দেশ কাল: কবি ও কবিতা

কবিতা আজও সার্বিকভাবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠেনি। সামান্য কিছু মানুষ কবিতা পড়েন। কবি এখনও অনেকের কাছে অবজ্ঞা বা করুণার পাত্র। তবে শুধু আজই নয়, শেলীর যুগেও একজন সমালোচক (T.Peacock) বলেছেন যে, ‘কাব্যের স্থান লৌহ-যুগে।’ যখন যুদ্ধবাজ তস্কর-বীরদের স্তুতিগান করাই কাব্যের মূল লক্ষ্য ছিল। সমাজ বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হলে নাকি কাব্য নষ্ট হয়।

এখনও কবিরা অতীত স্বর্ণ-যুগের দিকে তাকান, বার্তমান কালের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও। এটা কাব্যের স্বর্ণযুগ নয়, পিতল-যুগ। স্ব-সমাজচ্যুত কাব্যের দ্বিতীয় শৈশব।

সত্যযুগে কবিরা তখন আধা-সভ্য মানুষ।
কিন্তু কাব্যের পক্ষে শেলীর যুগ আজও স্মরণীয়।
কবি বর্তমান বস্তুজগতের বিধি নির্দেশ করেন,আর ইঙ্গিত করেন ভবিষ্যতের।

তারাই কাব্যের পিতল-যুগে বসবাস করেন,
যারা কোন কারণ ছাড়াই অতীতের একটা মায়া-জগতে বাস করতে পলায়ন করেন ।
কবির কল্পনা সামাজিক আত্মীয়তার বাহন।

‘প্রতিবেশীকে ভালবাসা কল্পনা সাপেক্ষ্য সামজিক
ক্রিয়া (Shelly), কল্পনা আবার কবির ভাষায় অনুভূতির প্রসার।’ ‘অনুভূতি করে দেয় জগৎ আপন ( কুমুদরঞ্জন মল্লিক)’। কবির প্রেরণা থেমে থাকে না, কারণ তার সৃজনশীল আবেগ চিরন্তন।

পরিবেশের বিকৃতি বা নৈরাজ্য অনেক সময় কবি মনকে বিকৃত করতে পারে সাময়িকভাবে। তাই কেউ কেউ ব্যক্তি-সাতন্ত্রের অলীক জয়গানে, নিজেকে ঘিরে আত্মরতির মিনার রচনা করেন, জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে, মায়া জগৎ সৃষ্টি করে তার মধ্যে বাস করতে শুরু করেন।যা সম্পূর্ণভাবে তার নিজের কল্পনার জগৎ মাত্র। তিনি সাধারণের জন্য লেখেন না। দুর্বোধ্য সংকেতে কথা বলেন। যেমন, ফরাসী বোদলেয়র, মালার্মে প্রমুখরা।

আবার কোন কোন কবি বর্তমানকে ত্যাগ করে অতীতের শীতল ছায়ায় আশ্রয় খোঁজেন। কেউ কেউ সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের আশ্রয় নেন। বর্তমান পরিবেশকে আয়ত্ব করতে না পেরে, কেউ কেউ খোঁজেন প্রকৃতির রমণীয় ক্রোড়ের আশ্রয়। কেউ কেউ স্বপ্ন-জগৎ সৃষ্টি করে তার মধ্যে নিশ্চিন্তে বসবাস শুরু করেন।

এইসব কবিদের কথা ভেবেই বোধহয় প্লেটো ঘোষণা করেছিলেন, ‘আদর্শ সমাজে কবিদের কোন স্থান নেই।’

কাব্যের মূল প্রাণ আবেগ, এ’কথা মিথ্যে নয়।
‘কবিমনকে সমাজের সূক্ষ্মতম বীণা-যন্ত্র বলা হয় (বিনয় ঘোষ)’। কবিই জীবন আর পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে কান পেতে থাকেন। তাই কাব্যের সঙ্গে সমাজ-জীবনের যোগ সর্বদাই নিবিড়। প্লেটোর শিষ্য এরিস্টোটল তাই কবিকে বলেছিলেন,’সমাজের জাগ্রত প্রহরী’। কালের বিচারে কবিই সমাজ-জীবনের চিরজাগ্রত সাক্ষী। কবিতা হলো, কাল ও দেশের প্রতিচ্ছবি।

কবিতার উদ্দেশ্য ও সার্থকতা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, গেটে (Goethe) তখন বলেন, ‘কবিতার কাছে কেউ কিছু শিখতে যায় না, কিছু হতে যায়।’ কিছু নীতিকথা কিংবা জ্ঞানদান কাব্যের উদ্দেশ্য নয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থার তাড়নায় কবি মনে যে সাড়া জাগে,শ্বাব্দিক রূপে এই বিভাব ধরা পড়ে তার সৃষ্টিতে। ‘কবির যে আবেগ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, সেই আবেগ ব্যক্তিরও চিত্ত শুদ্ধি করে (বঙ্কিমচন্দ্র)‘। প্রয়োজন নিরপেক্ষ কাব্য সমাজে অচল। কাব্য জ্যামিতিক চতুষ্কোন বা ত্রিভূজের নৈতিকতা নিয়ে চলতে পারে না। কবির ব্যক্তিত্বের গঠনই সারকথা। ‘শ্রেষ্ট শিল্প সৃষ্টির জন্য মহৎ জীবন একান্ত প্রয়োজন (মহত্মা গান্ধী)’। মনুষ্য সমাজের ইচ্ছা ব্যক্তির মাধ্যমে কবির কামনায় প্রথম রূপ পরিগ্রহণ করে। সমাজ এই আবেগ ব্যঞ্জনায় গতিশীলতা লাভ করে। এরিষ্টটল কবির এই ‘ঘটতে পারার’ দিকের আবেগকে বস্তুর সার্বজনীন রূপসৃষ্টি বলতে চেয়েছেন। কবিকে তিনি সমাজ থেকে নির্বাসিত করতে চাননি। কবিরা এক হিসাবে সামাজিক হয়েও বিপ্লবী, ভাব-রাজ্যের ঘর ভাঙার অগ্রদূত। কবির চোখে অন্তরের অক্লান্ত বিস্ময় যেন ব্যক্ত হয়েও,অব্যক্ত রূপ হতে অরূপে অভিব্যক্ত হচ্ছে। এই দৃষ্টি হতেই কবি সৃষ্টিকর্তা। ‘তাঁর দেখা,আর তার সৃষ্টি একই (রবীন্দ্রনাথ)’।

কবির আবেগের দু’টি দিক। একটি ভাব তরঙ্গ,অন্যটি শব্দ তরঙ্গ। একট রসাবোধ, সৌন্দর্যবোধ, বিশ্ববোধ, আনন্দলীলা। আর একটি সেই বোধের আনন্দ উপলব্ধিকে অন্য সামজিকগণের নিকট প্রকাশের আগ্রহে যথার্থ শিল্প মাধ্যম গ্রহণ করা। একটি কাব্যের বিষয়, অন্যটি কাব্যের প্রকাশ আঙ্গিক। ভাব ও জ্ঞান শব্দের মধ্যমেই প্রকাশিত হয়। শব্দই একমাত্র প্রকাশক। ভাব ও ভাষা এখানে অবিচ্ছেদ্য। ‘বাক ও অর্থ হর-পার্বতীর মতোই সংম্পৃক্ত (কালিদাস)’। ‘এই মিলন যখন বিশিষ্ট বাণী রূপে ফুটে ওঠে,কাব্য মন্ত্র হয়ে ওঠে (ঋষি অরবিন্দ)’।

‘অন্তরের ও বাইরের জগতের রসের যে যৌগিক অবস্থা তার অনুঘটক বলা চলে কবির আমিকে (T.S.Eliot-‘Catalystic agent)‘.

‘অন্তরে বাহিরে সেই ব্যাকুলিত মিলনেই কবির একান্ত সুখোচ্ছ্বাস’ (রবীন্দ্রনাথ – ‘মানসী’)
কাব্য কবির শুধু চৈতন্যই নয়, সমগ্র চিত্তই মুক্তি লাভ করে।

প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বরত যুগের মানব হৃদয়ের ভাবাবেগের ঘামের ধারাকে কাব্য বলে বর্ণনা করা হয় (Poetry is the emotional sweat of man’s struggle with nature -illusion and Reality – by Caudwel) ভেদের আঘাতেই প্রথম প্রেরণা জাগায়। ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনবোধের সঙ্গে বাইরের সংঘাতেই কাব্যের সৃষ্টি। ‘বস্তু সত্ত্বার ও আত্ম-চৈতন্যের আবরণ ভঙ্গ করাই কবির ব্রত (অভিনব গুপ্ত)’। শেলীর মতে ‘অবগুন্ঠন মোচন।’ আত্মার অহংকার, সৃষ্টির অনৈক্য কাব্যে এক বিরাট ঐক্যতানে, সুসমঞ্জম বলে প্রতীয়মান হয়।

কবির ‘আমি’ একটা ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন আমি নয়। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য একটি সদা জাগ্রত চেতনা। তাই কবি বলেন, ‘এক হয়ে গেছে আমার জীবন, আর এই ভুবন (রবীন্দ্রনাথ)’। তিনি আবার বলেন, ‘ভূত ভবিষ্যৎ লয়ে যে বিরাট অখন্ড বিরাজে / সে মানব মাঝে/ নিভৃতে দেখিব আজি এ আমিরে / সর্বত্রগামীরে'(রবীন্দ্রনাথ)’।

কবিচিত্ত সর্বমানব চিত্তের প্রতিনিধি এক সামাজিক চিত্ত। সমাজহীনতা চেতনাহীন – তারই সামিল (Keeping the consciousness on social rails is marely keeping it concious – Caudwel)। কবির আমির চেতনার জন্য সে সমাজের কাছে ঋণী।কাব্যের চিন্তা, ভাষা, বিষয় সবই সামাজিক। একজন কবি সামাজিক জীব হিসাবে কাব্যের উপাদানের জন্য সমাজের মুখাপেক্ষী।

সমাজের সাধারণ ভান্ডার থেকেই কবিমনকে বস্তু অভিজ্ঞতা ভাষা ও চিন্তা আহরণ করতে হয়। অথচ প্রত্যেক সামাজিক ব্যক্তিই কিন্তু কবি হন না। সমাজের আবেগ কোন ব্যক্তি বিশেষের হৃদয়ে মূর্ত হয়ে ক্রিয়াশীল হয়। ‘সমস্ত সৃষ্টির পিছনে এক বিশাল মনের পরিচয়, আধুনিক বিজ্ঞানীগণও পেতে আরম্ভ করেছেন (Jeans)’.
“The ‘I’ of a poem is more often than not a dramatic or representative I. He is medium of a creative force a reed though which the spirit blows (Sri Aurobindo).
(একটি কবিতার ‘আমি’ প্রায়শই নাটকীয় বা প্রতিনিধিত্বকারী নয়। তিনি একটি সৃজনশীল শক্তির মাধ্যম একটি নলখাগড়া যা আত্মাকে প্রবাহিত করে (শ্রী অরবিন্দ)।

কবি তার ব্যক্তিহৃদয়ের এই বিশিষ্ট স্পন্দনকে ভাষায় (শব্দে) রূপদান করেন। কবি হৃদয়ের আবেগই কাব্যের আশ্চর্যময়তা। এখানেই কবি আবিষ্কার কর্তা, স্রষ্টা। আবেগ তার প্রকাশ হয়, বিশিষ্ট এক ভাষার রীতিতেই ভাবের অনুভূতিকে, চিন্তাকে সমাজের সামনে বের হয়ে আসতে হয়। বিষয়ের ভান্ডারের মতো ভাষার ভান্ডারও সামাজিক। কবির চিন্তাস্পর্শে বস্তুতে ও ভাষাতে নবীনতার রঙ লাগে। কাব্যের রঞ্জন ধর্মের বৈশিষ্ট কবির ব্যক্তিত্বে।

বস্তুর প্রকৃতরূপ কি, তা কবিতায় ধরা পড়ে না। বিজ্ঞানেও ধরা পড়ে না বলে, বৈজ্ঞানিকগণ স্বীকার করেছেন।

‘বস্তুর আকার ও ভাব, স্তিতি ও গতি পর্যবেক্ষকের আমির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল (Einstein)’।”বিজ্ঞানও আমাদেরকে অহংয়ের দুয়ারে এনে একলা ফেলে গেছে বলা হয় (Plank)’

হিউম, মিকেল,হেগেল,ক্রোচে (A landscape is a state of mind) প্রকৃত দার্শনিকগণ, রিচার্ডসের (Beauty is emotional satisfaction) মতো সমালোচক, কোলরিজের (We receive but what we give And in our life does nature live) মতো কবি নিসর্গের এই আরোপিত সৌন্দর্যের কথাই বলেছেন। কবির আমির চেতনায় যা খন্ড খন্ড তা এক হয় সম্পূর্ণতা পায়। কবির আমির আবেগ সুন্দর করে। কবি বলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হ’ল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে /আমি চোখ মেললুম আকাশে/জ্বলে উঠল আলো/পূবে পশ্চিমে। গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর। সুন্দর হ’ল সে (রবীন্দ্রনাথ)’।

সচেতন কবি তাই নিজেই এই লীলায় ও ব্যঞ্জনায় মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠেন,-
‘যে আমি আমা হতে মুক্তি চাই কল্পনার নিশীথ স্বপনে,/সেই আমি বাঁধি পুনঃ আপনারে চেতনার জাগ্রত ভুবনে,/আমারি ঐশ্বর্য তাই হেরি আমি তার দেহ/মাঝে তাই সে সুন্দর হেন, সাজিয়েছে মোর দেওয়া ফুল্ল ফুল সাজে’ (মোহিতলাল)’।
‘জীবন মন্থন বিষ নিজে করি পান, যা অমৃত ওঠে তাই তিনি সমাজকে দান করে যান’ (রবীন্দ্রনাথ)’।

কবির সৃষ্ট জগৎ মিথ্যে নয়। ফ্রয়েডের মতে, ‘মানুষের উপহৃত সহজ প্রকৃতি জীবনের রূঢ় আঘাত হতে মনগড়া এক কল্পলোকে ক্ষণিক বিশ্রামের জন্য, সৌন্দর্যের এক অধ্যাস জগৎ সৃষ্টি করে।’

‘পৃথিবীর বেসৃরো বস্তু সংঘাতের জন্য তিনিই আক্ষেপ করেন যিনি প্রেমের দ্বারা মনের মতো একটি সুন্দর জগৎ গড়তে চান (W.B.Yeats)‘।’ Poetry is daughter of love (Bermard De Fontenelle)’. যিনি খন্ড দৃষ্টি ও ভেদবুদ্ধির পীড়া জানেন বলেই তিনি আক্ষেপ করতে পারেন – ‘On margate sounds I can connect nothing with nothing (T.S.Eliot)’.

কবির হৃদয়ে সীমার মাঝে অসীমের সুর বেজে ওঠে। কবির ছোট ‘আমি’ যদি তার সামাজিক বন্ধন ভুলে যায়, তখন কবিতা হয়ে পড়ে খেয়ালী মনের ক্রীয়নক। সেই কাব্যের আবেগ সমাজকে তখন সম্ভাবনীয়তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করে না।

কাব্যের বাহক নিছক বুদ্ধি নয়। বুদ্ধি স্থিতিশীল। কাব্যের বাহক আবেগ। আবেগই জীবনে গতি আনে। আবেগই স্বাভাবিক কর্ম প্রবণতার উৎস। বুদ্ধি চেতনার পথে তাকে সংগঠিত করে, প্লাবনের অসংযম হতে তাকে রক্ষা করে, সৃজনশীল করে, তাকে কখনও ধ্বংস হতে দেয় না।

ব্যক্তির বিকাশ গোষ্ঠীর মধ্যে আশ্চর্যজনক হলেও, অবিরাম ঘটে চলেছে। ধারাবাহিকভাবে যে অনুভব গভীর দ্যোতনা সৃষ্টি করে মনে, তাই ভাল কবিতার জন্ম দেয়। ‘For all good is the spontaneous overflow of the powerful feelings – Willim Wordsworth.’

‘বর্তমান অবস্থাকে অতিক্রম করার জন্য একটা চিরন্তন আবেগ রয়েছে সৃষ্টির মূলে। এই অতিক্রান্তির আবেগই বৃত্তিময় কাব্যের আবেগ (Croce)’। ক্রান্তি একটি বিমূর্ত অতীতের ছন্নছাড়া বৃত্তিময় অবস্থাকে, বর্তমানে এনে, ভবিষ্যতের বীজ বপন করে। এই কামনা আনন্দই কবিকে নন্দিত করে। কলাকৈবল্যের প্রচার না করেও ব্যক্তিত্ব স্ফূরণের সম্ভবনা বর্তমান থাকে। উদ্দেশ্যমুখী আবেগের সন্মুখের দিকের সম্ভবনার সাক্ষাৎকারে, সমাজের কাছে কবির মূল্য। যা ঘটে সব সত্য নয় বলে, কবি জীবনের পূর্ণতর রূপটিকে উদ্ঘাটন করতে চান।
‘ When man act he is a puppet
Who he describe he is a poet.- Oscar Wilde.

অনুলব্ধের জন্য যে কামনা,তাই সৃষ্টিশক্তি, কবিতায় সে ইচ্ছাই রূপ সৃষ্টি করে। ইচ্ছাই সত্তার বীজ। মনুষ্য সমাজের ইচ্ছা, ব্যক্তির মাধ্যমে কবির কামনায় প্রথমে রূপ পরিগ্রহণ করে। সমাজ এই আবেগের ফলে গতিশীলতা লাভ করে।

সমাজের সামাজিক বন্ধনের মধ্যেই কবির আবেগধ্বনি ও ব্যক্তিত্বের দ্যোতনা, শব্দে ও ভাষায় একটি বিশিষ্ট ব্যঞ্জনায় নবীনতার জোয়ার আনে। কবি ব্রাউনিং বলেছেন, ‘নতুন রঙ করা।’ সুকান্ত লিখলেন (বহু পুরাতন) ‘পাখি সব করে রব’ কবিতার অনুরণনে একটি নতুন ভাব ও দ্যোতনার রচনা –
‘পাখি সব করে রব রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে
ভোরের কাকলি শুনি, অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে।
হয়তো এখনি কোন মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল
মুক্তির অবাধ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল।’

বহু প্রচলিত শব্দের ঔজ্জ্বল্য ও কবির নতুন আবেগ নবরূপে বর্ধিত হয়ে তার ভাবাবেগ নতুন অনুভূতির সঞ্চার করেছে এখানে। ভাষার ধ্বনি সম্পদ এভাবে বেড়ে চলে।

‘যেখানে শুধু শব্দ গেঁথে গেঁথে কবিতা রচনা করা হয়েছে মনেহয় এবং শব্দ দোলা মনকে প্রায় অভিভূত করে, সেখানেও শব্দের নির্বাচন বা ধ্বনিতে কবি মনের ভাবাবেগের একটি বিশিষ্ট ঢঙ নিগূঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে (Arnold Bennet)’। শব্দের মূল্য , সেই গূঢ় আবেগের ধ্বনির মূল্যে। ‘আত্মপ্রকাশকে শিল্পের মূল কথা বলা ভুল (Carrit)‘ যেখানে ভাব সংত্রমণের স্পৃহা নেই সেখানে সাহিত্যও নেই। আত্মআলোড়ন শুধু আত্মপ্রকাশ নয়।

কাব্যের ভাষায় আর গদ্যের ভাষায় অনেক সময় একটা গন্ডি টানা হয়। গদ্য অর্থাৎ প্রকৃত গদ্য সংবাদের ভাষা আর কাব্য সংবেদনের ভাষা।
‘আবেগের ভাষা, মিলনের ভাষা, সংক্রমণের ভাষা কাব্য। জ্ঞাপনের ভাষা, তর্কের ভাষা, তিরস্কারের ভাষা, যুক্তির ভাষা গদ্য (Caudwell)’। খন্ডিত মনের ভাষা গদ্য, সামাজিক মনের ভাষা কাব্য। ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তির সাতন্ত্র ও অহংকার গদ্যে ভাল প্রকাশ পায়। সমন্বয় ও সংযোগের আবেগ প্রকাশ পায় কাব্যে।
যেখানে দোলা, যেখানে মিল, সেখানেই এই ছন্দ। এই ছন্দ বা rhythm কবির আবেগ প্রবাহের শাব্দিক রূপ। ভাষাকে ও অক্ষরকে ছন্দোবদ্ধ করাতেই কবির শিল্প। শুধু শব্দ বা অক্ষর ব্যবস্থাতেই নয়, ভাবসঙ্গতিও কাব্যে আবেগ সংগঠনের ছন্দিত গতি অব্যাহত রাখে। গতি ও যতির ব্যবহারও ছন্দের মধ্যে তৃপ্তি আনে।

‘সমতান এই বহুর ভাব ও ঐক্যের তৃপ্তি দেয় (Aristotle)”। ‘বিমূর্তনে নানাত্বের ঐক্যেই সৌন্দর্য। মূর্তনে প্রাণের সঙ্গে রূপের মিলন (Coleridge -‘Union of shapely with the vital) ঘটে’।

প্রচলিত অনেক গদ্য কাব্যের পর্যায়ে পড়ে। আবার অনেক কাব্য গদ্যের ছদ্ম আবরণ মাত্র।

‘ছন্দ বর্জনে কবির সামাজিক বন্ধনের অস্বীকৃতি প্রকাশ পায়,স্বকীয়তার একটা নৈরাজ্য অভীপ্সাই প্রতিবিম্বিত হয় ( Caudwell)’। কবিমন যখন যখন অসামজিক হয়, প্রতিবেশীদের প্রতি বিতৃষ্ণায় যখন মানসিক বিবমিশায়, বস্তু অর্জনতা সবকিছু ত্যাগ করেন। প্রতিবেশ তখন তার কাছে নরক (Jean Paul Satra)’

ধ্বনিময় গদ্য শব্দ অনুরণনে যখন বচনাতীতের আস্বাদ দিতে চায়, সঙ্গীতের সুরের মতো কবির বিশিষ্ট ব্যঞ্জনায় শব্দ রসজারিত হয়ে ওঠে, তখন সে গদ্য কাব্যের পর্যায়ে পড়ে।

‘আবেগের গতি সব সময় মসৃণ পথে, উদার পথে, বিশুদ্ধ আভিজাতিক ছন্দে সমুদ্রের আহ্বানে চলে না (রবীন্দ্রনাথ)’। জীবনের অসংযত অভিজ্ঞতার মধ্যেও একটা বিশেষ বেগ আছে। ভাষার গান আর ভাষার গৃহস্থালির সঙ্গে আপস হয় সেখানে।

‘তার ভাঙা তালে হেঁটে চলে যাবে ধনুক হাতে সাওতাল ছেলে / পার হয়ে যাবে গরুর গাড়ি/ আটি আটি খড় বোঝাই করে (রবীন্দ্রনাথ – কোপাই)’।

শব্দের সঠিক যোজনা হলেই, সঠিক উচ্চারণেই কাঙ্খিত আবেগ পাঠক মনকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। অনেক কবি আবার বলেন, ‘কাব্যের উপাদান ভাব বা ভাবনা নয়, ভাষা (Mallarme) কাব্যের এটা কৌশলের দিক।’ প্রেরণার দিক এখানে উপেক্ষিত মনেহয়।

কবিতায় চেতনা ও আবেগের মূলে আছে সামাজিকতা। তাই সহৃদয় পাটকদের কাছে কবিতা পাঠ সহজ হয়ে ওঠে। শ্রোতাদের কাছে আবৃত্ত কবিতা অপেক্ষা মুদ্রিত কাব্য পাঠের রস-সঞ্চয়ণ পাঠকের অন্তরের ও বাইরের ক্ষুদ্র পরিবেশের সমারূপতার উপর বেশী অসহায় ভাবে নির্ভর করে।

আগেকার কালে কবি ও শ্রোতা একসঙ্গে আবেগের সঙ্গে আগে মিলিত হতেন। এই সংযোগে শ্রোতাদেরও পরিমিত ব্যক্তিত্বের খোলস খানিকটা সরে যেত। মুদ্রিত কাব্য পাঠ রসাবেশ অনেকটা পরোক্ষ। কবি এই প্রতিবেশহীন অবস্থায় কিছুটা অসামাজিক হবার সুযোগ পান (We have been able to have fine poetry in England because public do not read it and consequently do not influence it – Oscar Wilde). ‘কবিতা চেঁচিয়ে পড়তে হলে বাজে চালাকির মোহ কবিদের বোধহয় কেটে যাবে (প্রেমেন্দ্র মিত্র)’, তিনি আরও বলেছেন, ‘তার ধ্বনি তার ছন্দ কানের সাহায্য না পেলে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সার্থক করতে পারে না।’

পাঠকের কাছে পৌঁছতে এখন কবিকে মুদ্রণের উপর নির্ভর করতে হয়। ছাপার অক্ষরে ব্যক্তিত্বের কতটুকু ধরা পড়ে, আর কতটুকু বাদ যায়,তা পরিমাপ করা কঠিন। কেউ কেউ আবৃত্ত কাব্যক, অনেক বিষয় আদর্শ ব্যবস্থা বলে মনে করেন (Arnold Bennet). কেউ কেউ বলেন, কাব্য কথিত কলা, লিখিত কলা নয় (Poetry is the spoken art – Amy Lawell). কেউ কেউ আবার শ্রুত কাব্য অপেক্ষা, পঠিত কাব্যোর আবেগ সঞ্চারণ অপেক্ষাকৃত সহজ ভাবেন (H.Stephwn).

কথা ও ভাবকে ঋজু ও সহজ হৃদয়গ্রাহ্য হতে হবে। শুধু পান্ডিত্য কাব্যে তেমন মর্যাদা পায় না। নীতি বাক্য বা কোন রকম উপদেশ আখ্যানও কাব্য নয়। অনেকে ছন্দবদ্ধ উপায়ে এইসবগুলির প্রকাশকে অনেকে কাব্য বলে ভুল করে থাকেন। তাই যদি হতো, তা’হলে ‘সদ্ভাব শতক’ – কাব্য বলে অবিহিত হতো। তারা দুধের স্বাদের বদলে ঘোলের স্বাদে পরিতৃপ্তি বোধ করেন। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে কবি হয় শ্রেণীচ্যুত কিংবা ক্ষুদ্র শ্রেণীভৃক্ত।

কাব্যের রস পান করতে গেলে, পাঠককেও কবি হতে হয় খানিকটা। ‘এখানে দুই হৃদয়ের সহৃদয়তা এবং হৃদয় সাদৃশ্য প্রয়োজন (অভিনব গুপ্ত)’। কাব্য রসাস্বাদন ব্যক্তিত্বের পরিচয় সাপেক্ষ, ( সম্পূর্ণ মানুষটির পরিচয়) শুধু বন্ধুত্বেই তা সম্ভব( Foad)।

‘সাহিত্যে মানুষের অনুরাগ সম্পদ সৃষ্টি করাই যদি যথার্থ কাজ হয়, তবে এই দান গ্রহণ করতে গেলে প্রীতিরই বড় প্রয়োজন। কেন না প্রীতিই সমগ্র করে দেখে (রবীন্দ্রনাথ)’।

বিশ্লেষণ, তর্ক ও ব্যবচ্ছেদের দ্বারা ব্যক্তি স্বরূপটিকে পাওয়া যায় না। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিশ্লষণে কাব্য রস তার রহস্যময়তা হারায়।

মুদ্রণের পরে আসে মূল্যের কথা। কাব্যের পক্ষে মুদ্রাযোগ শুভ হয়নি, যদিও গত্যন্তর ছিল না। মূলধনের অর্থনৈতিক বিবর্তনের সঙ্গে কাব্যের এই দিকটা বিষমভাবে জড়িত। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো যতদিন,শ্রেণী সংঘাতের বৈষম্যে বিক্ষত হয়নি, ততদিন কাব্য সমাজের সাধারণের কাছে আদৃত ছিল। অর্থনৈতিক চাপে সমাজে সাধারণের সহায় হারিয়েছে, তাই এখন কাব্য সমাজপতিদের অভিভাবকত্ব খোঁজে। কাব্যগ্রন্থ এখন ধনী ব্যক্তি বা অভিভাবকত্বে উৎসর্গিত হয়।

‘সমগ্র মানব সমাজকে যা উৎসর্গ করার কথা (Koestler)’ তা ব্যক্তি বিশেষের করকমলে কবি তুলে দিতে শুরু করলেন। ব্যাহত ব্যক্তিত্বের অভিমান, ক্ষুদ্র গন্ডিতে লুকোবার পথ ধরলো। যারা কবিকে বরণ করল না, তাদের প্রতি কবির সহানুভূতি থাকল না। আবেগের একতা সমাজে বিনষ্ট হলো। কাব্য সমাজ জীবন ত্যাগ করে, অসামজিক প্রতীকের পিঠে চড়ে, পণ্য হিসাবে অচল হয়ে পড়ল। কবিতা ব্যর্থ হলো, কবি হলেন নিঃশেষ। সমাজের ও ব্যক্তির, এ এক ব্যর্থতার ইতিহাস। অনাবশ্যক তুচ্ছ খেলনা গড়ার কাজে মশগুল হলেন কবি। আত্মবিনোদনই আদর্শ হয়ে উঠল তার। অথচ সমাজই কাব্যের পৃষ্ঠপোষক হতে পারত। অবসর বিনোদনের শ্রম বিমুখ চিত্ত বিলাসে ও আত্মরতির বিকারই কবির পক্ষে তা হাস্যকর ব্যর্থতা হয়ে উঠল।

‘পৃথিবীকে ও জীবনকে সুন্দর করার উন্মুখ আকাঙ্খা যেখানে, সেখানে গুরু গুরু গর্জন,গুণ গুণ স্বর, সুখে দুঃখে দিবস রজনী, জীবনের মহা মন্ত্রধ্বনি মুখরিত করে তোলে ( রবীন্দ্রনাথ)’, সেখানেই জীবনের ছন্দ, সামাজিক মিলনের জীয়ন কাঠি। কবি মাটির রসে ফুলের মতোই পুষ্ট।

যদি প্রয়োজনের চেতনা ও আবেগ কবিকে অনুপ্রাণিত করত, তাহলে – ‘হে মহাজীবন আর এ কাব্য নয়’ – বলে সুকান্তকে আক্ষেপ করতে হতো না। ‘দুঃসাহসী বিন্দু আমি বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা (সুকান্ত)’ বলে কবি পরিবেশকে জয় করতে পারতেন। ‘তার পরে হবো ইতিহাস (সুকান্ত)’ বলে মৃত্যুকে অবজ্ঞা করতে পারতেন কবি।

শ্রমের আবেগই সৃজনশীলতার আনন্দ। প্রকৃত রূপকার কবি আঙ্গিকের জন্য তার কুম্ভকারকে তার চাকার পাশে, সূত্রধরকে তার বেঞ্চের পাশে দাঁড় করান না (Goethe). কবি তাই যুগকে (সমকাল) অস্বীকার করতে পারেন না।

‘বেতারেও যদি কবিতা পাঠ করতে হয়, সমাজ মননে পৌঁছাতে, তাহলে কাব্য অবোধ্য হতে পারবে না এবং বিমূর্ত সাহিত্যশ্রুতির তাগাদায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে না (Valery)’.

অর্থনৈতিক চাপে কবিকে অভিভাবক খুঁজতে হয়েছে। সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতের ছাপ মেরে কাব্যকে পণ্য হিসাবে বাজারে ছাড়তে হয়েছে। এ অবস্থায় কবি খুশি নয়। তাই কবি বলেন, “কোলের কুকুর কিংবা জুয়োর ঘোড়ার মতো,সব। সব স্বত্ব হারিয়েছি অন্য হীন প্রভু মেনে নিয়ে ‘- বুদ্ধদেব বসু।

‘সাহিত্বের দাসত্বের ক্ষুদিত বশ্যতার বিরুদ্ধে’ সুকান্ত বিদ্রোহ করেছেন। তাই ‘কবি রাহুগ্রস্ত হলেও আমাদের নমস্য (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)’।
‘বিরোধের নৈরাজ্য কাব্যোর পরিপোষক নয়।আবদ্ধতা ও ভয়, হিংসা আর সুবিধাবাদ কবির উপযুক্ত পরিবেশ নয় (Cyril)’। বর্তমান ধর্মহীন সমাজে কাব্যের প্রসার আশা করা ভুল।
ধর্ম বলতে এইটুকু মেনে নিলেই যথেষ্ট যে ‘সামাজিক গুণের সর্বোচ্চ চেতনাই নামই ধর্ম (Ames)’।

কেউ কেউ কবিকে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষ নিতে বলেন। ‘Unless he joins in his writting will become increasingly false, worrhless as litareture …. Must first of all become a socialist in his pracrical life, must go over to the progressive side of class conflict – Stephen Spender ‘The mind of chains’ (তার লেখায় যোগ না দিলে ক্রমশ মিথ্যা হয়ে উঠবে, সাহিত্যের মতো দুশ্চিন্তাহীন।… সবার আগে তার ব্যবহারিক জীবনে সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠতে হবে, শ্রেণী সংঘাতের প্রগতিশীল দিকে যেতে হবে – স্টিফেন স্পেন্ডার ‘দ্য মাইন্ড অফ চেইন’)। কেউ আবার বলেন – ‘সাময়িক বন্ধনেই, সকলের সেবাব্রতেই কাব্য ও শিল্প পুষ্পিত হয়ে ওঠে (Schumann)’। অন্যদিকে বলা যায়, দলপতির দন্ড চালনায় কাব্য হয় না।

কবি চিরকালই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ধূলা মাটির জগতকে রূপে রসে পূর্ণ করতে, কবির রসস্পর্শ ও সংগঠক চেতনার প্রয়োজন সমাজের ও বস্তুর সংঘাতের আহ্বানে কবিকে সাড়া দিতে হয়। বিমূর্ত সুন্দরের স্বপ্নবিলাসে, কবির নিঃশ্চেষ্ট হয়ে থাকলে চলে না।

কবির কাছে প্রেমের সুর স্তব্ধ হয় না। তাই কবি বলে ওঠেন, ‘আর কিছু নাহি পারি / আমি তোমাদিগকে করি আনন্দ-অমৃতের অধিকারী (কুমুদরঞ্জন মল্লিক)’। তাই আমরা কবিকে বলি ‘আছে আছে স্থান’ (রবীন্দ্রনাথ)।

তবুও কবিকে হতাশায় ও বিরক্তিতে কখনও কখনও বলে উঠতে শুনেছি –
‘I think it better that in times like these
A poet’s mouth be silent: for in truth
We have no gift to get a statement rught.’
(‘আমি মনে করি এই ধরনের সময়ে এটি আরও ভাল যে
একজন কবির পক্ষে চুপ থাকা: সত্যের জন্য
আমাদের কাছে বিবৃতি পাওয়ার মতো কোনো উপহার নেই।’)

(ঋণস্বীকার – জ্যোৎস্না নাথ মল্লিক)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!