বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন ২

মধুসূদনের জন্ম হয়েছিল পূর্ববঙ্গের যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে, কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠা-গড়ে ওঠা উনিশ শতকের আধুনিক সংস্কৃতির লীলাভূমি কলকাতায়। সাগরদাঁড়িতে ছিলেন বোধহয় জীবনের প্রথম দশটা বছর। এই সময়পর্বে যথাকালে বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে তাঁর হাতেখড়ি হয়। বাল্যশিক্ষার শুভারম্ভ গ্রামের পাঠশালায়। ফার্সি শিখতেন গ্রামের এক মৌলবির কাছে। বাল্যে তাঁর বিদ্যানুরাগ ও পারদর্শিতা সকলকে চমৎকৃত করেছিল। মধুসূদনের জননী জাহ্নবী দেবী ছিলেন ভক্তিমতী ও তখনকার কালের স্বল্পশিক্ষিতা। তিনি খুলনার পাইকগাছার কাটিপাড়ার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা। বালক মধুসূদন যতদিন স্বগ্রামে ছিলেন ততদিন মায়ের কাছে বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। জাহ্নবী দেবী অবকাশ মতো পুত্রকে রামায়ণ, মহাভারত, কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি প্রাচীন কাব্যের গল্প মুখে মুখে শোনাতেন। এই শিক্ষা মধুসূদনের বালকচিত্তকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই দেখা যায়, পরবর্তীকালে মধুসূদন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে ও বিদেশিনী বিবাহ করে ইউরোপীয় সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেলেও অন্তর থেকে ভারতীয়ত্বকে বিসর্জন দিতে পারেননি। এর প্রমাণ তাঁর সমগ্র সৃষ্টিসম্ভার। হেক্‌টর-বধ ও দু’তিনটি সনেট ছাড়া তাঁর আর কোনো রচনাই ইউরোপীয় আখ্যানাশ্রিত নয়। ভার্সাইয়ে বসবাসকালে কবি যেসব চতুর্দশপদী কবিতা লিখেছিলেন তার অধিকাংশই ছিল রামায়ণ-মহাভারত-মঙ্গলকাব্য-স্বদেশ-মাতৃভাষা কিংবা ওই জাতীয় দেশীয় ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ বিষয়বস্তু। বাংলার নবজাগরণে দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা লক্ষ করেছেন অনেকেই। এদের একটিকে যদি বলা যায় প্রাচ্যানুসারিতা তাহলে অন্যটিকে বলতে হয় পাশ্চাত্যমুখিতা। ব্রিটিশ শাসনের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে নাগরিক মধ্যশ্রেণির একটি বিশেষ স্তর রূপে গড়ে উঠেছিল ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালি এলিট শ্রেণি। মধুসূদন এই শ্রেণিতেই বিরাজ করতেন। তাঁর পিতার আয় ছিল বিপুল। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের আগে (১৮৪৩ খ্রি.) পর্যন্ত মধুসূদনকে তাঁর পিতা প্রচুর অর্থ দিয়ে বিদ্যালাভে সাহায্য করতেন। মাইকেলের বিলাসিতার বীজ কিন্তু উপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকেই। তাঁর প্রতিভা ও সমৃদ্ধ পঠন-পাঠন তাঁকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলে। তাঁকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেন কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের সেরা শিক্ষক ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন (David Lester Richardson)। তাঁর প্রভাবে মধুসূদন ছাত্রাবস্থাতেই একটার পর একটা কবিতা লিখতে থাকেন। এমনকি রিচার্ডসনের বাঁকা বাঁকা হাতের লেখাও নকল করতে শুরু করেন তিনি। সেসময় হিন্দু কলেজের আবহাওয়া ছিল ভীষণ উদ্দীপনাময়। সেখানে দিনরাত বইত সংস্কার মুক্তির হাওয়া। মধুসূদনও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় তিনি অকুণ্ঠভাবে সমর্থন জানালেন নারীর বিদ্যালাভের অধিকারকে। নব্যশিক্ষিত যুবকের জীবনসঙ্গিনী কখনই অন্তঃপুরের কারাকক্ষে অশিক্ষার অন্ধকারে বিরাজ করতে পারে না— এই অভিমত ছিল মধুসূদনের। সে প্রবন্ধ লিখে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন মাইকেল। এই সময়েই যে তাঁর বিলাত যাত্রার ইচ্ছা অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে তার প্রমাণ পাওয়া যায় বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা পত্রে। তাঁর ধারণা ছিল ইংল্যান্ডে উপনীত হতে পারলেই প্রিয় কবি মিলটনের মতো বিখ্যাত হয়ে উঠবেন তিনি। তাঁর লেখা ইংরেজি কবিতা এদেশের কিছু পত্রিকায় (Literary Gleaner, Young Bengal Spectator, Calcutta Literary Gazette, Literary Blooms) প্রকাশিত হলেও বিলেতের ‘Blackwood Magazine’ তা গৃহীত হয়নি। কিন্তু তবুও তিনি মাদ্রাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের আগে ইংরেজি ভাষাতে লেখালেখির অভ্যাস ত্যাগ করেননি। বাংলার নবজাগরণের আদিপর্বে ইংরেজিয়ানার প্রতি এক ধরনের দুর্নিবার মোহ কাজ করেছিল। মধুসূদন তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর মধ্যে পাশ্চাত্যপ্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হয়। এই প্রবণতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায় ১৮৪৩ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পরে। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হয় তাঁকে। ১৮৪৪ সালের নভেম্বর মাসে রাজনারায়ণ দত্ত স্ত্রীর অনুরোধে পুত্রকে ভর্তি করলেন হাওড়া শিবপুরের বিশপস্ কলেজে। মধু থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। এখানে পড়া ও থাকার সুবাদে ইংরেজদের মতো পোশাক পরতে শুরু করলেন। মদ্যপান আগেই করতেন, ওখানে সে-নেশা পরিণত হল তীব্র আসক্তিতে। তাঁর নতুন পরিচয় হল,’মাইকেল মধুসূদন ডাট’। এই কলেজে ছিল অনেক রকম ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা। সেই সুযোগ তিনি পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করলেন। ল্যাটিন, হিব্রু তো ছিলই, শিখলেন গ্রিক, সংস্কৃত, সিংহলি, তামিল ও তেলেগু। জাতিতে কায়স্থ হওয়ার কারণে হিন্দু কলেজে সংস্কৃত পড়ার সুযোগ পাননি, এখানে তা পড়লেন এবং বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়লেন। এই সংস্কৃত শিক্ষাই পরবর্তীকালে তাঁর বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার পথকে মসৃণ করেছিল। তাঁর কাব্যগুলিতে আভিধানিক তৎসম শব্দের ব্যবহার সংস্কৃত ভাষার ওপর তাঁর দক্ষতার পরিচায়ক।

আরও পড়ুন: বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন ১ 

বাংলার নবজাগরণ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেছেন তাঁরা প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় রেনেসাঁ-দীপ্ত উনিশ শতক অনেকগুলি মাত্রায় সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। বহুবিধ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ লক্ষণের আবির্ভাব ঘটে এই সময়টাতে, যা বাংলার সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কিছুটা ভিন্ন পথে চালিত করেছিল। আসলে এই শতক ছিল একটা বিমিশ্র শতক। এখানে পাশাপাশি বহমান ছিল তিনটি ধারা : উগ্র, রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল। ডিরোজিয়ানদের উশৃঙ্খলতার পিছনে যেমন ছিল অন্ধতা ও মূঢ়তা, তেমনি প্রতিক্রিয়াশীলরা অজ্ঞতা আর কূপমণ্ডূকতায় আটকে পড়েছিল। এই দুই পথের চরমতাকে বর্জন করে উভয়পক্ষের ভালোত্ব নিয়ে গড়ে ওঠে উদারনৈতিক মধ্যপন্থী মত। প্রাচীনের সবকিছু নির্বিচারে বর্জন নয়, পুরোনো সংস্কার ও প্রথার অংশবিশেষ যুক্তির দ্বারা পরিশুদ্ধ করে গ্রহণ করা ও ইউরোপীয় আদর্শের মানবতা-অনুপন্থী শোভন ভাবনাগুলিকে বরণ করে নেওয়াই ছিল উদারনৈতিক মধ্যপন্থীদের লক্ষ্য। এজন্যই ইউরোপের মতো এখানেও রিফর্মেশন তথা নানাবিধ সংস্কারমুক্তির আন্দোলন শুরু হয়। জড়তাবদ্ধ ও কুসংস্কারপূর্ণ হিন্দুধর্মের সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন রাজা রামমোহন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন ভক্তিমার্গের সাধক। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বৈদান্তিক হিন্দু ধর্মকে নতুনভাবে সংস্থাপন করলেন শিকাগো ধর্মসভায়। আবার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে একরকম পরিহার করে মানবতার ধর্ম প্রচার করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর অনুশীলনবাদী হিন্দুধর্মের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে উঠল বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায়। মধ্যযুগ থেকে যেসব সামাজিক কুপ্রথা বাহিত হয়ে আসছিল তা নিবারণের জন্য সচেষ্ট হলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ, বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ রদ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, মদ্যপান নিবারণ ইত্যাদি নানাধরনের সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের তরঙ্গ বয়ে গেল উনিশ শতক জুড়ে। যেহেতু এই শতকটি ছিল চরিত্রে বিমিশ্র, তাই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের একত্র সমাপতন দেখা গিয়েছিল একই ব্যক্তিপুরুষের মধ্যে। যেমন–- উদারনৈতিক মধ্যপন্থার সমর্থক হিসেবে রামমোহন সংস্কৃত ভাষা বর্জন করে ইংরেজিকে শিক্ষার বাহন করে তুলতে চাইলেও খ্রিস্টধর্মের ত্রিতত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও তিনি ছিলেন ব্রিটিশ প্রশাসনের সমর্থক। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন আহার-বিহারে কুসংস্কার বিরোধী, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জাতিভেদপ্রথার অনুগামী। বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ভারতীয় চিরন্তন নারীর আদর্শ কোনোদিনও বিস্মৃত হননি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অগ্রনায়কদের মধ্যেও এই টানাপোড়েন সমানভাবে লক্ষ করা যায়। মধুসূদন এই দলের বাইরে ছিলেন না। তাই ইউরোপের সাহিত্যভাবনা ও আঙ্গিককৌশল তাঁর রচনাকে প্রভাবিত করলেও তিনি তাঁর কাব্য কিংবা নাটকের কোনো কাহিনি বিদেশ থেকে আমদানি করেননি। মধ্যপন্থী হওয়ার কারণে সম্ভবত সংস্কৃত নাট্যরীতি ভাঙতে গিয়েও পুরোপুরি সফল হননি তিনি। প্রহসনের ক্ষেত্রেও ছাপ পড়েছে তাঁর এই দ্বৈত চরিত্রের। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’-য় তিনি যেমন বিদ্রূপ ভরা প্রশ্নে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন তথাকথিত নব্যশিক্ষিত পরানুসারী অন্তঃসারহীন বাবুসমাজ ও সংস্কৃতিকে, তেমনি ব্যঙ্গ ও ঠাট্টায় ভরে উঠেছে ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেকালের ধর্মধ্বজী রক্ষণশীল সমাজ। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো শক্তিশালী লেখকের মধ্যেও ছিল এধরনের স্ববিরোধী মনোভাব। আসলে উনিশ শতকের যুগস্বভাবই ছিল পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবনায় আলোড়িত। মধুসূদন অসাধারণ প্রতিভা-বলে ‘যুগস্রষ্টা’ হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেও বৃহত্তর অর্থে তিনিও ‘যুগের সৃষ্টি’। যুগাতিশায়ী শক্তির অধিকারী হয়েও যুগের স্বভাবের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া সর্বক্ষেত্রে তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। তবুও মধুসূদনকে বন্দনা জানাতে হয় নবমানবতার অন্যতম উদ্গাতা হিসেবে। কেননা তাঁরই পদচিহ্ন অনুসরণ করে মধ্যযুগীয় প্রথাবদ্ধ ও পুচ্ছানুসারী সাহিত্যের অন্ধ তমসাগর্ভ থেকে আলোকোজ্বল নতুন পৃথিবীতে পদার্পণ করেছি আমরা। তাঁর হাত ধরেই পেরিয়ে এসেছি ঈশ্বর গুপ্তের কবিয়ালির যুগ কিংবা রামনারায়ণ তর্করত্নের অনুজ্জ্বল নাটুকেপনা। বাংলা কাব্য ও নাটকের জগতে তিনিই প্রথম আধুনিক।

ইউরোপের মতো বাংলার রেনেসাঁসও হিউম্যানিজমকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। উনিশ শতকে বাঙালি চিন্তানায়করা সবাই ছিলেন কমবেশি হিউম্যানিস্ট। হিউম্যানিজম্-এর মূল কথা হল সবকিছুতে থাকবে মানুষের প্রাধান্য। ধর্ম সমাজ শিক্ষা নীতি আইন দর্শন বিজ্ঞান— এ সবকিছুই মানুষের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশই হবে তাদের লক্ষ্য, সুতরাং মানুষের ঊর্ধ্বে এরা কেউই নয়। অথচ মধ্যযুগে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধর্ম, গোষ্ঠী ও সুপ্রাচীন কাল থেকে অপরিবর্তনীয়ভাবে চলে আসা প্রথা। যখন ধীরে ধীরে  ধর্ম, সমাজ ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার ঘটল, তখন পূর্ব প্রচলিত প্রথাসমূহ থেকে মুক্ত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হল। যুক্তিই আনল সেই প্রত্যাশিত মুক্তি। এই যুক্তিবাদের আশ্রয় ছিল জ্ঞানোদ্দীপ্ত ইউরোপ। শোনা যায়, টমাস পেইন (Thomas Paine)-র ‘দি এজ অফ রিজন’ (The Age of Reason) বইটি জাহাজে করে খিদিরপুর বন্দরে এসে পৌঁছানো মাত্রই কয়েক শত কপি বিক্রি হয়ে যায়। যুক্তির অস্ত্রে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কুপ্রথা ও অনাবশ্যক আচার-বিচারের শক্ত রজ্জু ছিন্ন করে ব্যক্তির মুক্তি ঘটানো হয়েছিল। তাই যুক্তিবাদের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বাংলার নবজাগরণে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবে গণ্য। আবার ব্যক্তির মুক্তির ক্ষেত্রে কেবল পুরুষই বহুকালাগত ‘জরাজীর্ণ আচারের মরুবালিরাশি’ থেকেই মুক্ত হয়নি, সেই সঙ্গে বন্ধনমুক্তি ঘটেছিল নারীরও। এতকাল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ছিল শোষিত, বঞ্চিত, দলিত। অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়ে থেকে সে হয়ে উঠেছিল পুরুষের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের বেতনহীন জোগানদার। চিরদাসীত্বের দর্শনে সে ছিল দীক্ষিত। কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণ মেয়েদের সামনে খুলে দিল আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সার্বিক বিকাশের পথ। অনেকগুলি কুপ্রথার বেড়াজাল থেকে যেমন মুক্তি ঘটল তাদের, তেমনি শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে আধুনিক সমাজ গঠনকার্যের উপযোগী মানবিক উপাদান হয়ে উঠল তারা। বাংলার নবজাগরণের আর একটি বড়ো লক্ষণ ছিল দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ তথা স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটা। এই দেশচেতনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বোধের জাগরণ ঘটে একটা সময় এবং দীর্ঘ সংগ্রামের শেষে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দখলমুক্ত হয়। সুতরাং বঙ্গীয় রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে উপরোক্ত চারটি বিষয়কে — যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নারীশিক্ষা-নারীমুক্তি ও জাতীয়তাবাদ— তার মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করতে হয়। এখন দেখার, মধুসূদনের সাহিত্যে এই প্রসঙ্গগুলি কীভাবে কতটা স্থান অধিকার করেছে।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!