ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ১০)

শনিবার সন্ধেয় বিভাস সামন্ত নিজের ড্রইংরুমে বসে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। স্বরূপনগর এলাকায় নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির শেষ নেই। সেকথা স্থানীয় থানার ওসিও জানেন। তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা ঘটলে ওসিকে না জানিয়ে রাজনীতির লেবেলে সামন্তবাবু আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। বাধ্য হয়ে তা ওসিকে মেনে নিতে হয়। ঘটনার গতিপ্রকৃতি নিয়ে অন্য ভাবনা থাকলেও কিছুই করার থাকে না। সামন্তবাবু প্রশাসন আর রাজনীতি একসূত্রে বেশ বেঁধে ফেলতে পেরেছিলেন। আসলে আম-মানুষের সমর্থন এত প্রবল ছিল যে তা ঠেলে ভিন্ন পথে এগোনো ওসির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হত না। আম-জনতাও এতদিনের অভিজ্ঞতায় বেশ বুঝে গিয়েছিল, বাবু সামন্তকে বাদ দিয়ে কেউ নিজের মতো চলতে চাইলে যে কোনো সময় তা ভয়ানক বিপদের হয়ে উঠতে পারে। বাধ্য হয়ে সকলকে সামন্তবাবুর মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হত। ভয় আর শ্রদ্ধার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এ আবহ বিভাস সামন্ত বেশ উপভোগ করতেন। রাজনীতির চাপান উতরে নিজেকে ধরে রাখার দৃষ্টান্তে নিজেই উল্লসিত হতেন বারবার।
সেই বিভাস সামন্ত রবিবার সকালে টেবিলের উপর দুপা তুলে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। সারা সপ্তাহে কীভাবে রাজনীতির ঘুঁটি এগিয়ে চলবে, রবিবার তার রূপরেখা নিজের মতো করে তৈরি করে ফেলেন। বাকি ছটা দিন সেই ছকের উপর কাজ চলে। সেদিক থেকে ভাবলে সামন্তবাবু কঠোর বাস্তবে সত্যিকারের প্ল্যানমাস্টার হয়ে উঠতে পেরেছেন।
একটু আগে পুঁটিরাম এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সম্মতি না পেয়ে ভিতরে ঢুকতে পারছে না। ইতিমধ্যে পাঁচবার বলেছে, আসব স্যার? কোনো উত্তর মেলে নি। কেমন যেন থমকে থাকতে হল। শেষে ভাবল, শেষ বারের মতো ডেকে সাড়া না পেলে ফিরে যেতে হবে। তাই আবার ডাকল, আসব স্যার?
ততক্ষণে সব প্ল্যান শেষ হয়ে গিয়েছে। সামন্তবাবু আলতো স্বরে বললেন, কে, পুঁটিরাম? তা এমন সময়ে? কিছু বলবি নাকি?
পুঁটি ঘরের ভিতরে ঢুকে বিনীত মুখে বলল, একটা ভালো খবর আছে স্যার।
মিস্টার বিভাস টেনে টেনে বললেন, আমার সব দরকার রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে, পুঁটিমাছে কোনো প্রয়োজন নেই।
স্যার, ঠাট্টা করছেন? এত কষ্ট করে কেবল আপনার জন্যে এত ভালো খবর নিয়ে এলুম, আর আপনি আমাকে পুঁটিমাছ বলতে পারলেন? আমি তো পুঁটিরাম চক্রবর্তী।
বিভাস সামন্ত নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন। লোকটা সত্যি সত্যি অনেকবার তার জন্যে বিশেষ ভালো খবর এনে দিতে পেরেছে। এও ভাবলেন যে পুঁটির পছন্দ বার বার তার পছন্দের সঙ্গে মিলে গেছে। খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে মুখ তুলে বললেন, হ্যাঁ বলো, খবরটা কী?
জবর খবর আছে স্যার।
সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
স্যার, একটা দারুণ মাল ঢুকেছে এলাকাতে। আপনার সঙ্গে মানাবে বেশ। একটু চেষ্টা নিলে হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে আছি।
বিভাস ভালোমতোই জানেন, পুঁটিরাম মাল বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছে। এতক্ষণ ভাবের ঘোরে ছিলেন বলেই পুঁটিরামকে দেখেও ঠিকমতো দেখতে পান নি। কিন্তু পুঁটির মালের প্রসঙ্গ শুনে দুলে না উঠে পারলেন না। চাপা স্বরে বললেন, হ্যাঁরে পুঁটি, আমাকে না জানিয়ে এত ভালো মাল এলাকায় ঢুকল কী করে? কোত্থেকে এসেছে জানিস? রঙে কেমন? ফর্সা তো? দোহারা আকৃতি, না শীর্ণকায়া? বয়স কত?
এসব আপনি ভালো বুঝবেন স্যার। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়েছে, ভাদ্র মাসের ভরা নদী। ভারি টুসটুসে, পাকা ফজলি আম। আপনি খেলেই বুঝবেন। ঠিক দিব্যভারতীর মতো দেখতে। হাঁটলে অবিকল সেরকম লাগে। তবে হাসলে কেমন দেখতে হবে, তা জানি নে স্যার।
হাসিটুকু দেখে আসতে পারলি নে?
আমাকে দেখে একবারও হাসে নি স্যার।
ভারি অন্যায় করেছে মেয়েটা। এখন বল্, জানতে পারলি কী করে?
তা বলতে পারব না স্যার, তবে একটা বয়স্ক লোকের সঙ্গে মেয়েটাকে ঘুরতে দেখেছি।
দেখতে কী সত্যি ভালো?
কী যে বলেন স্যার। ভারি সুন্দর চেহারা। ছবিতে কেবল এরকম দেখা যায়। মনে হয়, ঝগড়াঝাটি করে বাড়ি ছেড়েছে। নাহলে এখানে এসে ভাড়ার ঘর খুঁজতে যাবে কেন? বুড়ো লোকটা বাজারের মধ্যে বসে ছিল। মেয়েটা গ্রামে গিয়েছিল ভাড়া ঘরের খোঁজে।
ভাড়ার ঘর কী ওরা পেয়ে গেছে?
সে খোঁজ নিতে পারি নি স্যার।
কী রাবিস রে তুই। এমন একটা খবর আনলি যার অর্ধেক নিজেই জানিস নে। একটু কী ভেবে নিয়ে স্বগতোক্তির স্বরে বললেন, এ প্রসঙ্গ নিয়ে আবার যাকে তাকে জিজ্ঞেস করা যায় না রে পুঁটি।
তা অবশ্যি ঠিক। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি স্যার। থানার দারোগাবাবু ওই মালটাকে দেখে কেমন যেন নরম হয়ে পড়েছিলেন। আমার মনে হয়েছে, মেয়েটার সঙ্গে আগে থেকে দারোগাবাবুর নটখট ছিল। নাহলে এত নরম হতে যাবেন কেন? দারোগাবাবুর মুখের উপর যা তা বলার পরেও ওসি সাব মুখে রা কাটলেন না। কমলা লেবুর মতো মেয়ে এমন রাশ দিল যে দারোগাবাবু থ্ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একেবারে অসম্ভব কাণ্ড স্যার, চোখের সামনে তাই দেখেছি। রেগে গেলে মেয়েটাকে ভারি মিষ্টি লাগে। আহা!
কী রকম?
দার্জিলিং এর পাকা কমলালেবু বলে মনে হয়েছে। রাগি মুখে হাসি, দেখে আমার কমলালেবু ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় নি স্যার। গায়ের রঙটাও তেমনি। সোনার ঝিলিক সারা শরীরে। আমার ছেলে গুণধর লোভ সামলাতে না পেরে কাশ্মিরী আপেলের সঙ্গে তুলনা করেছিল। এ নিয়ে কিছু ভাববেন না স্যার, আমি তাকে খুব করে বকে দিয়েছি। আরেকটা প্রসঙ্গ আপনাকে শুনতে হবে। মেয়েটার সঙ্গে যে বুড়োকে ঘুরতে দেখেছি, হাটের মধ্যে চুরির দায়ে তাকে খুব মার খেতে হয়েছে।
হঠাৎ চুরি করতে গেল কেন?
বোধ হয় হাতটান পড়েছিল। গেঁটে পয়সা না থাকলে যা হয়। খবর পেয়েই তো দারোগাবাবু নিজেই এসেছিলেন জিপ নিয়ে চোরটাকে ধরে নিয়ে যেতে। বোধ হয় পিছনে প্রমোশনের তাড়া ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটার প্রচণ্ড বিরোধিতায় তা সম্ভব হয় নি।
কী বলছিস রে পুঁটি? ওসিকেও থামিয়ে দিতে পারল মেয়েটা?
এসব নিজের চোখে দেখেছি স্যার। কী তেজ মেয়েটার। ভয়ে দারোগাবাবু কেমন যেন কুঁকড়ে গেলেন। গোপন সম্পর্কের জেরে এভাবে ভয় পেয়ে যেতে পারেন। আমি নিশ্চিত হতে পেরেছি স্যার, গোপন সম্পর্কের কেলেঙ্কারি ঢাকতে এভাবে সিঁটিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
তাহলে কী মেয়েটা এখনও ওই বুড়ো লোকটার সঙ্গে রয়েছে?
তা বলতে পারব না স্যার। যখন দেখেছি, তখন সঙ্গে ছিল।
বিভাস সামন্ত যেন মস্ত বড়ো সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। কেবল ভাবছেন, ভালো করে খোঁজখবর নিতে পারলে আয়ত্তে পাওয়া অসম্ভব হবে। তখন দেখা যাবে, পুঁটির দেখা মেয়েটা সত্যি সত্যি দিব্যাভারতী কিনা। ভিতরের খুশিতে দুচোখ স্থির করে পুঁটিরামের দিকে চেয়ে থাকলেন।
আরেকটা কথা আপনাকে জানানো হয় নি স্যার। মেয়েটাকে দারোগাবাবু খুব নরম স্বরে হেনা বলে ডেকেছিলেন, শুনে আমার শরীরে ভীষণ ছিটপিটানি শুরু হয়েছিল। তাহলে কী স্যার, মালটা দারোগাবাবুর রক্ষিতা ছিলেন?
বিভাস সামন্ত আবেগে দুলছেন। এতসব কাণ্ড ঘটে গেল তাঁর অজান্তে? ভিতরের ঘোরে পুঁটির জন্যে একটা অচেনা দুঃখ গোলক ধাঁধা হয়ে মাথার ভিতরে ঘুরছে। ইচ্ছে করলেই পুঁটি দিব্যি খবরটুকু তাঁকে দিতে পারত। বাস্তব বুদ্ধি ছিল না বলেই তা সম্ভব হয় নি। শরীরের কম্পনে ঘেমে ওঠা সামন্তের কেবল মনে হতে থাকল, ডাঁসা জিনিস হওয়া সত্ত্বেও এত সহজে তাঁর মুঠো থেকে বের হয়ে গেল? পুঁটিকে নিয়ে তাঁর বিশ্বাস একেবারে কম নয়। সময় বিবেচনায় লোকটা অনেকবার সফল হতে পেরেছে। আগেও বেশ কয়েকবার তাঁর হাতে হিরে মানিক তুলে দিতে পেরেছিল পুঁটি। একটা দুঃখ সামন্তের মনের তলানিতে তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। খবর পেয়েও সময়মতো পুঁটি কেন তাঁকে জানাতে পারল না? বেশ কিছু সময় থমকে থাকলেন। আনমনে বললেন, হ্যাঁরে পুঁটি, তোর মালটা বিবাহিত, না অবিবাহিত? মাথায় সিঁদুর আছে, না নেই?
শাঁখা সিঁদুর কিছুই দেখি নি স্যার। বুড়োকে বৌমা বলে ডাকতে শুনেছি। ভিতরে ভিতরে এত রহস্য রয়েছে যে তা কিছুতেই ভেদ করতে পারছি নে। স্যার, সন্ধের পরে ওসি মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে নাতো?
বিভাস সামন্তের মুখে বিচিত্র হাসি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, হ্যাঁরে পুঁটি, তুই আমাকে এত দুর্বল ভাবছিস? এলাকায় যখন ঢুকেছে, জেনে রাখিস, ও সম্পত্তি আমার হয়ে গেছে। দেখভালের পূর্ণ দায়িত্ব আমার। ইচ্ছে থাকলেও ওসি ওর টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না। স্বরূপনগর থানার বড়বাবু আমাকে ভালো মতোই চেনেন। ও রকম দশ গন্ডা ওসিকে আমি গাঁটিতে গুঁজে রাখতে পারি।
পুঁটি খুব খুশি হল সামন্তবাবুর কথায়। লোকটা যা ভাবেন, তাই করেন। প্রশাসন থেকে বাধা দিয়ে কেউ কোনোদিন তাঁকে বিরত করতে পারে নি। পুঁটির খুশি লুকিয়ে রয়েছে আরেকটি কারণের মধ্যে। সামন্ত স্যারের খাওয়া শেষ হলে মাঝে মাঝে উচ্ছ্বিষ্ট ভোগের সুযোগ তার কপালে জোটে। তখন আর সামন্তবাবু রাগ করেন না। বরং বলেন, সংগ্রহ করতে তোর তো অনেক কষ্ট হয়েছে, নে, একটু ভোগ কর।
মানুষটা এমনিই। বাইরে বাঘের মতো রাসভারী কিন্তু ভোগ খাওয়া হয়ে গেলে ভিতরে ভিতরে ভিজে বেড়াল। বাচ্চাকাচ্চাদের শেয়ার দিতে না পারলে লোকটার যেন কত মন খারাপ হয়ে যায়।
বিভাস সামন্ত শিকারী বাঘের মতো মুখ নিয়ে চেয়ারে ঘাপটি মেরে বসে থাকলেন। দুঃখ একটাই, ঝোপের আড়ালে থেকেও একেবারে নাগালের কাছে চলে আসা শিকারটাকে গালে নিতে পারলেন না।
পুঁটিরাম সামন্তবাবুর মুখের দিকে দুচোখ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। লোকটা যে নতুন মালের নেশায় বুঁদ হয়ে উঠেছেন, তা বুঝতে পুঁটির কোনো অসুবিধা হল না।
সামন্তবাবু আবার ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, তোর উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলুম রে পুঁটি, কালকের মধ্যে খোঁজখবর নিয়ে আমাকে শুধু জানাবি, ওরা কোথায় ঘর ভাড়া নিয়েছে। তারপর দেখছি কী করা যায়। আমার এলাকায় ঢুকেছে যখন, তখন শেষ দেখতেই হবে, শুধু একবার সন্ধান পেতে দে আমাকে।
আরেকটা কথা জানাতে ভুলে গিয়েছি স্যার।
এত জটিল সময়ে খুচখাচ ভুলে যাচ্ছিস কেন?
নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি মতি ওদের ঘরভাড়া করে দিতে পারে। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। চুরির ঘটনার পরে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিতে হবে বলে মেয়েটাকে মতি নিজের ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিল।
তাহলে তো মতিকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জেনে নেওয়া সম্ভব। ছেলেটা ভালো, ক্লাব করে, দায়েঘায়ে আমার কাছ থেকে অনেকবার সাহায্য নিয়েছে, জিজ্ঞেস করলে অন্তত মিথ্যে করে কিছু বলবে না।
তাহলে তাই করুন স্যার, মতি কিন্তু আমাকে ঠিকমতো বিশ্বাস করে না। চারদিকে বলে বেড়ায়, আমি নাকি সাইলকের চেয়েও খারাপ মহাজন। কী নষ্ট কথা, একবার ভেবে দেখুন স্যার। একটা কিছু না করলে পেট চলবে কী করে? টাকা ফেলে রাখব, তার জন্যে অতিরিক্ত সামান্য চাইলে সব দোষ আমার হয়ে গেল? ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে তো সুদ পাওয়া যায়, লোকগুলোকে উপকার করে সেটুকুও আশা করতে পারব না? ওই মতি শালা তা চায় না। এখানে ওখানে আমার বিরুদ্ধে যা তা বলে, এক নম্বরের হারামি স্যার, লোকের পিছনে লেগে থাকার বদভ্যাস একেবারে পাকা করে ফেলেছে। স্যার, আপনি একটু কড়া হতে পারেন না?
সামন্তের মধ্যে সহানুভূতির সুর। তো তো করে বললেন, মতি এভাবে অকারণে পিছনে লাগবে কেন? এ তো সমর্থন করা যায় না। ক্লাব করতে গেলে সকলকে নিয়ে চলতে হবে। অন্যেরা কীভাবে চলবে, তা মতি ঠিক করে দেবে নাকি? তুই আবার ওর নামে বানিয়ে বানিয়ে এসব বলছিস না তো?
কী যে বলেন স্যার। মতিকে একটু বলে দেবেন, যাতে সে আর এভাবে আমার বিরুদ্ধে না বলে।
কেন বলে দেব না?
আরেকটা খবর আপনাকে দেব স্যার?
এভাবে একটা একটা করে বলছিস কেন? যা জানা আছে, পর পর বলে দিলে আমার পক্ষে ঠিকঠাক এস্টিমেট করা সহজ হয়ে ওঠে।
ওই দিন দারোগাবাবু মতির গালে সজোরে চড় মেরেছিল স্যার।
কী বলছিস রে? তাহলে তো খেলা জমে উঠেছে। কেবলমাত্র ওই ঘটনার জন্যে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। বহু লোকজন রয়েছে মতির সঙ্গে। হয়তো এ ক’দিনে থানার সামনে বিক্ষোভ দেখানোর প্রস্তুতি সারা হয়ে গেছে। আচ্ছা পুঁটি, বলতে পারবি, ঠিক কী কারণে দারোগাবাবু মতিকে চড় মারতে বাধ্য হলেন?
জানতে পারি নি স্যার। হঠাৎ ঘটনাটা ঘটে গেছে। তারপর মেয়েটা যা তা বলে বকে দিয়েছে ওসি সাবকে। তাতেও ওসি এতটুকু নড়েন নি। সাধে কী বলছি স্যার, ভেতরে বাজে নটঘট রয়েছে।
একটা দারুণ প্রসঙ্গ জানাতে পারলি রে পুঁটি। লোক পাঠিয়ে মতিকে ডেকে কথা বললে আরও তথ্য পেয়ে যাব। শুরু করেছি যখন, দ্যাখ না, হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কেমন তত্ত্বতালাস চালিয়ে যাই। একথা সেকথায় আবার ভুলে যেতে পারি, আমার টাকাটা সঙ্গে এনেছিস তো?
স্যার, এভাবে আমাকে ছোট করবেন না। বাজার যত মন্দা যাক, আপনার কথা আমাকে ভাবতেই হয়। এই নিন স্যার, বলতে বলতে পুঁটি পকেট থেকে টাকার বান্ডিল বের করে টেবিলের উপর রেখে দিল।
আমার কথা শুনে মন খারাপ করিস নে। আমার নাম করে লাখ লাখ টাকা লুটে নেওয়ার সিকিউরিটি পাচ্ছিস। বিনিময়ে আমাকে দিচ্ছিস কত? ওই তো সামান্য কটা টাকা। সেটাই তোকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি। মন্দা বাজারের কথা বলে শুধু শুধু কিন্তু প্রকাশ করা ঠিক নয়।
আপনি আমার ভগবান স্যার। কিন্তুর প্রসঙ্গ তুলছেন কেন?
চাপা স্বরে বিভাস সামন্তের সান্ত্বনা, আর দুঃখ করিস নে পুঁটি। আমাকে ভালো নরম করে দিতে শিখেছিস তুই। এখন যেটা খুব জরুরি, সেটা শুনে নে। কালকের মধ্যে মেয়েটার সব খবর আমাকে জানাতেই হবে, যে কোনো মূল্যে। শোনার পরে শরীরে কেমন যেন মোচড় শুরু হয়েছে।
তাহলে আসছি স্যার। পুঁটি গুটি গুটি পায়ে বাড়ির পথে ফিরে চলল, বিভাস সামন্ত ড্রইং রুমের টিউব লাইট নিভিয়ে দিয়ে রঙিন নাইট বাল্বের মনোহর আলোয় চেয়ারে বসে ছটফট করতে লাগলেন। নানা প্রশ্নের ডালি আবেগের গভীরে। মেয়েটা কী সত্যি সত্যি দারোগাবাবুর রক্ষিতা ছিল? তাই কী কপালে সিঁদুর নেই? হাতে শাঁখা পরে নি? নানা হিসেবের গরমিলের ছবি বিভাস সামন্তের মধ্যে। এমনও তো হতে পারে, স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। শেষে ভাবলেন, ওসিকে একটু বাজিয়ে দেখলে সহজে সব কিছু বুঝতে পারবেন। তাঁর পক্ষে যে কয়েক গন্ডা দারোগাকে পকেটে পুরে ফেলা সম্ভব, তাও ভাবতে এতটুকু কসুর করলেন না। মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে দিলেন। রিং বাজতে শুরু করল।
কয়েক সেকেন্ড পরে বিপরীত প্রান্ত থেকে প্রশ্ন ভেসে এল, হ্যালো, কে বলছেন?
আমি বিভাস সামন্ত। স্বরূপনগর থানার ওসি বলছেন কী?
ইয়েস। এসেই আপনাকে নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। ক‘দিন ধরে ভাবছিলাম, একবার ফোন করে খোঁজখবর নেব। তার আগেই আপনি আমাকে ফোন করে বসলেন। ধন্যবাদ। একদিন সময় করে থানায় চলে আসুন। সামনাসামনি না হলে ঠিক আসর জমে না। প্রত্যক্ষ আলাপের মজাই আলাদা। অনেক নতুন তথ্য জেনে নেওয়াও সম্ভব হবে। এতদিন ধরে রাজনীতি করছেন, নিশ্চয় অভিজ্ঞতায় আকর হয়ে উঠেছেন।
আমন্ত্রণের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। আগের সব ওসি এভাবেই আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আপনিও সেই পথে হাঁটলেন। গভীর পরম্পরা, অসীম ধন্যবাদ। একটু থেমে আরেকটু ভেবে নিয়ে বললেন, যেজন্যে ফোন করলাম, তা এখনও শোনানো হয় নি স্যার।
বলুন, শুনছি।
আগামিকাল সন্ধেয় আমার বাড়িতে একটা টি-পার্টির আয়োজন করেছি। আপনিও সাদরে আমন্ত্রিত। kindly আসতে ভুলে যাবেন না। আমার এলাকায় এসেছেন, আমি জানি, অনেক ঘটনায় আপনার পাশে থাকতে হবে। আপনিও কিছু কিছু ঘটনায় আমার পাশে থাকবেন। বিনিময় সূত্র তো এমনিই হয়। ফোনে আমন্ত্রণ করার জন্যে কী কিছু মনে করলেন স্যার?
কী যে বলেন বিভাসবাবু, আপনিই এলাকার মাথা। নিজের মুখে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন। খুব সম্মান বোধ করছি।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। বিভাস সামন্ত ফোনের সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে ডিম লাইটের প্রহেলিকার মধ্যে গুম হয়ে বসে থাকলেন। একটা নতুন দ্বন্দ্ব দোল খাচ্ছে ভিতরে, নতুন ওসি পুঁটির দেখা দিব্যাভারতীকে তুলে নিয়ে গেলেন নাতো? পুঁটি তো সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেল। হয়তো নতুন এসে তাঁর হিম্মত ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন নি। তাঁকে জানালে দিব্যি সাহায্য পেতে পারতেন। এভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার কোনো মানে খুঁজে পেলেন না।
সামন্তবাবু অশান্ত শরীরে শিকারী বাঘের মতো লাল দুচোখ নিয়ে নাইট বাল্বের আলোর দিকে চেয়ে থাকলেন। ডাকতে আসা একজনের কণ্ঠস্বর শুনে বিভাস ভিতরের ঘোর থেকে কঠোর বাস্তবে ফিরলেন। উঠে গিয়ে টিউবলাইটটা আবার জ্বেলে দিলেন। ভেজানো দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ভিতরে আয়, কিছু বলবি?
পঞ্চায়েতের উদ্যোগে আমার ঘর পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, তাই জানতে এলুম।
নিজে পঞ্চায়েতে গিয়ে কী খোঁজ নিয়েছিস?
পঞ্চায়েতের সকলে আপনার কথায় চলে, তাই এখানে চলে এলুম।
তা নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু ঘরের আবেদন অনুমোদন পেয়েছে কিনা, তা তো পঞ্চায়েতে গিয়েই জানতে হবে।
প্রয়োজন হলে যাব।
তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব নয়ন? যেন ঘুরিয়ে উত্তর দিস নে।
আপনিই উপযাচক হয়ে আমাকে ঘর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, আর আপনার প্রশ্নের উত্তরে আমি ঘুরিয়ে উত্তর দেব? এভাবেই ভাবছেন?
আমাদের পঞ্চায়েতকে মন দিয়ে সমর্থন করিস তো?
আপনি জড়িয়ে রয়েছেন, আমার পক্ষে কি অন্য কিছু ভাবা সম্ভব?
তাহলে পঞ্চায়েতকে না জানিয়ে মতির ক্লাব-ঘরে বাড়ির লোকজন নিয়ে লেখাপড়া শিখতে গেলি কেন? সর্বশিক্ষার ওই স্কুলটা খোলা হয়েছে গ্রামের মানুষদের মাথা হেঁট করে দেওয়ার জন্যে। সারা দিন মাঠের কাজে নেতিয়ে পড়া লোকগুলোকে জোর করে বয়স্কদের স্কুলে ধরে রাখার কোনো মানে হয় বল তো? এসব নিয়ে ভাববি নে?
একবার এরকম ভেবেছিলুম স্যার, তারপর দেখি সকলে যাচ্ছে, আমিও ওদের সঙ্গে চলে গেলুম।
পরিস্কার করে বলছি, কাল থেকে ওখানে কেউ পড়তে যাবি নে। মতি স্কুল খুলে রাজনীতি করতে চাচ্ছে না তো? সামনাসামনি নামলে বুঝতুম, বাপের ব্যাটার মতো হিম্মত দেখাতে শিখেছে। তা না করে বেনামে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। বেয়াদপির একটা সীমা আছে রে। একটা কথা মনে করিয়ে দিই, বুড়ো বয়সে পড়াশোনা করে কারুর পক্ষে কী চাকরি পাওয়া সম্ভব? তাহলে এভাবে ডেকে ডেকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে বইপত্র কিনে দেওয়ার মানে কী? ছেলেটা মাথা হওয়ার মতলবগিরিতে ইঁচড়ে পাকা হতে চাচ্ছে তো। হয়তো ভাবছে, ওর ছলচাতুরি কেউ ধরতে পারবে না। আরে, তুই ক্লাব করিস, আর আমি রাজনীতি করি। কিসে আর কিসে। কতবার নিজের দায়দরকার নিয়ে আমার কাছে এসেছিস। একবারও না করি নি। তোকে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিই, এসব করার আগে আমাকে অন্তত একবার জিজ্ঞেস করতে পারত। তা করেছে কী? আমার এলাকায় থেকে যা খুশি তাই করবে? ছেলেটা ঘুঘু দেখেছে, এখনও ফাঁদ দেখেনি। সেটাই আমাকে দেখাতে হবে।
ভিতরে ভিতরে নয়ন যে মতির সমর্থনে রয়েছে, সে কথা বিভাস সামন্তের সামনে প্রকাশ করার সাহস পেল না। সে ব্যক্তিগত ভাবে খুব ভালো করেই জানে, ছেলেটা দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্যে অনেক কিছু করছে। সারা দিন ক্লাবের মাধ্যমে দেশের মানুষের উন্নতি নিয়ে পড়ে থাকে। কেউ অসুখ-বিশুখে ভুগলে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। খুব প্রয়োজন বোধ করলে ক্লাবের ফান্ড থেকে ওষুধপুত্র কিনে দেয়। বিভাসবাবুর কাজ হল দায়সারা হুকুম করে শুধু শুধু নিজের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা। সামনে বলবেন একরকম, পঞ্চায়েত গেলে ওর সাকরেদদের সম্পূর্ণ অন্য রকম কথাবার্তা। কিছুতেই মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এসব কথা প্রকাশ্যে বলাও ভয়ানক বিপদের, গত বছর একটানা বৃষ্টির সময় মতি গরিবদের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে যেভাবে আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দিয়েছিল, তা এলাকার সব মানুষ মনে রেখেছে।
আবার সামন্তবাবু চাপা স্বরে বলতে শুরু করলেন, তোকে একটা বিষয়ে সাবধান করে দিই, যা বললুম, এলাকার অন্যদের কাছে প্রচার করতে এতটুকু কিন্তু করবি নে, কিন্তু আমার নাম কোথাও উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। জানিস তো, রাজনীতির দায় নিয়ে চলতে হয় আমাকে। শুধু শুধু ব্যক্তিবিরোধে যেতে যাব কেন? সমাজে মতির মতো অনেক খানাডোবা রয়েছে, তাতে ডুবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
বিভাসদা, আর বলতে হবে না, সব বুঝেছি, সেভাবেই চলব। আমাকে নিয়ে একটু ভাববেন, ঘরদোর না থাকায় শীতকালে বেশ কষ্ট পেতে হয়। ছেলেটা আবার এ বছর সেভেনে উঠবে। ওর পিছনে একটু খরচ তো করতেই হবে।
এত করে বলছিস কেন রে? কথা দিয়েছি যখন একটা কিছু করতেই হবে।
মাথা নেড়ে নয়ন ফেরার পথে হেঁটে চলল। একবার ভাবল, সামন্তবাবু কথা দিলে এত সহজে নড়চড় করেন না। মতির স্কুলে যাওয়া নিয়ে কম বেশি বিপত্তি তৈরি করতে হবে বলেও ভাবল। কিছু পেতে হলে কিছু করে দেখাতেই হবে। এও বুঝল, বিভাস সামন্ত যেটুকু করবেন, নিজের রাজনৈতিক লাভের জন্যে, যদি তা দেখতে না পান, এতটুকু নড়বেন না। কিন্তু মতির স্বভাব পান্না হিরের মতো, কোনো বিনিময় চায় না সে। সকলকে ভালো করার একটা সাধারণ ধর্ম গড়ে উঠেছে তার মধ্যে। বয়স্কদের স্কুল করার মাধ্যমে আম-মানুষের গণচেতনা যে যথেষ্ট বেড়েছে, তা নিয়ে নয়নের মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না।
বিভাস সামন্ত তখন মনের গলি বেয়ে দ্রুত সামনে ছুটে চলেছেন। পুঁটির ছেলে যখন বলেছে দিব্যাভারতীর মতো, তাহলে নিশ্চয় সুন্দরী না হয়ে পারে না। ভিতরের অস্থিরতায় একা একা ড্রইং রুমে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েটার কল্পিত শরীর দুচোখের সামনে কেন যে এত বেশি করে লাট খাচ্ছে। মতি কী শেষ পর্যন্ত মেয়েটার ঘরভাড়া করে দিতে পারল? যদি পেরে থাকে, তাহলে ওই ঢ্যামনার কবল থেকে সহজে মুক্ত করা যাবে না। হারামজাদা, ক্লাব করার নামে নারীভোগের গোপন ছলচাতুরী পুষে রাখে নি তো? তাঁর কাছ থেকে যখন তখন উপকার পায় ছেলেটি, তার পরেও এত বড়ো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না? ক্লাব করতে গেলে এটুকু কমনসেন্স থাকা খুব জরুরি। এতদিনে মতি কেন যে তা আয়ত্ত করতে পারল না। একটা চাপা আক্ষেপ বরফ গলা জলের মতো ঝরে পড়ছে সামন্তের বুক থেকে। একবার ভাবলেন, এত ভেবে লাভ কী। মতি যাতে কাল সকালে এসে তার সঙ্গে দেখা করে, সেজন্যে খবর পাঠানো হয়েছে। মুখোমুখি হলেই সব কিছু বুঝতে পারবেন। ওতো স্রেফ ক্লাব করা ছেলে, তাঁর ঘোড়েল বুদ্ধির রাজনৈতিক প্যাঁচে পেরে উঠবে কেন? নিজের উপর বিভাস সামন্তের বিশ্বাস হিমালয়ের মতো উঁচু।
একদিকে নেতাজী সংঘের সেক্রেটারি মতি, অন্যদিকে স্বরূপনগর থানার ওসি আকাশ— দুজনের বিপরীত টানে বিভাস সামন্ত কেমন যেন জেরবার হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে রাগের ঝংকারে শরীর কাঁপছে কিন্তু সামন্তবাবু ভালো করেই জানেন, রাজনীতির প্রকাশ্য আসরে রাগের বহিঃপ্রকাশ শুধুমাত্র নাসূচক ফলাফল উৎপাদন করতে পারে।
সকাল হলেই সামন্তবাবু পুঁটিরামের কাছে খবর পাঠিয়ে দিলেন। মতিকে নানাভাবে আটকানোর ছকে পুঁটিকে খুব করে দরকার। ওর আর্থিক শক্তিকে মতির বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর কথা ভেবে মনে মনে শ্রী সামন্ত একটু উৎফুল্ল হলেন। মতির মতো স্রেফ ক্লাব করা ছেলেকে উপেক্ষা করে চলার অনুমতি পেয়ে গেলে তার পক্ষে রাজনীতির আসর জমিয়ে রাখা একরকম অসম্ভব হয়ে উঠবে। কিছুতেই এ সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সব প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়াই হল একজন ধাকুড় রাজনীতিকের মূল কাজ। এতদিন কূটনীতির পথে চলতে চলতে বিভাস সামন্ত সেই কঠোর সত্যটুকু মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছেন। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সব গণতান্ত্রিক সামাজিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে নিজের বিশেষ অগ্রগতি যে ধরে রাখা সম্ভব নয়, তাও বিভাস সামন্ত ভালো করেই জানেন।
চিন্তার ফাঁক গলে সকাল গড়িয়ে কখন দুপুর এসেছে তা সামন্ত ঠিকমতো টের পান নি। গভীর চিন্তা কখনো কখনো সময়ের দৌড়কে কত সহজে না হার মানাতে পারে। সেই সূত্র ধরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসেছে সময়ের মাপকাঠি মেনে। আরেকটু পরে সন্ধে এসে সারা দিনের সব স্মৃতি মুছে দেবে। বিভাসের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে আঁধারের খেলা জমে উঠছে। গভীর অন্ধকারে পুঁটির ছেলের দিব্যা ভারতীর সঙ্গে জীবনের অবৈধ খেলা যত বেশি সংগঠিত হোক না কেন, দিনের আলোয় কাউকে জানতে না দিলেই রাজনীতির দৈনিক মহড়ায় দিব্যি টিকে থাকা সম্ভব।
মতি এসেছে বিভাস সামন্তের সঙ্গে দেখা করতে। আবেগের ছটফটানি থেকে বিভাস সামন্ত ধীরে ধীরে কঠোর বাস্তবে নামতে বাধ্য হলেন। একজন রাজনীতিকের কাছে বাস্তব মানে তো বুদ্ধির খেলা, কূটনীতির নিত্য মহড়া। সামন্ত প্রথমে ভাবলেন, এক্ষুণি দেখা করে মনের কথা জেনে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। বুদ্ধি করে একজনের হাতে ড্রইংরুমের চাবি পাঠিয়ে দিলেন। বসার জন্যে সাদর আপ্যায়ণ সেরেও ফেললেন পরোক্ষভাবে। বসিয়ে রেখে নার্ভের উপর চাপ তৈরির কৌশল নিয়ে ফেললেন। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মতির মধ্যে বিরক্তি বাড়ছে। ভিতরে কী অন্য কেউ এসেছেন দেখা করতে? হতেই পারে। রাজনীতিকদের কাছে লোকজন কত রকম দরকার নিয়ে আসে। আরও মিনিট পনেরো গেল। মতির মধ্যে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছে। একবার চলে যাবার কথাও ভাবল। তারপর দেখল, পুঁটিরাম ড্রইংরুমের সামনে এসে ঘুরঘুর করছে। মুখের অবয়বে হাসির ঝিলিক। কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর জানাতে আসে নি তো? মেয়েটার শুলুকসন্ধান জেনে তা কী বিভাস সামন্তকে জানাতে এসেছে?
পুঁটি ভাবছে অন্য আরেকটা প্রসঙ্গ নিয়ে। গতকাল মাসিক কাটমানি নিয়ে বিভাসবাবু তার উপর ঠিকমতো সন্তুষ্ট হয়ে কথা বলতে চান নি। আজকের খবরটুকু দিয়ে সামন্তবাবুকে গলিয়ে জল করে দিতে চায়। তখনও পুঁটি জানতে পারে নি যে কেবলমাত্র মতি ড্রইংরুমে বসে রয়েছে। ঢুকতে ঢুকতে বলল, সব খবর পেয়ে গিয়েছি স্যার। সেজন্যে কথা বলতে এলুম। ভিতরে ঢুকে মতিকে দেখে চমকে না উঠে পারল না। নিজেকে সামলে নিয়ে চাপা স্বরে বলল, মতিবাবা, কখন এলে এখানে?
আগে বলো, তুমি এসেছ কেন? এত আনন্দ কিসের? কাউকে নতুন করে ঠকানোর মতলবে নয় তো? তা ম্যানেজ করতেই কী এখানে আসতে হল?
পুঁটিরাম জানে মতিকে কেমন করে ম্যানেজ করতে হয়। এ অভিজ্ঞতা তার অনেক পুরনো। সমগ্র এলাকার মধ্যে মতিই একমাত্র ঢ্যামনা ছেলে যে সামনা সামনি চিবিয়ে চিবিয়ে অপ্রিয় সত্যি কথা বলে দিতে পারে। কিন্তু সেসব ব্যবসার কারণে পুঁটিকে সহে নিতে হয়। তাই মতিকে সন্তুষ্ট করতে বলল, ভালো আছ তো বাবা? ক্লাব কেমন চলছে? চারদিকে কেবল তোমার সুনাম শুনছি। খুব খুশি হই এসব শুনে। মাঝে মাঝে বড়ো অনুষ্ঠান করছ, সেসব খবরও পাই। রাগ করে আছ বলেই কী আমাকে ডাকো না? এসব করতে যথেষ্ট খরচ লাগে। তাও বেশ বুঝি। তুমি বললে আমি একটা মোটা অঙ্কের টাকা ক্লাবের নামে দিতে পারি।
এর ভিতরে তোমার নিজস্ব কোনো অভিসন্ধি নেই তো? আগে বলো, বিভাসবাবুর কাছে এসেছ কেন? সাধারণ মানুষের জীবনে আর্থিক অসুবিধা দেখা দিলে তোমার আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠে। তাই নিয়ে বিভাসবাবুর নতুন সাহায্য চাইতে এসেছ কী?
মতি যে নিজের কথার ভিতরে অন্য প্রসঙ্গ ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে, তা বুঝতে পুঁটির কোনো অসুবিধা হল না। বিড়বিড় করে বলল, একেবারে ঢ্যামনা সাপ, শুধু খোঁচা মারা কথা বলতে শিখেছে। সারাক্ষণ তাকে ফ্যাসাদে ফেলার ধান্দায় রয়েছে ব্যাটার ছেলে। তুই কে হুতি, সব গরিবদের ঠিকে নিয়ে রেখেছিস নাকি? কার কী হলো, তাতে তোর কী? তোর বাপের কী? তাতে তোর চৌদ্দপুরুষের কী এসে যায়? এসব বুঝতে হয় রে হারামির বাচ্চা।
কিন্তু মনের সেই বিশ্লেষণ এতটুকু প্রকাশ করল না পুঁটি, বরং বেশ সুধিয়ে বলল, আমাকে দেখলে তোমার রসিকতা করার ইচ্ছে কেন যে এত বেড়ে যায় তা মাথায় আসে না। তোমার নামে চারদিকে কত প্রচার করি জানো? কোথাও গেলে সবার আগে তোমার পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু করি। আর করবই বা না কেন? ক্লাব চালিয়ে এত উপকার করছ, এতে তো ভিতরের সমর্থন এমনি এমনি চলে আসে। আমার কেবল মনে হয় ভালো নাম করে ফেলেছ বাবা। বজায় রাখতে পারলে কপালে বড়ো পুরস্কার জুটে যেতে পারে। সময় সুযোগ পেলে তুমি আমাকে নিয়ে মসকরা কর, আর আমি তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই। মতি বাবাজি, এই ফারাকটুকু ঘুচিয়ে দিতে পারো না?
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
কেন করবে না বাবা? জানতে চাইলেই তো কিছু শেখার সুযোগ পাই।
নয়ন বাউরি তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে?
মিথ্যে বলব না বাবা, তা নিয়েছে। তোমাকে কিছু বলেছে নাকি? কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলতে পারো। তোমার সম্মান রাখতে যে কোনো সমাধান করে দিতে পারি।
বিষয়টা নিয়ে ও ক্লাবকে জানিয়েছিল। তা নিয়ে একটা সাধারণ সভাও হয়ে গেছে। বর্ধিত সভায় বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো মতামতও দিয়েছেন। সকলে সহমত হয়ে একটা সিদ্ধান্তও নিতে পেরেছি। তাই একটা অনুরোধ করছি, পরবর্তী মিটিং না হওয়া পর্যন্ত জোর করে ওর জমিতে দখল নিতে যাবেন না।
এ কী বলছ বাবা? টাকার বিনিময়ে যা পেয়েছি, তার উপর আমার কোনো অধিকার থাকবে না?
নয়ন তো মাসে মাসে সুদের টাকা দিয়ে যাচ্ছে।
এক অর্থে তা ঠিক বলেছ।
বর্ষার সময় তুমি ওর জমিতে চাষ করো না?
তা করি।
তারপরেও বলছ, সুদের টাকা পাচ্ছ না? চামড়া এত মোটা হয়ে গেছে পুঁটিরাম?
যুক্তিজালে ধরা পড়ে ছটফট করতে লাগল পুঁটি। বিড় বিড় করে মতিকে যা তা বলে অভিশাপ দিয়ে বলল, ঈশ্বর, এ ঢ্যামনাকে ক্যানসার দিয়ে জগৎ থেকে তুলে নাও। নয়নের জমি গেল না থাকল, তাতে ওর কী? ঢ্যামনার ব্যাটা ঢ্যামনা, গোটা এলাকাটা পুড়িয়ে খাক করে দিলে, এমনিই ছুঁচো স্বভাবের যে সব ব্যাপারে নাক গলানো চাই।
বিভাস সামন্ত বলতে বলতে ড্রইং রুমে ঢুকল, ভিতরে লোকজন ছিল বলেই আসতে দেরি হল। কিছু মনে করো না মতি, রাজনীতির নিত্য নতুন হ্যাপা নিয়ে আর পারছি নে। তারপর বলো, কেমন আছ, অনেক দিন পরে দুজনের একসঙ্গে দেখা হল, পুঁটি, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন? ওই বামপাশের চেয়ারে বসে পড়্। খুব দরকার থাকলে এখন চলে যেতে পারিস।
একটা সংবাদ দিতে এসেছিলুম স্যার। বলতে একটু সময় লাগবে। পারি তো দুপুরের দিকে আরেকবার আসব, নতুবা সন্ধের পরে।
তাহলে এখন যা, মতির সঙ্গে কথা সেরে ফেলি।
পুঁটিরাম মাথা নীচু করে ঘরের বাইরে চলে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে মতির দিকে একবার কটমট চোখে তাকিয়ে নিল। —হারামির বাচ্চা, শুধু ফুটুনি মেরে কথা বলতে শিখেছে। ক্লাবের নামে তোর লাটসাহেবি ঘোচাতে না পারি তো আমার নাম পুঁটি নয়। পুঁটিকে ঠিকমতো চিনিস নে রে। নামে পুঁটি, কাজে জাব্বা বোয়াল।
মতি এতক্ষণ বসে বসে একটু অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল, বলল, কেন ডেকেছেন বলুন?
আজকাল দেখছি ক্লাবের নামে নানা ছেলেমানুষি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলছ।
নির্দিষ্ট করে বলুন বিভাসদা। ক্লাবের কর্মকাণ্ড নিয়ে আগেও অনেকবার আপনার সঙ্গে আলোচনা করেছি। কোথাও প্রবল আপত্তি থাকলে তা পাল্টে নেব। পাবলিকের উপকারের কথা ভাবতে গিয়ে এমন কিছু করব না যা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আপনি বয়সে সিনিয়ার, দুজনের মধ্যে দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক, চোখে কিছু ভুল দেখলে বলতেই পারেন।
রায়চকের ঘটনা নিয়ে এত কিছু করতে যাচ্ছ কেন? আমাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে যে কেস ঠুকে দিলে তাতে কী এলাকার সুনাম বেড়েছে? আমি ফেল করলে তবেই কোর্ট কাছারি করতে পারতে। তা না করে—। অবশ্য যদি ভেবে থাকো যে আমার সব ভালো রেকর্ড ভেঙে দেওয়াই তোমার একমাত্র কাজ, তাহলে তো কিছুই বলার থাকে না।
এ নিয়ে একটু বুঝিয়ে বলতে পারি কী? কেস করার আগে আপনাকে জানাতে পারি নি, সেজন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছিল, তাতে হাইকোর্টে না গিয়ে উপায় ছিল কী? ওখানে যেসব লোক বসবাস করছে, বালি তুলে নিয়ে গেলে ওরা যাবে কোথায়? এতগুলো লোকের কথা তো একটু ভাবতে হবে। পিছনে পিছনে দেখছি, বালি তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ছক কষে নানান খেলা চলছে। তার পরে তো হাতপা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না।
তুমি কী কেবল আইন দিয়ে দেশের মানুষের মঙ্গল করার কথা ভাবছ? রায়চকের বালিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে সব বিরাট বিরাট বিল্ডিং গড়ে উঠছে, সেই খবরটুকু রাখবে না? তোমার কথা মেনে নিলে, কিছু লোক অবশ্যই বাস্তুচ্যুত হচ্ছে বা হবে, কিন্তু তার বিনিময়ে যে হাজার হাজার ইমারত গড়ে উঠছে, তা নিয়ে ভাববে না? দেশের আপামর মানুষের জন্যে নতুন কলকারখানা গড়ে তুলতে হলে বালির যে প্রয়োজন রয়েছে, তা কী অস্বীকার করতে পারো? যে সব হাজার হাজার শ্রমিক সেখানে কাজ করছে, তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে ভাববে না? তুমি অবশ্যই দাবি করতে পারো যে রায়চকের বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্যে বিকল্প অবস্থান তৈরি করে দিতে হবে। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই। এজন্যে কী পরামর্শ দিতে চাচ্ছ বলো? কিন্তু না-সূচক মনোভাব নিয়ে তুমি এত বড়ো কর্মযজ্ঞকে Standstill করে দিতে পারো না। তাই বলছি, আরেকটু বেশি করে ভাবো মতি। তুমি তো ক্লাব করে দেশের মানুষের উপকার করতে চাও।
বিভাসদা, আপনি কী এখনও শোনেন নি যে ওখানে আমেরিকার এক ওষুধ কোম্পানি নিজস্ব কারখানা গড়ে তুলতে চাচ্ছে। তার চেয়ে বড়ো খবর হল, ইতিমধ্যে ওই কোম্পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে পাঁচটি কারখানা তৈরি করেছিল, তার একটাও চলে নি। সেই কোম্পানি এখানে একই ধরনের কারখানা গড়ে তুললে এ দেশের মানুষের কতটা উপকার হবে, তা নিয়ে সবার আগে আপনাকেই ভাবতে হবে। আমরা কৃষিপ্রধান দেশে বসবাস করি, সেই সত্যটুকু আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। সেই কৃষিব্যবস্থাকে নির্মূল করে দেশের গরিব মানুষদের ক্ষতি করে বিদেশি কোম্পানির জন্যে কারখানা গড়ে তোলার সুযোগ করে দেওয়ার কোনো অর্থ আছে কী? রায়চকের গরিব মানুষগুলোর স্বার্থ যে এভাবে ভীষণভাবে বিগ্নিত হতে পারে, সেই ভাবনা থেকেই আমরা কোর্টের দ্বারস্ত হতে বাধ্য হয়েছি। তার আগে বিষয়টার উপর কয়েকটা সেমিনার করেছি, সেখানে কয়েকজন কৃষি বিজ্ঞানী উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা একমত হয়ে বলেছেন, জীবন ধারণের বিকল্প পথ গড়ে না তুলে এতগুলো চাষি পরিবারকে পথে বসিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
শুনতে শুনতে বিভাস সামন্ত ভিতরে ভিতরে খুব উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলেন কিন্তু বাইরে তা এতটুকু প্রকাশ করলেন না। নিজস্ব মনোভূমির অবস্থানকে ভিতরের নদীতে ডুবিয়ে রেখে অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললেন, তোমাকে সবার আগে বিদেশের উন্নত দেশগুলোর কথা ভাবতে হবে। এ দেশগুলো উন্নত, কারণ তারা শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি করতে পেরেছে। সেজন্যে ওই সব দেশে যে যথেষ্ট কৃষিভূমি নষ্ট করতে হয়েছে, তা অস্বীকার করতে পারবে? তারা যদি পারে, সেই সামর্থ অর্জনের পথে আমরা বাধা দিতে পারি কী? দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কাছে রায়চকের কয়েকটা মানুষের ব্যক্তিস্বার্থকে এভাবে বড়ো করে দেখছ কেন? তুমি ক্লাব করো, দেশের উন্নতির ভাবনা তোমার মাথায় রয়েছে, তার পরেও দেশের সার্বিক মঙ্গল নিয়ে ভাববে না?
বিভাসদা, মাফ করবেন আমাকে। কাদামাটির সঙ্গে যুক্ত মানুষরাই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। দেশ বিদেশ নিয়ে যে আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ তুলছেন, তা জেনেও কিছুতেই ওই সব চাষিভাইদের ক্ষতি হতে দেব না। একটা পাল্টা যুক্তি আপনাকে জানাতে বাধ্য হচ্ছি। হাইকোর্ট কিন্তু চাষিদের পক্ষে রায় দিয়েছে। এটা সম্ভব হল কী করে? বিচারকরা কেন বিদেশের বড়ো বড়ো কোম্পানি গড়ে তোলার উপর বিশেষ জোর দিতে পারলেন না?
বিভাস সামন্তের বুকের গভীর থেকে একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। হতাশার প্রকাশ। কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। অনেক চেষ্টা করেও মতিকে কিছুতেই মুরগি বানাতে পারলেন না। আভ্যন্তরীণ বিপন্নতার কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই। থেমে থেমে বললেন, সমস্যা কী জানো মতি, দেশের উন্নতির প্রশ্নে বিচারক থেকে আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন পথে হাঁটছি যার ফলে ঐক্যের জাল বুনে দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি নে। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে ব্যক্তি বিরোধে যাওয়া ঠিক হবে না। বিচারক যখন ভিন্ন মতামত দিতে পারেন, ভিন্ন পথে ভাবার স্বাধীনতাও তোমার আছে। সেই অর্থে তোমার সঙ্গে ফাটল তৈরি করে অসামজিকতার পরিচয় দিতে পারি না আমি। একটা নতুন প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করি, একজন বয়স্ক হাতটান মানুষ নাকি একটা মেয়েকে নিয়ে আমার এলাকায় ঢুকে পড়েছে। ইতিমধ্যে লোকটা চুরির দায়ে কয়েকজনের হাতে বাজারের মধ্যে উত্তম মধ্যম মার খেয়েছে। তুমি নাকি ওই সময় উপস্থিত ছিলে। বলতে পারবে, ওরা কোথায় বাসা ভাড়া নিয়েছে? বুড়ো চোরটাকে নজরে নজরে রাখার প্রয়োজন আছে হে। জানতে পারলে থানাতে ইনফর্ম করতে পারতুম।
বিভাসদা, লোকটা আদপে চোর নয়, ঘটনাক্রমে চুরির দায়ে জড়িয়ে পড়েছিল। পরে আসল সত্য বের হয়ে এসেছে।
তাহলে দারোগাবাবু তোমাকে এভাবে হেনস্থা করলেন কেন? একজন নতুন ওসি এসে তোমার মতো নির্ভীক ছেলেকে অপদস্ত করবে, এভাবে চলতে পারে না মতি।
থানার বড়বাবু প্রশাসন চালাতে গিয়ে যা ভেবেছেন, তাই করেছেন। শুধু বলতে পারি, সেই ভাবনার সঙ্গে আমার কোনো যোগ ছিল না। এই যেমন আলোচনা করতে গিয়ে আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারছি নে। আমি ভাবছি, শিল্পের জন্যে দেশের মানুষের বসবাসের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। আপনি ভাবছেন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমি ভাবছি, তাদের চাষ নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়োজনে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে। আপনি সেই পথ দেখতেই পাচ্ছেন না। আমি ভাবছি, রুটি রোজগারের বিকল্প অবস্থান তৈরি করার পরেই বালি তোলার প্রসঙ্গ আসতে পারে। আপনার মাথায় তা আসছে না। আমার ভাবনায়, দেশের অসহায় মানুষের কঙ্কালের উপর জোর করে অন্যের অট্টালিকা বা কারখানা তৈরির স্বপ্ন দেখা অন্যায়। এজন্যে প্রয়োজন হলে থানা ঘেরাও করা যেতে পারে, বিক্ষোভ সমাবেশ হতে পারে। আপনি নিশ্চয় সেভাবে ভাবছেন না। আমি বিশ্বাস করি, প্রসঙ্গটা আম-মানুষ গিলে খেলে জনতার শক্তি দিয়ে কয়েক গন্ডা থানাকেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। আমার স্থির বিশ্বাস তখন প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হবে।
শোনো মতি, এ নিয়ে পারস্পরিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়া একেবারে শোভনীয় নয়। তোমার কাছে আরেকটা তথ্য জানতে চাই। বুড়োর সঙ্গে ঘুরছে যে মেয়েটি, সে নাকি নতুন ওসির রক্ষিতা ছিল। অবশ্য সব শোনা কথা। এ সব নিয়ে তোমার কিছু জানা আছে কী? কোনো সংশয় থাকলে, আমাকে জানাতে পারো। তেমন হলে এখন থেকে প্রশাসনকে জানিয়ে রাখতে পারি। একজন ওসির ভরসায় তো হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। এলাকা আমার, তা সামলানোর দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে।
মতির মনোভাবে অন্য প্রসঙ্গের দৃঢ়তা প্রকাশ পেল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তাহলে কী আপনি নানা প্রসঙ্গের আলোচনায় কে কেন ওসির রক্ষিতা হয়ে ছিল, সেটাই মূলত জানতে চাচ্ছেন? কোনটা আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? রায়চক থেকে জোর করে বালি তুলে নেওয়ার ঘটনা? নাকি যে কোনো মূল্যে মেয়েটার খোঁজ পাওয়া?
বিভাস সামন্ত রাগে গরগর করতে করতে বললেন, কী বলতে চাচ্ছ তুমি? ক্লাব করো বলেই কী যা খুশি তাই বলতে পারো?
তাহলে আসছি বিভাসদা।
এমন ভাব দেখাচ্ছ, ক্লাব করে সব কিছু জেনে ফেলেছ তুমি, আমরা এসবের কিছুই বুঝি না। তারপর দাঁতে দাঁত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ঠিকমতো খোঁজখবর পেলে কত ধানে কত চাল তা বুঝিয়ে দিতে পারব। তোমার মতো দশ গন্ডা ছেলেও ইচ্ছে করলে এতটুকু সামনে আসতে পারবে না।
মতি সেসব কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কানে না শোনার ভান করে সামনে এগিয়ে চলল।
বিভাস গুম মুখে একা ড্রইংরুমে বসে বিকল্প হিসেবে পুঁটিরামের কথা ভাবতে শুরু করলেন। বিকেলে পুঁটি এলে যে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন, তা নিয়ে বিভাসের মধ্যে কোনো সন্দেহ থাকল না। হয়তো টাকা পয়সার ব্যাপারে পুঁটি একটু বেশি কৃপণ কিন্তু মতির মতো ঢ্যামনা এঁড়ে নয়। হিম খাওয়া ষাঁড়ের মতো শুধু শুধু পাহারায় থাকতে ভালোবাসে। মতিকে উদ্দেশ্য করে বিভাস গজগজ করতে করতে বললেন, ওরে ঢ্যামনা, শেষ পর্যন্ত যদি শরীরে আরাম না পেলি, কেবল পাহারায় থেকে লাভ কী?
ফেরার পথে বিভাসকে নিয়ে মতির মূল্যায়ন উপছে পড়ছে। —তবুও বিভাসবাবুরা নিজেদেরকে মডেল নেতৃত্ব হিসেবে ভাবছেন? মুখে শুধু বড়ো বড়ো কথা, সেবার নামে জীবনপণ করে লড়াইয়ের গল্প আজও শুনিয়ে যাচ্ছেন আর ভিতরে ভিতরে লুকিয়ে রেখেছেন অন্যকে বঞ্চিত করে নিজের অন্যায় ভোগের তীব্র কামনা।
দ্বিতীয় মূল্যায়ণের কথা ভাবতে গিয়ে মতি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। এতক্ষণ নিশ্চয় ক্লাবের সামনে অনেক লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। আগে ভেবে রেখেছিল, নটার মধ্যে বিলিবন্টনের কাজ শেষ করতে পারলে টিফিন দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকেই ভাবতে হচ্ছে, দূর থেকে আসা লোকগুলোকে টিফিন না খাইয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। অস্থির মন নিয়ে দ্রুতপায়ে সামনে এগিয়ে চলল।

চলবে…

এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৯)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!