পরব ভাঙা হাটের হাটুরে ৪

।।শেষ পর্ব।।

হাটের নানা রূপের আরেকটি রূপ- মারামারি। কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই মারামারি কিংবা খুবই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি। কোন কিছু বুঝবার আগেই ধর ধর মার মার কাট কাট মারামারি। মাথা ফাটাফাটি মারামারি। রক্তারক্তিতে সয়লাব হাটের প্রান্তর। যোগানিয়া বনাম গড়কান্দা অথবা গোবিন্দ নগর বনাম গড়কান্দা। ঝগড়া ব্যক্তিগত পরিসর থেকে শুরু হয় শেষ পর্যন্ত নামটা গ্রামের সাথে জড়িয়ে যায়।

স্বাজাত্য বোধের মতো গ্রামবোধে সংক্রামিত হওয়া। সকলকে একে বোধের জারিত করা। অপরকে ঘায়েল করার জন্য এক বোধে জারিত হবার তাড়নাই থেকে গ্রামের নাম জড়িয়ে যায়। ফিবছর এই ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। যে কোন মঙ্গলবার হাটে শুরু হতে পারে তবে সেদিনই শেষ হতো না। সিরিজ খেলার মতো কয়েকটি মঙ্গলবারের হাটে জের লেগে লাগত। যতক্ষণ না মনে আঁশ না মেটে। প্রতিপক্ষের মাথা ফেটে চৌচির না হচ্ছে ততক্ষণ চলে। ধাপে ধাপে চলে।খুনোখুনি পর্যন্ত চলে…

উত্তর-দক্ষিণে বরাবর রাস্তা পূর্ব পাশে পর পর চালাঘর– দোচালাও আছে কিছু। এখানে ক্যাঁচিদের কোরাস একটু বেশি। অনাহাটবারের চেয়ে হাটবারেই বেশি চুল দাড়ি কাটাবার ব্যস্ততা। আবার নিচে টুল পেতে বসেন কেউ কেউ। মন্টু শীল তাদের একজন।আমাদের শৈশবের হেয়ারড্রেসার।এখানে এই নীচেই তিনি বসতেন। দুই হাটুর ফাঁকে আমাদের ছোট্ট মাথা চাপটে ধরে ক্যাচ ক্যাচ করে বাটি ছা্ট দিয়ে দিতেন মন্টু শীল। তার হাটুর ঘামের বোটকা গন্ধ আমার তখন জীবন জেরবার হয়ে ওঠে। আহা! কবে যে বড় আয়নাঅলা উঁচু চেয়ারে বসে চুল কাটাবো?

লাঠিখেলা নেই– নেই মানে খেলোয়ার নেই– তাই মাঠ কাঁপানো লাঠিখেলাও নেই। আর খেলাবার পরিসরও ছোট হয়ে আসছে যেমন তেমনি জন-আগ্রহও শূন্যের কোঠায়। একবার তারাগঞ্জ হাটে লাঠিখেলা দেখেছিলাম– সেই একবারই। কিছুদিন আগে বয়ড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়েছিলাম লাঠিখেলা দেখতে। রেজ্জাক মিয়া ও তাঁর দলের লাঠি খেলা দেখতে। সাপমারি গ্রামের রেজ্জাক মিয়াই শেষ প্রজন্ম। তার বাবা লাঠি খেলতেন— জেঠাও। রেজ্জাক মিয়ার বয়স সত্তুর পেরিয়েছে।
তাঁর ছেলেরা খেলেন না। বরং বাপের খেলায় ঘোর আপত্তি। তবু রেজ্জাক মিয়া খেলেন পাঁচ হাতি লাঠির খেলা। ঢোল আর কাঁসরের তালে তালে প্রতিযোগির উপর হামলে পড়েন। সত্যি সত্যি নয়– মিথ্যে গল্পের হামলা।এই হামলা ঢোল আর কাঁসরের তালে তালে তালে রেখে হামলা। ঢোলে তাল বেতাল হয়ে গেলেই সব্বনাশ।
লাঠির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয় প্রতিযোগী। মাথার উপর দিয়ে লাঠির চক্কর ও হামলা আর প্রতি-হামলা ঢোল কা়ঁসরের তালে বাঁধা। তাকেই লাঠিয়ালরা বলেন ‘বয়ান’– বয়ান যত নিঁখুত খেলাও তত নিঁখুত। লাঠি খেলার সাথে ছিল পাজন খেলা রাম দা খেলা আর কাঁসার থালা নিয়ে বাজনার তালে তালে নানা কসরত।

‘লাঠি খেলা আমরা ছোটবেলায় দেখেছি’ প্রদীপ দেবনাথ সেদিন নানা কথা প্রসঙ্গে লাঠিখেলার কথা বললেন।’ মহরম মাস উপলক্ষে গড়কান্দার কিছু পরিচিত মুখ সৌখিন লাঠিয়াল বাজারের খালি জায়গায় লাঠি খেলা প্রদর্শন করতেন। তখন লাঠিয়াল মনু মিয়াকে চিনতাম। দোকানে দোকানে গিয়ে সদগা তুলতেন। লাল সালুতে ঢাকা বড় থালায় ভরে উঠত দোকানি আর হাটুরেদের দেয়া নানা সদগায়। সাথে থাকত ঢাক ঢোল আর ঝাঁঝর আর তেকোনা পতাকা।

আমাদের সময়ের আরো দুই নায়ক ছিলেন। একজন গনেশ দা। অন্যজন কালী দা। একটা পুরান সাইকেলের পেছন কেরিয়ারে বাঁধা আইসক্রীম বাক্স নিয়ে একবার হাটের এই মাথায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াতো; পরক্ষণেই অন্যমাথায়। রঙিন আইসক্রিম কাঠি ধরে চাটতে চাটতে রঙিন হয়ে উঠত আমাদের জিভ– আমাদের শৈশব। মালাই আইসক্রীমের আগার দিকে নারকেলের প্রলেপ থাকতো– দাম একটু বেশি। এক টাকা। সব সময় কিনতে পারতাম না। হাটের দিনে তাদের গলা উঁচিয়ে.. এ্যাই আইস ক্রিম… অ্যাই আাইস ক্রিম… শুনলেই তেষ্টা পেয়ে যেতো। এক্কেবারে জন্মের তেষ্টা।

হাটের ব্যস্ততা ত্রস্ততা শুধু কালী দা বা গণেশ দাই বাড়াতো তা কিন্ত নয়।আরো ছিল গোলাপি রঙের হাওয়াইমিঠাই। অথবা ছিক্কা বাইনের ডুলিতে রাখা সম্পাপড়ি বা কটকটি হাটুরেদের আর্কষণ না করলেও হাটুরেদের সাথে আসা পোলানের জিভে জল আসতই। আলা জিভ লকলক করত।যেমনটি বড়দের চোখ থাকত পানের দোকানের দিকে। তামাক গুড়া আর লালী দিয়ে মিশ্রিত তামাকের দিকে। হাতের কারসাজিতে শক্ত মোয়ার মতো হয়ে যেতো তামাক।

তামাক ঢলা একটি চমৎকার কায়দা। লালী আর তামাকচূর্ণে মিশিয়ে দু’হাতের ঢলাতে বেশ কালচে রঙ ধারন করে। তরল সুগন্ধিও মেশায়।অতিথি সৎকারের জন্য মাখা তামাক প্রয়োজন। হুক্কা গুড়গুড় করে না টানলে খাওয়াই অপূর্ণ থাকে। গোটা তিনেক হুক্কা কলকির দোকান এই ছোট বা বড় হাটবারেই ঝাপ খুলে। নইলে বন্ধই থাকে।

আটের শুরুতে সবে ৩০ নং রশিদা বিড়ি বাজারে ঢুকছে। অন্যদিকে মান্না বিড়ি সরে সরে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের ঝোঁক রশিদার দিকে। দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছ। টাকা আমদানি হচ্ছে। দু’টিই শেরপুরের প্রোডাক্ট। রশিদার বিজ্ঞাপন তখন চারদিকে ছেয়ে যাচ্ছে। মাইকিং হচ্ছে। টিনের বেড়ায় পোস্টার সাঁটিয়ে দিচ্ছে।
”সুখ টানে সুখ পাই।
তাই আমি রশিদা চাই।”

এমন নানা কিসিমের বিজ্ঞাপনের ঘোষণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রান্তিক মানুষ বিড়ি-ই টানে। ’কুছে’ তিন ঘোড় ম্যাচ আর কানে গোঁজা বিড়ি-ই তার ফুয়েল। বিড়ি ছাড়াও পাইলট বৃস্টল স্টার সিজার অনেকেই টানে— টানতে টানতে কাজ কারবার করে। সোনালি রঙের ফাইভ ফিফ্টি ফাইভ বা কড়া লাল রঙের প্যাকেটের গোল্ড লিফ একটু দামী–কেউ কেউ টানে ।গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।দোকানদারকে হাটকে কেন্দ্র করেই চলতিমাল মজুত রাখতে হয়। রাখেও বটে। তারাগঞ্জ বাজার হাটে স্থায়ী পাইকারি দোকানে বিড়ি সিগারেট মজুত করে রাখে।বাকিরা খুচরা বিক্রিতা। হাটের ভীড় দুই জায়গায়ই একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।

তখন শুধু ৩০নং রশিদা বিড়ির বিজ্ঞাপন নয়–রাস্তার মোড়ে টিনের বেড়ায় সিনেমার পোস্টারের বিজ্ঞাপন আমাদের আর্কষণ। ”আসিতেছে’’ মাহমুদ কলি অভিনীত ‘টক্কর’ বা নায়ক রাজ রাজ্জাকের ‘বদনাম’ মুভির পোস্টার। গত সপ্তাহে হাউজফুল ছিল “চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা” ওয়াসিম অভিনীত। হাটকে মাথায় রেখেই নতুন ছবির আগমন। মফস্বলের একমাত্র বিনোদন সিনেমা হল— আমার মফস্বলে দুটি হল– একটি মা সিনেমা হল অন্য রূপালি সিনেমা হল। মেটিনি শোয়েই হাউজফুল। এই হাটুরেদের সিনেমা দেখা। আমোদিত হওয়া। আপ্লুত হওয়া। সওদা কেনাকাটার পর মর্নিং শো অথবা মেটেনি শো দেখে বাড়ি ফেরা।

মফস্বলবাসী আনন্দ বিনোদন সেই সময়ে এই সিনেমা হলই একমাত্র ভরসা। তবে মাঝে মাঝে সিনোর যুক্ত হতো নতুন নতুন অনুষঙ্গ। তবে কালে ভদ্রে হলে কি হবে, মফস্বলবাসি ও তার হাটুরেদেরকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। এই যেমন গত শতকের সাতের দশকের শেষের দিকে সম্ভবত ১৯৭৮/৭৯ সাল হবে বৈকি। পুরো হাট কাঁপিয়ে সেবার শুরু হলো সাইকেল সার্কাস। শহীদ মিনার মাঠে বসল সেই সার্কাস। মস্ত তাঁবু টানিয়ে একটা টাকা টিকেটে সেই সাইকেল সার্কাস দেখছে।

অনাহাটবারে ভীড় কম হলেও হাটবারের দিন মানুষের মাথা মানুষ খায়।কেরামত আলী সেই যে সাইকেলে উঠেছে আর নামছে না। পনেরো দিন হয়ে গেলো। সাইকেল থেকে নামছে না। সাইকেলে খায়। সাইকেলে স্নান করে। সাইকেলে মুতে। সাইকেলে হাগু করে– এমন কী সাইকেলে বসে তাঁবুর কেন্দ্রস্থ বাঁশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে নেয় একটু। তার সাইকেলের নানা কসরত কেউ দেখল না দেখল তাতে কেরামত আলির কোন নজর নেই—গোল বৃ্ত্তের মাঝে কেরামত আলি শুধু সাইকেলে ঘুরছে আর ঘুরছে আর ঘুরছে— কেবলই ঘুরছে। সাইকেলে বসে হাসছে। হাত নাড়ছে। জামা খুলছে। গেঞ্জি খুলছে। সামনের ক্যারিয়ারে পা রেখে বুট জুতার ফিতে লাগাচ্ছে। নানা কসরত দেখতে দেখতে হাটুরে দর্শক হেসে লুটিয়ে পড়ছে একের উপরে আরেকজন। কেরামত আলির একক সাইকেল সার্কাস একমাস ব্যাপী চলেছিল।

সাইকেল সার্কাসের গল্প থিতু হতে না হতেই হাতি ঘোড়া খচ্চার বাঘ ভাল্লুক আর এক দল বামন মানুষের দল নিয়ে হাজির ‘দি নিউ রওশন সার্কাস।’ সে কি উত্তেজনা! গমগম করা হাটের মাঝে গোটা পাঁচেক বামন মানুষ রণ পায়ে এতো এতো ভীড়ের মাঝে কী দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে তাদের রঙিন পোশাক। মানুষের মাথা ছাড়িয়ে রণ পায়ে হেটে হেটে বিজ্ঞাপিত করছে হাটের হাটুরেদেরকে। মাইকেও ঘোষণা দিচ্ছে আগামী মঙ্গলবার মানে বড় হাটের দিনেই শুভ উদ্বোধন।

রওশন সার্কাস আমাদের এলাকায় তাবু ফেলার আগে অবশ্য টগবগ শব্দ আমি কানে শুনিনি। আটের দশকের গোড়ার দিকে রওশন সার্কাস আমাদের এলাকায় এলো। কী সাজ সাজ উত্তেজনা। অগ্রায়হনের ধান কাটার পর পতিত জমিতেই আকাশ সমান উঁচু করে অনেক বড় জায়গা নিয়ে লাল রঙের ত্রিপলের ছাদ হলো। সেখানে নানা রঙের নানা সাইজের ঘোড়া মাথা নিচু করে গামলায় জলে খৈলে মিশানো খাবার খাচ্ছে। রেলিঙের এপাশ থেকে বন্ধুদের সাথে আমিও দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে।

ঘোড়ার খাবারের পরই একেক জন সাওয়ার হয়ে রাস্তায় নামে। সবাইকে দেখাতে সবাইকে জানাতে– দেখ, দেখো গো, আমরা এসেছি, আমরা এসেছি। চলে এসো সার্কাস মাঠেবিজ্ঞানের। তখনই টগবগ শব্দটি কানে এলো। মাইকম্যানের ঘোষণায়। এমনি আমাদের মফস্বল শহরের ইটের সলিং করা রাস্তায় গোটা দশেক ঘোড়া লাফাতে লাফাতে চলছে এই মাথা থেকে অন্য মাথা। দুই পাশে নানা বয়সের মানুষজন। তাগড়া ঘোড়া টগবগিয়ে চলছে খুরের আঘাতে আঘাতে। এর আগে এতোগুলো তাগড়া ঘোড়া আমার মফস্বল দেখেনি। টগবগের শব্দের সাথে আমরা শিখলাম চিঁচিঁ চিঁচিঁ ডেকে ওঠা তাগড়া ঘোড়ার ফুলে ওঠা কেশর। লাল কালচে লোমে ঢাকা ঘোড়া পিঠ আমাদের মাথাকে ছাড়িয়ে গেছে; গোড়ালি উঁচু করেই তবে ঘোড়া পিঠে পাতা ঝালরযুক্ত আসন ঝুলে পেটের নীচে চলে এসেছে। মাস দুই চলল সেই রওশন সার্কাসের দড়ি উপর দিয়ে হা্টা। জ্বলন্ত রিঙের ভিতর দিয়ে লাফ দিয়ে এপাড় ওপাড় করা। আর বান্দরের বাঁদরামী আর বামনদের নানা কায়কারবার তখন তো হাটুরেদের মুখে মুখে। অনাহাটবার আর হাটবারগুলো শীতের মাঝেও উত্তাপ ছড়িয়ে রাখল দি নিউ রওশন সার্কাস।

এইগুলো মফস্বল মানুষের বিনোদনের উৎস। নানা স্মৃতি ও কথকতা ছড়িয়ে থাকে মানুষের মাঝে। এক ঘেয়ে মফস্বল যাপনের এইসব পরশ হাটুরেদের মাঝে দাগ রেখে যায়। তারা মুখিয়ে থাকে। হাটের কেনাবেচে আছে থাক– সারা বছরই করতে হয়। এই সওদা আনো তো আরেকদিন আরেক সওদা আনো। তাই খানেক পরশে মফস্বল উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আটের দশকের মাঝামাঝিতে বসলো হাউজি ও যাত্রাপালার আসর– কলেজের ফাণ্ড রাইজিঙের জন্য আয়োজন।

আমরা মৃত্যুকুপে মটর সাইকেল চালানো দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। প্রচলিত কথা— যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে— উড়িয়ে দিয়ে রাত ব্যাপী চলল যাত্রা। বাসন্তী অপেরার যাত্রা গৌরিপুরের নবারুণ অপেরার যাত্রা। কোন রাতে গুনাই বিবি কোন রাতে সাত ভাই চম্পা অথবা দাতা হাতেম তাঈ। আর বলা ভালো উদ্দাম নৃত্য ছিলোই প্রধান আর্কষণ– যে ভাবে মিলন দে মাইকে ঘোষনা করতেন হাটের মাঝে রিক্সায় ঘুরতে ঘুরতে, “এক ঝাঁক ডানাকাটা পরীর মর্ত্যে স্বর্গীয় নৃত্য।”

বিকেল থেকেই একদিকে মানুষের ভীড় বাড়ে আর ওদিকে হাট ভাঙতে শুরু করে।রঙিন আলোয় ঝকমকে হাউজি গ্রাউন্ড। টুইটুম্বর চারদিকে। মঞ্চে বসে চলছে রাউন্ড ঘুরানো। চলছে ডাক….
প্রদর্শনীর গেইট নাম্বর এইট।
উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন নাম্বর টেন
উল্টা পাল্টা সিক্স এন্ড নাইন সিক্সটি নাইন

এতো এতো মানুষের ভীড়ে নীরবে চলছে হাউজি খেলা। ডাক উঠছে আর দশ টাকা করে কেনা শীটে মিলিয়ে কাটছে সংখ্যা। মিলে গেলেই চিৎকার করে বলছে ইয়েস। এই ইয়েস এই প্রাপ্তি হাটুরেদের প্রাপ্তি। হাউজি খেলার নেশার প্রাপ্তি। এমন কী রাতের অন্ধকারে যে সর্বশান্ত হাটুরে সেটাও তার প্রাপ্তি।

হাটুরেদের কায়কারবার অন্ধকার নামার আগেই শেষ করতে চাইলেও পারেন না। নানা কারণেই দেরি হয়ে যায়। তখন হুট করে সন্ধ্যা নামে।দোকানে দোকানে তখনো বিদ্যুৎ সংযুক্ত হয় নি। তখনো হ্যারিক্যান। তখন হ্যাজাক বাতি। ম্যান্টেল উত্তপ্ত হলেই তবে সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ে। পাম্প করে করেই ম্যান্টেলে তেলের বাষ্প চলে যাবার কারণেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত হ্যাজাক বাতি। আর যাদের রাস্তার পাশে চলার পথে ছালা বিছিয়ে দোকানের পসরা সাজাতেন অন্ধকার নামলে তাদের কুপি কিংবা ‘ভোগা বাতি’ ভরসা। ভোগা বাতির জ্বলজ্বলে আগুনের শিখা কিংবা হ্যারিকেনে হলুদ মায়াবী আলোয় সন্ধ্যায় ভেঙে যাওয়া হাটকে ও হাটের হাটুরকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হতো। বাড়ি ফেরার তাড়ায় বিষণ্ণতার পর্দা আলো-আঁধারিতে ক্রমেই দুলে উঠল আস্তে আস্তে।

হাটের শরীরে কত রূপ কত স্মৃতি। নানা হাটুরের নানা কথকতা। এমন বারোয়ারী মেলায় বার রকমের কথা হাটের ভিতর থেকেই ওঠে। হাটেই মিলিয়ে যায়। কিছু কথা থেকে যায় মানুষের স্মৃতিতে। ১৯৭১ সালে শেষ চৈত্রের এক মঙ্গলবার হাটে দোকানের ঝাপ না খুলেই গাট্টি বোঁচকা নিয়ে পালাতে হয়েছিল উত্তরে দিকে। খোলা সীমান্তদ্বারের দিকে। ডালু নাকুগাও রোড ধরে বারেঙ্গা পাড়ার দিকে।

মঙ্গলবারে সেদিন হাট হয়নি। সকালেই হাট শেষ। জানমাল নিয়ে পালাচ্ছে সবাই। এই বুঝি চলে এলো মিলিটারি। সারারাত কারো ঘুম হয়নি।সারারাত গুলাগুলি হয়েছে। সেই ভয়েই পেছনে পড়ে থাকল মানুষজনহীন ঘরবাড়ি দোকান পাঠ। হাট বাজার। হিসাবের খাতা। শূন্য ক্যাশবাক্স।

আর ক’দিন পরেই হালখাতা। নিজের পাওনা টাকা আর দেনার টাকা দেবার মধ্য দিয়ে নতুন হালখাতা। সে বছর আর হালখাতা হয়নি। হাট বসে নি বৈশাখ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত। বিরানই ছিল। কেউ কেউ হাটুরে ছিল বটে। হাটের শরীর ফুলে ফেঁপে ওঠেনি।

আমি এ কালের পরব ভাঙা হাটের হাটুরে। এবারের বিরান পুঁজির দাপটের বিরান। স্থানিকের রূপ রস–সব কিছুর গণিত সে পাল্টে দিয়েছে।পাল্টিয়ে দিতে হয়। পু্জির তো জড়ো হবার চেয়ে ছড়িয়ে পড়ার দিকে ঝোঁক। যেমন কাল তেমন টাল— তেমনি তাল। হয়েছেও বটে। তবুও কান পাতলে কত কথা কানে আসে।

১৯৭১ সালে অনাহাটবার ছিল আট নয় মাস। তারও আগে বারেক দুইবার এমন ঘটনা ঘটে ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজন রেখা আঁকার সময়ে।ধান পাট সরিষা বা মুদি পাইকারি দোকানদারেরা একদিন সকালে হাওয়া হয়ে গেলেন। চুপিচুপি পালিয়ে গেলেন। ঘরের দরজা হা-করে খোলা রইল। পড়শির পাশে পড়শি নিয়ে যাপনে কোনো কোনো পড়শি নেই। চলে গেছে। ওপাড়ে চলে গেছে।ভোর রাতে। সে বছর হাটুরেদের বুক কোলাকুলির হাটবার। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বলে,’কত্তা আর দেহা অইব, না? সকলেই চলে যাবেন?’

একে একে চলে গেলেন অনেকেই। যারা আগে থেকেই ওপাড়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তারাই আগে চম্পট দিলেন। পেছনে পড়ে থাকল গদিঘর চৌচালা গুদামঘর। বসত আাড়ি। ইস্টদেবতার ঘর। পাকের ঘর।ঢেঁকিঘর আর গোল বৃত্তের মাঝে পাতকুয়া। পরিচিত পরিসরে গোছানো সংসার ব্যবসায় বাণিজ্যে অপরের সাথে চলবার বসবার স্থান ফেলে তারা চলে গেলেন। সব–ই চলছে। শুধু গত কালকের লোকটি নেই। আর কি আর কখনো ফিরবেন এই নাড়ী পোঁতাশ্রায়ে? কে জানে?

না— নালিতাবাড়িত কোনদিন রায়ট হয়নি। যে অর্থে রায়টকে আমরা বুঝি। এই তল্লাটে ১৯৪৫-৪৬ সাল থেকেই দুটি ধর্মমতের মানুষের ফারাক হতে থাকে। ভীত মাটি আলগা হতে শুরু করে। সকলের সামনে। অথচ কেউ কাকে কিছু বলে না। মনের দূরত্ব বেড়ে গেলে কি আর গায়ের সাথে গা লাগিয়ে থাকা যায়? গোপনে ভাঙতে থাকে সব। ঐ যে বলছিলাম যেমন কাল তেমন টাল তেমনি তার তাল। রায়টের ভীতি— একটা চাপ অজানা অচেনা ভয় মনোজগতে বিরাজ করছিল। ভিতর ভিতর সন্ত্রস্ত হচ্ছিল।কী জানি কী হয়… কী জানি কী হয়।
“দাদা— আপনারাও কী চইল্লা যাবেন?
—এখনও ভাবি নাই, ক্যান?
ওপাড়ের ওমুক চইল্লা গেলো।
আমারে কইয়েন। আমি আগায়া দিমুনি।”

১৯৪৯ এপ্রিলের কোন সোমবার এই রায়টের মনোজাগতিক ভয় চরমে ওঠেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় নালিতাবাড়ী বন্দরের সকল হিন্দু একত্রিত হয়েছিল শের মাহমুদ সরকারের পাকা গুদাম ঘরে। সেদিন রাতে তিনি নিরাপত্তার বলয় দিয়েছিলেন। পরদিন হাটবার। হাটুরেদের হাটবার নানা প্রস্তুতি আগের দিন থেকেই শুরু হয়। শুরু করতে হয়। সোমবার সকাল থেকেই আকাশে বাতাসে ছড়াচ্ছে রায়ট লেগে গেছে রায়ট লেগে গেছে। ছড়িয়ে দেয়া ভয় নিয়ে সারারাত সরকার সাহেবের গুদাম ঘরে রাত্রি বাস—পরিবার পরিজন নিয়ে। পরদিনের হাট কি বসেছিল? বিক্রেতা হাটুরেরা কি বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মিতে মন দিতে পরেছিল?

আমি জানি না। সে হাটের হাটুরে আমি ছিলাম না। হাতবাহিত পণ্যের কথকতা যেমন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৯ ঘটনা তেমনই ছড়িয়ে থাকে স্মৃতিতে শ্রুতিতে। হাট একটি জাদুর বাক্স। একের পর এক এক করে গল্প বেরিয়ে আসে। গল্পের শেষে নেই। এই হাটের এক হাটুরে গানপাখির কথা বলেই বন্ধ করে দেই আমার কালের জাদুর বাক্স। অন্য কেউ অন্য কোন পরব ভাঙা হাটের হাটুরে খুলবেন তার সময়ের জাদুর বাক্স।

শুকলাল সরকার আমাদের মফস্বলের গানের পাখি। নিজের গরজে নিজেই গানকে ভালোবেসে নিজেরই আনন্দে একাই গেয়ে ওঠেন গান।হাটের দিন তো বটেই অনাহাটবারে যখন বাজার বিরান মাঠ। কারো কোন তাড়া নেই। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গান গেয়ে ওঠেন শুকলাল। মনের সুখই বড় সুখ। এই সুখের গরজেই শুকলাল দা গেয়ে ওঠেন ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো আমি তো আর নেই কারো’। অথবা এই তল্লাটেরই গীতিকার মোস্তাক হাবিবের লেখা আর শিল্পী মাহদুন্নবী গাওয়া গানঃ
কাঁচ কাটা হীরে নয়
হীরামন পাখি নয়
শুধু একটি মন আমি চাই
বল কে দেবে আমায়…

শুকলাল দার হাঁটার ভঙিমা দারুণ। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বাম হাত পেছন দিকে ঘুরিয়ে ডান হাতের কব্জি আঁকড়ে ধরে খুবই ধীর পায়ে গান গাইতে গাইতে হাঁটেন। এখনো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এই দৃশ্য।শুকলাল দা এভাবে হেঁটে হেঁটে কোথায় যান? সেটা হাটুরেরা জানতেও চায় না। শুধু আমার মতো হাটুরেরা কানখাড়া করে কান পেতে শুনে সময়ের জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার গান।

পরব ভাঙা হাটে হাঁটতে হাঁটতে আমি পুরাতন একজন হাটুরে আজও চোখ বুঝে শুনতে পাই শুকলাল দা গাইছে, ”পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না… ওকে গাইতে দাও… ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ে নিও না…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!