ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৩)

সন্ধের কিছু পরেই আকাশ সেদিন প্রথম বাড়িতে ফিরল। থানার বড়বাবু বলে কথা। এ নিয়ে একটা গালভরা ইংরেজি শব্দদল রয়েছে— অফিসার-ইন-চার্জ। আকাশ টানা কয়েক বছর সেই দায়িত্ব পালন করে আসছে। অনেকগুলো গ্রামপঞ্চায়েত থাকে প্রতিটা থানার অধীনে। সর্বত্র শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে তাকে অধস্তনদের উপর নানা গুরুভার চাপিয়ে দিতে হয়। নিজেই পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধানে থাকে। ক্রিকেট দলে ক্যাপটেন যেমন, থানার পুলিশ দলে ওসির ভূমিকা তেমনি। তার নির্দেশই শেষ কথা। হুকুম পেলে কনস্টেবল নিজের মতো করে নির্দেশিত কাজটা সম্পন্ন করে ফেলে কিন্তু ওসিকে উপরওয়ালার কাছে সেই কাজের জবাবদিহি করতে হয়। কাজটা প্রশাসনের পক্ষে কতটা ভালো হল, তা নিয়ে গুছিয়ে রিপোর্ট লিখতে হয়। এজন্যে ওসির মাথায় বিশেষ ভাবনা রাত দিন খেলা করে। ঘুমানোর আগে পর্যন্ত সেই খেলা সমানতালে চলতে থাকে। হেড বলে কথা, তাকেই উদ্যোগ নিয়ে থানার মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

হেনা আকাশকে সন্ধের শুরুতে বাড়িতে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হল কিন্তু তা প্রকাশ করল না। বিয়ের পরে তার একটাই তিক্ত অভিজ্ঞতা, লোকটা একেবারে অন্য ধরনের, অপছন্দের কথা শুনলে অকারণে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে পারে। হেনার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা, আকাশের সেই বদভ্যাস অনেকখানি বেড়ে গেছে। একজন সুগৃহিনীর পক্ষে তা মেনে নেওয়া কত কঠিন, হেনার চেয়ে সেই তিক্ত বোধ কেউ বেশি বোঝে বলে মনে হয় না। পাহাড় কঠিন কিন্তু বিপরীত অভিজ্ঞতা মানুষের মননকে সময়ে সময়ে কঠিনতর করে তোলে। হেনার ভিতরের অবস্থা তেমনি। তা শুধু কঠিন নয়, পাহাড়ের মতো উঁচুও বটে।

আকাশ পদস্থ পুলিশ অফিসার, নিজের বাড়িতেও ওসিসুলভ মনোভাব ধরে রাখতে চেষ্টা করে। দৈনিক অফিস-অনুশীলনের এ যে কত বড়ো মারাত্মক কুফল, তা একবারও ভেবে দেখার অবকাশ পায় নি। বাড়িতে ফিরে বারান্দার চেয়ারে গুম মুখে বসে থাকল, হেনা তখনও হেঁসেলের কাজে ব্যস্ত। তার মধ্যে চা করে দেওয়ার তাৎক্ষণিক তাগিদ বড়ো হয়ে উঠছে। আকাশকে দেখে থানার অন্য সকলে টরটরে হয়ে থাকে। সেই পরিবেশ বাড়িতে ধরে রাখতে পারলে তার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও রয়েছে। হেনা কোনো অতিরিক্ত প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে না, ডুরানিও সিঁটিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন।

প্লেটে চা-বিস্কুট সাজিয়ে আকাশের সামনে এসে দাঁড়ালো হেনা। তখনও আকাশ অফিসের গম্ভীরতা থেকে এতটুকু নীচে নামতে পারে নি। পাশে রাখা ব্যাগটা হেনার হাতে দিয়ে বলল, এটা ঘরের আলমারিতে রেখে দাও, লক করে দিতে ভুলে যেও না যেন।

হেনার মধ্যে একটা নতুন প্রশ্নের বোঝা ভারী হয়ে উঠছে আকাশের অসংগতিসূচক মন্তব্যে। অন্য কোনো দিন তো এভাবে লক করে দেওয়ার কথা বলে নি? আজ নতুন করে এ প্রয়োজন দেখা দিল কেন? একটা গভীর সন্দেহ মন্দগতির বলের মতো মনের ইজেলে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। হেনার পক্ষে কৌতূহল চেপে রাখা আর সম্ভব হল না। ব্যাগের চেন খুলে ভিতরে উঁকি মেরে দেখে ভীষণ অবাক হল কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ না করে মনের খুশি জানিয়ে বলল, একটা দারুণ ভালো দিন বাড়িতে বয়ে আনতে পারলে। তুমি আমার স্বামী, বেশ গর্ব অনুভব করতে পারছি।

আর বলো না হেনা, রোজ ভাবি, এমন ভালো দিন মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে আসুক কিন্তু সেই সুযোগ সহজে আসে না। তাছাড়া থানার মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটছে যা সামাল দিতে হিমসিম খেয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে ভালো দিনের জন্যে খুব বেশি ভাবার অবকাশ পাই না। এক শুয়োরের বাচ্চাকে ধরে এনে তার পেট থেকে আসাল তথ্যটুকু বের করতে আজ মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ হয়ে গেছে। শেষে পেরেছি বটে, তাই ভাবলুম, একটু আগে বাড়িতে ফিরে যাই। অফিসে থাকতে আর মন টিকছিল না।

এভাবে বাড়িতে বসে মুখ খিস্তি করে কী কিছু বলা যায়? পাশের ঘরে শ্বশুর রয়েছেন, শুনলে তোমাকে নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারবেন তো? থানার পরিবেশ খারাপ বলেই যে এভাবে বলা সম্ভব হয়েছে, সেই ভাবনা মাথায় আসছে না বুঝি? পাপান তোমার ছেলে, এসব শুনে তার মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে ভাববে না? ভুলে যেও না, শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি খারাপ জিনিস শিখে ফেলতে পারে। আরেকটা প্রসঙ্গ তোমার কাছে জানতে পারি কী? এখন তো মাসের মাঝামাঝি সময়, এত টাকা পেলে কোত্থেকে? বেশ উঁচু উঁচু বান্ডিল দেখলুম।

আকাশের মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা, এ জবাব সে হেনাকে দিতে চায় না। একজন ওসি কীভাবে টাকা রোজগার করবে, তা নিজের স্ত্রীকে জানাতে হবে কেন? আকাশ মনে মনে সত্যি বেপরোয়া। থেমে থেমে বলল, কোথা থেকে এত টাকা পেলাম, তার জবাবদিহি কী তোমাকে করতে হবে? ভুলে যেও না, থানার গুরুত্বপূর্ণ অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে যে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রোজ সম্পন্ন করতে হয়, ঘরে বসে একজন সাধারণ মহিলার পক্ষে তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। কোনো দরকার থাকলে তা আমাকে অবশ্যই বলতে পারো কিন্তু অন্য কোনো বিষয়ে বাড়তি কৌতূহল ভালো নয়। সাবধান করে দিয়ে বলছি, কোনোদিন এভাবে আমাকে প্রশ্ন করবে না।

তাহলে স্ত্রী হিসেবে এটুকু জানার অধিকার আমার নেই? নামেই শুধু অর্ধাঙ্গিনী, কর্মক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন থাকবে না? যে বাড়িতে আমি থাকি, সেই বাড়িতে বাড়তি টাকা এলে তা কিন্তু আমাকে জানতেই হবে।

ভুলে যেও না, থানার কোনো ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার তোমার নেই।

এটা শুধু থানার ব্যাপার নয়। বরং বলব, থানার গন্ডি টপকে আসা একটা কঠিন সাংসারিক সমস্যার প্রসঙ্গ। সেই সংসার আমাকে চালাতে হয়। কেন অতিরিক্ত টাকা অসময়ে ঢুকবে, এটা কী পারিবারিক প্রশ্ন হতে পারে না? আজ একটা কথা তোমাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিই, সংসারে থেকে যে টাকা আমি বা আমার ছেলে ভোগ করব, তা পাপের, না পুণ্যের তা জানার অধিকার আমার আছে।

আকাশের মুখে বাঁকা গম্ভীর হাসি। চাকরি করব আমি, আর হিসেব নেবে তুমি? এক অদ্ভুত প্রসঙ্গ শোনাতে পারলে হেনা। ভালো করেই জেনে রাখো, টাকার গায়ে পাপ-পুণ্য বলে কিছু লেখা থাকে না। টাকা হাতে আসে মানুষের প্রয়োজনে, তা খরচও হয়ে যায়। এমনি আসা যাওয়ার মধ্যে ধম্মবাজির পাপ-পুণ্য টেনে আনছ কেন?

ধমকানিতেও হেনার কণ্ঠস্বর থামল না। বরং গলার স্বর আরেকটু চরমে তুলে বলল, তাহলে এ টাকা কী বাবু বোসের কাছ থেকে পেয়েছ?

মৌচাকে ঢিল পড়লে সাধারণ মৌমাছিদের মধ্যে হঠাৎ করে যে ছত্রভঙ্গ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, আকাশের ভিতরের অবস্থা তেমনি হয়ে উঠল। গলার স্বর নেমে এল তলানিতে। চাপা স্বরে ছোট্ট প্রশ্ন, এসব জানলে কী করে? যদি জেনেই থাকো, স্ত্রী হিসেবে তোমার কী কর্তব্য হওয়া উচিত, তা নিয়ে ভাবতে পারলে না কেন? প্রশ্ন তুলে স্বামীকে ছোটো করে দেওয়ার অধিকার তোমার আছে কী? মনে হচ্ছে, বাইরের কেউ এসে প্রশ্ন করছে আমাকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করার জন্যে।

রোজগারের তাৎপর্য নিয়ে সংসারের ভিতর থেকে যে এভাবে প্রশ্ন উঠে আসতে পারে, তা আকাশের মাথায় ছিল না। চীৎকার করে গলা ফাটিয়ে বলল, এসব কথা কার কাছ থেকে শুনেছ, আগে তার জবাব দাও।

হেনা দাঁতের উপর দাঁত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তাহলে আমি যা বলেছি, তার সবটাই সত্যি? জবাব দেওয়ার থাকলে তা তোমাকেই দিতে হবে, নাকি শুধু শুধু চীৎকার করছ আমার মুখ বন্ধ করতে? নিজের অপকর্ম ঢেকে রাখার জন্যে এ তো লজ্জা আর গ্লানির ফাঁকা আস্ফালন। শরম থাকলে এভাবে গলা ফাটাতে পারতে না। বাবু বোসের টাকা খেয়ে একজন গরিব লোককে এভাবে….।

আকাশ রাগে কাঁপছে। ডান হাত সামনে বাড়িয়ে রাসভ স্বরে বলল, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি হেনা। কখনো সীমা ছাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করবে না। তুমি কে শুনি? সংসারে আছ, আমার খাচ্ছ, আমার টাকায় তোমার দিন চলছে, তারপর এত বড়ো বড়ো কথা বলতে পারছ কোন্ মুখে? সংসারের ভিতরে সুখভোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলার অধিকার তোমার আছে কী? ভালো করে জেনে রাখো, সংসারের বাইরে গিয়ে কথা বলতে চাইলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

পাপান দাদুর ঘরে বসে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকায় ব্যস্ত। চীৎকার শুনে চমকে উঠল। আগে কখনো নিজের বাপিকে এভাবে উদ্যত হয়ে চেঁচামেচি করতে দেখে নি। বুকের ভিতরে অচেনা খেলা লুটোপুটি করছে। তাতেই দুলছে পাপান। দরজার সামনে এসে ভিতরে মুখ বাড়িয়ে কী যেন ভেবে নিল। ভিতরে ঢুকে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

ছেলের উপস্থিতিতে বাবু বোসের কথা শোনার পরে হেনার মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা প্রশমিত হতে থাকল। পাছে আকাশের কথা শুনে পাপান বিপরীত কিছু ভেবে ফেলে, সেই ভয়ে হেনা হঠাৎ সিঁটিয়ে গেল। আকাশও। দুজনে পাপানের কারণে কম্পিত হতে থাকল। হেনা ধমক দিয়ে বলল, এভাবে চলে এলি কেন? এতে ছবি আঁকার মনোযোগে কতটা ব্যাঘাত হয় জানিস? দাদু এ নিয়ে তোকে  কতবার সাবধান করে দিয়েছে। আমি তোর বাপির সঙ্গে অন্য একটা প্রসঙ্গ নিয়ে একটু কথা বলছিলুম রে।

পাপান পায়ে পায়ে আবার দাদুর ঘরে ফিরে গেল। চাপা গম্ভীর স্বরে হেনা বলল, চীৎকার করে কঠোর বাস্তবকে চেপে রাখার চেষ্টা করো না আকাশ। সব জেনে শুনে বাবু বোস নিজের স্বার্থে স্রেফ টাকার লোভ দেখিয়ে একজন অসহায় শ্রমিককে….

আকাশ থানার ওসি। ধমকে অন্য সকলের মুখ বন্ধ করার কাজে শক্তপোক্ত। তার মনের সেই রাজত্বে হেনা যেন প্রতিবাদের নতুন প্রতিমূর্তি। আকাশ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সপাটে চড় বসিয়ে দিল হেনার গালে। আঘাতের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে হেনা মেঝেতে ছিটকে পড়ল। দাদুর ঘরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য পাপানের চোখ এড়িয়ে গেল না। পায়ে পায়ে ফিরে এসে মাকে ধরে দাঁড় করালো। কাঁদু কাঁদু হয়ে বলল, খুব লেগেছে মা? এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে চলো। তারপর আগুনে দুচোখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেই চোখের ভাষায় যে প্রতিবাদের ফুলকি রয়েছে তা বুঝতে আকাশের কোনো অসুবিধা হল না। মুখ ঘুরিয়ে মাথা নীচু করে চেয়ারে বসে থাকল। যেন ছেলের দিকে মুখ তুলে তাকানোর অধিকার হারিয়ে ফেলেছে সে। চকিতে শুধু একবার ভাবল, টাকার প্রসঙ্গ পাপান জেনে ফেলে নি তো? পারলে ছেলের মনের পৃথিবী যে সম্পূর্ণ তার বিরুদ্ধে চলে যাবে, তা নিয়েও একবার ভাবল, খুব লেগেছে মা— পাপানের এ প্রশ্ন কত বেশি স্পর্শকাতর তা আকাশকে বার বার ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হেনাকে নিয়েও আকাশের ভাবনা ক্রমে উর্দ্ধমুখি হয়ে উঠছে। যে মেয়েটি তার মনের বাসর ঘরের একান্ত সঙ্গী হিসেবে এত দিন কাছে ছিল, পরবর্তী সময়ে তা সম্পূর্ণ বদলে যাবে না তো? কিন্তু আকাশ যে থানার দাম্ভিক ওসি, চাবুক ঘুরিয়ে সকলকে ঠাণ্ডা করে রাখাই তার মূল কাজ। হেনা-প্রসঙ্গে খুব বেশি সময় আটকে থাকতে পারল না। হেনা যা ভাবে ভাবুক, তাকে ভাবতে হবে বাবু বোসকে নিয়ে। মনের পটে ভাসছে শ্রমিকটাকে ধরে এনে লক-আপের মধ্যে বেধড়ক পেটানোর দৃশ্য।

চলবে…

ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ২)

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!