বলাগড়ের নৌকানির্মাণ প্রযুক্তি: লোকগণিতের প্রেক্ষিত

আদিম সভ্যতার গোড়া থেকেই মানুষ জলপথকে যাতায়াতের কাজে লাগিয়েছিল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে এই জলপথ। মানুষ যেদিন প্রথম দেখল জলে কাঠের টুকরো ভেসে উঠছে, সেদিন মানুষের কৌতূহল বেড়ে গেল। মানুষ অজানাকে জানার কৌতূহলে জলপথে কাঠের গুঁড়ি ভাসিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত শুরু করল। কাঠের গুঁড়িই ধীরে ধীরে ডোঙা, ডোঙা থেকে নৌকার রূপ লাভ করল। এইভাবে নৌকা তৈরিতে আদিম মানুষ তারা তাদের বৈজ্ঞানিক চেতনাকে কাজে লাগাল। নৌকা তৈরির পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নির্ভর। নৌশিল্পীরা Indigenous technology-র প্রয়োগ করে নৌকাতে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহার করল। এবং নৌকাকে বিবর্তিত করে বহুবিচিত্র কাজে লাগানো হচ্ছে। নৌকা এখন মানুষের নানাবিধ প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। যাতায়াত ছাড়াও মালপত্তর বওয়া, মৎস্যশিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তার কাজে, রণতরী, প্রমোদ-ভ্রমণ ইত্যাদি কাজে নৌকা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

নৌকা তৈরি করে সাধারণত লোকসমাজের শিল্পীরা। তারা তাদের শৈল্পিকসত্তার বিকাশ ঘটায় কাজের মধ্য দিয়ে। শিল্পচেতনার প্রয়োগ তাই তাদের কৃত নৌকাতেই দেখা যায়। আজকের বিবর্তিত নৌকার পিছনে রয়েছে লোকসমাজের দীর্ঘদিনের প্রজ্ঞার প্রকাশ। নৌশিল্পকে আগে ব্রিটিশরা Village Industry বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আবার এই নৌশিল্প লোকশিল্প হিসাবে গৃহীত হয়েছে।

নৌকানির্মাণ প্রযুক্তি ও লোকগণিত:
নৌকানির্মাণ একটি বৈজ্ঞানিক গতিশীল প্রক্রিয়া। নৌকা তৈরির ইতিহাসে আমরা গাছের গুঁড়ি থেকে ভেলায় রুপান্তরের অবস্থা পাই; এবং সেই ভেলা বিবর্তিত হতে হতে বর্তমান নৌকার রূপ পরিগ্রহ করেছে। নৌকা আবার ট্রলার, লঞ্চ, জাহা-এর রূপ নিয়েছে। তবে একথা বলা বাহুল্য গাছের গুঁড়ি থেকে রূপান্তরিত বর্তমান নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, জাহাজের বিবর্তনের ধারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উপর নির্ভর করেই এগিয়ে চলেছে। বর্তমান প্রবন্ধের এই অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় নৌকানির্মাণের প্রযুক্তি ও নোকগণিত। তাই প্রথমে নৌকা নির্মাণের প্রযুক্তি ও তারসঙ্গে সম্পৃক্ত লোকগণিত কিভাবে রয়েছে সেদিকে দৃকপাত করব।

প্রগতিশীল সমাজে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যে কোনো পরিবহনে সাহায্যকারী সমস্ত যানবাহনই তৈরি হয় কিছু নিজস্ব ক্রিয়াকৌশল ও পদ্ধতির সাহায্যে। যানবাহন তৈরির কৃৎ-কৌশল ও পদ্ধতিতে শিল্পী, মিস্ত্রি, কর্মী বা শ্রমিকরা নিপুণভাবে দক্ষ হয়ে থাকে। নৌকা তৈরি করে মূলত নমশূদ্র, জেলে, রাজবংশী, মিস্ত্রি, ক্যাঁওট, মুসলমান নিকারি, প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এরা লোকসমাজ নামে পরিচিত। এছাড়া সাঁওতাল (সহকারি শিশুশিল্পী) সম্প্রদায়ের মানুষেরাও রয়েছে। এদের অধিকাংশই নিরক্ষর বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাচর্চার আঙিনা বহির্ভূত। কিন্তু এদের বাস্তব জীবন লৌকিক শিক্ষায় পরিপূর্ণ। এদের জ্ঞানকে Indigenous Knowledge বলা হয়। Indigenous Knowledge-এর একটি বড় অংশই বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। এই বিজ্ঞানকেন্দ্রিক Indigenous Knowledge আবার Folklore Science বা লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞানের অন্তর্গত। নৌকা নির্মাণের প্রযুক্তিকে লোকপ্রযুক্তি বলে। আর এই লোকপ্রযুক্তি ও লোকগণিত লোকসংস্কৃতিবিজ্ঞানের অন্তর্গত। এবং এদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান।

Technique –এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে Oxford Dictionary-তে বলা হয়েছে: method of achieving purpose, esp. by manipulation. আবার Technology-র সংজ্ঞা প্রসঙ্গে Oxford Dictionary-তে বলা হয়েছে: knowledge or use of mechanical arts and applied sciences.(Oxford Dictionary & Thesaurus- ।।।, 2006. pp.792)।
Technology-র অপর সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে: Systematic knowledge of and its application to industrial processes: closely related to engineering and science. (McGRAW-HILL DICTIONARY OF SCIENTIFIC AND TECHNICAL TERMS, 2003. pp2109)

প্রযুক্তি নির্ভর করে কিছু কৌশলের (technique) উপর। এই কৌশল বা technique মানুষ তার সমস্যামূলক কাজকর্মকে সুষ্ঠুভাবে সহজে সমাধান করার জন্য নির্দিষ্টক্ষেত্রে ব্যবহার করে। আর এই কৌশলের ব্যবহার যখন প্রয়োগভিত্তিক বাস্তবতার রূপ লাভ করে তখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যন্ত্র বা প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট কাজ বা সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট কৌশলভিত্তিক যন্ত্রপাতি ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের উপর ভিত্তি করে যন্ত্র বা প্রযুক্তির ব্যবহার নির্ধারিত হয়।

আধুনিক সমাজে বা ক্রমবিকশিত সমাজে প্রত্যেকটা মুহুর্ত মানুষের জীবন ধারণের জন্য নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং তার ব্যবহার চলছে। এটা হল তার দৈনন্দিন চর্যা অভিজ্ঞতা ও গবেষণার নিরিখে। অনুরূপভাবে লক্ষ্য করা যায় যে আদিম অরণ্যবাসী জারোয়া সমাজ থেকে এস্কিমোসমাজ কিংবা লোকসমাজ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ঐতিহ্য পরাম্পরা ও নিজেদের পরিচিত জগতের মধ্য থেকে সমস্যা সমাধান বা কাজ সম্পন্ন করার জন্য কিছু কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যা অত্যাধুনিক আবিষ্কার নয়। লোকসমাজের দৈনন্দিন কাজকর্মকে, জটিলতাকে সহজে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এই সকল technique বা technology ব্যবহার করে চলেছে। যা প্রকৃতপক্ষে অত্যাধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান গবেষণা থেকে অনেক দূরে। সহজ সরল লোকজীবনের এই প্রযুক্তির ব্যবহার স্বভাবতই লোকপ্রযুক্তি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ লোকসমাজে লোকসাধারণের দ্বারা ব্যবহৃত যে প্রযুক্তি তাই হল লোকপ্রযুক্তি। যেমন- লাঙল, কোদাল, হাল, শাবল, তীর-ধনুক ইত্যাদি। বর্তমান প্রবন্ধের আনুষঙ্গিক কয়েকটি লোকপ্রযুক্তিরও দৃষ্টান্ত দেওয়া হল—ট্যাঙা, ছেনি, চেরা শাবল, করাত, রেঁদা, বাঁটালি, শেনিম, বাইস ইত্যাদি।

আর নৌকা নির্মাণ করে যে সকল শিল্পী তারা লোকপ্রযুক্তি ও লোকগণিতের চেতনা বংশ পরম্পরায় বয়ে আনছে। তাই তারা অতি সহজেই নিজস্ব কৃৎ-কৌশলে ছোটো বড় নৌকা নির্মাণ করে ফেলছে। এরা দড়ি দিয়ে ফিতের মত নির্দিষ্ট মাপ-জোক করে। তাদের গ্রামীণ জীবন সম্পৃক্ত লৌকিক পরিভাষাও অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন। অঞ্চল ভেদে পরিমাপের এককও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের এই কারিগরীবিদ্যা যা শৈল্পিক চেতনাকে বংশ পরম্পরায় বয়ে আনে। স্বত:স্ফূর্তভাবে অনায়াসে তারা পরিমিতবোধের সাহায্যে Indigenous technology- র জ্ঞানকে ব্যবহারিক প্রয়োগে দক্ষতার সঙ্গে কত বড় বড় নৌকা নির্মাণ করে থাকে। তারা বাস্তবে কোনোদিনই আর্কিমিডিসের সূত্র পড়েনি, কিন্তু নৌকা জলে ভাসানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অজান্তেই আর্কিমিডিসের সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ করে থাকে।

আর্কিমিডিসের সূত্রানুসারে আমরা জানি কোনো বস্তুকে তরলে নিমজ্জিত করলে বস্তুটির ওজন হ্রাস পায়। এই হ্রাসের পরিমাণ বস্তু দ্বারা অপসারিত তরলের ওজনের সমান। অর্থাৎ,

বস্তুর তরলে ওজন= বস্তুর ওজন- বস্তু কর্তৃক অপসারিত তরলের ওজন

নৌকা তৈরির সময় নৌশিল্পীরা নৌকার তলদেশ থেকে দুপাশের ডালি পর্যন্ত যে কাঠ ব্যবহার করে এবং নৌকার সমস্ত শরীরে ব্যবহৃত মোট কাঠের ওজন নৌকা দ্বারা অপসারিত জলের ওজনের কম। তাই সমগ্র নৌকার ওজন অপসারিত জলের ওজনের কম হওয়াতে নৌকা সহজেই ভেসে থাকে। তাই কতটা গভীর খোলওয়ালা নৌকা কতটা জলকে অপসারণ করবে এবং তার ওজনের পরিমাপ নিরক্ষর নৌশিল্পীদের নৌকা তৈরির সময় খেয়াল রাখতে হয়। এই বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞাকে তারা বংশ পরম্পরায় কাজে লাগয়ে আসছে। এছাড়া নৌকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নির্ণয় করে নিজস্ব কিছু নিয়ম-রীতি মেনে। যা তাদের একান্তই নিজস্ব। পরিমাপের ক্ষেত্রে তারা গাণিতিক চেতনাকে কাজে লাগায়। নৌশিল্পীদের মধ্যে লোকগণিতের চেতনার যে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তাদের জীবনকে করাছে সুষমমণ্ডিত । তারফলে তারা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে প্রতিকূল পরিবেশে অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। জীবনের অঙ্গ যে গণিত তা তারা উপলব্ধি করে জাবনকে একটি পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। পরে লোকগণিতের পরিচয় প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করা হবে।

নৌকা নির্মাণের পদ্ধতি:
হুগলি জেলার বলাগড় অঞ্চলের যে সমস্ত লোকশিল্পিসমাজ নৌশিল্পতে জড়িত তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তাদের গাণিতিক চেতনার স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া শিল্পীদের জাবনে গণিতের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়েছে কীভাবে তাও ধরা পড়ে ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পদ্ধতির ব্যবহারে। পরিসংখ্যানবিদ্যার মাধ্যমে নৌশিল্পে নিয়োজিত শিল্পীদের জীবনযাত্রার গতিধারা ও মান সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বর্তমান প্রবন্ধে।

এবার আসি নৌকা নির্মাণের প্রসঙ্গে। নৌকা নির্মাণ একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে হয়। ধাপে ধাপে নৌকার পরিকাঠামোটি তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে নৌকাটি একটি সম্পূর্ণ রূপ পায়।

নৌকা তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে দুটি গলুইকে ত্রিকোণ আকারের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। দুই গলুইকে সংযোগ রক্ষা করে একটি কাঠ যাকে বলা হয় নীল দাড়া। কাঠটি আকাশের দিকে ফেরানো ধনুকের মতোন। নৌকা যাতে বেঁকে না যায় সোজাসুজি থাকে তারজন্য গলুই- এর উপর সুতো বেঁধে দেওয়া হয়। নীল দাড়া ধনুকের মতোন বাঁকা করতে কাঠের গায়ে নরম কাদা মাখিয়ে আগুনের তাপ দিয়ে বাঁকা করা হয়। নীল দাড়ার দুই পাশে তক্তা জুড়ে নৌকার খোল তৈরি হয় তারজন্য দাড়ার দুই পাশ থেকে বান বা খাঁজ কাটা হয়। অনুরূপভাবে দাড়ার চাইতে পাতলা ( দাড়া যদি দেড় ইঞ্চি পুরু হয় তক্তা হবে এক ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চি পুরু।) খাঁজ বা বান কাটা হয়। এই তক্তা জোড়া দেওয়ার জন্য খাঁজ বা বানের মধ্যে পুটিং দেওয়া হয়।

(পুটিং: ধূপ মিহি করে গুঁড়ো করা হয় তারপর তারমধ্যে কেরোসিন দিয়ে গোলানো হয়। তারপর জল দিয়ে ধূপের গুঁড়ো কেরোসিনের মিশ্রণ অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করলে গুঁড়ো আঠার মতোন যে বস্তু তৈরি হয় তাকে পুটিং বলে।)

এবার দাড়া এবং তক্তা যেখানে জোড়া লেগেছে সেখানে ছোটো ছোটো খাঁজ কেটে পাতাম পেটানো হয় যাতে দাড়া এবং তক্তার মধ্যে সংযোগ রক্ষিত হয়। (পাতাম: লোহার তৈরি চ্যপ্টা দুই প্রান্ত সরু এক ধরনের কাঁটা।)

লম্বা তক্তাকে লম্বালম্বি জোড়া দিতে ঘাই কাটা হয়। ঘাই কাটার ফলে একটি তক্তাকে অন্য একটি তক্তার সাতে পাতাম পিটিয়ে জোড়া লাগানো হয়; আবার এই ঘাই কাটাকে বলা হয় শান কাটা। এইভাবে দাড়ার দুইপাশে সমান সংখ্যক তক্তা জুড়ে ক্রমশ নৌকার শরীর তৈরি হয়। নৌকার পেটের দিকটা মোটা এবং দুই প্রান্ত ক্রমশ সরু হয়ে যায়। এভাবে এক সময় গলুই দাড়া-সহ তক্তা দিয়ে নির্মিত হল একটি পূর্ণাঙ্গ শরীর। এবার নৌকার মাঝে খোলের মধ্যে তলি বরাবর বাগ বসানো হয়, আর নৌকার খোল থেকে দুইপ্রান্ত পর্যন্ত বসানো হয় গোছা। এই গোছা এবং গুড়োগুলোকে নৌকার শরীরের সঙ্গে গজাল দিয়ে আটকে দেওয়া হয় যাতে নৌকার তক্তাগুলো ঠিক ঠিক মজবুত হয়ে থাকে। না হলে জলের চাপে ধাক্কা খেয়ে তক্তাগুলো ভেঙে যেতে পারে।

নৌকার দুদিকে লম্বালম্বি করে তক্তার সবচেয়ে উপরে এবং শেষ গড়নটি দেওয়া হয় মোটা কাঠ দিয়ে যাকে বলা হয় ডালি। ডালির সঙ্গে সমান্তরালভাবে নৌকার মধ্য দিয়ে লম্বালম্বি গোছার উপর দিয়ে গলুই-এর দুইপ্রান্তে দুটো কাঠ জুড়ে দেওয়া হয় একে বলে বাতা। দুপাশের বাতার উপরে দুই ডালিকে সংযোগ রক্ষা করে ‘গুড়া’ বা ‘গুড়ো’। মাঝ নৌকাতে একটি চওড়া বড় গুড়ো বা গুড়া তৈরি করা হয়। এবং ওর নিচের বাগটিও চওড়া বড় করে তৈরি করা হয়, কারণ এই গুড়ার মাঝ বরাবর একটি গোল বড় গর্ত থাকে এবং ওই সোজা বাগেও একটি গর্ত করা হয় এরফলে পাল তুলে দেওয়ার জন্য মাস্তুলের বাঁশটি গুড়ার ও বাগের খাঁজ দুটোর মধ্যে পড়ে পড়ে সরলভাবে। ঠিক গলুই-এর সংলগ্ন নৌকার দুইপ্রান্তে দুটো ত্রিভূজাকৃতির কাঠের পাটাতন থাকে। একে ‘চরাট’ বলে। গুড়ার সমান্তরাল করে বিভিন্ন নৌকায় বিভিন্ন রকমের পাটাতন ব্যবহার হয়ে থাকে। নৌকা চালানোর জন্য পিছনে থাকে হাল। হাল পাছানৌকার ডালিতে বাঁধা থাকে। আর দাঁড় নৌকার সামনের দিকে দুই পাশের ডালিতে আটকানো থাকে। এইভাবে একটি নৌকা পরিপূর্ণতার রূপ পায়।

নৌশিল্পের উপকরণ, উপাদান ও যন্ত্রপাতি:
যে কোনো শিল্পকর্ম প্রস্তুত করতে গেলেই প্রয়োজন হয় কিছু উপাদান, উপকরণ। যা দিয়ে ঐ শিল্পকর্ম শিল্পীরা তৈরি করে থাকেন। নৌশিল্পে ব্যবহৃত উপাদান ও উপকরণের বর্ণনা নিচে দেওয়া হল—

নৌকা তৈরির কথা মনে পড়লেই প্রথমে আমাদের নজরে আসে কাঠের তক্তা—উপযুক্ত কাঠের গুঁড়ি ও প্রয়োজন মত সঠিক মাপ অনুযায়ী কাঠ। কাঠের (মিস্ত্রি কারিগর, শ্রমিক) যন্ত্রপাতি—দড়ি, জাতবারি, রঙিনসুতো, পাতাম, পেরেক, গজাল, কচিগাবের টাটকা রস, ঘুঁটের ছাই, ধানের কুড়ো, করাতের গুঁড়ো, আলকাতরার সঙ্গে একটু পিচ, ধূপ, কেরোসিনের তেলসহ মিশ্রণ ইত্যাদি। এছাড়া টিন, অ্যালুমিনিয়ামের শিট, তাল গাছের মোটা গুঁড়ি প্রভৃতি দিয়ে ডোঙা নৌকার মতো ব্যবহার হয় বলে একেও নৌকা তৈরির উপাদান হিসাবে ধরা হয়। নৌকা তৈরির পরে তাকে কাত করে (পাল দিয়ে) রাখতে গেলে নৌকার মিস্ত্রিরা কিছু সহযোগী লোকজনের সাহায্য নেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নৌকা মেরামতের জন্য নৌকা ইচ্ছামতো কাত করতে গেলে প্রচুর লোকজনের প্রয়োজন হয়। এই লোকজন মালিকের বা মহাজনেরই লোকজন হয় অথবা ক্রেতারাও যোগ দেয়।

এই সকল কাজ করে যে সকল মিস্ত্রিরা তাদের নানা রকম পরিবারগত লোকবিশ্বাস-সংস্কার থাকে। এদের মধ্যে লোকসংস্কৃতি ( লোকসংগীত, লোকনৃত্য, লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া, ধাঁধা ইত্যাদি ) বিশেষভাবে চর্চিত হয়ে থাকে।

যে কোনো শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে থাকে যেমন তার বিষয় ও আঙ্গিক, তেমনই লোকশিল্প সৃষ্টিতে তার উপস্থিতি দেখা যায়। তবে কারু ও লোকশিল্প মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন আগে মেটায় তারপর নির্ণীত হয় তার নান্দনিক দিক। এখানে নৌকা নির্মাণের যন্ত্রপাতির বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হল—
১. ব্রীজকল—নৌকা তৈরির সময় ভারসাম্য রক্ষা করে।
২. শেনিম বা শ্যাম্পেন—নৌকার কাঠ সমতল করার যন্ত্র।
৩. কুশার—কোশার মতন দেখতে।
৪. হাতুড়ি—পেটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
৫. বাঁটালি—কাঠ কাটতে এবং কাঠের খাঁজ কাটতে লাগে।
৬. রাঁদা—কাঠ মসৃণ করার কাজে লাগে।
৭. ডিসকাপ—নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্র।
৮. বাঁশ—কাঠে বা নৌকায় চাপ দিতে লাগে।
৯. কুড়ুল—কাঠ কাটা হয়।
১০. করাত—কাঠকে চেরাই করতে লাগে।
১১. তুরপুন—কাঠকে ছিদ্র করতে কাজে লাগে।
১২. খড়ি বা কালো সুতো—মাপতে ও দাগ দিতে কাজে লাগে।
১৩. ট্যাঙা—নৌকা তৈরি হওয়ার পর টান দিতে লাগে।
১৪. ছেনি—কাঠের ঘাই কাটতে কাজে লাগে।
১৫. চেরা শাবল—পারেক তুলতে কাজে লাগে।
১৬. জলুই, পেরেক, তারকাটা, পাতাম ও বোটল—কাঠকে জোড়ালাগাতে কাজে লাগে।
১৭. কাটারি বা দা—কাঠ কাটতে কাজে লাগে।
১৮. বোয়া/কারান/গগদেরান/গাড়ান—নৌকা তৈরির সময় পাসে গোজের কাজ করে। এটিকে মাটিতে পুঁতে কাছি দিয়ে বাঁধা হয়।
১৯. কাছি—বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়।
২০. বাইস—কাঠকে সমান করার কাজে লাগে।
২১. শরখালি—কাঠকে ছিদ্র করতে কাজে লাগে।

লোকগণিত:
মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা কাজকর্মে গাণিতিক চেতনার প্রকাশ ঘটে; এই গাণিতিক চেতনা মানুষ বংশ পরম্পরায় বয়ে আনে স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিকভাবে। মানুষের এই গাণিতিক চেতনা সহজাত এবং তা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবনের সঙ্গে; একেই সাধারণত লোকগণিত বলা হয়। লোকগণিত-এর ইংরেজি পরিভাষা ‘Folk Mathematics’ আর এই Folk-Mathematics এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে— ‘Folk-mathematics means the mathematics of life. We have followed easily some techniques for generation after generation. From the beginning, men have borne the conception of measurement, assessment and counting without any instruction, in broad sense which called folk-mathematics. We see various application of Folk-mathematics in every stage of the daily life. Our every human action like walking, acting, thinking, swimming, eating, drinking, dancing etc. are measurable and countable and is included in the folk-mathematics.’ অতএব লোকগণিত যে জীবনেরই গণিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংখ্যাকেন্দ্রিক গাণিতিক ধাঁধা নৌকার উপকরণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এখানে সেই দৃষ্টান্তটির উল্লেখ করা হল—
হাতুড়ি বাটালি বাইসটি
চোরে নিল বাইসটি
আর রইল কটি?
উত্তর: চোরে বাইসটি নিলে— পড়ে থাকে হাতুড়ি আর বাটালি। বাইস একটি যন্ত্রের নাম।

বিবর্তন: নৌকা নির্মাণের প্রযুক্তি ও লোকগণিত:
বিবর্তনের ধারা মেনে সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি আজকের সমাজ-সভ্যতাতে একটি বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে। বিবর্তনের ফলে আদিম সমাজ আজকের সমাজের রূপ পরিগ্রহ করেছে। তেমনি সংস্কৃতির বলয়েও বিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। বাদ যায়নি লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্র; লোকসংস্কৃতির সমস্ত উপাদানই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট চেহারা লাভ করে উন্নীত হয়েছে বিশেষ পর্যায়ে। বিবর্তনের ফলে লোকসংস্কৃতির উপাদান কখনও Micro Scale থেকে পরিবর্তন হয়ে Macro Scale-এ পর্যবসিত হয়। আবার কখনও তা বিপরীতমুখীও হয়ে থাকে। অনেক সময় MicroMacro Scale-এর লোকসংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। লোকসংস্কৃতি কখনো কখনো মার্জিত সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। আবার মার্জিত সংস্কৃতি কখনো কখনো লোকসংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করে। এটি বিবর্তনের নিয়ম মেনেই সংঘটিত হয়।

নৌকা নির্মাণের প্রযুক্তি বিবর্তিত হয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে নব্যতর রূপ লাভ করেছে। Village Industry থেকে ক্রমশ এই নৌকা নির্মাণ কারখানাতে হয়ে থাকে। বলাগড়ে নৌকা তৈরির কারখানাও গড়ে ওঠে। যদিও বর্তমানে তা রুগ্নদশা প্রাপ্ত হয়েছে। নৌকা নির্মাণের জন্য বর্তমানে প্লাই, টিনের শিট, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল প্রভৃতি উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নির্মাণের পদ্ধতিতেও অনেক অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

নৌকা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত লোকগাণিতিক প্রয়োগ দেখা যায়, তাতেও বিবর্তনের প্রভাব লক্ষিত হয়। পরিমাপের একক পরিবর্তিত হয়েছে। পরিমাপ করার পদ্ধতিতে এবং উপকরণেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। নৌকা তৈরির সময় বাধার ও টানা দেবার পদ্ধতিতে বদল এসেছে। আগে বাঁশ, ও কাঠ মাটিতে পুঁতে টানা দেওয়া হত। এখন আলাদা টানা দেবার জন্য বিশেষ অত্যাধুনিক হুক পাওয়া যায়। গণিতের প্রয়োগের বিবর্তন ঘটেছে। আগে নৌশিল্পীরা নিজেরাই লোকসংগীত করত নৌকা নির্মাণের সময়। এখন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে গান বাজতে থাকে।
সব শেষে বলতে হয় যে, লৌকিক জীবনের সংস্কৃতিকে যেমন আমরা উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করতে পারি না, তেমনি উপাদানের বাস্তবভিত্তিক গুরুত্বকেও অস্বীকার করতে পারি না। তাই একথা আমরা মানতে বাধ্য যে নৌকা নির্মাণের প্রযুক্তিতে লোকগণিতের ব্যবহার অপরিহার্য এবং গুরুত্ব অপরিসীম।

সহায়ক পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ :
১। সঞ্জয় রায় ও নারায়ণচন্দ্র ঘোষ: জীবনের গণিত—লোকগণিত, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জুন ২০০৮ পৃ. ১০৮-১১২
২। সঞ্জয় রায়: লোকচিত্র ও লোকগণিত, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১০ পৃ. ৮০-৮৬
৩। পশ্চিমবঙ্গ: হুগলি জেলা সংখ্যা ১৯৯৬।
৪। বলাগড় বার্তা: শারদীয়া সংখ্যা ১৯৯৪।

গ্রন্থ:
১। সঞ্জয় রায়: বলাগড়ের নৌশিল্প ও শিল্পীসমাজ, উর্বী প্রকাশন, ১ম প্রকাশ, কলকাতা, ২০১০।
২। দুলাল চৌধুরী(সম্পা.): বাংলা লোকসংস্কৃতি কোষ, আকাদেমি অফ ফোকলোর, ১ম প্রকাশ,কলকাতা, ২০০৪।
৩। সুধারকুমার মিত্র: হুগলিজেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ।

Dictionary:
McGRAW-HILL DICTIONARY OF SCIENTIFIC AND TECHNICAL TERMS, Sixth edition, New York, 2003
Oxford Dictionary & Thesaurus- ।।। Fifth Impression, 2006, New York, pp.792

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!