্নময় বলে মনে হয়েছিল, আজ ৩৮ বছর বয়স্ক কবির কাছে সেই দেশের জীবন হয়ে উঠল বিভীষিকাময়। সমস্যার সূচনা ঘটে তাঁর বিলেতে যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে। হেনরিয়েটা দুই সন্তানসহ কবির কাছে উপস্থিত হলেন। লন্ডনে খরচ চালানোর জন্য নিজের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে নিয়মিত অর্থপ্রাপ্তির যে-ব্যবস্থা কলকাতায় করে গিয়েছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে সে বিষয়ে নানা গোলযোগ দেখা দিল। এর পরিণাম হল ভয়ঙ্কর। তিনি ব্যয়সাধ্য বিদেশভূমিতে প্রচণ্ড অর্থ-কষ্টের সম্মুখীন হলেন। ব্যয়ভার কমানোর জন্য কবি সপরিবারে চলে এলেন ফ্রান্সের ভার্সাই-এ। বিব্রত মধুসূদন কিছুদিনের জন্য আইন পড়াও বন্ধ রাখলেন। তবে এই নিদারুণ সমস্যার মধ্যেও মগ্ন হতে চাইলেন কাব্যসৃষ্টিতে। বিদেশের মাটিতে মহাভারতের কাহিনি নিয়ে বাংলা ভাষায় লিখতে আগ্রহী হলেন ‘দ্রৌপদী স্বয়ম্বর’ ও ‘সুভদ্রা-হরণ’। কিন্তু প্রত্যেকটিতে ২০/৩০ পংক্তির বেশি লেখার পর আর উৎসাহ পেলেন না। আসলে একদিকে অর্থনৈতিক সমস্যার চাপ অন্যদিকে পরিচিত পৃষ্ঠপোষকবর্গের অভাব থাকায় তাঁর এখানকার কাব্যস্ফূর্তিতে তেমন কোনো উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়নি। এর আগে তিনি তো গ্রিক ল্যাটিন হিব্রু সংস্কৃত তামিল তেলুগু ফারসি শিখেছিলেন, ফ্রান্সে এসে অধিগত করলেন ইতালি ও ফরাসি ভাষা। রপ্ত করতে শুরু করলেন জার্মানও। বৃহৎ কাব্য রচনায় ব্যর্থ হলেও এইসময় বাণীর বরপুত্র মধুসূদনের সারস্বত প্রতিভার শেষ প্রজ্জ্বলন ঘটল। শেষ পর্যন্ত তিনি সাহসে ভর করে ইউরোপীয় সাহিত্যকলার বিশিষ্ট কাব্যরীতি সনেটের আটোসাঁটো গঠনে তাঁর আবেগকে ভরে দিলেন। এরা হয়ে উঠল এক একটি নিটোল ভাবস্তম্ভ। সৃষ্টি হল বাংলা সাহিত্যের নতুন কাব্যরূপের, যার নাম চতুর্দশপদী কবিতা। ভার্সাই-এ থাকাকালে আর্থিক অনটনে দিশাহারা হয়ে কবি স্মরণ করলেন দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরকে। চিঠি পাঠিয়ে কাতর প্রার্থনা জানালেন অর্থ সাহায্যের। সময়টা ১৮৬৪ সালের প্রথম দিক। অবশেষে বিদ্যাসাগরের প্রেরিত অর্থে মধুসূদন সে-যাত্রা রক্ষা পেলেন এবং ১৮৬৭ সালে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একাকী জন্মভূমির উদ্দেশে রওনা দিলেন।

কলকাতায় এসে উঠলেন ব্যয়বহুল স্পেন্সেস হোটেলে। এর পিছনে বোধহয় সদ্য ইউরোপ প্রত্যাগত কবির মনে সেখানকার বিলাসবহুল জনজীবনের একটি অস্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতার হাইকোর্টে ব্যারিস্টার পদে যোগদানের জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু এত সহজে চাকরি মিলল না। চুক্তিমতো নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যাসাগরকে পূর্ব ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে। মাসকয়েক পরেই জানা গেল কবির গলার অসুখের কথা। বিলেত থেকে ফিরে এরই মধ্যে লিখে ফেলেছেন একমাত্র গদ্য রচনা ‘হেক্টর বধ’। নিজের খরচ চালানোর জন্য ও বাকি দেনা শোধের জন্য অবশেষে ১৮৬৮র ফেব্রুয়ারি মাসে কবি তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করলেন মাত্র কুড়ি হাজার টাকায়। ততদিনে হেনরিয়েটা দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছেন কবির কাছে কলকাতায়। ১৮৬৯ সালে জুন মাস থেকে হোটেল ছেড়ে কবি সপরিবারে লাউডন স্ট্রিটে ভাড়াবাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। পরের বছরের জুনে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিলের রেকর্ড সমূহের পরীক্ষক পদে যোগদান করলেন। ১৮৭২এর গোড়ার দিকে একটি মামলায় বাদীপক্ষের তরফে ডাক পেয়ে গেলেন পুরুলিয়া। সেখানে খ্রিস্টান-নেতা কাঙালিচরণ সিংহের পুত্র কৃষ্ণদাসকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিলেন। তাঁর মন বোধহয় এই প্রথম ধর্মভাবের পবিত্রতায় ভরে উঠল। উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখে ফেললেন একটি বাংলা কবিতা। মার্চে পুরুলিয়ার পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহদেব কবিকে ম্যানেজার পদে যোগ দিতে আহ্বান জানান। মাসে মাসে নির্দিষ্ট আয়ের নিশ্চয়তার কথা ভেবে ও পাওনাদারদের হাত এড়াতে পারবেন মনে করেই কবি তৎক্ষণাৎ সে ডাকে সাড়া দিলেন। এর পিছনে হয়তো তাঁর রাজকবি হওয়ার অপূর্ণ বাসনাও কাজ করে থাকবে। কিন্তু স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হতে বিলম্ব হয়নি। মাসকয়েক পরে কবির তত্ত্বাবধানে একটি সুনিশ্চিত পরাজয়ের বেআইনি মামলায় রাজা নীলমণি সিংয়ের হার হলে কবি গোপনে রাত্রির অন্ধকারে পালিয়ে জীবন ও সম্মান রক্ষা করলেন। কলকাতায় ফিরে আবার শুরু হল তাঁর দুর্দশার দিন।

১৮৭৩ সালে মে মাসে কবির মন আরো ভেঙে পড়ল তাঁর ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ২৭ বৎসর বয়স্ক পাত্র উইলিয়াম ফ্লয়েডের সঙ্গে ত্রয়োদশী কন্যা শর্মিষ্ঠার বিবাহে। এ বিবাহ জীবন ও ভাগ্যের কাছে মধুসূদনের পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার এক চরম দৃষ্টান্ত। যাইহোক, মনের এই অবস্থায় অক্ষম দেহ নিয়ে গেলেন উত্তরপাড়ায় পরিচিত জমিদার রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে। ছিলেন মাত্র ছ’সপ্তাহ। এই সময় তাঁর চোখে কেবল মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তহীন হতাশার নিষ্প্রভ বিবর্ণতা। কবি-পত্নীও ভেঙে পড়েছেন, মৃত্যুরোগ গ্রাস করেছে তাঁকেও। স্ত্রীকে জামাতা ফ্লয়েডের কাছে পাঠিয়ে কবি গিয়ে উঠলেন আলিপুর জেনারেল হসপিটালে। নিজের সাহেবি পরিচয়ের দরুন বিদেশি ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য স্থাপিত এই চিকিৎসালয়ে জীবনের শেষ কটা দিন কাটানোর অনুমতি পেলেন। এখানেই তিনি তাঁর পত্নীর মৃত্যুর খবর পান। এরপর মর্মাহত বিষণ্ণ মুমূর্ষু কবিকে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন, রবিবার, বেলা দুটোয় আলিপুর হাসপাতালের এক নিভৃত কক্ষে নিঃশব্দে স্বজন পরিজনহীন অবস্থায় অবজ্ঞাত এই মহান মানুষটির শেষ নিঃশ্বাস নির্গত হল। পরবর্তীকালে তাঁর গুণগ্রাহী পাঠক ও বন্ধুবর্গ মিলে গড়ে তুললেন কবির এক সমাধি-স্তম্ভ, যার গায়ে পাথরে খোদিত হয়েছে মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা তাঁরই রচিত এই এপিটাফ:
“দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম!) মহীর পদে চিরনিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!”

বাঙালি কবিদের মধ্যে এটাই ছিল এপিটাফ রচনারও সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!