বিবর্ণ অভিযোজন: পর্ব ৬

উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।

।। ষষ্ঠ পর্ব ।।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাথার উপরের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। রোদের তাপ ক্রমে কমছে। ফুরফুরে হাওয়া। গাছের ছায়া প্রকৃতির নিয়ম মেনে দীর্ঘতর হচ্ছে। লিজা তানুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে এল। হৃদয়ের গভীরে খুশির হাওয়া। মাম্মুকে সামনে পেয়ে বলল, কাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি দ্যাখো।।
তানুবাবাজি, তোমার চাকরি পাওয়ার খবর ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি। খুব খুশি হয়েছি বাবা।
ক্ষমা করবেন, ক’দিন প্রবল টেনশনে থাকতে হয়েছিল বলে আপনাকে জানাতে পারিনি। বলতে পারেন, একটা বড়ো ভুল হয়ে গেছে। সে জন্যে আজ নিজেই এসেছি আপনাদেরকে মিষ্টি খাওয়াতে।
তানিস বেজায় খুশি। ছেলেটা বেশ। ভিতরে যথেষ্ট সামাজিক বোধ রয়েছে। সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলার মন রয়েছে বলেই এভাবেই কথা বলতে পারল। মনের ভিতর একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আর দেরি করা চলে না। ছেলেটা চাকরি পেয়েছে যখন, আজকের মধ্যে প্রস্তাবটা পাকা করে নেওয়া প্রয়োজন। লিজা সঙ্গে রয়েছে। তাই ধরে নেওয়া যায়, তানুর সম্মতি রয়েছে। তবুও তো তো করে বলল, তোমাকে একটা প্রস্তাব দেব বাবা?
অবশ্যই বলতে পারেন।
লিজার মাম্মি এগিয়ে এল প্রস্তাবটা খুলে বলতে।—শোনো বাবা, অনেক দিন ধরে ভাবলেও কথাটা তোমাকে খুলে বলতে পারি নি। তোমার চাকরির খবর শুনে আমরা খুব খুশি হয়েছি। এখন তুমি রাজি থাকলে লিজার সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রসঙ্গটা পাকা করে ফেলতে পারি।।
লজ্জিত লিজা রিক্তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মাম্মি…।
এতে লজ্জা করার কিছু নেই রে মা। বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। তানুর মতো ছেলে তোমার ভাগ্যে জুটেছে। কপাল চওড়া হলে এমনিই হয়।
তানু সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল, মাসিমা, আমার তো কেউ নেই, আপনারা যা ভালো বুঝবেন, তাই করুন। আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি।
তাহলে কী ১৫ ফাগুন কাজটা সেরে ফেলতে পারি? ওই দিন তোমার কোনো বিশেষ অসুবিধা নেই তো?
মাসিমা, আপনাদের সিদ্ধান্ত আমার কাছে ফাইনাল।
মাম্মু তানিস পরম খুশি হয়ে বলল, তোমার মনটা কী ভালো বাবা। খুব নিশ্চিন্তে ভরসা করতে পারছি। এটুকু থাকলে তো নির্ভয়ে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়।।
তানু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো গিলতে থাকলেও নিজের বিয়ে বলেই ভিতরের উচ্ছ্বাস এতটুকু প্রকাশ করল না। চাপা স্বরে বলল, তাহলে আজ আসছি মাসিমা, আপনারা আমার সব, যা করবেন, তা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।
পড়ন্ত বিকেলে দ্রুত নেমে আসা সূর্য শেষ উজ্জ্বলতা সবুজ মাঠে ছড়িয়ে সরে পড়ার তাগিদে ব্যস্ত। তানিস আর রিক্তা সন্ধের আবছা অন্ধকারে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে। মনের আবেগে উচ্ছ্বসিত হতে হতে তানুকে নিয়ে নতুন নুতন মূল্যায়ণে ভাসছে। ছেলেটা কী ভালো। উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত, স্বপ্নভাসি, সামাজিক, বড়োদের প্রতি খাঁটি শ্রদ্ধাশীল। রিক্তা চাপা স্বরে বলল, তাহলে তো খুব বেশি দিন বাকি নেই, সাগরকে ডেকে পাঠালে বিয়ের কাজটা সুষ্ঠুভাবে সারার জন্যে কথা বলতে পারি। বনেদি বাড়ির ছেলে তো। কাজ কর্ম বেশ উতরে দিতে শিখেছে।
তাহলে কী জগাকে পাঠাবো?
সম্ভব হলে ওকে পাঠিয়ে সাগর শাহিনকে ডেকে নাও।।
সন্ধে ৭টা। বারান্দায় বসে তানিস আর রিক্তা লিজার বিয়ে নিয়ে নানা আলোচনায় ব্যস্ত। চনমনে সাগর জগার সঙ্গে ভিতরে ঢুকে বলল, আমাকে ডেকেছেন মাসিমা?
হ্যাঁ বাবা, লিজার মাম্মু তোমার সঙ্গে লিজার বিয়ে নিয়ে আশু কথাগুলো সেরে ফেলতে চাচ্ছে।
বেশ তো বলুন শুনি।
আমার পাশে এসে বসো বাবা, লিজাকে বলল, আর এক কাপ চা বেশি করিস মা। সাগর আমার খুব প্রিয় ছেলে।
লিজার উত্তর, তাহলে রান্নাঘরে যাচ্ছি।
তাই যাও মা, আমি ততক্ষণে সাগরের সঙ্গে দরকারি কথাগুলো সেরে নিই। সাগরকে শুনিয়ে আবার বলতে শুরু করল, তুমি চলে যাবার পরে তানু নিজেই আমাদের বাড়িতে এসেছিল। লিজার সঙ্গে বিয়ে হওয়া নিয়ে নিজের সম্মতির কথা জানিয়ে গিয়েছে। সেজন্যে আবার তোমাকে ডাকতে হল বাবা। তোমাকে ছাড়া আগে এ বাড়িতে কোনো কাজ হয়নি, আজও হবে না। তাই বলছি সব ঝক্কি নিজের কাঁধে নিয়ে শুভ কাজটা সেরে দিতে পারলে আমরা খুশি হই। পয়সা-কড়ির দিক থেকে কোনো কার্পণ্য করব না বাবা। এই তো শেষ কাজ, সকলে অন্তত জানুক, ভাগনির বিয়েতে আমি কার্পণ্য দেখাই নি। জীবনের এ পাওনা একেবারে কম নয় বাবা। লিজার মা পরোলোকে বসে ভাবতে পারবে যে তার দেওয়া দায়িত্ব আমি ঠিকমতো পালন করতে পেরেছি।
শেষতম চেষ্টা করব। আপনারা বিশ্বাস রাখতে পারলে ভাবতে পারব, আমিও কোনো কাজে অন্যের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারি। আর কিছু থাকলে বলুন।
মনে মনে তোমাকে একান্ত আপন বলে মনে হচ্ছে বাবা।
লিজা রান্নাঘর থেকে বলল, চা হয়ে গেছে মাম্মু।
তাহলে আনো মা। সাগরের ব্যস্ততা রয়েছে। ব্যবসা আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ছেলেটা। তাতেই অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয়। রোজকার হিসেব নিকেশ মেলানো, লোকজনদের আর্থিক চাহিদা মেটানো, মালপত্র আনা, চালান মিলিয়ে দেখা। নানান ঝামেলা নিয়ে চলতে হয় সাগরকে।
লিজা চা দিতে এল। সাগর একবার আড়চোখে লিজাকে দেখে নিল। ভিতরের ভাবনায় একটাই প্রসঙ্গ আছড়ে পড়ছে, লিজার কী সেই মন নেই যা দিয়ে সে তার মনকে বুঝতে পারে? মেয়েটা কেন বুঝতে চায় না, তার সব চিন্তা লিজাকে নিয়েই।
সাগরের ভিতরটা যেন নদীর জোয়ারে ছুটে চলা একটা ছোট্ট পানসি। তাতেই একা বসে আছে সে। খুব ইচ্ছে করছে, লিজা এসে তার পাশে বসুক। গল্পে গল্পে সময় পার হয়ে যাক। কিন্তু সেই সুযোগ যেন ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। একটা অবাক ভাবনা সাগরকে বার বার বিড়ম্বিত না করে পারছে না। যে ছেলেটাকে তার বাবা হাতে ধরে নিজেদের স্কুলে চাকরি করে দিল, সে লিজার মন চুরি করে নিয়ে তার পথে মূল কাঁটা হয়ে উঠতে পারল? জীবন কী এমনি করে মাঝে মাঝে প্রকৃতির নিয়ম মেনে মানুষের চাহিদার পথে ছুটে চলে? তা ঘুরিয়ে নিজের পক্ষে নেওয়ার কোনো যাদুমন্ত্র নেই মানুষের হাতে?
চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই সাগর বারান্দা থেকে উঠোনে নামল। মুখ ঘুরিয়ে শুধু বলল, আসছি মাসিমা।
কেন এত মন খারাপ, বলে গেলে ভালো করতে বাবা।
না না, ও কিছু নয়। অন্ধকার রাস্তায় টর্চ ফেলে হন হন পায়ে সামনে এগিয়ে চলল। চারদিকে অন্ধকার, টর্চের আলো পথ চেনার মতো পরিসরকে কেবল আলোয় ঝলমলিয়ে উঠছে। তাতেই দুলছে সে। মাঝ রাস্তায় এসে থমকে দাঁড়ালো একবার। কোকিলের ডাক ভেসে আসছে কানে। শীতের হাড় কাঁপুনি ঠান্ডা শেষ হলে বসন্তের শুরুতে এমনি করে কোকিল ডেকে নতুন প্রাকৃতিক সম্ভারকে স্বাগত জানায়। ঋতুচক্রের এমনিই নিয়ম। শীত আসে, আবার চলে যায়। ভিতরে ভিতরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে শুরু করল সাগর। বিড় বিড় করে বলল, লিজাকে কোনোক্রমে তানুর হাতে তুলে দেওয়া যায় না। ও ভেবেছে কী, আমার পিতার হাত থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আমাকেই বঞ্চিত করবে? তানু যে কোন্ সাহসে এত স্পর্ধা দেখাতে পারছে, তা মাথায় এল না সাগরের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলল, কত ধানে কত চাল, তা তোমাকে বুঝিয়ে দেব তানু।

তানুর মধ্যে খুশির হাওয়া বইছে তিরতির করে। ভিতরে রয়েছে নতুন বসন্তের ইমেজ। বিয়ের সম্মন্ধ ঠিক হয়ে গেলে প্রত্যেক যুবকের মধ্যে এমনি উতলা অবস্থান তৈরি হয়। তানুও তার ব্যতিক্রম হতে পারে নি। এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও তানুর ভিতরে অনুক্ষণ অনুভবের জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। পরের দিন নিয়ম করে আকাশে চাঁদ উঠেছে। তানুর ভাবনা, এ চাঁদের বাহার কেবল তার বিয়েকে উপলক্ষ করেই। রাত শেষ হলে নতুন সকাল শুরু হয়েছে সাতরঙের বিস্তার নিয়ে। তানুর বিহ্বল ভাবদ্যোতনা, এ সকাল এসেছে তার শুভ বিবাহকে স্বাগত জানাতে। দখিনে বাতাসে গাছে গাছে পাতায় পাতায় মর্মর ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়েছে। তানুর মনে হয়েছে, সবুজ পাতার এ কম্পন তার ভিতরের কম্পনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দুপুরে সূর্যালোকের সাত রঙে আলোর উদ্ভাসে চারদিকের প্রকৃতি উজ্জলতর হয়ে উঠেছে। তানুর ভাবনা, এ সূর্য যেন তার মনের রঙবাহারকে প্রকাশ করে চলেছে।
পরদিন সন্ধেয় কপালে হাত রেখে অনুভব করতে পারল যে কাশির সঙ্গে শরীরে জ্বর জ্বর ভাব রয়েছে। বিয়ের আগে এভাবে শরীর খারাপ হওয়া ঠিক নয়। ভাবনার গতিপথে নিজেই সিদ্ধান্ত নিল, আজকালের মধ্যে কোনো পাশ করা ডাক্তারকে দেখানো খুব প্রয়োজন।
পরের দিন শনিবার। সকাল সাতটায় এম বি বি এস জলিলের ডিসপেন্সারিতে উপস্থিত হয়ে দেখল, সবে রোগীদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দু’জন পেশেন্ট নাম লিখিয়ে দিয়েছে। নিজেও নাম লিখিয়ে দিয়ে তানু ভাবল, ডাক্তারবাবুর যথেষ্ট হাতযশ রয়েছে। ওষুধ খেলে দু’চারদিনের মধ্যে শরীর ঠিক হয়ে যাবে। হাত ঘড়িতে সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। ডাক্তার জলিল এসে ডিসপেন্সারিতে বসলেন, এ সময়নিষ্ঠা তার জীবনের নতুন কোনো বিষয় নয়। ডাকলেন, কৃষ্ণ চ্যাটার্জি ভিতরে এসো।
ডাক্তারবাবুর প্রিয় কম্পাউন্ডার। অনেক বছর তাঁর সঙ্গে রয়েছে। ভিতরে ঢুকে বলল, বলুন ডাক্তারবাবু।
তাহলে পরপর পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
রামপ্রসাদ ঘোষ আগে আসুন।
নতুন সকালে ডাঃ জলিলের রোগ নিরীক্ষণ শুরু হল। ডাক্তারবাবুর প্রথম প্রশ্ন, কী কী অসুবিধায় ভুগছেন বলুন?
গায়ে ভীষণ জ্বর। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। দিনের চেয়ে রাতে জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। সারা শরীরে ব্যথা রয়েছে।
ডাঃ জলিল একটু ভেবে নিলেন। প্রেসক্রিপশন করে দেবার পরে বললেন, সাতদিনের ওষুধ দিলাম। আশা করছি, আর আসতে হবে না। এতেই কিওর হয়ে যাবে।
যাবার সময় রামপ্রসাদ বললেন, আসছি ডাক্তারবাবু। অসুখ বিসুখ হলে আপনার এখানেই আসি। আমার বড়ো ছেলে আপনাকে খুব প্রেফার করে।
ওকে আমি চিনি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, গত মাসে জ্বর নিয়ে আপনার কাছে এসেছিল।
প্রয়োজন হলে আবার আসবেন।
রামপ্রসাদের মুখে উচ্ছ্বাসের হাসি।
দ্বিতীয় রুগি সুশান্ত মিত্র, পেশায় উকিল। ডিসপেন্সারিতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, গত সপ্তাহে ওষুধ খেয়ে হাঁটুর ব্যথা অনেকখানি সেরে গেছে।
ডাঃ জলিলের অন্যতম পুরানো পেশেন্ট হলেন সুশান্ত মিত্র। নতুন প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে ডাঃ জলিল বললেন, বাকিটুকু সেরে যাবে আজকের দেওয়া ওষুধগুলো খাওয়া শেষ হলে। সাবধানে থাকবেন। সবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। বাত-বেদনা বৃদ্ধির সময়। একটু সচেতন থাকলে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তারপর ওকালতি কেমন চলছে বলুন?
অনেকখানি প্রসার বেড়েছে।
পুরানো হলে প্রসার বাড়বে। এটাই নিয়ম। ডাক্তার উকিলের ক্ষেত্রে একথা সর্বাংশে সত্যি।
সুশান্ত মিত্রের মুখে হাসি।
তিন নম্বরে ছিল তানুর নাম। ভিতরে ঢুকতেই ডাঃ জলিলের প্রশ্ন, কাশির বেগ বেশ আছে দেখছি। আর কী কী সমস্যা অনুভব করছেন?
গায়ে জ্বর শুরু হয়েছে। রাতে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। পরের বুধবার আমার বিয়ে। রাতে কাশি বাড়ে ডাক্তারবাবু। মাঝে মাঝে কাশির ধমকে শ্বাস-প্রশ্বাসে টান পড়ে যায়, বিশেষ করে ভোরের দিকে।
ডাঃ জলিল তানুকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। মিনিট পাঁচেক পরে প্রশ্ন করলেন আরও কিছু সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গের উত্তর জেনে নিতে। ডাঃ জলিলের চোখে মুখে অভিনব উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছিল। তা তানুর চোখ এড়িয়ে গেল না।
কম্পাউন্ডার কৃষ্ণ ডিসপেন্সারির মধ্যে উপস্থিত ছিল। ডাঃ জলিল বললেন, তিন নম্বর পেশেন্টের রক্ত পরীক্ষা করা খুব জরুরী, ফলাফল না জেনে চিকিৎসা শুরু করা যাবে না, এখনিই রক্ত নিয়ে শুভ ডায়গনোস্টিক সেন্টারে চলে যাও। তানুকে বললেন, আপনাকে ততক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতেই হবে।
কৃষ্ণ তৎপর কম্পাউন্ডার, খুব বিশ্বাসী। তানুর রক্ত নিয়ে ছুটলেন শুভ ডায়গনোস্টিক সেন্টারের উদ্দেশ্যে, মনে মনে ভাবল, ডাক্তারবাবু পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় খারাপ কিছু দেখলেন না তো? প্রায় ক্ষেত্রে কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পরে প্রয়োজন হলে ব্লাড পরীক্ষার কথা বলেন। সেই অর্থে আজকের রক্ত পরীক্ষার ফরমান সত্যি সত্যি ব্যতিক্রম।
শুভ ডায়গনোস্টিক সেন্টারে উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণ দেখল, শাহিন সাগর খুব নিবিষ্ট মনে নিজের কাজে ব্যস্ত, জানালার ফাঁকে মুখ রেখে বলল, আসব সাগরদা?
আরে, এসো এসো। পার্টির মিটিং মিছিলে তোমাকে আর পাই নে কেন ?
ডাক্তারবাবুর কাছে রোজ এনগেজমেন্ট থাকে। বেরোনোর সুযোগ পাই না, একটা জরুরী রিপোর্ট করে দিতে হবে, পেশেন্ট বসে রয়েছে।
এত বেশি প্রয়োজনীয়?
ডাঃ জলিল সেকথা বলে পাঠিয়েছেন।
তাহলে দাও দেখি।
কম্পাউন্ডার কৃষ্ণ হাত বাড়িয়ে দিল।
সাগর তা নিয়ে চেম্বারে ঢুকে প্রেসক্রিপশনটা আবার ভালো করে পড়ে নিলেন। তানু অসুস্থ? তার রক্তের জরুরী রিপোর্ট চেয়েছেন ডাক্তারবাবু? সাগরের বুকের গভীরে একটা অদম্য ইচ্ছা দ্রুততালে ওঠানামা করতে থাকল। মুখটা বজ্রকঠিন করে বেশ কিছু সময় চেয়ারে বসে থাকলেন। দাবা খেলার আসরে তাকেই যে উপযুক্ত দাবাড়ু হয়ে উঠতে হবে, সেই ইচ্ছা জেগে উঠল সাগরের মনে। তানুর ইচ্ছেকে যে কোনো মূল্যে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। বিড় বিড় করে বললেন, অস্ত্র পেয়ে গিয়েছি তানু, তোমাকে এত গভীর গাড্ডায় ফেলে দেব যে কিছুতেই তা থেকে উঠে আসতে পারবে না।
সামনের টেবিলে রয়েছে লিজার রঙিন ছবি, চেয়ার টেনে নিয়ে সেদিকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকলেন সাগর। অস্ফুটে বললেন, সুন্দরী, হয়তো তুমি আমাকে চাও না কিন্তু আমি যে তোমাকে খুব করে চাই। তোমাকে ছাড়া আমি যে চলতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করে দিও লিজা, তোমাকে চিরদিনের জন্যে কাছে পেতে বোড়ের উপযুক্ত চাল তৈরি করে ফেলেছি। তানু তা থেকে কিছুতেই বের হতে পারবে না।
ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে সাগরের হৃদয় সত্যি সত্যি সাগর হয়ে উঠছে। মনোযোগ দিয়ে ব্লাড রিপোর্ট তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিলেন। কমপাউন্ডার বাইরে অপেক্ষায় থাকল। সাগর বাইরে এসে বললেন, রিপোর্টটা নাও কৃষ্ণ। ডাক্তারবাবু কেন যে এত দ্রুত রিপোর্ট চেয়েছেন, তা বেশ বুঝতে পারছি।
রিপোর্টে খারাপ কিছু ধরা পড়ে নি তো?
কৃষ্ণ, রিপোর্টের ফলাফল সত্যি খুব খারাপ কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই। যা দেখেছি, তাই লিখে দিতে বাধ্য হয়েছি।
তাহলে সত্যি সত্যি ব্লাড ক্যানসার হয়েছে?
শোনো কৃষ্ণ, আমি তো ভুল রিপোর্ট দিয়ে রুগিকে ঠকাতে পারি না।
কিন্তু, এ রিপোর্ট দেখে কী ভাবে রুগিকে বলব?
ভুলে যেও না, আমার যে নিজস্ব মূল্যবোধ রয়েছে, তা কোনো অবস্থাতেই বিসর্জন দিতে পারি না, নিজের কর্তব্যে কখনো ফাঁকি দিইনি, আজও সেই অবস্থানে রয়েছি।
কৃষ্ণ বিবর্ণ মুখে, বিষণ্ণ মনে ডায়গনোস্টিক সেন্টার থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল, সাগর আবার ল্যাবের ভিতরে ঢুকে লিজার ফটোর সামনে বসে নিজস্ব মৌতাতে ডুবে থাকলেন।
একটা অজানা জয়ের আগাম সংবাদে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
তাহলে তানু শেষ পর্যন্ত লিজাকে পাবে না? তার বিয়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? সাগরের মধ্যে প্রশ্নের বিহ্বলতা, এও ভাবলেন যে লিজাকে খুব করে বোঝাতে হবে। বিকল্প গ্রহণ করে জীবনে যে সুখি হওয়া যায়, সেই ভাবপ্রবণতা ঢুকিয়ে দিতে হবে লিজার মধ্যে।
কম্পাউন্ডার কৃষ্ণ চিন্তিত হয়ে পথ চলছে। কেবল ভাবছে সাগরের কথাগুলো নিয়ে। ক্যানসার মানে নো এ্যান্সার। এ তো সবার জানা কিন্তু তা ঠিক বিয়ের আগেই ধরা পড়ে গেল? সাগরদা ঠিক কথাই বলেছেন, নিয়তির উপর মানুষের কোনো হাত নেই। বিজ্ঞান নানা শক্তি দিয়ে আমাদের জীবনে নানা সুখ শান্তি এনে দিতে পেরেছে কিন্তু অকাল নিয়তিকে জয় করার কোনো চাবিকাঠি মানুষের হাতে তুলে দিতে পারে নি।
তানু তখনও চিন্তিত মনে ডাঃ জলিলের ডিসপেন্সারির সামনের বেঞ্চে বসে। ভাবছে, ডাক্তারবাবু তার রক্ত পরীক্ষার উপর এত জোর দিতে গেলেন। কেন? তাহলে কী অন্য বিশেষ রোগের কথা ভেবেই এমনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ? কৃষ্ণকে হনহন পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল, রিপোর্ট ভালো তো?
কৃষ্ণর মুখ থমথমে।
তানু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কী রিপোর্ট দিয়েছে দেখি?
কৃষ্ণর গম্ভীর উত্তর, আগে ডাক্তারবাবুকে দেখাতে হবে।
কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছ নাতো?
তোমাকে সব কথা ডাক্তারবাবুর মুখ থেকে শুনতে হবে।
যা লেখা আছে, তার বাইরে তো ডাক্তারবাবু নতুন কিছু বলবেন না। তাহলে তুমি এত সংকোচবোধ করছ কেন?
মেঘলা আকাশ কৃষ্ণর মুখ জুড়ে, শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা দূর করে চাপা স্বরে বলল, তোমার ব্লাড ক্যানসার হয়েছে, রিপোর্টে তাই আছে।
স্তম্ভিত হয়ে যেতে বাধ্য হল তানু, বিড় বিড় করে বলল, না না, এ হতে পারে না, লিজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার ভালোবাসা আমার কপালে নেই লিজা। আমার শিক্ষকসত্তা নিয়ে বলছি, এ রিপোর্ট লুকিয়ে আমি তোমাকে ঠকাতে পারব না, তাহলে মনুষত্বকে অপমান করা হবে, একটা জীবন নষ্ট করে ডাকাতি করার মতো ঘৃণ্য অপরাধ আমি কিছুতেই করতে পারি না।

চলবে…

আরও পড়ুন: বিবর্ণ অভিযোজন: পর্ব ৫

Facebook
Twitter
LinkedIn
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!