ধর্মের নামে যারা ঘর পোড়ায়, তারা কি সত্যিই ধার্মিক?
ধর্ম, ইতিহাসের শুরু থেকেই মানবজীবনের গৌরবময় ও গভীর অনুভবের সাথে মিশে আছে। ধর্ম যেমন মানুষকে নৈতিকতা, ভালোবাসা ও সহানুভূতি, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির পথ দেখিয়েছে। তেমনি কালে কালে মানুষ ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী মানুষকে দমন, শোষণ এবং ব্যক্তি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধর্মক অস্ত্র বানিয়ে বারবার ব্যবহার করেছে। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশও এই সত্যের ব্যতিক্রম নয়। বরং এখানে ধর্ম আজ ক্ষমতার হাতিয়ার, বিভাজনের কৌশল, এবং ভয়ের এক নতুন ভাষা।
ইতিহাসে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ধর্মের নামে সংঘটিত সহিংসতা ও অত্যাচারের উদাহরণ প্রচুর। ইউরোপীয় ক্রুসেড যুদ্ধের ঘটনা (১১শ-১৩শ শতাব্দী), ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, কিংবা সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে তালেবান ও আইএসের উত্থান- এসবই ধর্মের অপব্যবহারের এক বেদনাদায়ক ইতিহাস।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পেছনে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নামে দেশের অভ্যন্তরে গণহত্যা ও বিরোধিতা- এ সবই ধর্মের অপপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত। এমনকি স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও বিভিন্ন সরকার বা দল কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে জনসমর্থন, নিয়ন্ত্রণ কিংবা বিরোধী কণ্ঠ দমন করতে।
আমরা দেখছি, বাংলাদেশে ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, স্কুলের পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হচ্ছে, নারী ও শিশুদের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধর্ম নয়, বরং ধর্মের ছদ্মবেশ।
বাংলাদেশে ধর্মের নামে সহিংসতার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হতে পারে রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী ইউনিয়নের ঘটনা। সেখানে মাইকে ঘোষণা দিয়ে এক কিশোরের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগ তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ২০টি হিন্দু পরিবারের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়- ডেইলি স্টার।
এছাড়া, Human Rights Watch‑এর Attacks on Ethnic and Religious Minorities শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগস্ট থেকে অক্টোবর ২০২৪‑এ শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, দাঙ্গাকারীরা হিন্দু, আহমদী মুসলিম এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সহ তার সমর্থকদের উপর আক্রমণ করে, যার ফলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
Bangladesh Hindu Buddhist Christian Unity Council (BHBCUC)‑এর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ৪ থেকে ২০ ২০২৪‑এর মধ্যে দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রায় ২০১০টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৫৬৫টি বাড়ি, মন্দির বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুনে রূপান্তরিত হয়েছে (hrcbm.org)। সামগ্রিকভাবে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫‑এর মধ্যে সংঘটিত সহিংসতার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩২টি, যা BHBCUC‑এর সদ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে সংবাদ মাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউন।
এই ঘটনার প্রতিচ্ছবি আমরা আগেও দেখেছি রামু, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিংবা শাল্লায়। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, আগুন লাগানো, দেশছাড়া করে তোলার এই প্রবণতা কেবল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নয়; বরং রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দেউলিয়াপনার নিদর্শন।
এমনকি এই ধর্মীয় উন্মাদনায় যে রাজনীতি লুকিয়ে আছে, তাও স্পষ্ট। সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করে, একধরনের ‘জাতীয়তাবাদী’ আবেগ তৈরি করা হয়, যেটা আদতে সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্ব কায়েমের কৌশল মাত্র। অথচ আমরা জানি, ইসলাম হোক, হিন্দুধর্ম হোক, বা যেকোনো ধর্ম হোক না কেন, কোথাও এমন ঘৃণা, উসকানি ও আগ্রাসনের স্থান নেই। ধর্ম সবসময় ক্ষমতাবান নির্যাতকদের দমন করবার, নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াবার আহ্বান জানায়। কিন্তু ধর্মের নামে যারা হত্যা করে, ঘর পুড়িয়ে দেয়, তারা ধর্ম নয়, নিজের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
এই সমাজে ‘ধর্মপ্রেমী ধার্মিকে’র সংজ্ঞা আজ ভয়াবহ রকম বিকৃত। যার যার কণ্ঠ বেশি উচ্চ, যে বেশি নিষেধ করে, বেশি রেগে যায়, বেশি হুমকি দেয়- সেই যেন ধর্মের তত বড় রক্ষাকর্তা। অথচ যিনি ন্যায় ও সহনশীলতার কথা বলেন, তিনি ‘ধর্মদ্রোহী’ হয়ে ওঠেন এবং আল কোরআনে বানী দেখিয়ে দেয়, “ধর্মে জোরজবরদস্তি নেই,” (সূরা বাকারা, ২:২৫৬), তাদেরকে বিদ্বেষের টার্গেটে পরিণত করা হয়।
এই চিত্র শুধু ধর্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই নয়, একটি জাতির বিবেকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ধর্মের নামে যদি কোনো কিশোরের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে তার পরিবার সহ অন্যান্য পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়, ধর্মের নামে যদি বাকস্বাধীনতা বন্ধ করা হয়, নারীর পোশাক নির্ধারণ করা হয়, শিক্ষাক্রম বদলে দেওয়া হয়, তবে সেই ধর্ম আর আধ্যাত্মিক নয়; বরং তা হয়ে ওঠে নিছক ক্ষমতার ধর্মতন্ত্র।
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ অবশ্যই আছে, কিন্তু তা সহজ নয়। দরকার, সমাজে একটি ‘নৈতিক নীরব বিপ্লব’। দরকার শিক্ষিত মানুষের কণ্ঠে স্পষ্ট প্রতিবাদ, দরকার মুক্তমনের ধারাবাহিক উচ্চারণ। সবচেয়ে বেশি দরকার, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিতরে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার দায়বোধ। রাষ্ট্রকে সাহস দেখাতে হবে। দল মত নির্বিশেষে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে যারা মানুষের ঘরে আগুন দেয়, যারা মানুষ পিটিয়ে মারে, যারা গুজব ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।যখন ধর্ম রাষ্ট্রের কাঁধে চড়ে বসে, তখন দুইয়েরই অপমান হয়।
সবশেষে বলতেই হয়, ধর্মের মূল কথাগুলো হলো সততা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, আত্মশুদ্ধি। এসবের কোনোটাই হুমকি-ধমকিতে আসে না। এসব আসে নীরবে, আলোচনায়, যুক্তিতে, ভালোবাসায়। তাই ধর্ম নিয়ে যদি কাউকে মুখ বন্ধ রাখতে হয়, কারও ঘর জ্বালিয়ে দিতে হয়, কারও বই নিষিদ্ধ করতে হয়, তবে তা ধর্ম নয়, বরং ধর্মের ছদ্মবেশে ক্ষমতার রাজনীতি। ধর্মকে ভালোবাসার নামে যারা এই সহিংসতা করে, তারা আসলে ধর্ম নয়, তাদের নিজেদের ঘৃণার রাজনীতি রক্ষা করে এবং সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো- এই অন্যায় যারা করে, তারা বারবার রক্ষা পায়। ফলে দেশে এক ধরনের ‘ধর্মীয় ভীতির সমাজ’ তৈরি হয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা শুধু তাদের বিশ্বাস নয়, হারায় শেকড়, অধিকার, এমনকি নাগরিক মর্যাদা। তাই আজ সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে ধর্ম নয়, ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এ লড়াই শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নয়, এ লড়াই প্রতিটি বিবেকবান মানুষের।
ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে নীরব থাকা মানেই অন্যায়ের পক্ষে থাকা। আজ সময় এসেছে মুখ খুলবার, যুক্তির পাশে দাঁড়াবার।#