নিস্তব্ধতা এসে কথা কয়

গদ্য সাহিত্যে থাকে More reality more excellence কিন্তু কবিতা হল Art of reflectionযেখানে More reflection more excellenceই শেষ কথা। প্রতিবিম্বনের কারুতে কবির প্রতীতির বুক বেয়ে মানুষের জীবন কথাকে আবিষ্কার করাই একমাত্র পাথেয়। একজন কবি তাঁর কাব্যিক রিফ্লেকশনে সমাজকে, প্রকৃতিকে, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংস্থাপনকে চিনিয়ে দিতে সক্ষম হন।। যত বেশি পারেন তত বেশি তাঁর আত্মিক শক্তিমত্তার পরিচয় মেলে।

শব্দগুচ্ছের তাৎপর্যময় বিন্যাসই হল কবিতা। সেক্ষেত্রে অলংকার শুধুমাত্র কাব্যদেহে আবির্ভূত হয়ে কবির ভাবকে মণ্ডিত করে তোলে, সার্থকতাকে গভীরতা দেয়। “নিস্তব্ধতা এসে কথা কয়” কাব্যগ্রন্থের ‘মানুষ’ কবিতায় কবির অভিব্যক্তি “প্রেমের পাঠশালায় ধরে আগুন/ দিগভ্রান্তের বাঁচার মানে খোঁজে”। শেষতম অনুভূতি, “বিভ্রান্তের আগুনে পোড়ায় মনুষ্যত্বের প্রাঞ্জল বিবেক” – অপূর্ব দ্যোতনায় ভরপুর। আবার “সবুজের স্নিগ্ধতা বদলায় জীবনের পট/কাঁকর মেশানো সুখে”- বোধের সমুন্নতি মেশানো এ কাব্যিকতা প্রকৃত আত্মিক প্রেমের ছোঁয়া লাভ করে হয়ে উঠেছে যেমন গভীর তেমনি প্রাণবন্ত। কবির মানসিক বিষাদের মধ্যে সমাজচেতনা নিখুঁত রূপচিত্র হয়ে ধরা দেয় যখন তিনি লেখেন “চেষ্টা করছি লিখতে খুবলে ওটা মাংসের কল্পচিত্র/ কীর্তিনাশা অকুলের মাঝখানে সূর্যাস্তের গল্প” আবেগময় এমনি অভিব্যক্তিতে মোহিত না হয়ে পারা যায় কি?

কবিতার বিষয় কতটা ব্যাপক কিংবা কতটা তুচ্ছ তা মূল্যায়নে এতটুকু matter করে না বরং কবি তাঁর বিষয়বস্তুকে কিভাবে আবেগদীপ্ত করে পাঠককে উপহার দিতে পেরেছেন, সেটাই প্রথম ও শেষ কথা।। ‘আঁধার’ কবিতার তুচ্ছ প্রতীতি নিয়ে কবি লিখেছেন “মৌনতার অন্ধকারে ডুবছি বলেই /ব্ল্যাকবোর্ডের ধূসরতায় না ধূসর জীবন কথা” -আসলে বাস্তবের রূপকল্প রচনায় আব্দুস সালাম অতুলনীয়। তাই লিখতে পারেন “শূন্যতা ছিঁড়ে খায় অভ্যর্থনার কেক” কিংবা ”চিত্রনাট্য বদল হলে ব্যস্ত শব্দগুলো মুখর হয়” অথবা “অপ্রাপ্তবয়স্ক ঘুম স্বপ্নের সাথে খেলা করছে” – রূপকথা রচনার যতসব অনন্য নজির।

টমাস ব্ল্যাকওয়েল, প্যারিংটন এবং সেই সঙ্গে অধুনা মার্কসবাদী সমালোচকরা কবির উদ্দীপনায় কিভাবে বস্তুবিশ্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছায়া বিস্তার করে তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। আলোচিত কবির অনুধ্যান সময়ের খেয়ালে ঢুকে তাঁর কাব্যিক অনুষঙ্গকে সার্থক করে গড়ে তুলতে পেরেছে।

কবিতায় থাকে অনুভবের বিচিত্র প্রতিফলন যা বাদ দিলে সেই কবিতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সেই অনুভবের বিচিত্র প্রতিফলন ঘটাতে কবি আব্দুস সালাম যেন অন্যতম সার্থক মাস্টারমাইন্ড হয়ে উঠতে পেরেছেন। ‘কলহবেগ’ কবিতায় “বিরহিনী খোঁজে আকাঙ্খাহীন রঙিন উষ্ণতা” অথবা “আর্যকুলে ভাসে আর্য বিরহের নিবিড় কাহিনি” – দুটি ছত্রই কি অনুভবের বিচিত্র প্রতিফলনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেনি? কবির দ্যোতনায়, ভাবচেতনায় মনন- হরনের অভিব্যক্তি ভারি চমৎকার ভাবে পরিস্ফূট যখন তিনি লেখেন “ফুটে ওঠে মন খারাপের নির্ভেজাল কবিতা”

প্লেটো লিখেছেন, চুম্বক অন্তর্নিহিত শক্তিবলে লোহার টুকরোগুলোকে যেভাবে সংহত করে তোলে, শ্রেষ্ঠ কবিতা ঠিক তেমনি দৈবীবলে প্রেরণার উৎসমূলে দাঁড়িয়ে শব্দময় জাদু তৈরি করতে পারে পাঠকের মনে। ‘সংসারযাত্রা’ কবিতায় আব্দুস সালামের কলমে সেই চুম্বকীয় আকর্ষণ ধরা পড়েছে যখন তিনি লেখেন-
“উপলব্ধির সীমানায় যুগান্তরের ঘন্টা বাজে/ক্রমশ মিশে যায় ধূসর বালিয়াড়ির আহবানে।”

কবিতাতে শব্দচয়ন, ভাবগত অনুভূতিতে সমুন্নতি প্রদান, চরাচরকে জীবনের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ কিংবা যুগান্তরের ঘন্টায় চুম্বকীয় আকর্ষণ সৃষ্টি -সবই কবির কাছে নিজস্ব স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের নিজস্ব চেতনা হয়ে উঠেছে। চিচেরো বলেছেন, দৈবীপ্রেরণা ছাড়া কেউ মহৎ কবি হতে পারেন না।। হোমার বলেছেন, তিনিও দৈবীপ্রেরণার উপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। সেক্সপিয়ার লিখেছেন- The poet.s eye in a frenzy rolling /doth glance from heaven to earth, from earth to heaven. আসলে কাব্যসাধনায় যে প্রেরণা মূল ফলশ্রুতি হিসেবে ধরা দেয় তা কবির নিঃসঙ্গতার গভীর ধ্যানে লাভ করা সম্ভব। কবি আবদুস সালামের কাব্যিক অভিব্যক্তি কি সেই দিকেই ছুটছে? বোধহয় অনাগত ভবিষ্যৎ তা অনেক বেশি নিশ্চিত করে বলতে পারবে।
কবিতা ছিল আমারও প্রথম প্রেম, পরে গদ্য সাহিত্যে নিজের বিচরণকে যৎসামান্য সাবলীল করে তুলতে পেরেছি কিন্তু আজও ভুলিনি আমার প্রথম প্রেমের ভালবাসাকে। সেই ভালোবাসায় ঋদ্ধ হতে হতে কেবল ভাবছি, কবি আবদুস সালাম এর দুর্গম কাব্যিক যাত্রাপথ Bliss of solitude এর আলোয় আরও সার্থকতায় ভরে উঠুক।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!