।। এক।।
সংস্কৃতির বিকাশে যুগ যুগ ধরে সাধারণ গণমানুষ মুখ্য ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। ধর্মীয় পরিমণ্ডলের একটি প্রার্থনা পর্ব, যার রীতিনীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে ব্রাহ্মণ উপাসনা সম্পন্ন করেন। এই পর্বে শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুসারিগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ধর্মীয় উপাসনার পাশাপাশি আরেকটা পর্ব থাকে। যাকে আনুষ্ঠানিকতার উৎসব বলা হয়। এই উৎসব লোক সংস্কৃতির সাথে আধুনিক যুগের নানা প্রবাহের সংকরে ‘জন-উৎসবে’ পরিণত হয়। যেখানে নানাবিধ কৃত্য, গীত, নৃত্য ও আহারাদির আয়োজনে সামাজিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
বাংলাদেশ সহ ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা বৃহৎভাবে পালিত হচ্ছে। এই পূজার উদ্ভব বিকাশ ভারতবর্ষে, বাংলায়। দৈনিক প্রথম আলোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপ ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘বিগত বছর ৩১ হাজার ৪৬১টি দুর্গাপূজা হয়েছিল। সেই হিসাবে এবার ১ হাজার ৮৯৪টি দুর্গাপূজা বেশি’ হলো।
বিভিন্ন পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পূজামণ্ডপে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার তথ্য জানা যায়। অতি উৎসাহীরা, ইসলামের ফতোয়ার নামে যেসব উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তার সাথে ইসলামের এবং সকল মুসলিমের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মের দোহাই দিয়ে উদ্ভূত ঘটনার বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন, জ্ঞানবুদ্ধিওয়ালারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর-একটি বিষয় বলতে চাই, পূজামণ্ডপ রক্ষা ও পাহারা দেবার জন্য অন্যধর্মের লোকজনের উপস্থিতি, অবস্থান দীর্ঘসময় হলে ধর্মের স্বাভাবিক কৃত্য বিঘ্ন হতে পারে।
বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষতা। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্গাপূজাকে নিয়ে নানারকম সংশয়-সংকট-শঙ্কা বিভিন্ন পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশা করি, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। তথাপি দুর্গাপূজার সময়কালে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা কারো কাম্য হতে পারে না। আমরা আশা করব, সরকারের গৃহিত পদক্ষেপে নির্বিঘ্নে শঙ্কামুক্ত হয়ে সকলেই পূজা-উৎসব সম্পন্ন করতে পারবেন। এই বছর সরকারের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতা প্রশংসনীয় মনে হয়েছে।
।। ২।।
বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কলকাতার দুর্গাপূজাকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমানিটি’ হিসেবে তালিকায় যুক্ত করেছে। ২০২১ সালের ১৩ থেকে ১৮ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ইন্টারগভর্নমেন্ট কমিটির ১৬তম অধিবেশনে স্বীকৃতির বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।
বাংলার দুর্গাপূজা উৎসবের স্বীকৃতি অপার আনন্দের এবং মর্যাদার বলে মনে করি। ইউনেস্কোর কার্যক্রমকে অভিনন্দন জানাই।
বাংলাদেশের চারটি এবং ভারতের চৌদ্দটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত বিশ্বসংস্কৃতির ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের ০৪টি হলো– বাউল গান, জামদানির বুনন শিল্পরীতি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, শীতলপাটি।
ভারতের ১৪টি হলো- কুদিয়াত্তম, বৈদিক মণ্ত্র, রামলীলা, রামমন, ছৌ নাচ, কালবেলিয়া, মুদিয়েত, বৌদ্ধমণ্ত্র, মণিপুরী সংকীর্তন, থাথেরা, নওরোজ, যোগ, কুম্ভমেলা, দুর্গাপূজা।
।। ৩।।
সকল ধর্মীয় প্রথার ভেতর আধ্যাত্মিক, সামাজিক জীবন আচার, কৃত্য প্রথা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অনবদ্য হয়ে প্রকাশ পায়। নৃ-গবেষণায় দেখা যায়, সমাজে মানুষের সামাজিক বিভাজন বৃত্তিকে সম্পৃক্ত করে অগ্রসর হয়েছে। বাঙালিকে বর্ণভেদে ছত্রিশ জাতে বিভাজন আনুমানিক তের শতকের দিকে সংকলিত বৃহদ্ধর্ম পুরাণে লক্ষ্য করা যায়।
প্রাচ্যের মানুষের আত্মপ্রত্যয় ও জীবনের নিরাপত্তা আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যকে উদ্যম আনন্দে বিশ্বাস সংস্কারে জীবন জীবিকায় প্রতিফলন করে। ফলে বহুকাল অববাহিকার আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য সংস্কৃতির বিবর্তনে ‘ মাতৃদেবী’র শক্তিশালী রূপের আবর্তন ঘটে। আরাধনা, সঙ্গীত, নৃত্যনৈপুণ্যে সংস্কৃতির সম্প্রীতিকে জাগ্রত করে।
হেনরি ও লংফেলোর মতো বলতে হয় Music is the universal language of mankind. তাইতো দুর্গা পূজার সময়কালকে শারদীয় উৎসব বলা হয়ে থাকে। শব্দযন্ত্রে সুমধুর সংগীত বাজতে থাকে, সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, মান্না দে’সহ সমকালের শিল্পীদের গান।
১৯৪১ সালে কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতায় সুরারোপ করেন সঙ্গীতজ্ঞ গিরীন চক্রবর্তী। লক্ষ্য করি, পূজা উপলক্ষ্যে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরে হৈমন্তী শুক্লার গান, ওস্তাদ আলী আকবরের সুরে শিল্পী আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গান, সঙ্গীতজ্ঞ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২টি গানের কথায় পন্ডিত রবিশঙ্করের সুরারোপ, শিল্পী কিশোর কুমারের গানে শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সুর সহ অসামান্য সংগীতের নিদর্শন মেলে। তখন বলতে ইচ্ছে করে, শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান, স্মৃতির জানালা খুলে চেয়ে থাকি/ চোখ তুলে যতটুকু আলো আসে, সে আলোয় মন ভরে যায়।”
উৎসবের মন্দির তটে গীত হয়, এলো মা আমার, ঢাক বাজা কাসর বাজা, এলোরে এলো দর্গা মা, আসে মা দুর্গা আসে, দুর্গা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, অয়ি গিরিনন্দিনী নন্দিতমেদিনি, সবার দুর্গা মা সহ বেচিত্র্যের গান। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালে দুর্গা পূজা সংস্কৃতির সম্প্রীতি গড়ে তুলেছে।
৪. বাংলাদেশে দুর্গাপূজার আনন্দ তীর্থের উৎসবে সকল ধর্মের লোকজন ও গণমানুষ মিলিত হয়ে থাকে। কারণ ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও উৎসবের বৈশিষ্ট্য গণসংস্কৃতিতে রূপান্তর ঘটেছে। দুর্গাপূজার বিগত সময়ের আয়োজন উল্লেখ করা হলো।
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বত্রিশ শয়ের অধিক দূর্গামন্ডপ তৈরি হয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ি দেখা যায়, ২০২০ সালে পুজামন্ডপ ছিল ৩০ হাজার ২১৩টি। ২০২১ সালে পুজামন্ডপের সংখ্যা ৩২ হাজার ১১৮ টি। ২০২২ সালে ৩২ হাজার ১৬৮টি, যা এটি আশাব্যঞ্জক। প্রতিবছর বাগেরহাটের শিকদার বাড়ি বৃহৎ পূজামণ্ডপ তৈরি করে থাকে। ২০১৯ সালে বাগেরহাটের শিকদার বাড়িতে সর্ববৃহৎ পূজামন্ডপ তৈরি হয়েছিল। ৮০১ টি মূর্তি দিয়ে সেখানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দূরদূরান্ত থেকে বহু লোকের আগমন ঘটে ঐ এলাকায়। ২০১০ সালে ২০১ টি মূর্তি দিয়ে বাগেরহাটের খানপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর গাঁয়ের ব্যবসায়ী লিটন শিকদার ‘ শিকদার বাড়ির পূজা’ হিসেবে দূর্গাপূজা প্রচলন করে। ২০১৯ সালে স্থানীয় মৃৎশিল্পী বিজয় কৃষ্ণ বাচাড় ও ১৫ জন সহ মৃৎশিল্পী নিয়ে ৬ মাস ধরে মূর্তি তৈরি করে।
নোয়াখালি জেলার রামেন্দুসাহার বাড়ির সামনে ৭১ ফুট দেবী দুর্গার প্রতিমা সেরা প্রতিমা খ্যাতি আছে। ফরিদপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরে ধোপাডাঙ্গা গ্রামে ২৫০ প্রতিমা নিয়ে দেবীদুর্গামন্ডপ করেছেন তিনজন মৃৎশিল্পী, প্রলয় বিশ্বাস, শিশির বিশ্বাস, চয়ন বিশ্বাস। এসব পূজার আয়োজন ব্যতিক্রমধর্মী, যা পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে সৃষ্টি করা হয়। সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা ও কলি- এই চার কালে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে চার দেবতার আর্বিভাব ঘটে। শ্রীহরি, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীগৌরাঙ্গের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ তুলে ধরা হয়েছে।
যশোদা জীবন দেবনাথের বাড়িতে বিশাল দুর্গাপূজা প্রসিদ্ধ। পৌরাণিক দেবী দুর্গা, সকল দেবতার তেজঃপুঞ্জ থেকে দেবীর জন্ম। কথিত আছে, ব্রহ্মার বরে পুরুষের অবধ্য হয় মহিষাসুর এবং স্বর্গ দখল করে নেয়। স্বর্গরাজ্য হারা দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলে, তাঁর নির্দেশে দেবতার তেজঃপুঞ্জে দেবী দুর্গার আর্বিভাব হয় এবং দানবের নিকট থেকে স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করেন। আরো জানা যায়, দুর্গ বা দুর্গম নামে দানবকে বধ করেন বলে নাম হয়েছে মা দুর্গা। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে দেবী দুর্গার আর্বিভাব , অসুর দমনে মহাশক্তির প্রয়োগ ঘটে। এজন্য দেবী দুর্গা মহাশক্তিশালী।
বাংলাদেশের শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্গাপূজা দ্বিতীয় প্রধান উৎসব হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। প্রায় সকল পূজামন্ডপে সরকার থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে।
৫. দেবী-দুর্গাপূজা প্রচলনের ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ছিলো বলে জানা যায়। জীমূতবাহনের( আনু:১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসবনির্ণয়, বিদ্যাপতির ( ১৩৭৪-১৪৫৬) দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৫৬) দুর্গোৎসব বিবেক, কৃত্তিবাস ওঝার ( ১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়াচিন্তামণি, ইত্যাদি নিদর্শনে দুর্গাপূজা প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।
বাংলাদেশে সম্রাট আকবরের ( ১৫৫৬-১৬০৫) সময়ে রাজশাহীর রাজা কংস নারায়ণ দুর্গাপূজা প্রচলন করেন। মতান্তরে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের( ১৭১০-১৭৮৩) সময়কালে সূচনা হয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে এসব মতের তথ্য যাই থাকুক, আদি ঐতিহ্যের নিদর্শন দুর্গাপূজা মহাকালপ্রবাহে নব উদ্যমে বিশ্বসংস্কৃতিতে দাপটের সাথে স্থান করে নিয়েছে।
জানা যায়, কলকাতার চিৎপুরে চিত্তেশ্বরী দুর্গার বিগ্রহ ১৫৮৬ সালে মুর্শিদাবাদের জমিদার স্থাপন করেন। তবে ইংরেজ আগমনের পর দুর্গাপূজা উৎসবে পরিণত হয়। পাথুরিয়াঘাটের ঘোষবংশের শ্রীরামলোচন ঘোষ ১৭২৭ সালে সূচনা করেন।
১৭৫৭ সালের পর শোভাবাজারের রাজবাড়িতে মহারাজা নবকৃষ্ণদেব ধুমধাম করে যে দুর্গাপূজা সূচনা করেন, সেই অনুষ্ঠানে লর্ড ক্লাইভসহ বহু ইংরেজ, স্থানীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা যোগ দিতেন।
বিশেষ করে ১৭৬০ সালে নবকৃষ্ণদেবের দুর্গোৎসব মহাউৎসবে পরিণত হয়। পূজার অঙ্গনে নৃত্যগীত, বাঈনাচ, যাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠান বিশালরূপ ধারণ করে। খাওয়া দাওয়াও ছিল উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট। ইংরেজ শাসকরা যোগ দিতেন অনুষ্ঠানে, যার ফলে দুর্গা উৎসব পর্যায়ক্রমে সকলের উৎসবে পরিগণিত হতে থাকে। এই উৎসবে মুসলিম বাঈরা আমন্ত্রিত হতো।
পূজা এতটাই ব্যাপক ছিল, তা নিয়ে কটাক্ষ করে দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর ‘পল্লীচিত্র’ এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ কলিকাতা কমলালয়’ লেখেন। ভবানীচরণ লেখেন, কলকাতার দুর্গোৎসব দেবার্চনা না বলে, ঝাড় উৎসব, বাতি উৎসব, কবি উৎসব, বাঈ উৎসব, কিংবা স্ত্রীর গহনা উৎসব ও বস্ত্রোৎসব বলিলেও বলা যায়।’ এইসব যা কিছু ঘটুক না কেন, ১৮২০ সাল পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন জেলা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করে। দুর্গাপূজার উৎসবে বহু লোকের সমাগম ঘটে।
কবিগুরু ধর্মকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, সেখানেই আমাদের বৃহৎ উপলব্ধি সৃষ্টি করে । উৎসবের দিন আমরা যে সত্যের নামে বহুতর লোকে সম্মিলিত হই, তাহা আনন্দ, তাহা প্রেম। উৎসবে পরস্পরকে পরস্পরের কোন প্রয়োজন নাই– সকল প্রয়োজনের অধিক যাহা, উৎসব তাহা লইয়া। এইজন্য উৎসবের একটা প্রধান লক্ষণ প্রাচুর্য। এইজন্য উৎসবদিনে আমরা প্রতিদিনের কার্পণ্য পরিহার করি। প্রতিদিন যেরূপ প্রয়োজন হিসাব করিয়া চলি, আজ তাহা অকাতরে জলাঞ্জলি দিতে হয়। দৈন্যের দিন অনেক আছে, আজ ঐশ্বর্যের দিন।….
‘তাই উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এই দিনকে আমরা ফুলপাতার দ্বারা সাজাই, দ্বীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি।
এইরূপ মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুটমণিস্বরূপ করিয়া তুলি। যিনি আনন্দের প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে, সৌন্দর্যে বিশ্বজগতের মধ্যে অমৃতরূপে প্রকাশমান–আনন্দরূপমমৃতং যদাবিভাতি– উৎসবের দিন তাঁহারই উপলব্ধি দ্বারা পূর্ণ হইয়া আমাদের মনুষ্যত্ব আপন ক্ষণিক অবস্থাগত সমস্ত দৈন্য দূর করিবে এবং অন্তরাত্মার চিরন্তন ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য প্রেমের আনন্দে অনুভব ও বিকাশ করিতে থাকিবে।’ (উৎসব, ধর্ম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কাল পরিক্রমায় মাতৃরূপে শক্তিতে আর্বিভূত দুর্গাপূজা উৎসব অনন্ত সৌন্দর্য ঐশ্বর্যে সকলের অন্তরলোককে আলোকিত করছে। বিশ্বব্যাপী যে অস্থির, চরম পরিস্থিতি বিরাজমান, তা থেকে মানবমনের অসুরশক্তির বিনাশে উৎসব থেকে গণশক্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। যার থেকে, ব্যক্তি, সমাজবদ্ধ মানুষ, রাষ্ট্র কাঠামোর শাসকদের মানবিক শান্তির গুণাবলি সত্যরূপে জাগ্রত হয়ে ওঠে।
দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের, কিন্তু তার উৎসব সংস্কৃতি সকল জনমানুষের হয়ে গেছে। এ এক সত্যের জ্যোতি, অনন্ত ঐশ্বর্য, যা তার নিজস্ব গতিতে চলে। চারপাশের সকলের ভেতর শান্তি সম্প্রীতি বিরাজ করার মহিমায় দুর্গাপূজা ও উৎসব আনন্দময় হয়ে থাকে।
দুর্গাপূজায় হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় সহ সকল ধর্মের মানুষের সম্প্রীতি বাজায় থাকবে কিনা তানিয়ে সংশয় থাকতেই পারে। তথাপি বহুবিধ কারণে দুর্গাপূজার আবেদন ধর্মীয়কে আবর্তন করে সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে সম্প্রীতির জয়গানে নিবেদিত হয়ে যায়।
পূজার উৎসব সংস্কৃতি শুধুমাত্র সর্বভারতীয় নয়, তা অসীমান্তিক বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতির সাথে সগৌরবে ও সগর্বে উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। দুর্গা পূজা, শারদীয় উৎসব বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কোনো কোনো সময় বাহুল্য চাকচিক্য পরিলক্ষিত হয়। এইরকম চাকচিক্য সকল ধর্মের সম্পদশালীরাই করে থাকেন। বিষয়টির সাথে সমাজতত্ত্বের শ্রেণীভেদ-জাতিভেদ-বর্ণভেদের উপনিবেশিক মানসিকতা পরিপূরক বলা যায়। যারা সম্পদশালী ধনপতি, তারা উদার হয়ে শ্রমজীবীদের জীবনমান উন্নয়নে যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সেই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হবে।
সকল মানুষের কল্যাণের জন্য অপশোষণ, অপশাসন, দুর্নীতি, বৈষম্যকে পরাজিত করে সমানাধিকারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা যদি জাগ্রত হয়, তবেই উৎসব হবে সার্থক।
বিশ্বশান্তির জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে উঠৈছে। আর শারদীয় উৎসব বিশ্বে ঐক্য ও শান্তির বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। বিশ্বের নিপীড়িত গণমানুষের উপর নির্বিচারে সাম্রাজ্যবাদের নৃশংস যুদ্ধ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জেগে ওঠার অপূর্ব শক্তি দুর্গাপূজার উৎসব সংস্কৃতি। বীরত্বের শক্তি সকল অপশক্তিকে ধ্বংস করুক।
দুর্গাপূজার সংস্কৃতির ভেতর থেকে উদ্ভূত গণসংস্কৃতিই বিশ্বসংস্কৃতি সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। যা অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্যরূপে সাম্য রাষ্ট্রের বিজয়ে পরিপূরক ভূমিকা রাখবে।#