উত্তর উপনিবেশিকতা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে বিশ্ব বন্দোবস্তের যে প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়, সেই ধারাবাহিকতায় উপনিবেশ ভারতবর্ষের পরিণতি ব্রিটিশরা নির্ধারণ করে ফেলেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রয়োগে ভারতের দ্বিখন্ডিত বিভাজন ঐতিহাসিক হলেও একটি অসম বিভাজন তৎকালিন বাংলার অঞ্চলে ঘটে যায়। যার পরবর্তী অধ্যায় পূর্ব বাংলায় তথা পূর্ব পাকিস্তানে অবধারিত হয়ে উঠেছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের। যা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক, পাকিস্তান সাম্রাজ্য থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ব পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বীকৃতি হলেও পরবর্তী বিনির্মাণ বার বার বিপদগ্রস্থ হয়েছে। যা বর্তমান অবধি সক্রিয় ও সচল বলে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিলগ্ন চলছে। সেই ক্রান্তির সময়ে বাংলাদেশের সংবিধান, মূলনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি, হেরিটেজসহ বিবিধক্ষেত্রে বিদ্যমান ঘটনাবলি মোটেই কাঙ্খিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরল ইতিহাস, স্বাধীনতার বিস্তৃত ঘটনা, বীর শহীদদের আত্মত্যাগ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, বিপ্লবী নিদর্শন, সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে নিয়ে বিপথগামীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য, অনাহূত নৈরাজ্যের একটি বীভৎস চিত্রের সাথে প্রতিনিয়ত দেশের জনগণ অতিবাহিত করছেন।
মৌলবাদীদের উত্থান, নৃশংস সংঘবদ্ধ (মব) সন্ত্রাস, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বুলডেজারের মাধ্যমে ধ্বংসযজ্ঞ, নারী-কিশোর-শিশুর প্রতি পাশবিক নির্যাতন, চাঁদাবাজি, লুটপাটসহ ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ২০২৫ সালে মহান স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে। এই দিবসে জাতীয় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান বাতিল এবং নানাবিধ স্মরণ-বরণ-শ্রদ্বার্ঘ্য অনুষ্ঠান বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হবে না বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান বহু ঘটনায় দেশের মধ্যে জনভীতি স্বাভাবিক জনজীবনকে সংকটে পতিত করেছে।
ইতিহাসে দেখা যায়, গ্রীক ভাষায় কৈনোনিয়া শব্দের অর্থ জনসমষ্টির সমাহার, যেখানে সব ধরনের মানুষ একে অপরের পরিপূরকভাবে বসবাস করে। রাষ্ট্র সকল নাগরিকের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করে এবং নাগরিকের সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধনে ব্যাপৃত থাকে। পাশ্চাত্যের আদি রাষ্ট্র দার্শনিক এরিস্টটলের এই রাষ্ট্রভাবনায় রাষ্ট্রকে সদগুণ দ্বারা শাসন এবং শ্রেষ্ঠ নাগরিক দ্বারা পরিচালনার কথা ব্যক্ত করেছেন। আদি দার্শনিকের রাষ্ট্র সর্ম্পকিত সব বক্তব্য আমাদের গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু তাদের অগ্রসর ভাবনা স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনায় পথ নির্দেশনা সৃষ্টি করতে পারে। এসব রাষ্ট্র ভাবনা স্বাধীন জনগোষ্ঠির, স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য নিবেদিত । বাংলার জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার মূলনীতি – আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, পরমতসহিষ্ণুতার উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং সাম্য সমাজের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিদের বহুবছর আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলা নামক ভূখন্ড প্রাচ্যে পূর্বে থেকেই বিদ্যমান ছিলো। ভারত থেকে প্রবাহিত বৃহৎ নদীগুলোর পলিমাটির সুবৃহৎ ভৌগোলিক অবকাঠামোর নাম বদ্বীপ। এই বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের জীবন ছিল কৃষি ও মৎস্য নির্ভর। রাষ্ট্রের পরিচালনায় যারা ছিল, তাদের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাজনা দেয়া ছাড়া কার্যত কোন সর্ম্পক লক্ষ্য করা যায় না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবন ছিল দুঃখ দুর্দশায় ভরা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এবং ভাগ্যকে দৈব বিধান বলে তারা মনে করতো। ফলে বিজাতীয় বিধর্মী পরদেশী শাসক শোষক দ্বারা বদ্বীপ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী বহুকাল পরাধীন হয়ে জীবন যাপন করে এসেছে। এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন ছিল পশ্চাৎপদ, বহু জাতি ও ধর্ম ভেদে জীবনকে নিয়তির বিধান বলে মেনে নিতো। অথচ পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছে, গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রের মতবাদ নিয়ে তাদের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এই বদ্বীপ খ্যাত পূর্ব বাংলা ১৯৪৭-এর দেশভাগের কারণে পাকিস্তানের অংশে পাকসাম্রাজ্যে চলে যায়। বৃটিশরা চলে গেলেও বাংলার মানুষ স্বাধীন হতে পারেনি, বরং একটি নতুন সা¤্রাজ্যে মধ্যে পতিত হয়। এমন নৈরাজ্যের বিভাজনে পাকিস্তানের সূচনা হয়। পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ধারাবাহিকভাবে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলো।
পাকিস্তান পর্বে রাজনৈতিক আন্দোলনে জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যকর নেতৃত্বে বাংলার মানুষ নিজস্ব রাষ্ট্রের আকাঙ্খা দেখতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, গণ আন্দোলন. গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। বিশ্বের যে সব দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিংবা মুক্তির আন্দোলন হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের মহান জননেতা আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, মাও সে তুঙ, মহাত্মা গান্ধী, কামাল আতাতুর্ক, ফিদেল কাস্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ রাষ্ট্রনায়কের বীরোচিত পদক্ষেপে নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বীরোচিত রাষ্ট্রনায়কদের ভূমিকার ধারাবাহিকতায় একটি সফল মুক্তিযুেদ্ধর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনন্য অবদান বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয়ে গেছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি, তাও আবার দুই প্রান্তের দু’টি দেশ; একটি পূর্ব পাকিস্তান; আরেকটি পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তান। পূর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্যে পূর্বের যে পরাধীনতা ছিল, তা যেন নতুন অবয়বে আরোপিত ও শাসিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সেটি অনুভব করেন, আর সেজন্য পূর্ব বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য মাঠে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলার জনগণকে সংগঠিত করেছেন, পুর্নগঠিত আওয়ামী লীগকে জনগণের আশা আকাঙ্খার রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, এই দীর্ঘ সময় পূর্ব বাংলার অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব বৃহৎ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার সাথে মজলুম নেতা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সংযোগ ও নেতৃত্ব প্রদানের অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সময়ের আবর্তনে হিসেব করলে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে গণ আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান, তারপর বৈপ্লবিক মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ অনিবার্য সশস্ত্র সংগ্রাম । বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাায়ত্তশাসন সম্পর্কিতত দাবীর একটি কার্যকরি ইশতেহার।
ফর্মুলার প্রথম দফা— ‘দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সত্যিকার ধারণার ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ করে, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, আর সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ হবে সার্বভৌমত্বের অধিকারী ।’ এখানে ‘সার্বভৌমত্বের’ শব্দের সাথে সুদূরপ্রসারী স্বাধীনতা শব্দের যোগসূত্র যেন স্থাপিত হয়ে আছে। দফার ভিতর ফেডারেল ব্যবস্থা , মুদ্রা নীতি, কর ও রাজস্ব ব্যবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ও মিশন স্থাপন সর্ম্পকিত দাবীনামার মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পদ্ধতি বিকশিত করার কথা ব্যক্ত হয়েছে। ৬ নং দফা অতি গুরুত্বপূর্ণ — পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।’ এভাবেই দাবীনামার ভিতর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। এই ছয় দফা সম্পৃকিত ব্যাখ্যায় বঙ্গবন্ধু বলেন— আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬ দফা কর্মসূচি দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। …আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব – পাক জনগণের মুক্তি সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালেরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন। …আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা সমিতির বিবরণে, সকল সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ – উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে।, বাংলা ৪ঠা চৈত্র ১৩৭২, ইংরেজি মার্চ ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু নিজের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ – দফা কর্মসূচি’ ব্যাখ্যা সম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যা পূর্ব বাংলার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে ছয় দফা ইতিহাসের ঐতিহাসিক সনদ বলে বিবেচিত হবে।
২. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধটি ১৩১০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে (মার্চে) বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধে কবি মানুষের জাগরণের কথা বলেছেন।
‘উত্তিষ্ঠত! জাগ্রত! উত্থান করো, জাগ্রত হও – এই বাণী উদঘোষিত হইয়া গেছে। আমরা কে শুনিয়াছি, কে শুনি নাই, জানি না – কিন্তু ‘উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রত এই বাক্য বার বার আমাদের দ্বারে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। সংসারের প্রত্যেক বাধা প্রত্যেক দুঃখ প্রত্যেক বিচ্ছেদ কতশতবার আমাদের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে আঘাত দিয়া যে ঝংকার দিয়াছে, তাহাতে কেবল এই বাণীই ঝংকৃত হইয়া উঠিয়াছে ‘উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত’- উত্থান করো, জাগ্রত হও। অশ্রুশিশিরধৌত আমাদের নবজাগরণের জন্য নিখিল অনিমিষনেত্রে প্রতীক্ষা করিয়া আছে- কবে সেই প্রভাত আসিবে, কবে সেই রাত্রির অন্ধকার অপগত হইয়া আমাদের অপূর্ব বিকাশকে নির্মল নবোদিত অরুণালোকে উদ্ঘাটিত করিয়া দিবে। কবে আমাদের বহুদিনের বেদনা সফল হইবে, আমাদের অশ্রুধারা সার্থক হইবে।’
কেন জানি মনে হয়, এই মার্চের সাথে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নটি নিহিত ছিল। পূর্ব বাংলায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার আন্দোলনের সূচনার মাস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬ দফার ব্যাখ্যা মার্চে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম মার্চে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ মার্চে এবং মহান স্বাধীনতা দিবসও মার্চে।
এ এক অপূর্ব সমন্বয়। অর্থাৎ কোন কোন ঘটনাবলির যোগসূত্র স্বমহিমায় উদভাসিত হয়ে যায়। বিশ্বকবির ভাবনার যোগসূত্র উচ্চকিতভাবে উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-উত্তর বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী’ কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে। ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শির।” এই যে পরম্পরা তা ঐতিহাসিক।
অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা যেন মিলেমিশে অবিমিশ্র হয়ে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের কবিতা, সংগীত বীরযোদ্ধাদের যুদ্ধে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।
ইতিহাসের অধ্যায়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক অসাম্য পূর্ব বাংলার জনগণকে প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে। ১৯৫০¬Ñ১৯৫৪-১৯৫৫ কালপর্বের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মোট উন্নয়ন ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ২০ ভাগ, আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৮০ ভাগ নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে বরাদ্দ সামান্য বৃদ্ধি পেলেও সমান কিংবা কাঙ্খিত ছিল না। মোট বাজেটের সর্বাধিক শতকরা ৩৬ ভাগ কাগজে কলমে দেখানো হলেও শুভংকরের ফাঁকি ছিলো। অর্থনীতিবিদরা গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৪৮/৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮/৬৯ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সম্পদের ১০ শতাংশ প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যায় এবং যার পরিমাণ ছিল ৩১১২ কোটি টাকা। এই চরম বৈষম্যে পূর্ব বাংলার জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তারপরে উপর্যুপরি পীড়ন দমন, সামরিক শাসন, গ্রেফতার নির্যাতন পূর্ব বাংলার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করে। বিশেষ কওে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে আছে। পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৬ দফা, মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৭০ সালে সামরিক জান্তার অধীনে জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নের্তৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পশ্চিমাগোষ্ঠী এই রায়কে উপেক্ষা ও গণতান্ত্রিক রীতিকে অমান্য করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে কার্যত মুক্তির তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। পশ্চিমা সামরিক জান্তা বাংলার জনগণের মুক্তির আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেবার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে বাঙালি জনতার উপর নির্বিচারে গণহত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।
ঢাকায় সেনা অভিযানের পরপরই ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বার্তা চট্রগ্রামে প্রেরণ করেন।
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যান্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা পৌঁছে যায় । এই বার্তা শোনা মাত্রই বীরযোদ্ধারা পশ্চিমা সেনাদের প্রতিরোধে যুদ্ধে নেমে পড়ে।
চট্রগ্রাম বেতার থেকে তৎকালিন বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। একজন সামরিক কমান্ডের যুদ্ধের আহবান বীর বাঙালিদেও যুদ্ধে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়। পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়েছে মুজিবনগর সরকার। সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল, প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ, তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার কারণে পূর্ব বাংলার সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। ২৭ শে মার্চ ভারতের লোক সভা ও বিধান সভায় পূর্ব বাংলায় পাকসেনাদের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা জানানো হয়। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোক সভায় বক্তৃতা দেবার সময় বাংলার আন্দোলনকে সমর্থন দেন। একই সাথে সকল প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ভারত সরকার প্রথম পর্বে পরোক্ষ এবং পরে মিত্র বাহিনীর গঠনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাস্ত হতে বাধ্য হয়। ইতিহাসের বিশাল অধ্যায় বাংলাদেশের মহান মুক্ত্যিুদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় ০১ কোটি শরনার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমর্থন আদায়, অস্ত্র ক্রয়ে সহযোগিতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন, মুজিবনগর সরকার গঠন সহ বিবিধ ব্যবস্থায় ভারতের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের দোসর আলবদর রাজাকার আলশামস নামক বাহিনী ও তার হোতাদের দ্বারা বহু নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বিবরণ লিপিবদ্ধ ও দৃষ্টান্ত দৃশ্যযোগ্য হয়ে আছে। স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষ বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়াদি নিয়ে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য ও রাষ্ট্রে অপ-অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি, দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের অপশক্তির বিরূদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাধীনতার মাসে যখন পত্র পত্রিকায় দেখতে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চারনেতাসহ চারশত বীরমুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের প্রস্তাব নেয়া হয়েছে, তখন অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের এই পদক্ষেপকে প্রত্যাখান করতেই হবে। তিরিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ বীরমাতার বীভৎস নির্যাতনের উপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হয়ে আছে। বীরদের মর্যাদাকে নিয়ে উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা যারা দেখাচ্ছেন, তাদেরকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের অনুসারি বলতে পারেন না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যে ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ করেছে পাকবাহিনী, তা কী সহজেই মুছে ফেলা সম্ভব? ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সাল, কেমন ছিলো ঢাকা শহর? শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। যা তাণ্ডব হচ্ছে চারদিকে, কারফিউ না দিলেও বের হয় কার সাধ্যি! গোলাগুলির শব্দ থামেই না। মাঝে-মাঝে কমে শুধু।আগুনের স্তম্ভ দেখার জন্য এখন আর ছাদে উঠতে হয় না।”
সেই সময়ের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে, কিছু শুনে “ আমি (জাহানারা ইমাম) চেঁচিয়ে কেঁদে ফেললাম, ‘আর জানতে চাই না। যেটুকু জেনেছি, তাতেই কলজে ছিঁড়ে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ, একি সর্বনাশ হল আমাদের। ওরা কি মানুষ, না জানোয়ার?’
‘ওরা জানোয়ারেরও অধম। ওরা যা করছে, তাতে দোজখেও ঠাঁই হবে না।”
এই তো আমাদের স্বাধীনতার সময়কার পাকসেনা ও তাদের দোসরদের নির্যাতন নৃশংসতার ইতিহাস। এই সময়ে যুদ্ধাপরাধী, তাদের দোসররা মহান স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য, কল্পিত ইতিহাসের বয়ান দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। বীর বাঙালি, বীর জনতা, বীর আদিবাসীবৃন্দরা স্বাধীনতার বিপক্ষবাদীদের কল্পিত ইতিহাসকে মিথ্যাচার বলে মনে করে। বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ বীরত্বের বিজয় গাথা দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন। সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে মহান স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।#