বেদনার মহাকাব্য কাদম্বরী

বোশেখের আট থেকে দশ তারিখ কোথা হতে আবেগের বেদনা এসে জুড়ে থাকে, আর কেন যেন মর্মাহত হয়ে পড়ি। এ কোন প্রেম প্রতিনিয়ত বিশ্বালয়ের ভেতর বেদনা ও সৃষ্টির প্রমত্ত অভিলাষে নিয়ে যায়। উর্বশী, আফ্রোদিতের প্রেমের উপাখ্যান আজো বিশ্ব বিধৃত, এক গভীর উন্মাদনা সৃষ্টি করে। উন্মত্ত প্রেমের উপাখ্যানে সত্যি বিচলিত, যে প্রেম সৃষ্টিশীল পথকে উন্মত্ত করে, গভীর সংযোগে মানব মানবীর ঐকতানে নতুন সুর তৈরী করে, তা কী সব সময় বিপরীতধর্মী! মহাকবি কালিদাসের ‘বিক্রম -উর্বশী’, মহাকবি ভার্জিলের ঈনিয়াড; উর্বশী ও আফ্রোদিতের প্রেম উপাখ্যান, যা যুগ থেকে যুগে বাহিত হয়েছে প্রেমের আরাধ্যরূপে। জগতের নানা বলয়ে, পরিবর্তনে সেসব দিকভ্রষ্ট হয়নি, বরং কালে কালে তা যেন জ্যোতি দেয়। জ্যোতিরূপে যে প্রেম নতুন আলোয় আমাদের নিয়ে চলে সৃষ্টির গোপন অভিসারে, তা কী সুদূর পরাহত? কোন লাজে, কোন প্রায়শ্চিত্তে বোশেখের তীব্রদহনে ঝড় ওঠে! এই তো প্রেমের সারথী জারুল, সোনালী, কৃষ্ণচূড়ার মতো রাঙিয়ে দাও – এই বেদনার মহাকাব্য।

বোশেখ বিবিধ স্বপ্নসুন্দরে অভিনব সৌন্দর্যে মানবিক রূপে, লাবণ্যে, প্রেমে, বেদনায় পূর্বকালের সনাতন ঐতিহ্যে লালিত পালিত হয়ে আছে। দ্রোহ বেদনার নির্মলরূপে চিরকালের নিবেদনে বেদনার আকাশকে ছুঁয়ে যায়, নিভৃত স্বপ্নাচারের ভিতর শিল্পের উৎস অনুবর্তীরূপে মোহমুগ্ধ করে। যাপিত জীবনে ‘কাদম্বরী দেবী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পের উৎস এবং সতের বছরের নিবিড় সান্নিধ্য সারাজীবন ধরে শিল্পের সম্ভার রূপে দীপ্যমান ছিল। শিল্পের অনুধ্যানে কাদম্বরী দেবী এক বিপুল বিস্ময় এবং বেদনার মহাকাব্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স সাত, আর কাদম্বরী দেবীর নয় বছর বয়স। ১৮৬৮ থেকে ১৮৮৪, এই সতের বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প সাধনার ও শক্তিশালী প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

১৮৭৭ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতী’ পত্রিকা বের করলেন এবং এই পত্রিকাকে ঘিরে সাহিত্য আড্ডা। সেই আড্ডায় বিহারীলাল সহ সাহিত্যের দিকপালরা, কাদম্বরী দেবী ও তাঁর স্বামী, দেবর রবীন্দ্রনাথ প্রাণ ছিলেন। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্ম প্রকাশিত হতে থাকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রহসন’ এমন কর্ম আর করবো না'(১৮৭৭), -র বাড়িতে প্রথম অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ কোন কিছু লিখলেই প্রথম পাঠক তাঁর বন্ধু বৌদি এবং বৌদির অনুপ্রেরণা উৎসাহ তাঁকে সাহিত্যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরিতে সহায়তা করে।

কাদম্বরী দেবী’র কেশবিন্যাস, আঁখি, মধুর হাসি, রূপ লাবণ্য -এ যেন রবীন্দ্র অন্ত:সৌন্দর্যকে শিল্পসুষমায় নিয়ে যায়। কাদম্বরী দেবী’ স্বামীর সাথে যতবার বাইরে গেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সহচর ছিলেন। আহা কী অপূর্ব সে সব গান, তোমারি করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা; আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ, সুরের বাঁধনে; আমার নয়ন , তব নয়নে; বনে এমন ফুল ফুটেছে, মান করে থাকা আর কী সাজে; তুমি কোন কাননের ফুল… এসব তো প্রাণ ছুঁয়ে যায়। কিংবা গঙ্গার ধারে দোতলা বাড়িতে বসে যা লিখলেন, ছম্ছম্ ঘন ঘনরে, গগনে ঘনঘটা; তা যেন বিস্ময়। চন্দননগরের বাগানবাড়িতে রাষ্ট্রচিন্তা, বিবিধ প্রসঙ্গ, বৌ-ঠাকুরানীর হাট.. এসব তো বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল কাদম্বরী দেবী’র ১৮৮৮ সালের ১০ বৈশাখে, আত্মহত্যার প্রচেষ্টা ৮ বৈশাখ, দুদিন মৃতু্যর সাথে লড়াই করে জীবনের অবসান। এই অবসান রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন তাড়িত করেছে, স্ত্রী’র মৃতু্যর (১৯০২) পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন একাকী, নি:সঙ্গ..সেই নি:সঙ্গতার দেবী কাদম্বরী। সে সময় বহু গ্রন্থ উৎর্সগ করেছেন’ শ্রীমতী হে.. তোমাকে দিলাম’ এই শিরোনামে। ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান , তার বদলে আমি চাইনে কোন দান; আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো, সে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল; এ সব আমাদের গভীর বেদনায় সিক্ত করে। তেমনি সিক্ত করে টলস্টয়ের’ আন্না কা্যারেনিনা’র যন্ত্রণাময় ট্রাজেডিতে।

বোশেখের উচ্ছ্বল ও শক্তিশালী দ্রোহ বেদনার নির্মল প্রান্তে আমিও উন্মত্ত হই…
এমনও প্রেম দিও নাগো তুমি
এমনও ভরা দিনে
নিশিদিন ভাবি তোমারে, ওগো প্রিয়
এমনও প্রেম দিও নাগো তুমি….
তোমারে ভাবিয়া, আকুল হয়ে আমি
খুঁজি ফিরি নিরালায়,
তবু কেন দেখা মেলে না তোমায়
তবু কেন এত প্রেম দিলে
এমনও প্রেম দিও নাগো তুমি।’
আমার অন্তরতম প্রেয়সীর বেদনার মহাপ্রলয়ে আমি যেন বিসর্জিত না হই, যে আছে অন্তরতম তারে আপন করে বারে বারে যতনে রাখি, স্বপনে রাখি এবং রাখি সৃষ্টিশীলতায়।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!