উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
।। দ্বিতীয় পর্ব ।।
মাত্র একটা সপ্তাহ দিন ঘন্টা মিনিটে ফিনিস হয়ে গেল। কোনো হিসেব মেলাতে পারছেন না তানুস্যার সামগ্রিক ভাবনার মধ্যে এত সব বৈচিত্র্য ফুটে উঠল যে কিছুতেই নিজেকে সে সবের সঙ্গে মিল করে উঠতে পারছেন না। প্রতিদিন সকালে নতুন সূর্য উঠল পূর্ব আকাশে, সারা দিন আলো দিল। বিকেল হলে তা ডুবে গেল পশ্চিম দিগন্তে, সন্ধে এল আপন নিয়মে, রাত গভীর হল। তাও সময়ের টানে চলে গেল। আবার নতুন সকাল এল আলো দান করতে কিন্তু প্রকৃতির এত কিছু রূপ বৈচিত্র্য তানুস্যারকে এতটুকু আকর্ষণ করতে পারল না। কেমন যেন এক গভীর বিষাদ ঢেকে রেখেছে তাঁকে। মনের অনুরাগে সদর্থক মেঘ না জমলে কেউ মুখের অবয়বে সুখের হাসি ফোটাতে পারে না। তানুস্যার সেই মানসিক গর্তে ঢুকে পড়েছেন। শিক্ষকতা খুইয়ে নিঃসঙ্গতার গহ্বরে একা একাই দাঁড়িয়ে। একটাই চিন্তা মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। আয়ের উৎস না থাকলে সংসার চলবে কী করে? ক’দিন গেলে যে সেই টান তীব্রতর হয়ে উঠবে, তা নিয়ে তানুস্যারের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। এও জানেন যে গ্রামীণ জীবনে নতুন কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া এত সহজে সম্ভব নয়।
পরের সপ্তাহে সোমবার। প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে তানুস্যার পায়ে পায়ে জয়নগর স্টেশনে এসে উপস্থিত হলেন। স্টেশন সংলগ্ন হাসানপুরেই বাড়ি। প্লাটফর্মের উপরে আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। একটু আগে লক্ষীকান্তপুরগামী ট্রেন এসে চলে গেছে। যাত্রীদের দৌড়াদৌড়ি, ব্যস্ততা তখনও চলছে। যথাসম্ভব দ্রুত অটো, টোটো, রিক্সাভ্যানে নিজেদের গন্তব্যস্থলে চলে যেতে চায় তারা। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই প্লাটফর্ম একরকম ফাঁকা হয়ে গেল। পশ্চিমপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক তানুস্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, শুনতে পাচ্ছেন?
আমাকে বলছেন?
স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্পাদকের বাড়িতে যাব। কোথায়, কোনদিকে, কতটা সময় লাগবে, একটু বলবেন?
আপনি কী বনবিবি উচ্চবিদ্যালয়ের সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
ঠিক ধরেছেন। সমস্যা হল, উনি বলেছিলেন, লোক পাঠাবেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কিন্তু কাউকে তো দেখছি নে। আপনি কী ?
না না, আমি সম্পাদকের লোক নই তবে সমস্যার কথা বলছেন যখন…।
না মানে আমি যাদবপুর থেকে আসছি। সঙ্গে বড়ো ল্যাগেজ রয়েছে। এতগুলো নিয়ে একার পক্ষে তো…।
এভাবে ভাবছেন কেন? আপনার বড়ো ব্যাগটা আমার হাতে দিন। রিক্সাস্টান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসছি।
শহুরে বিজয় সামন্ত খুশি না হয়ে পারলেন না। গ্রামীণ সরলতার ছোঁয়ায় মনে মনে বেশ আপ্লুত হলেন। দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন। সত্যজিৎ রুইদাস, বাড়ি রথতলায়, খবরের কাগজের স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর, তানুস্যারের প্রিয় ছাত্র, অবাক হয়ে দেখল এবং এক পলক ভাবল, তানুস্যার না? এভাবে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছেন? কৌতুহলে বেশ জারিত হল, তা চাপতে না পেরে দ্রুতপায়ে তানুস্যারের সামনে গিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছেন স্যার?
অনেকদিন পর দেখা, কেমন আছ বাবা? শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো? এই ভদ্রলোক কলকাতা থেকে এসেছেন সম্পাদক সাগরের সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু কাউকে রিসিভ করতে পাঠান নি। তাই একটু সাহায্য করে দিচ্ছি।
স্যার, ব্যাগটা আমাকে দিন, ভদ্রলোককে আমিই রিক্সাস্টান্ডে তুলে দিয়ে আসছি।
তানুস্যার মনের আড়ষ্টতায় দুলছেন।
কিন্তু করবেন না স্যার। আমি আপনার অনুগত ছাত্র, এটুকু করে দিতে পারব না কেন? ক’দিন ধরে আপনার বাড়িতে যাব বলে ভাবছি। স্মৃতিগুলো খুব তাড়া করছে। খুব মনে পড়ে স্যার, আপনি আমাদেরকে নিজের ছেলে হিসেবে ভাবতেন। সে সব আজও ভুলতে পারি নি। কোনো কোনো স্মৃতি কেন যে ভোলা যায় না।
তাহলে এই নাও বাবা, তোমার জোরের কাছে হেরে যেতে হল।
স্যার, শিক্ষক জীবনের এটাই সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। তানুস্যার চেয়ে থাকলেন প্রিয় ছাত্রের মুখের দিকে।
স্যার, এসে আরও কথা বলছি।
ভদ্রলোকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সত্যজিতের প্রশ্ন, ক’টার সময় বের হয়েছিলেন?
ভোর পাঁচটার ট্রেনে, সম্পাদকের সঙ্গে সেভাবেই কথা হয়েছিল।
তাহলে উনি কাউকে পাঠালেন না কেন?
সেটাই তো বুঝতে পারলুম নে।
সত্যজিৎ একবার পিছনে তাকিয়ে তানুস্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল, খবরের কাগজের বান্ডিলগুলো প্লাটফর্মের শেষে রয়েছে স্যার। কয়েক মিনিট পরে ফিরে আসছি।
তাহলে তানুস্যার তোমার শিক্ষক? বিজয় সামন্তের আলতো প্রশ্ন।
সত্যজিৎ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
ভীষণ লজ্জা পেয়েছি সত্যজিৎ। এভাবে আমার উচিত হয় নি ওঁকে নিজের প্রয়োজনে লাগানো। মানুষটা কী উদার। দেখে মনে হচ্ছে, তোমাকেও গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে।
সত্যজিৎ গর্ব ভরে বলল, তানুস্যার প্রকৃত অর্থে একজন আদর্শ শিক্ষক। অনেক দিন স্কুল ছেড়েছি কিন্তু আজও ওই স্যারকে ভুলতে পারি নি। যখন কাছে ডেকে নিজের শরীরটা আমার শরীরের সঙ্গে সেঁটে দিতেন, তখন ভিতরে নতুন তৃষ্ণা জেগে উঠত। সেই কবে ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি, শুধু আবছা স্মৃতি বেঁচে আছে মনের ভিতরে। আমি তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আড় চোখে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতুম। শরীর জুড়ে অভিনব কম্পন শুরু হত। এ তো সেই স্নেহ, সেই ভালোবাসা। মানুষ ভেদে স্নেহের স্পন্দন তাহলে একই রকম হতে পারে? দু’চোখে জল ভরে উঠত। ভিতরে ভিতরে কান্না শুরু হত। বোধহয় স্যার সে সব টের পেতেন, মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, ওরে, আমি তো আছি, একই অপত্য স্নেহ পেলেই হল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারতুম না। হারানো বাবার সঙ্গে অভেদ কল্পনা করে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলতুম। স্যার বার বার বলতেন, এ্যাই সত্যজিৎ, তোকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কী ভুল করলুম? জানেন বিজয়বাবু, এমনি কত ছাত্রের জীবনে তানুস্যার দ্বিতীয় পিতা হয়ে বেঁচে আছেন, তা গুণে শেষ করতে পারবেন না।
ততক্ষণে সত্যজিৎ রিক্সাস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল। বিজয়বাবুকে রিক্সাতে বসিয়ে দিয়ে সত্যজিৎ বলল, এই ভদ্রলোক সাগরবাবুর বাড়িতে যাবেন। ওর প্রকৃত নাম শাহিন। রেট অনুসারে ভাড়া নিও। বিজয়বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাহলে আসছি স্যার। আমি খবরের কাগজ সাপ্লাই করি। পরে দেখা হলে তানুস্যার সম্পর্কে আরও অনেক কথা শোনাতে পারব। সেসব শুনতে শুনতে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। অভিজ্ঞতা আর মানবতার তীর্থভূমি। যত জানবেন, ততই আপনার শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে।
বিজয় সামন্তকে নিয়ে রিক্সাওয়ালা এগিয়ে চলল, সত্যজিৎ দ্রুত স্টেশনে ফিরে এল।
তানুস্যার সপ্রতিভ হয়ে বললেন, ভদ্রলোককে রিক্সায় তুলে দিতে পেরেছে তো?
স্যার, বসিয়ে দিয়েই ফিরে আসছি।
বেশ করেছ বাবা। একটা উচিত কর্ম করতে পারলে। কলকাতার মানুষ, রাস্তাঘাট ঠিকমতো চেনেন না। এই সাহায্যটুকু পাবার পরে গ্রাম সম্পর্কে অন্তত একটা ভালো ধারণা নিয়ে ফিরতে পারবেন। তারপর বলো বাবা, তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?
স্যার, সবই সম্ভব হয়েছে আপনার পরামর্শ মেনে নিতে পেরেছি বলেই। বি.এস.সি. পাশ করার পরে হাতে কোনো কাজ ছিল না। আপনিই বলেছিলেন, কাজের ক্ষেত্রে ছোটোবড়ো ভাবনাটা একেবারেই ভুল। যে কোনো কাজ আন্তরিকতা দিয়ে করতে পারলে জীবনে সফল হওয়া যায়। সেই মন্ত্র নিয়ে লেগে পড়েছিলুম, এখন এত খরিদ্দার যে একা একা সামাল দিতে পারি না। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতে হয়। তখন আপনার কথা সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে। প্রতিদিন এত নতুন অর্ডার পাই যে সবগুলো নিতে পারি না। এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম। সকলে বলেন, তানুস্যারের প্রিয় ছাত্র, কাগজ নিলে তোমার কাছ থেকেই নেব। শুনতে শুনতে গর্বে বুক ভরে ওঠে স্যার। এ মাসে নতুন সাপ্লাই নিতে পারব না বলে সব অর্ডার ক্যানসেল করে দিয়েছি।
তোকে একটা কথা বলব সত্যজিৎ?
বলুন স্যার, শুনতে শুনতে তো এত দূর আসতে পারলুম। সত্যজিৎ কাগজ গোছাতে থাকলেও দু’কান খাড়া করে রাখল তানুস্যারের কথায়।
স্কুলের চাকরিটা তো আর নেই রে।
কী বলছেন স্যার?
যেটা বাস্তব সেটাই বললুম তোকে।
তাহলে চলবে কী করে?
তোর ব্যবসাতে আমাকে নিতে পারিস না?
কী যে বলেন স্যার?
তুই কী এখন কাজের ক্ষেত্রে ছোটোবড়ো ভাবতে শিখেছিস?
তা শিখি নি, কিন্তু…
একটা কিছু না করলে পেট চলবে কী করে?
সত্যজিৎ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তানুস্যারের দিকে। ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ভাবতে গিয়ে কেমন যেন দু’চোখ জলে ভরে উঠছে। যেন বাপ তার ছেলের কাছে মনের আর্তির কথা বলছে। দু’চোখ রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল, বেশ তো, আমি মোট চারটে এলাকাতে কাগজ দিই। আজ থেকে দুটো এলাকার দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিলুম। সব লাভ আপনার। এই লিস্টটা ধরুন স্যার। নতুন ক’জনকে আজ থেকে কাগজ দিতে হবে বলেই তালিকাটা আবার তৈরি করে নিতে হয়েছে। সব বাঁধা খরিদ্দার। ক’দিন দেখলে মুখস্ত হয়ে যাবে। অতিরিক্ত পাঁচটা কাগজ নিয়ে যান, পারলে বিক্রি করবেন, না পারলে এসে আমাকে ফেরত দেবেন। ওগুলো আমি বিক্রি করে দিতে পারব। এর সম্পূর্ণ লাভ আপনিই পাবেন। ফিজা পড়ছে তো? শুনেছি, খুব বুদ্ধিমতি। ওকে গড়ে তোলার জন্যে আপনাকে বড়ো দায়িত্ব নিতে হবে স্যার।
নিজে ভেঙে পড়ে অন্যকে ঠিকমতো গড়ে তোলা যায় না রে।
সত্যজিৎ থমকে যেতে বাধ্য হল।
তানুস্যার আরেকটু সরে গিয়ে চেয়ে থাকলেন সত্যজিতের মুখের দিকে। মনের অজান্তে হাতের পাঁচ আঙুল কখন প্রিয় ছাত্রের কাঁধ ছুঁয়ে গেছে। সত্যজিতের মধ্যে পুরনো স্মৃতিটা আবার ভুস করে ভেসে উঠল মনের পাতায়, শরীর জুড়ে সেই পুরনো হিল্লোল। একই অপত্য স্নেহ। একই ভালোবাসা। একই আন্তরিকতা। শরীর ভেদে দু’জন পৃথক মানুষের ভিতরে একই সত্তার রিদম এভাবে একই ভাবে বাজতে পারে? অপার অনুভূতিতে সত্যজিৎ ভেসে যেতে থাকল। টুপ করে তানুস্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে নিল। ছলছলে দু’চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ল তানুস্যারের পায়ের উপর।
কাঁদছিস সত্যজিৎ? ব্যবসায় এত বড়ো সাফল্যের পরে কাঁদতে নেই রে।
না না স্যার, অন্য কারণে।
আমি তো শুধু উপদেশ দিতে পেরেছি।
রুমালে চোখ মুছতে মুছতে সত্যজিৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আর দেরি করবেন না স্যার। একটা কিছু পেয়ে গেলে ব্যবসাটা আপনার হাতেই তুলে দেব। তখনও এমনি করে রোজ সকালে স্টেশনে আসব আপনাকে সাহায্য করতে।
আবেগে আন্দোলিত হতে হতে অস্ফুটে তানুস্যারের প্রশ্ন, তখনও?
সত্যজিৎ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। একটাই প্রশ্নে বার বার আন্দোলিত হতে থাকল। এখনও এমন কঠিন হৃদয়ের মানুষ আছেন যিনি দেবতাতুল্য তানুস্যারকে বিনা কারণে শাস্তি দিতে পারেন?
নিথর তানুস্যার সত্যজিতের শরীর ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা অদ্ভুত রোমন্থন সত্যজিতের মনের সমুদ্রে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠছে।
চলবে…