দেশকে সঠিকভাবে জানতে হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম পাঠ প্রয়োজন। ইতিহাসের সাথে মিশে আছে , তাঁর সংগ্রাম, রাজনীতি, কর্ম পরিকল্পনা এবং স্বাধীন দেশ পরিচালনার নীতিসমূহ। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বিদেশ নীতি একটি অপরিহার্য বিষয়, যা দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও ভাবনায় প্রণীত হয়েছিল। সেই সময়ের প্রণীত বিদেশ নীতি অনুযায়ি বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক অটুট রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর বিয়োগাত্মক মহাপ্রয়াণের পরও সেই নীতিসমূহ কেউ পরিবর্তন করেনি। এযাবতকাল যাঁরাই দেশ পরিচালনা করেছেন, তাঁদেরকেও বঙ্গবসন্ধুর বিদেশনীতির নির্ধারিত কর্মপদ্ধতি অনুযায়ি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়েছে। দেশের সংকটকালে সকল প্রজন্মকে প্রায়োগিক ও তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টি অনুধাবন করা আবশ্যক।
১. রাষ্ট্র সম্পর্কে রাষ্ট্রবিদ Aristotle বলেন It is an association of human beings and the highest form of human association. প্রাচীন রাষ্ট্র দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটল রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ধংংড়পরধঃরড়হং এবং নাগরিকের কল্যাণ সাধনের সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র সম্পর্কে ভাবতে হলে প্রাচীন রাষ্ট্রবিদদের দর্শন ভেবে দেখতে হয়। রাষ্ট্র নিয়ে কালে কালে ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে, সাথে সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে সামাজিক অবকাঠামোকে। সামাজিক, রাষ্ট্রিক, আর্থিকসহ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রূপকার ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র উদ্ভব হবার পর, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেসব ভাবনা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন , তা বোধকরি বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মানস গঠন, কর্ম উদ্দীপনা , রাজনৈতিক ভাবনায় তা লক্ষ্য করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পর, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন, তা হলো-
“পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র । এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম হাতে না দিয়ে একসঙ্গে যে শ্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হল ‘ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ও ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না। জমিদার ও জায়গিরদাররা যাতে শোষণ করতে পারে সে ব্যাপারেই সাহায্য নিতে লাগল। কারণ এই শোষক লোকেরাই এখন মুসলিম লীগের নেতা এবং এরাই সরকার চালায়। ‘১
ফলে অনিবার্যভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন বৈষম্য, অনাচার বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই বৈষম্য সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, ভাষা, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প কলকারখানা, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহ রাষ্ট্রের নীতিমালার সর্বত্র শোষণ ত্রাসন বৃদ্ধি পায় । গণতান্ত্রিক সকল রীতি নীতিকে উপেক্ষা করে সামরিক শাসন পূর্ব বাংলায় তথা পূর্ব পাকিস্তানে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে । এরকম পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে সাবজেক্ট কমিটির সভায় ৬ দফা উত্থাপন করেন এবং ১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯, ২০ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ৬-দফা দলের প্রধান ইশতেহার হিসেবে গৃহীত হয়। এই ৬ দফায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে দাবী তোলেন। এই দাবীনামায়-
“২. ফেডারেল সরকার মাত্র দুটি বিষয় পরিচালনা করবেন। এ দুটি বিষয় হলো প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। আর অন্য সকল বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলির হাতে ন্যস্ত থাকবে;
৫.ক) দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব থাকবে;
গ) শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলোর বিদেশে বাণিজ্য মিশন খুলতে ও বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা- বাণিজ্য বিষয়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে; ২
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পূবর্ পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবী করেন এবং একই সাথে বিদেশ নীতি কি হবে তা উল্লেখ করেন। বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের যে হাওয়া বদল, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমাজের উত্থান, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে উদ্যোগ, তার সাথে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা যেন সমান্তরাল ছিল। ফলে ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পর বৈদেশিক নীতিতে বহু পরিবর্তন সূচিত হয়। তবে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পূর্বে পররাষ্ট্র নীতি কি হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মতামত দিয়েছিলেন।
“পররাষ্ট্র নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজ বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে, সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোন মতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না। এজন্যে আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে হবে।
আমরা ইতিপুর্বে ‘সিয়াটো-সেন্টে’ ও অন্যান্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবী জানিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোন জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত জনগণের যে সংগ্রাম চলছে সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।
কারুর প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব-এই নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।
আমরা মনে করি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত। এর মধ্যে আমাদের জনগণের বৃহত্তম স্বার্থ নিহিত রয়েছে। সেজন্যে প্রতিবেশীদের মধ্যে বর্তমান বিরোধসমূহের নিষ্পত্তির উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছি। …৩
এই বক্তব্যটি বঙ্গবন্ধু প্রদান করেন ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ সালে। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস কর্তৃক আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ বক্তৃতামালায় তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭০ সালের বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই নীতিমালা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর অত্যন্ত সচেতনতা ও দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেন। এমন কি, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র নীতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছিল।
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। বৈদেশিক নীতির ব্যাপক বৈশিষ্ট্য হলো সকল বাস্তব প্রয়োজনে মৌলিক ধারনার ব্যাখ্যা।
২. রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অবসানে বিশ্বাসী।
৩. জোটনিরপেক্ষ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান-এই তিনটি আমাদের বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিপ্রস্তর (corner stone)
৪. পৃথিবীত্রাসী ও আঞ্চলিক শান্তিবিনষ্টকারী সকল প্রকার সামরিক চুক্তির আমরা বিরোধিতা করি। আমরা সেনটো (CENTO) এবং সিয়াটো (SEATO)- ( ঝঊঅঞঙ)-কে নিন্দা করি। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অস্থিশীলকারী অথবা কোনো দেশের নিজেদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দানকারী সকলপ্রকার সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিকভাবে আমরা বিরোধিতা করব।
৫. বাংলাদেশ নিন্দা জানায় সাম্রাজ্যবাদ এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ এবং ছোট দেশগুলোর উপর অন্যান্য সর্বপ্রকার বহিঃশক্তির অশুভ প্রভাব বিস্তার ।
৬. বাংলাদেশ পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে এবং সংলাপ-প্রক্রিয়ায় ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে বিরাজমান জটিলতা সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী।
পরাশক্তি:
৭. আমরা মনে করি ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলি নিম্নরূপে বিন্যস্তঃ
ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
খ) সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া
গ) চীন
৮. আমরা সকল পরাশক্তির সমর্থন এবং তদনুযায়ী সার্বক্ষণিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। আমরা এশিয়ার পুনঃজোটবদ্ধতার বিরোধিতা করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি, ইসলামাবাদের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগ সংক্রান্তে বিষয়ে চাপ সৃষ্টির কারণে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ভূমিকার নিন্দা জ্ঞাপন করি। বাংলাদেশ ইস্যুর প্রতি সহযোগিতা ও সহানুভূতির জন্য আমেরিকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অন্যান্য সংগঠন, যেমন কংগ্রেস ও সিনেটের প্রতিও কৃতজ্ঞ।
৯.সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া প্রাথমিক পর্যায়েই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্নতর কৌশলের কারণে আমাদের সংগ্রামের প্রতি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। ভারত-সোভিয়েত সাম্প্রতিক ইসতেহারও বাংলাদেশের জন্য ফলদায়ক নয়। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় মদদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সাথে প্রয়াস চালাতে হবে।
১০. চীনের ব্যাপারে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা রক্ষা করছি এবং তা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণসমূহ খুবই স্পষ্টভাবে বলা যায়।
আফ্রো-এশীয় দেশসমূহ:
১১. সমগ্র আফ্রো-এশীয় দেশ সমূহের কল্যাণের জন্য আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সেই লক্ষ্যে আফ্রো-এশীয় সংহতির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব। আফ্রো-এশীয় সকল দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ লালন করব।
মধ্যপ্রাচ্য:
১২. খুবই বেদনার সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, আরবদেশসমূহ আমাদের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করেছে, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখব এবং রাখতে হবে। আমরা মনে করি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ব্যাপক প্রচারকারী সরকারসমূহের এটি একটি ভয়ংকার ব্যর্থতা। আমরা বাস্তব সত্যের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালিয়ে যাব এবং সেই সঙ্গে তারা যে ভুল-বোঝাবুঝিতে ভুগছে তা দূর করার চেষ্টা করব।
১৩. আরব-ইসরাইল সম্পর্কের সূত্রে আামাদেরকে কোনো পক্ষেই রাখিনি এবং তা অব্যাহত রাখব যতদিন না আমাদের নীতিমালা পরিবর্তিত হয়।
১৪. শুধুমাত্র লন্ডন ছাড়া সমগ্র ‘স্বাধীন’ ইউরোপ কমবেশি নীরব। অতএব পাকিস্তান প্রায় ওয়াকওভার পেয়ে যাচ্ছে।
১৫. ইউরোপের সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ আমাদের সংগ্রামের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন জ্ঞাপন করেছে এবং আমরা সেইসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
১৬. উপর্যুক্ত নীতিমালা চলতি সময়ের জন্য। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিমালা আরো সংক্ষেপ করা হবে। বৈদেশিক নীতিমালা ধারাবাহিকভাবে পুনঃনিরীক্ষা করা হচ্ছে এবং যখনই যেখানে যে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি বা প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে, যথাযথভাবেই সমন্বিত করা হচ্ছে।” ৪
এই নীতিমালা বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্দেশনা ও পথরেখা অনুযায়ি তৈরী করা, যা মুজিবনগর সরকারের বহিঃপ্রচার বিভাগ থেকে সে সময় প্রচারিত হয় । ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠতে যেমন সহায়তা করে, তেমনি যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে বৈদেশিক সহায়তার পথ সূচিত হয়। এর ফলে বহু বিদেশী সংসদ সদস্য, বার্তা সংস্থার প্রতিনিধি সাংবাদিক মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগ এবং সরেজমিনে অবস্থা পরিদর্শনে জন্য শরনার্থী শিবিরে আসেন। এই পররাষ্ট্র বিষয়ক চিন্তা বঙ্গবন্ধু পূর্বেই করে রেখেছিলেন, এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে..
” ১৯৫৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান-আমেরিকা মিলিটারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরে পাকিস্তান সিয়াটো ও সেন্টো বা বাগদাদ চুক্তিতে যোগদান করে পুরাপুরি আমেরিকার হাতের মুঠোর মধ্যে চলে যায়। এই দুইটা চুক্তিই রাশিয়া ও চীনের বিরোধী বলে তারা ধরে নিল। চুক্তির মধ্যে যা আছে তা পরিষ্কারভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী চুক্তি বলা যেতে পারে। নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের উচিত ছিল নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। আমাদের পক্ষে কারও সাথে শত্রুতা করা উচিত না। সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বাস করা আমাদের কর্তব্য। কোনো যুদ্ধ জোটে যোগদান করার কথা আমাদের চিন্তা করাও পাপ। কারণ, আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য দরকার, দেশের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও তা জরুরী।
আমাকে গ্রেফতারের পূর্বেই পাক-আমেরিকান মিলিটারি প্যাক্টের বিরুদ্ধে এক যুক্ত বিবৃতি দেই । আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি ছিল স্বাধীন, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি।” ৫
ফলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র বিষয়ক ভাবনা এবং নীতিমালা পূর্বেই তিনি করে রেখেছিলেন, সেই নির্দেশনার সঠিক প্রয়োগ মুজিবনগর সরকার করেন । বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শিতা মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে প্রতিফলন ঘটে।
২. স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি:
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন পৌঁছান, সেখানে সাংবাদিক সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য ভারতের প্রতি ধন্যবাদ এবং ফোনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সেখানে এক বিবৃতিতে মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোলান্ড, ফ্রান্স, ব্রিটেনকে এবং মার্কিন জনগণকে ধন্যবাদ প্রদান করেন।
লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার পথে দিল্লিতে এবং দিল্লির বিমানবন্দরে পৌঁছে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে বলে তিনি ঘোষণা দেন। পরে দিল্লির ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড গ্রাউন্ডে তাঁর সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনায় ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। পরে ১০ জানুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে ঢাকায় অর্থাৎ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তা ছিল একজন বীর রাষ্ট্রনায়কের ভাষণ। সেই ভাষণে রাষ্ট্রের নীতি কি হবে তা উল্লেখ করেন..
” বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপক্ষতা । এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।….
আমার সাথে দিল্লিতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে । এখন আস্তে আস্তে অনেককেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে।” ৬
বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম পদক্ষেপে দেশবাসীকে, একই সাথে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মূলনীতি কি এবং স্বাধীন দেশের সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সম্পর্ক কেমন হবে , তা জানিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতকে প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে যেমন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন, একই সাথে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। সেসব বিবেচনায় এনে বঙ্গবন্ধু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফর করেন। বিশাল ও ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী চিরকাল অটুট থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহবান জানান। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, মৈত্রী ও সৎপ্রতিবেশীসুলভ সহযোগিতার জন্য মতৈক্যে পৌঁছান। উভয়ের যুক্তবিবৃতিতে তার ঘনিষ্ঠ চিত্র ফুটে ওঠে।
১. ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ।
২. ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী সকল উদ্বাস্তু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সাহায্যর আশ্বাস প্রদান।
৩. সীমান্ত চোরাচালান অবিলম্বে বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ,
৪. ফারাক্কা বাঁধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি বিদ্যুত সহ উন্নয়নের সমস্যা নিরসনে সহযোগিতা,
৫. উভয় সরকার সহযোগিতার বিষয়ে মতামত অব্যাহত রাখা এবং সহযোগিতার জন্য উপযুক্ত সংস্থা গঠন করা ।
কলকাতায় মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক সার্থক ও সফল বৈঠক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তারই ফলশ্রুতিতে ১২ মার্চ ১৯৭২ সালে মিত্রবাহিনীর বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় মনোভাব এবং ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে এই দিন স্মবণীয় হয়ে থাকবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭-১৯ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেন। এই সফরটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯ মার্চ ১৯৭২ সম্পাদিত হয়। ২৫ বছর মেয়াদী এই চুক্তি নানাভাবে তাৎপর্যময়। চুক্তির অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে আদর্শগত মিল, যেমন শান্তি, ধর্মনিরপক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে। 25 years Treats of peace, Friendship and Co-operation নামে এই চুক্তি জাতিসংঘের নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং উভয় দেশ জাতীয় স্বার্থে ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় এশিয়া তথা বিশ্বে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক অটুট রাখবে। চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদে একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষপ করা থেকে বিরত থাকবে , ২য় অনুচ্ছেদে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদ বিরুদ্ধে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন, ৩য় অনুচ্ছেদে জোট নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ৪থর্ অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে দুই পক্ষ মতবিনিময় ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়। এছাড়াও অন্যান্য অনুচ্ছেদে বাণিজ্য , পরিবহন, যোগাযোগ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, জল বিদ্যুৎ, শিল্পকলা, সাহিত্য,সংস্কৃতি, শিক্ষা, ক্রীড়া, স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা, প্রয়োজনীয় সমীক্ষার কথা বলা হয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এই চুক্তিটি বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে।
Article-8,
In accordance with the ties of friendship existing between two countries, each of the high contracting parties solemnlz declares that it shall not enter into or participate in anz militarz alliance directed against the other partz.
Article-9
Each of the high contracting parties shall refrain from anz aggression against the other partz and shall not allow the use of its territorz for committing anz act that maz cause militarz damage to or constitute a threat to the securitz of the other high contracting partz. 7
এই চুক্তির ফলে উভয়ের বৈদেশিক ভূমিকা ও প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত প্রতিফলিত । তবে ১০ নং অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকে বিতর্কের সূত্রপাত করলেও ১১ ১২ অনুচ্ছেদে তা মীমাংসিত হয়েছে। অযথা বিতর্ক বলে এখন তা গণ্য করা হয়। কারণ উভয় পক্ষই কোনো মতবিরোধ দেখা দিলে পারস্পরিক আলোচনা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে শ্রদ্ধা ও সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি তথা সমাধানের কথা বলা হয়েছে।
Article-10
Each of the high contracting parties shall refrain from giving anz assistance to anz third partz taking part in an armed conflict against the other partz.
In case either partz is attacked or threatened with attack, high contracting parties shall immediatelz enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and securitz of their countries.
Each of the high contracting parties solemnlz declares that it shall not undertake anz commitment, secret or open, towards one anz more states which maz be incompatible with the present treatz. 8
এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে সমর্থ হয়। ১৯৯৭ সালে ১৯ মার্চ এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় এবং এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওপর কোন ক্ষতিকর কিছু ভারত চালিয়েছে, এমন কোন দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবে না। বরং বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক দেশ ও সংস্থাসমূহের স্বীকৃতির জন্য এই চুক্তি তাৎপর্য বহন করে।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন দিন পর্যন্ত শুধুমাত্র ভারত ও ভুটান স্বীকৃতি দেয়। পরে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় প্রথম তিন মাসে স্বীকৃতি মেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩ দেশের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজয় অর্জনের ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালে ৯৬টি, ১৯৭৩ সালে ২০টি, ১৯৭৪ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫টির অর্থাৎ সবর্মোট ১২১ দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হন। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ৯
উল্লেখ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে স্বীকৃতি মেলে চীন, সৌদি আরব, জর্দান, ইরান সহ অন্যান্য দেশের।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পুনর্গঠনের মনোনিবেশ দেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আর্থিক সাহায্য অত্যন্ত জরুরী। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ভারত বরাদ্দ দেয় ২০০ (দুই শত) কোটি টাকা, এবং প্রথমেই ছাড় দেয় ৮৫ কোটি টাকা। এভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ভারতের পর বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফর করেন ২-৬ মার্চ ১৯৭২ সালে, এই সফরের সময় বাংলাদেশ- সোভিয়েত যুক্ত-ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আর্থিক সহায়তা, বন্দী বিনিময় সহ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য সীমাহীন পরিশ্রম করেন। তারই অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে চিলির রাজধানী সান্তিনিয়াগোতে শান্তি পরিষদে প্রতিনিধি পাঠান। এই সভায় বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৫-৬ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন, ১৯৭৩ সালের ১৭ অক্টোবর জাপান সফর, ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই যুগোশ্লাভিয়া, ১৯৭৩ সালের ৩ আগস্ট কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান ও ৭ আগস্ট সম্মেলনে ভাষণ দেন । ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেন, এই সম্মেলনে যোগদানের পূর্বেই পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়। মুসলিম বিশ্বে ইরাক, তুরস্ক স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশকে এভাবে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হন।
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভে চীন ভেটো দেয়, ফলে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ পেতে বিলম্ব হয়। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক তৎপরতায় ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন, সেই ভাষণে তাঁর পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা তুলে ধরেন।
সেই ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো,
“আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এইজন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে বাংলাদেশের সাড়া ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত । স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারাই বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য মিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্খিত ছিলেন । যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সন্দেহ রক্ষিত আছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ…।…..
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম হইতেছে সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম আর সেইজন্যে জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আসিতেছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পরে এই ২৫ বৎসরের অভিজ্ঞতা হইতে দেখা যায় যে, এইসব নীতিমালার বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে কি তীব্র সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন হইতেছে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ বীর যোদ্ধার চরম আত্মদানের মাধ্যমে শুধুমাত্র জাতিসংঘ সনদ স্বীকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার পুনরুদ্ধার সম্ভব।
আগ্রাসনের মাধ্যমে বেআইনীভাবে ভূখন্ড দখল, জনগণের অধিকার হরণের জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার এবং জাতিগত বৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনো অব্যাহত রহিয়াছে। আলজিরিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ এবং গিনিবিসাউ এই সংগ্রামে বিরাট বিজয় অর্জন করিয়াছি। ….
এই অঞ্চলের জিম্বাবুয়ে (দক্ষিণ রোডেশিয়া) এবং নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়াই করিয়া যাইতেছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, যাহাকে মানবতার বিরোধী বলিয়া বার বার আখ্যায়িত করা হইয়াছে তাহা এখন আমাদের বিবেককে দংশন করা অব্যাহত রাখিয়াছে।….
আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব-যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। …
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে মারাত্মকভাবে আঘাত হানিয়াছে।… এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উৎসাহ প্রদর্শন করায় আমরা জাতিসংঘ, তার বিভিন্ন সংস্থা ও মহাসচিবের নিকট কৃতজ্ঞ।….
একটি যথার্থ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘে এর আগে কোথাও এই ধরনের চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলা করিতে হয় নাই।…আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের কল্যাণের পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে।…
বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব -এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।…এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা সম্পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে আমরা সমর্থন করি।…
আমরা নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সাথে শুধুমাত্র সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি।….
৬৩ হাজার পাকিস্তানি পরিবারের অবস্থা এখনো মানবিক সমস্যারূপে রহিয়া গিয়াছে। তাঁহারাই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছে এবং নিজ দেশে ফিরিবার জন্য আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির কাছে নাম তালিকাভুক্ত করিয়াছে।..এই মানবিক সমস্যার অবিলম্বে সমাধান প্রয়োজন।….
শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সাবর্ভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সাথে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে।…
আমাদের লক্ষ্য স্ব-নির্ভরতা। …আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানদের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করবে এবং আমাদের কর্মকান্ডের সহজতর করিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয়ের ঘটিতেছে।..
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা অনুযায়ি জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আন্তর্জাতিক ভাবনার সাহসী মাইলফলক। এই নীতিমালা বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকেই পোষণ করতেন এবং ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সম্মেলনের রিপোর্টেও এই মতের প্রতিফলন ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু নয়, বরং বিশ্ব মানবিকতা পরিস্ফূটিত । ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২৫ নং-এ ‘ আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন’ শীর্ষক অনুচ্ছেদের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
” জাতীয় সাবর্ভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সন্দেহ বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা -এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র-
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;
খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায়-অনুযায়ি পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন;
গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে সমর্থন করিবেন।”
বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে প্রণীত বৈদেশিক নীতি বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি যুগান্তকারী এবং মানবতার শান্তির জয়গানে এই নীতি ক্রমান্বয়ে বিশ্বকে আলোকিত করবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী । দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ, ৬১ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০। প্রথম প্রকাশ ২০১২। পৃঃ ২৪১
২. শ্যামলী ঘোষ, অনুবাদ- হাবীব-উল-আলম, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯-১৯৭১। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ প্রথম প্রকাশ ২০০৭। পৃঃ ১১৮
৩.বাঙালির কণ্ঠ, সম্পাদকঃ মোনায়েম সরকার । আগামী প্রকাশনী, ৩৬ বাংলা বাজার, ঢাকা- ১১০০। দ্বিতীয় মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৫। পৃঃ ১৬০
৪. এইচ. টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ, ঈষৎ সম্পাদিত সংস্করণ, আষাঢ় ১৪১৯/ জুন ২০১২। পৃঃ ১২০-১২১
৫. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী। প্রাগুক্ত। পৃঃ ২৭৯
৬. কামরুল ইসলাম, বাঙালির আত্মপরিচয় ও অন্যান্য । সারস্বত, বি-৭০ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপে¬ক্স , ২৫৩-২৫৪ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫। পৃঃ ১৭১
৭. মোহাম্মদ সেলিম, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক ( ১৯৭১-১৯৮১)। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। প্রথম পুনমুর্দ্রণ চৈত্র ১৪২২/ মার্চ ২০১৬। পৃঃ ২৬৫
৮. প্রাগুক্ত । পৃঃ ২৬৫
৯. মোতাহার হোসেন সুফী, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক। পাক্ষিক অনন্যা, ঢাকা। তৃতীয় সংস্করণ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
১০. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, দ্বিতীয় খন্ড। সম্পাদক মোনায়েম সরকার। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪১৪/ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। পৃঃ ৮৯২-৮৯৫
১১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান । সর্বশেষ সংশোধনসহ মুদ্রিত এপ্রিল ২০০৮। পৃঃ ৭