পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর ৩

।।তিন।।

ঠিক এর বিপরীতে যারা মাতৃতান্ত্রিক ইতিহাসের মঙ্গলময় দিক সম্পর্কে অতিরিক্ত আস্থাশীল তারা পিতৃতান্ত্রিকতাকে মানব সভ্যতার একটি মধ্যবর্তী অপসৃয়মান সময় বলে মনে করে এবং মানব সমাজের ভবিষ্যতকে মাতৃতান্ত্রিকতায় শ্রীমণ্ডিত হতে দেখে।

মাতৃতান্ত্রিক এই চিন্তাধারা নারীকে পুরুষের থেকে রূপে ও গুণে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। পুরুষতন্ত্রের উদ্ভবে স্ত্রীজাতির সাময়িক পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু ক্রমশঃ শিক্ষাদীক্ষা চেতনার বিকাশের মধ্যে দিয়ে স্ত্রীজাতি আবার তার কর্তৃত্ব স্থাপন করবে। মানব সভ্যতায় হিংসা, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতি পুরুষ তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সৃষ্টি করেছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এ সব ছিল অজ্ঞাত। প্রাচীন বহু সভ্যতা দেখা গেছে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে চলতেই ধ্বংস হয়ে গেছে নানা কারণে। অনেক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষতন্ত্রের উত্থানের ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে। মেসোপটেমিয়ায় উর প্রভৃতি সভ্যতার খননকার্যের মধ্যে দিয়ে পাওয়া না, ধ্বংসাবশেষ কোন দুর্গ বা ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান। তা থেকে বলা হয় ঐ সময় কল্যাণময়ী নারী শাসন বিরাজমান ছিল।

পুরুষের এই উত্থানের পিছনের কারণ ও তার সঙ্গে হিংসা, যুদ্ধ ও যৌন আক্রোশের সংযোগকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়ে থাকে, স্ত্রী আধিপত্যে নারীশাসনে যে সমস্ত পুরুষ নানা অপরাধে নির্বাসিত হত, যৌন অক্ষমতায় যে সমস্ত পুরুষ ধিকৃত হত- তারা দেশান্তরে গিয়ে বর্বর যাযাবর জাতির সঙ্গে মিলে হিংস্র প্রতিহিংসায় সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন সভ্যতাকে আক্রমণ করেছে। তীব্র আক্রোশে পুরুষেরা যখন কোন অঞ্চলে জয়লাভ করেছে, তখন তারা হয়ে উঠেছে নারী-বিদ্বেষী। একদিকে তারা হিংসা ও যুদ্ধকে এনেছে, অন্যদিকে তারা নারী প্রতি ঘৃণাকে জাগ্রত করেছে, পরিপোষণ করেছে এবং নিয়মবদ্ধ করেছে। লিঙ্গপূজার প্রচলন হল চরম নারী বিদ্বেষীর আত্মতুষ্টি সাধনের এক বিকৃত উপায়।

আরও পড়ুন: পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর ২ 

সব দেশেই দেখা যায়, পুরাণে কথিত হয়েছে যে একদিন ছিল স্বর্ণযুগ। ছিল না হিংসা। ছিল না হানাহানি। গ্রীক, রোমান, ভারতীয়, পলিনেশিয়, রেড ইন্ডিয়ান প্রভৃতি সব জাতির পুরাণেই একথা লিখিত আছে। এই স্বর্ণযুগকে মাতৃতান্ত্রিক চিন্তাধারায় মাতৃতান্ত্রিক কল্যাণী রাষ্ট্র বলে মনে করা হয়। সেই
দিনগুলো পুরুষতন্ত্রের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে।

একদিনে পুরুষতন্ত্রকে গোটা সমাজ মেনে নেয় নি। তাই দীর্ঘকাল নারী প্রাধান্য নানা ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দীর্ঘকাল বহু প্রাচীন সমাজে পুরুষ পুরোহিতদের নারীর পোষাক পরতে দেখা গেছে। এমন কি বুকে কৃত্রিম স্তন ধারণও পোষাকের অঙ্গ ছিল কোথাও কোথাও। অনেক প্রাচীন মূর্তিতে এমন দেখা যায়। কঙ্গো, তাহিতিতে এবং রেড ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল। গোল্ডেনবাউ-গ্রন্থে এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলি নারী প্রাধান্যাকে প্রথাগত ভাবে বহন করে চলার ইঙ্গিত।

চরম মাতৃকর্তৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গী কতকগুলি শব্দ যা ক্লীবলিঙ্গ হলেও, তার স্বরূপে নারীত্বকে প্রতিষ্ঠা করে সেই সব গুণের সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক সময়ের শান্তির প্রতীকের কথা তুলে ধরে- যেমন-শান্তি, শ্রী, বিচার, তিতিক্ষা, প্রজ্ঞা, উদারতা, স্বাধীনতা, দয়া, ক্ষমা, মুক্তি, মিলন, নম্রতা, সাধুতা প্রভৃতি। এই সব শব্দের মধ্যেই একটা নারী সুলভ স্নিগ্ধতা, নমনীয়তা, সৌম্যতা লক্ষ্য করা যায়। ভবিষ্যৎ মানব সমাজকে ও শ্রীমণ্ডিত হতে হলে শান্তি সুখের আগর হতে হলে মাতৃতান্ত্রিকতায় ফিরে যেতে হবে।

মাতৃতান্ত্রিকতার পরাজয় সুতরাং মানব সমাজের সুখ-শান্তির পরাজয়। নারীকে পদদলিত করে রাখার জন্যই পুরুষতন্ত্র এত উদগ্র পথ ধরেছে। রোমান সেনেটর কাটো এই অবস্থাটাই সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন তার আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে, মেয়েরা ক্ষমতা লাভ করলেই তোমার প্রভু হয়ে উঠবে এবং তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসাবে স্থান গ্রহণ করবে। অতএব মেয়েদের শিক্ষা দিও না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতার ফল হিসাবেই মাতৃতান্ত্রিক ইতিহাস ধ্বংস হয়ে গেছে।

মাতৃধারাকে ঐতিহাসিক ভাবে গ্রহণ করে তা থেকে পুরুষতন্ত্রের উদ্ভব এবং বিজ্ঞানসম্মত বিকাশের পথ ধরে নারী-পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি হল সব থেকে সবল ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি।

ম্যাক্সমূলার পৌরাণিক ঘ্রাণ থেকে মাতৃতান্ত্রিকতার রেশ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি মাতৃতান্ত্রিকতাকে আঁচ করেই বলেছিলেন, এমন সমাজ ছিল কিন্তু তা ধ্বসে হয়ে গেছে। বেকফেনি মাতৃতান্ত্রিকতার কথা সোচ্চারে বলবার চেষ্টা করেন।

মাতৃতান্ত্রিকতার ধারণা ও মাতৃঅধিকারের পরাজয়ের ভিতর দিয়ে পিতৃতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা সব থেকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন এঙ্গেলস। মর্গানের প্রাচীন জাতিগুলোর বর্ণনা এবং বেকফেনের সুত্রায়নকে অবলম্বন করে মাতৃতন্ত্র থেকে পিতৃতন্ত্র উদ্ভবের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ধারণ করেন তিনি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাজকে দেখার এই প্রয়াস স্বভাবতই মাতৃতন্ত্র থেকে সামাজিক কারণে পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব এবং সামাজিক কার্যকারণের গতিতেই পিতৃতন্ত্রের অবসান হয়ে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশ করে।

সর্বশেষ অর্থাৎ পঞ্চম দৃষ্টিভঙ্গি হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বলা যায়, অতীতে নারীর ভূমিকা ছিল নারী ও পুরুষের যৌথ ভূমিকার অংশমাত্র। পরবর্তী সময়ে পুরুষ প্রাধান্য নারীকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সচেতন প্রয়াসে সমাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে, পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের আরও এগিয়ে আসার মধ্য দিয়ে, আবার নারী-পুরুষের সাম্যপ্রতিষ্ঠিত হবে। হিংসা, দ্বেষ, বিভেদবুদ্ধির অজ্ঞতা নর-নারীর মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে পারে নি সুদূর অতীতে। আবার হিংসা, দ্বেষ, বিভেদবুদ্ধির ক্ষতিকে সচেতন জ্ঞান দিয়ে দূর করে নর-নারীর মধ্যে থেকে ভেদাভেদের অবসান ঘটিয়ে সাম্যপ্রতিষ্ঠিত হবে ভবিষ্যতে। পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপরের অনুসন্ধানে অতীত ও ভবিষ্যৎ দুটিই আমাদের কাছে অস্পষ্ট। অতীতের সন্ধান পাওয়া যায় সংগৃহীত তথ্যের মাঝখানে আর ভবিষ্যতকে চিহ্নিত করা যায় সামাজিক গতির দিক নির্দেশের দিকে তাকিয়ে।

মানব সমাজের সুদূর অতীতকে মর্গান প্রধানতঃ দুটো ভাগে ভাগ করেছেন- বন্য অবস্থা ও বর্বর অবস্থা। বন্য অবস্থাকে সাধারণভাবে বলা যায় সেই অবস্থা যখন মানুষ কিছুই উৎপাদন করতে শেখে নি। কেবল ফলমূল, মাছ, পাখি, বন্যপশু আহরণের জন্য কিছু হাতিয়ার তৈরী করতে শিখেছে। এই পর্যায়ে মনুষ্যোচিত উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল তীর ধনুক সৃষ্টি, আগুনের আবিষ্কার ও ভাষার জন্মদান। বর্বর অবস্থা হল এর পরবর্তী ধাপ। তখন মানুষ পশুপালন ও চাষ ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছে। ভাষা থেকে লিপির আবিষ্কারে এগিয়ে গিয়েছে। ধাতুর ক্ষেত্রে মানুষ লৌহ নিষ্কাশন করতে শুরু করেছে।

এই দুই স্তরের নানা উপবিভাগের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে দেখা যায় মানবগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের যুথ জীবন অতিক্রম করে এসেছে। রক্তসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন নিয়ে গঠিত হয়েছে গোত্র। একসঙ্গে থেকে তৈরী হয় ফ্রাত্রী বা ভ্রাতৃত্ব। ফ্রাত্রী মিলেমিশে উপজাতি। আর তার থেকে বৃহত্তর জনসমষ্টি হল কনফেভারেন্সি বা সমামেল। কোন কোন অঞ্চলের অধিবাসীরা এই পথ ধরে গঠন করেছে রাষ্ট্র। বিকাশের ধারাটি এইরকম: গোত্র-ভ্রাতৃত্ব-উপজাতি- সমামেল-রাষ্ট্র।

ক্রমশ…

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!