প্রকৃতির রাজ্যে যেমন ঝড় ঝঞ্ঝা ঘটে থাকে, মানুষের জীবনেও তার সার্থক প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। রোজকার জীবন যেন প্রকৃতির আদলে এগিয়ে চলে। গ্রন্থিবন্ধনে প্রকৃতি আর মানুষ যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। রাতের শেষে সকাল আসে। পূবের আকাশ লাল হয়। সূর্যের উঁকি দেখতে পাওয়া যায়। দুপুরে বিস্তার ঘটে পৃথিবীর প্রাচীনতম বন্ধুর গনগনে আলো। বিকেল হলে হেলে পড়া সূর্য জানিয়ে দেয়, একটু পরে তাকেই অস্তগামী হতে হবে। আরও কিছু পরে সন্ধে আসে চুপিসারে। রাত বাড়তে থাকে। গভীর হয়। মাঝরাতের নির্জনতায় লুকিয়ে থাকে শব্দহীনতার হাতছানি। হাজার গন্ডা রহস্য তার ভিতরে। সেই রাতও শেষ হয়, আবার নতুন সকাল আসে। মানুষের জীবনে নতুন করে রোজকার বিধিবদ্ধতা শুরু হয়ে যায়। দাঁত মাজা, মুখ হাত ধোওয়া, খবরের কাগজ পড়া কিংবা বাজারে যাওয়া। বেলা বাড়লে কর্মস্থলে গিয়ে নির্দিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেই হয়। শুভ সকালে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে পাঠ গ্রহণ শুরু হয়। তারপর স্কুলে যাওয়া। শিক্ষার্থীদের সেখানে যাওয়া একেবারে বাধ্যতামূলক। অভ্যেসের বশে আপন নিয়মে মানুষ এসব করে থাকে। আবার এসবের উল্টো চিত্রও রয়েছে। সেসব যেন প্রকৃতির বুকে হঠাৎ ঘনিয়ে আসা কালবৈশাখী তান্ডবের মতো। তার অকস্মাৎ আগমন সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায়। যত সব অনিয়মের খেলা লুকিয়ে রয়েছে সেসবের মধ্যে। সব কিছুর মধ্যে ভেঙে ফেলার দুর্বার গতি পরিলক্ষিত হয়। মানুষের জীবনেও দুর্ঘটনা আসে নানা নেতিরূপ নিয়ে। সেসবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে যত সব অনিয়মের তামাশা।
জিততে জিততে ভারতের হঠাৎ হেরে যাওয়াটা নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি মতি কাছে একটা অঘটন ছাড়া কিছুই নয়। তবুও পরাজয়ের যন্ত্রণা কিছুতেই থামছে না। মনের তলানিতে সেই আক্ষেপ মন্দগতির বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। কেবলমাত্র সেই কারণে মতি স্থির থাকতে পারছে না। সারা দিন ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকতে হয় তাকে, আম-মানুষের সুবিধে-অসুবিধে দেখাই তার মূল কাজ। আপ্রাণ চেষ্টা করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে নিজের অভ্যেসে পরিণত করতে পেরেছে। তবে তার এ চেষ্টার মধ্যে একটা বড়ো গ্যাপ রয়ে গেছে। ভারতের ক্রিকেট খেলা থাকলে সেদিন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। দেশের প্রতি মনের টান এত গভীরতর হয়ে ওঠে যে সারা দিন টিভির সামনে বসে থাকতে বাধ্য হয়। ভারতের পক্ষে কে ব্যাট করল, কেমন ব্যাট করল, কার উচিত ছিল কতটা রান করার, তার পর্যালোচনা চলে মনে মনে। কোন্ বোলার কীভাবে সফল হল, কিংবা কেন অসফল হল, সেই ভাবনা, সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ মতির মাথায় ঘোরে লাট্টুর মতো। সেদিন ভারত যে এভাবে ওয়েষ্ট ইণ্ডিজের কাছে হেরে যাবে, তা খেলার শুরুতে ভাবতে পারে নি মতি। ভারতীয় বোলারদের উপর খুব রাগ হচ্ছিল তার। জাহির ছাড়া কেউ লাইন লেন্থ ঠিক রেখে বল করতে পারল না। একা জাহিরের পক্ষে আর কতটা টানা সম্ভব? শ্রীনাথ সারাদিন এলোপাতাড়ি বল করে গেল। তার সঙ্গে অনেকগুলো ওয়াইড নো দিল। এভাবে কী ম্যাচ জেতা যায়? মতির বিশ্লেষণ সূক্ষ্ম পথে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে। আনন্দকে সামনে পেয়ে বলল, আজ খেলা দেখেছিস?
হারের ভয়ে মাঝপথে টিভি বন্ধ করে দিয়েছি।
ঠিক করেছিস। আমি পারি নি বলেই চোখের সামনে এত বড়ো পরাজয়ের দৃশ্য দেখতে হল। একটা বিশ্রি অস্থিরতা মনের মধ্যে পাহাড় তৈরি করে দিয়েছে। জেতার অবস্থায় চলে এসে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ হেরে গেলে বোধ হয় মনের অবস্থা এমনিই হয়। চল্, বাজারের দিকে যাই, গল্পে মজে থেকে আর চা খেয়ে মনটাকে হাল্কা করি। মাথা পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে রে। একশ’ কোটির দেশ হেরে গেলে কী মনের উপর এমনি করে চাপ তৈরি হয়?
আনন্দের মূল্যায়ন আলাদা পথে ছুটছে। দুজনে হাঁটছে বাজারের দিকে। ভাবনার গতিপথে রুদ্ধ হয়ে আনন্দ বলল, শুধু শুধু বোলারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই মতিদা। গতরাতে বৃষ্টির কারণে পিচের চরিত্র যে এতটা পাল্টে যেতে পারে, তা ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক ঠিকমতো বুঝতে পারে নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। তাছাড়া মিডিয়াম ফাস্ট বোলার দিয়ে সব ম্যাচে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। ওয়েষ্ট ইণ্ডিজের বোলারদের সঙ্গে ভারতীয় বোলারদের গুণগত পার্থক্য এ ম্যাচের ফলাফল ঠিক করে দিয়েছে। একেই বলে ক্রিকেট খেলা। শেষ বলেও হারজিতের অঙ্ক লুকিয়ে থাকে। এত মিরাক্যাল আছে বলেই ক্রিকেট আম-মানুষের কাছে এভাবেই আকর্ষণীয় হয়ে বেঁচে আছে। এও বলছি, ক্যাপটেন হিসেবে সৌরভকে খুব বেশি দোষ দিতে পারব না। আসলে ক্রিকেট এগারোজনের খেলা। ক্যাপটেনের স্পেশাল পরিকল্পনা থাকলেও রূপায়ণের দায়িত্ব সবার উপর থেকে যায়। পারলে ক্যাপটেনের নাম সবার আগে চলে আসে। না পারলে আমরা কখনো বোলারদের দোষারোপ করি কিংবা প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার জন্যে বিশেষ কোনো ব্যাটসম্যানকে দায়ী করে থাকি। বাস্তব অর্থে পরিকল্পনা রূপায়িত না হলে বার বার এমনি নেতি ফলাফল সামনে আসবে। ভারতীয় মানুষ হিসেবে দুঃখের পাহাড় জমবে আমাদের মধ্যে।
ঠিক বলেছিস তুই। তবে খেলোয়াড়দের মাথায় রাখতে হবে, তারা একশ’ কোটি মানুষের দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই যে এখন দেশের হারের জন্যে এত মাথা ধরেছে, কপাল টনটন করছে, সে তো ভারতের হারের কারণে।
এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না।
চা দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে মতি বলল, চা বল্ রে আনন্দ। ক্রিম ক্রেকার বিস্কুট নে, খেতে খেতে দুজনে গল্প করি। মাথাটা ভারী পাথর হয়ে উঠেছে। এত ছোটো মাথার উপর এত বড়ো ভারত ভর করলে যা হয় আর কী।
মাত্র মিনিট পাঁচেক গেল। দোকানদার চা বিস্কুট দিল আনন্দকে, মতিকে। মতিবুর নামটা প্রিয় হতে হতে সবার কাছে শুধু মতি হয়ে উঠেছে মহামূল্যবান অর্থে।
তারিয়ে তারিয়ে গরম চা খাওয়া চলছে। একটা নতুন প্রসঙ্গ মনে পড়ল মতির। আনন্দের গায়ে ঠ্যালা দিয়ে বলল, হ্যাঁরে, নয়নের ব্যাপারটা নিয়ে এখনও তো কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। তোর সামনেই কথা দিয়েছি, একটা কিছু করতেই হবে। নাহলে বেচারা আমাদের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। আজ তো সোমবার, আমরা কী ব্যবস্থা নিয়েছি তা জানতে আসবে নয়ন। বলবি কী ওকে?
আনন্দ চায়ের কাপে আবার চুমুক দিয়ে বলল, ওই তো, তোমার সেই আসামি এদিকে আসছে।
মতি সামনে চেয়ে দেখল, নয়ন হন্হন্ পায়ে এগিয়ে আসছে।
আনন্দের প্রশ্ন, নয়ন তো?
ঠিক ধরেছিস। মতি বেশ ভাবিত হল। ভারতের হারের জন্যে এতক্ষণ যে বিমর্ষভাব ছিল, তার ভিতরে নতুন আরেকটা ভাবনা তরতর করে ঢুকছে। নয়ন এসে দাঁড়ালো মতির সামনে, তার বিনীত প্রশ্ন, আমার কথা একটু ভাবতে পেরেছ কী মতিদা?
তোমার বউমার সেলাই মেসিন তো? মনে আছে আমার। যেখানে যা লিখে পাঠানো দরকার, সব করে দিয়েছি। এলেই খবর পাঠিয়ে দেব। শুধু এটুকু জানতে এসেছিলে, নাকি বাজারে অন্য দরকার ছিল?
বেগুন বিক্রি করতে এসে মনে হল, একবার দেখা করে যাই। ভালো করে চেষ্টা নিও মতিদা। পুঁটিরামের মতো লোকের পাল্লায় পড়ে আছি। সময়মতো শোধ দিতে না পারলে বন্ধক রাখা জমিটা বিকিয়ে যাবে। ভাবছি, সেলাই মেসিন থেকে কিছু আয় হলে, বেগুন বিক্রি করে কিছু বাঁচলে সবার আগে পুঁটিরামের দেনাটা শোধ করে দেব। ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে লোকটার মিষ্টি হাসি ভারি মারাত্মক, শোষণ করার ধারালো অস্ত্র।
মতির মধ্যে সেই প্রতিক্রিয়া তীব্র ধাক্কা সৃষ্টি করল, বলল, তাহলে তো আরও আন্তরিক চেষ্টা নিতে হয়। কাল পরশু অফিসে গিয়ে জেনে আসব, যাতে করে তোমার বৌমা তাড়াতাড়ি সেলাই মেসিন হাতে পেতে পারে।
সন্ধের দিকে এসে একবার খোঁজ নিয়ে যেতে পারো। ক্লাবেই থাকব। আশা করছি, ঠিক কবে পাবে, বলে দিতে পারব।
তাহলে আসছি মতিদা।
যাও, বাড়িতে গিয়ে আমার চেষ্টার কথা বৌমাকে বুঝিয়ে বলো। বাউরি পাড়ায় সর্বশিক্ষার স্কুল খুলব বলে ভাবছি, তাহলে তোমার বৌমার একটা কর্মসংস্থান হয়ে যেতে পারে। মাধ্যমিক পাশ তো?
নয়ন সদর্থক মাথা নেড়ে সামনে হেঁটে বলল।
মতি ভাবতে শুরু করল পুঁটিরামকে নিয়ে। এলাকার একমাত্র কুচক্রী মহাজন। সামনের ব্যবহার দেখে কেউ বুঝতে পারবে না লোকটা মানুষকে এত ক্ষতি করতে পারে। সকলে বোঝে, এত মারাত্মক সর্বনেশে লোক এলাকাতে একটাও নেই কিন্তু সামনাসামনি প্রতিবাদ করার মতো যে সাহস দরকার, আর্থিক দায়ে পড়ে থাকা মানুষরা তা দেখাতে পারে না। নয়নের মতো গরিবরা বাধ্য হয়ে পুঁটিরামের কাছে যেতে বাধ্য হয়। পুঁটিরামও সুযোগ বুঝে উথলে ওঠা দরদ দেখাতে এতটুকু ভুল করে না। অর্থ সাহায্যের প্রশ্নে পুঁটি তখন যেন দ্বিতীয় ঈশ্বর কিন্তু ভিতরের কৌশল সম্পূর্ণ আলাদা। ঋণজালে এমনভাবে জড়িয়ে নেয় যাতে লোকটা তার ফাঁদ থেকে আর বের হতে না পারে। মৌখিক হিতাকাঙ্খী সাজার ক্ষেত্রে পুঁটি একেবারে বোয়াল মাছ কিন্তু পিছনের ভাবনায় হারামির ছুরি ছাড়া কিছুই নয়। ঋণজালে জড়িয়ে পড়া লোকগুলোর প্রতি পুঁটির আন্তরিক সান্ত্বনা, কী আর করবি বল্, চেষ্টা তো কম করিস নে। সব সময় সফল হওয়া যায় না রে। আমার কথাও তো ভেবে দেখতে হবে। কতদিন ফেলে রেখেছি। আর পারছি নে ভাই। একটা কিছু করতে হবে তোমাকে।
সেই ভাবেই পথ তৈরি হয়ে যায়। খুলে বলতে হয় না কিন্তু পুঁটি অচিরে দিব্যি কাজের কাজ সেরে ফেলতে পারে। যথাসম্ভব কম দামে কত গরিবের জমি কিনে নিতে পেরেছে। পুঁটির সেই রেকর্ড বেড়ে বেড়ে আকাশ-সমান হয়ে উঠেছে। আর্থিক বেড়াজাল এমনিই যে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমবেত সমর্থন লাভ করা সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার।
ভাবতে ভাবতে মতি একরকম হাঁপিয়ে উঠল। আনন্দকে বলল, ফক্কড়বাজি করে জমি জায়গা কেনার লোভ পুঁটির জীবনে কবে শেষ হবে রে? ইতিমধ্যে এলাকার অর্ধেক জমি কিনে নিয়েছে, তবুও তো দেখছি মন ভরছে না, খিদে পূরণ হচ্ছে না। আজও পুরনো ব্যবসায় সমানভাবে লেগে রয়েছে। এত সম্পত্তি নিয়ে করবে কী লোকটা?
উত্তর শোনার আগেই মতি শুনতে পেল, হাটের দক্ষিণ দিকে চোর চোর শব্দ করে খুব সম্ভব কাউকে পেটানো হচ্ছে। মনে মনে ত্রস্ত হতে বাধ্য হল, আনন্দকে বলল, পায়ে পায়ে এগিয়ে যা, আর মারতে দিস নে। লোকটাকে ধরে নিয়ে আমার কাছে আয়। মনে রাখিস, সাধারণ মানুষ একবার হুজুগে মেতে উঠলে সাতে সত্তর করে দিতে পারে।
আনন্দ গিয়ে যা দেখল, তাতেই হতবাক। কিছু মত্ত যুবক ষাট উর্দ্ধ একজন মানুষকে চুরির দায়ে মারধর করতে শুরু করেছে। কিছুতেই থামানো সম্ভব হচ্ছে না। থামানোর চেষ্টার শুরুতে তাদের আক্রোশ আরও বেড়ে চলেছে। লোকটার মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, তবুও শান্ত হচ্ছে না ছেলেগুলো। শেষ ব্যবস্থা হিসেবে আনন্দ গলার স্বর উঁচু করে বলল, মতিদা দোকানে বসে আছে, মারধর না করে লোকটাকে নিয়ে প্রয়োজন হলে থানা-ফাঁড়ি করে দেব বলছে।
মত্ততায় মেতে থাকা যুবকদের মধ্যে থমকে যাওয়ার অবস্থান শুরু হল। মতিবুর মানে নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি, খুব ন্যায়বাদি মানুষ। অন্যের উপকারে লেগে থাকার জন্য জীবনপণ করে চলেছে। সারা দিন ক্লাব নিয়ে পড়ে থাকে। তবে একটা দোষ থেকে মুক্ত হতে পারে নি। ভারতের খেলা হলে সব কাজ ফেলে রেখে টিভির সামনে বসে পড়া চাই। মতির আত্মিক চেতনা, ভারতের খেলা দেখলে যেভাবে দেশপ্রেম বেড়ে যায়, তা নিয়ে মানুষের সমস্যা দিব্যি অনুভব করা সম্ভব, তাদের জন্যে সারাদিন কাজে লেগে থাকলেও এতটুকু ক্লান্তি থাকে না শরীরে।
আনন্দের সঙ্গে লোকটা মতির সামনে এলেও এত ঠকঠক করে কাঁপছিলেন যে দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে কষ্ট বোধ করছিলেন। চিবুক বেয়ে তখনও রক্ত ঝরে পড়ছে। মতি উঠে গিয়ে লোকটাকে ধরে বেঞ্চের উপর বসিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, আপনাকে মারল কেন ওরা?
জানি না বাবা! যারা মেরেছে, তারাই বলতে পারবে। একটু আগে বৌমা বের হয়েছিল বাড়ি ভাড়ার খোঁজে, আমি ওখানে বসেছিলুম। ওরা এসে আমাকে চোর বলে মারতে শুরু করল।
আপনি কিছু বললেন না?
শুনলে তবে তো! বাজারের মধ্যে ততক্ষণে আরেকটা ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে পাশাপাশি। গুণধর এসেছে বাবা পুঁটিরামকে সঙ্গে নিয়ে। পুঁটি হন্যে হয়ে খুঁজছে ছেলের পছন্দের মেয়েটাকে। কোথাও দেখতে না পেয়ে তার বিরক্তি বাড়ছে তরতর করে। কথার ঝাঁকুনি দিয়ে ছেলেকে বলল, তুই যে বললি, বাজারের মধ্যে আছে, সব জায়গায় খুঁজে তো দেখলুম, গেল কোথায় মেয়েটা?
মাইরি বাবা, আমি নিজে দেখে গিয়ে তোমাকে খবর দিয়েছি। দেখতে কী সুন্দর, আমার সঙ্গে এট্টু কথাও বলেছে। দেখতে দেখতে আমারও এট্টু লোভ হচ্ছিল।
শুয়োরের বাচ্চা, এতে তোর লোভ হওয়ার কী আছে?
পুঁটিরামের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কেবল ভাবছিল, ছেলে নিজের চোখে দেখেছে যখন, নিশ্চয় কোথাও আছে, সুন্দরী নিশ্চয়। গুণধরের পছন্দ ঠিক তার মতো কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা? ভালো একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্যে মনে মনে ছটফট করতে থাকল পুঁটিরাম।
গুণধর বলল, আরেকটু খুঁজে দেখব বাবা? মেয়েটার নাকের গঠন ভারি সুন্দর। দুচোখে ভ্রমরের যাদু রয়েছে। ঠিক দিব্যাভারতী। দেখেই আমার নোলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
বাঁদরের মতো কথা বলিস নে তো। তোর নোলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে কেন?
আমাকে বাঁদরের বাচ্চা বললে বাবা?
প্রসঙ্গটা পুঁটির মাথায় ঢুকল না। ছেলের দেখা সুন্দরী মেয়েটাকে খুঁজে পাবার জন্যে ভিতরে ভিতরে অস্থির হতে থাকল। বেশ বুঝতে পারছিল, দিন শেষ হয়ে রাত বাড়লে তাকে শরীরের যন্ত্রণায় ভীষণ কষ্ট পেতে হবে। একটাই আক্ষেপ, এত বড়ো সুযোগ কাছে পেয়েও শেষ পর্যন্ত তাকে উপোষ থাকতে হবে। রাতে শরীরের ঝক্কি কত যে গভীর হয়ে ওঠে, পুঁটি ছাড়া তা আর কে বুঝবে?
গুণধরের কাতর মিনতি, এভাবে ভেঙে পড়ো না বাবা। আর এট্টু খুঁজে দেখি। তোমার ভয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে। দোকানের পিছনগুলো এট্টু ভালো করে দেখে নিই বাবা। তোমার জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আগে এমনি কত সুযোগ এনে দিয়েছি তোমাকে। তবুও তো তুমি আমাকে কিসের বাচ্চা বলে গাল দিলে?
পুঁটিরাম গুম মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। শরীরের ভিতরটা খিদেয় কেমন যেন উতলে উঠছে যা ছেলেকে কিছুতেই বলতে পারল না। হাঁটতে শুরু করল পুঁটিরাম, পিছনে গুণধর। দু’জনের ভাবনা একসঙ্গে ছুটছে কিন্তু এক পথে নয়। অকুস্থলে গিয়ে মার খাওয়া বুড়ো লোকটাকে দেখে গুণধর একেবারে অবাক, বলল, বাবা, এই লোকটা সেই মেয়েটার সঙ্গে ছিল।
মতি তখনও মার খাওয়া বুড়ো লোকটার সেবায় ব্যস্ত। পুঁটিরামকে শুনিয়ে গুণধর বলল, জানো বাবা, এই লোকটাই আমার গলা টিপে ধরেছিল, কিন্তু…. মেয়েটা গেল কোথায়?
পুঁটিরাম মনে মনে অর্ধেক খুশি। একটা সূত্র চোখের সামনে ভাসছে। লোকটাকে পাকড়াও করতে পারলে মেয়েটাকে খুঁজে বের করা সহজে হয়ে যেতে পারে। মতিকে চাপা গলায় বলল, আমার কথা শোনো মতি, তুমি এখনও জানতে পারো নি, এই বুড়োটা অকারণে আমার ছেলের গলা টিপে ধরেছিল। এত তেজ কী ভালো? তাই বলছি….।
মতির মধ্যে তখন বিশেষ সহানুভূতির ঝড় বয়ে চলেছে। এত বেশি বয়সে কাউকে এভাবে মার খেতে দেখে নি সে। তাই পুঁটিরামের কথা মন দিয়ে না শুনে মার খাওয়া লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এভাবে চুরি করতে গিয়েছিলেন কেন? মার খেয়ে কী অবস্থা হয়েছে আপনার!
লোকটার মুখে কোনো উত্তর নেই। চেয়ে থাকল মতির দিকে, কিছু বলতে চাইলেও মুখের ভাষায় কথা যোগান দিতে পারল না। পুলিশ ভ্যানের হর্ন কানে আসতেই সকলের চোখ সেদিকে নিবদ্ধ হল। জিপ থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছেন স্বরূপনগর থানার ওসি। মানুষের কৌতূহল বাড়ছে। আগত ওসির তৎপরতায় ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাবে না তো? সেই সন্দেহ সকলের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
পুঁটিরাম ওসির সামনে এসে হাত জোড় করে গদগদ হয়ে বলল, স্যার, আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন। এই বুড়ো লোকটা বাস্তবিক অর্থে দোষী। কী মাথারাগি একবার ভাবুন স্যার। একটু আগে বিনা কারণে আমার ছেলেকে চড় মেরেছে। এই বয়সে চুরির অভ্যেসও ছাড়তে পারে নি। বেচারা ধরা পড়ে বেধড়ক মার খেয়েছে। বূড়োভাম পালানোর চেষ্টাও করেছিল কিন্তু পারে নি। মারের চোটে মাটিতে পরে গিয়েছিল স্যার। মতি বাবাজি ক্লাব করে, লোকটার সহানুভূতি পেতে সেবা করতে শুরু করেছে। অপরাধীকে সেবা করা কী অন্যায় নয় স্যার?
ওসি বুঝলেন তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি থেকে বের হতে গেলে মার খাওয়া লোকটাকে এক্ষুণি থানায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সঙ্গে আসা এক কন্সটেবলকে হুকুম করলেন, আগে লোকটাকে আমাদের জিপে তোলো, পরে ওকে জিজ্ঞেস করে আরও অনেক কিছু জেনে নেওয়া সম্ভব হবে। আর কিছু করণীয় থাকলে তাও সম্ভব করে তুলতে পারব।
হেনা আশেপাশের পাড়া ঘুরে অকুস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে। ওসির কথা শুনে তার গলায় তীব্র হুঙ্কার, কাকে গাড়িতে তুলতে চাচ্ছেন? লোকটা আমার শ্বশুর, সত্যের পূজারী। অভিযোগ পেলেই বুঝি যাকে তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া যায়? এ অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? মিথ্যে অভিযোগ শুনে যাকে তুলে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন তার সঙ্গে ঘুষখোর খুনি পুলিশকে এক করে দেখছেন নাকি?
ওসি আকাশ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, হেনার অগ্নিমূর্তি দেখে ভীষণ হতবাক। কোন্ হেনাকে দেখছে সে? এতটাই পাল্টে গেছে? মনের অজান্তে অত্যন্ত বিনয়ী স্বরে ডাকল, হেনা, তুমি?
আগের হেনা কবে মরে গেছে তা বোধ হয় আকাশ বুঝতে পারে নি। ভিতরে কান্নার জোয়ার থাকলেও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে কণ্ঠস্বর কতটা কঠিন করে তোলা যেতে পারে, হেনা পথ চলতে চলতে তা শিখে ফেলেছিল। আবার হেনার রাসভ প্রতিবাদ, যারা মেরেছে আমার শ্বশুরকে; আগে তাদের খুঁজে বের করুন। তা না করে একজন নিরীহ মানুষকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন কেন? কাপুরুষের সাহস কী এমনিই হয়?
ঝড়ের বেগে স্তম্ভিত আকাশের বিস্ময় বাড়ছে। হেনার কথার প্রতিবাদ করতে আকাশ নিজের মধ্যে পুলিশি মনোভাব জাগিয়ে তুলতে পারল না বরং মিইয়ে যাওয়া মন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, লোকটা ঠিক কী করেছিল, বলতে পারবে?
চুরি করেছিল স্যার।
আকাশ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, সজোরে চড় বসিয়ে দিল মতির গালে। শুধু চড় মারল না, হুঙ্কার দিয়ে উঠল, কী মনে করেছ তুমি? ক্লাব করো বলেই একটা নিরীহ মানুষকে এভাবে চোর বানিয়ে দিতে পারো নাকি?
পাপান এতক্ষণ দাদুর ঘটনায় কেমন যেন সিঁটিয়ে ছিল। ওসিকে দেখে বলতে শুরু করল, দেখছ মা, সেই পুলিশটা আবার এখানে এসেছে।
আকাশের গলা আবেগের আর্দ্রতায় ভিজে গেছে। চাপা স্বরে ডাকল, পাপান।
পাপানের বিরক্তি, ওমা. দেখো, দেখো, পুলিশটা কেমন ভুল বকছে।
হেনার ভিতরে বিতৃষ্ণা দ্রুত বাড়ছে। উল্টোদিকে মুখ করে বলল, পাপান, পুলিশটাকে বল, এভাবে ভালো মানুষের গালে চড় না মেরে চোর গুন্ডাদের পেটাতে। তাহলে অন্তত কাজের কাজ কিছুটা হতে পারে। যা শুনেছে, তা প্রকাশ করতে দোষ কোথায়? এজন্যে তাকে চড় খেতে হবে কেন? পুলিশের বড়ো পদে থাকতে হলে এ নিয়েও ভাবতে হবে। পাপান, কথাটা ওই পুলিশকে বলে দে।
আকাশের কণ্ঠস্বর একেবারে তলানিতে নেমে গেল। চাপা স্বরে ডাকল, হেনা….।
হেনার গলায় তীব্র প্রতিবাদ। —কোন অধিকারে আমার নাম ধরে ডাকছেন? সত্যের দেবতা আমার শ্বশুরের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উঠেছে, পারলে আইন মেনে যা করণীয় তাই করুন।
আমার কথা আরেকবার ভেবে দেখতে পারো হেনা, বলছিলাম কী….।
আপনার কিছুই বলার নেই। আমরা সাধারণ মানুষ। সেভাবেই চলতে হবে আমাদেরকে। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমাদের লাভ কী?
ডুরানির শরীর রাগে কাঁপছিল, হেনাকে বললেন, ওই পুলিশটার সঙ্গে একটাও কথা বলবে না মা। পকেটমার পুলিশের জীবনে মনুষত্ব বলে কিছু নেই। মনুষত্ব চুরি করাই ওদের একমাত্র কাজ।
হেনাকে উদ্দেশ্য করে আবার আকাশ বলল, আর যন্ত্রণা দিও না হেনা। শূন্যতায় ভুগতে ভুগতে শেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়েছি।
হেনার মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। পাপানকে উদ্দেশ্য করে বলল, পুলিশটাকে চলে যেতে বল্ রে খোকা, আর সহ্য করতে পারছি নে।
অকুস্থলে থাকা আকাশের ভাবনা মুহূর্তে বিপরীতমুখি হয়ে উঠল। তাদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেলে অন্য ধরনের ভুল ধারণা দ্রুত সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। স্বরূপনগর থানার ভিতরে তা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে মুস্কিল। হয়তো সামনাসামনি কেউ কিছু বলবে না কিন্তু পিছনের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। বদনকে বলল, আর এক মুহূর্ত এখানে নয়, ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট করতে বলো, আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।
কান্নায় ভেঙে পড়া হেনা কাপড়ের আঁচল দিয়ে ডুরানির রক্তঝরা মুখটা ভালো করে মুছিয়ে দিতে ব্যস্ত। পায়ে পায়ে মাথা নীচু করে পুলিশ ভ্যানের দিকে এগিয়ে চলল আকাশ। মনের গভীরে তীব্র যন্ত্রণার কাঁটা। হেনার মধ্যে একই অনুভূতির বিস্তার দ্রুততর হয়ে উঠছে। হেনার স্বগতোক্তি, নিষ্ঠুররা কী সাংঘাতিকভাবে মেরেছে তার সত্যনারায়ণ শ্বশুরকে। মনে মনে ধিক্কার জানাতে থাকল হেনা। হেনার শেষ মন্তব্য, আসল-নকল চেনার ক্ষমতা নেই রে তোদের।
মতি একপাশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। একটা তীব্র সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে মনের গভীরে। এত তির্যক কথার পরে ওসিসাব কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না কেন? মেয়েটির কথার ভিতরে ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রচণ্ড ঢেউ চলাচল ছিল, তাওে তো ওসি কিছু বিরুদ্ধ কথা বলতে পারলেন না। মেয়েটির শ্বশুর যে ভাষায় আক্রমণ করল, তাতেও পূর্ব সম্পর্কের সূত্র রয়েছে বলে মতির মনে হল। ওসির সঙ্গে মেয়েটির কোনো গোপন সম্পর্ক নেই তো? তা ভেঙে পড়াতেই কী এমনি নতুন অবস্থান তৈরি হয়েছে? আরেকটা নতুন সন্দেহ মতির মধ্যে বার বার উঁকি মারতে থাকল। মেয়েটির শরীর স্বাস্থ্য, গঠনশৈলী ও পোষাক পরিচ্ছদ দেখে অবশ্যই মনে হতে পারে যে কোনো ভদ্র ফেমিলি থেকে ছিটকে পড়া একটি জীবন। হয়তো মনের দুঃখে পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। ভিতরের প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে মরে যায় নি বলে এভাবেই প্রতিবাদ করতে পারল।
মতির মধ্যে আরেকটা নতুন দোলাচল ক্রমে বড়ো হয়ে উঠছে। এমন বিধ্বস্ত জীবন নিয়ে এরা থাকবে কোথায়? চোখের সামনে কোনো অবস্থান আছে বলে মনে হচ্ছে না। থেমে থেমে বলল, আপনারা এখন যাবেন কোথায়?
একটা ভাড়া ঘরের সন্ধান পেতে পাশের গ্রামে গিয়েছিলুম, এসে দেখি মিথ্যে করে আমার শ্বশুরকে….
নিজেদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকলে তো এভাবে পথে পথে ঘুরতে হয় না।
আমার শ্বশুর কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাবেন না। আপনিই কী নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি? পাশের গ্রাম থেকে ফেরার পথে আপনাকে নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। সম্ভব হলে একটা ভাড়া ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, মাসে মাসে যা ভাড়া লাগে, দিয়ে দেব।
মতি নতুন কম্পনে দুলছে। এতক্ষণ ধরে যে ভাবনায় জারিত হচ্ছিল, তা যে সম্পূর্ণ সত্যি, একেবারে নিশ্চিত হল মনে মনে। পাপানের ডান হাত চেপে ধরে বলল, এসো, আমার সঙ্গে।
তুমি কে আগে বলো?
আজ থেকে আমাকে কাকু বলে ডাকবে। হেনাকে বলল, বুবান চলুন। বুঝতে পারছি, মেসোমশাই যেভাবে মুখে আঘাত পেয়েছেন, সেরে উঠতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে। আপাতত আমার ক্লাবে চলুন। তারপর অন্য কিছু ভাবব।
হেনার বিনম্র প্রশ্ন, কোথায় আপনাদের ক্লাব?
ওই তো, সামনের মোড় পার হলেই। আমি বলছি কী, যতক্ষণ না মেসোমশাই সুস্থ হয়ে উঠতে পারছেন, ততদিন আমার বাড়িতে থেকে যেতে পারেন। ক্লাবের সকলকে বলে দিচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমারও একটু আধটু জানাশোনা রয়েছে, ক্লাব করার সূত্রে বেশ কিছু মানুষ আমাকে বিশ্বাসও করেন। সেই সূত্র ধরে চেষ্টা নিতে পারি।
বেশ বললে ভাই। খাঁটি আন্তরিকতার মূলে থাকে এক ধরণের সততা যা থাকলে বিশ্বাস এমনিতেই গড়ে ওঠে, না থাকলে গড়ে ওঠা বিশ্বাসও ভেঙে যায়।
মতি একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল। এ তো গভীর জীবনবোধের কথা। উচ্চ শিক্ষা না থাকলে তো এভাবে জীবনের গভীর পরিমাপ নিয়ে কথা বলা যায় না।
নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময় হাতের কাছে কাঠের ছোটো গুঁড়ি জীবন বাঁচানোর প্রধানতম অবলম্বন হয়ে ওঠে। মৃত্যুর ভয়ে কাতর মানুষটা অন্তত বাঁচার আশায় উদ্বেলিত হয়। জীবনের যাদুমন্ত্র এমনিই। হেনা মনের দুরূহ কোণে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত যেন তেমনি একটা অবস্থান পেয়ে গেল। আপাতত বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি থেকে সাময়িক মুক্তি। সম্পাদক তাকে আন্তরিক আশ্বাস দিয়েছে। খুব আশা, ভাড়া ঘরের জন্যে একটা সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। পাপানকে বলল, কাকুর হাত ধরে হেঁটে চল্। আমি তোর দাদুকে নিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছি। ডুরানিকে বলল, হেঁটে যেতে পারবেন তো?
ডুরানি তালে তালে মাথা নাড়ছেন। মনের নদীতে অন্য সুখের ঢেউ বইছে। উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। হেনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সত্যের পথ যে এত দুর্গম হতে পারে, সেই অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। তবুও বার বার মনে হতে থাকল, দুঃখের সাগর পেরিয়ে বোধ হয় পাড়ে পা রাখা সম্ভব হয়েছে। পাপানও সেই অনুভূতিতে দুলছে। মতির হাত ধরে এগিয়ে চলল। মতির সাহচর্য পেয়ে হেনার বার বার মনে হতে থাকল, হঠাৎ পাওয়া সুযোগটুকু যেন জলের উপরে লাফিয়ে ওঠা ডলফিন মাছের মতো।#
চলবে…
এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৮ )