আজ ১০ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এবছর মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হল, আওয়ার রাইটস, আওয়ার ফিউচার, রাইট নাও। এইটার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় আমাদের অধিকারই আমাদের ভবিষ্যৎ যেটা নিশ্চিত করতে হবে এখনই। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার ইস্যু সব সময় গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয় কিন্তু এর মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো সব সময় ছিল বরং এখনও রয়েছে। আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বরং বেশি হয়। সবচেয়ে বড় সমালোচনা হল, যারা মানবাধিকার মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন, যারা মানবাধিকার রক্ষার জন্য আমাদেরকে তাগিদ প্রদান করেন, তারা নিজেরাই নিজের দেশে এবং দেশের বাইরে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা’র দিন থেকে এই আলোচনা, সমালোচনা চলমান রয়েছে। তবে একটা বিষয় এই যে ঘোষণায় যে নীতিগুলির উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে কোনো গর্হিত বক্তব্য আছে এমন প্রশ্ন কিন্তু কেউই তোলেন নাই। সমালোচনা হল, তুমি মানছ না আমি মানব কেন? তুমি লঙ্ঘন করে আমাকে ছবক দিচ্ছ কেন প্রতিপালনের? এইটাকে ঠিক সমালোচনা না বলে বিরোধিতা কিংবা পাল্টা প্রশ্ন কিংবা যুক্তিও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে আরেকটা সাধারণ বক্তব্য হল, এইটা পশ্চিমাদের মস্তিস্কপ্রসূত ধারণা, আমাদের মত দেশের ক্ষেত্রে এর সবগুলি প্রযোজ্য নয়। আরো একটা বক্তব্য বেশ প্রকট, সেটা হল, সবই ঠিক আছে কিন্তু এর অনেকগুলিই আমাদের ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্সিক। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কেউ কেউ বলে থাকেন মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা যা যা বলা হয়েছে তা অনেক আগেই থেকেই নাকি তাদের ধর্মীয় বিধানের মধ্যে রয়েছে। কথা হল, সেগুলি অন্য ধর্মের মানুষেরা কিভাবে বুঝবেন? চর্চায় কতটুকু রয়েছে? একটা রাষ্ট্রে তো আর একই ধর্মের, গোষ্ঠীর, ভাষাভাষী মানুষেরা বসবাস করেন না। কাজেই এখানেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। ঘোষণাপত্রে ৩০ টি মূলনীতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর মূল কথা হল ‘জীবন, নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার অধিকার।‘ খুব সহজ ভাষায় যদি বলি, তাহলে বলতে হবে ‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারই হল মানবাধিকার।‘ মানবাধিকারের প্রশ্ন আরো উচ্চতর ধারণায় উন্নীত হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যেই একে সীমাবদ্ধ করা যায় না। অধিকার জন্মলাভ করে একজন শিশুর ভ্রুণবস্থা থেকে এবং এটি মৃত্যুর পরও বহাল থাকে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি ২০১১/১২ সালের দিকের কথা। দেশের বিভিন্ন জেলার একেবারে তৃনমূলের নারী, এনজিও কর্মী এবং আইনজীবীদেরকে নিয়ে একটা কর্মশালা পরিচালনা করছি ঢাকাতে। মানবাধিকার ইস্যুতে একজন আইনজীবী বললেন, আইনের ভাষায় মানুষের অধিকারের প্রশ্ন জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভূমিষ্ঠ হবার আগে এবং মৃত্যুর পর মানুষের কোনো অধিকার থাকে না। আমরা যুতসই কোনো উদহারণ আইনজীবীর বক্তব্যের বিপরীতে দেবার আগেই একজন গ্রামীণ নারী বললেন, যদি সেটাই হয়, তাহলে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের শরীরের ধ্বংসাবশেষ কেন এতদিন পর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশে ফেরত আনা হল? এই গল্পটা এখানে পাঠকের সাথে সহভাগিতার উদ্দেশ্য হল, মানবাধিকারের মর্মবাণী যদি আমরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি তাহলে, স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো একজন গ্রামীণ নারীও সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। আর যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে সমাজে বিজ্ঞজন বলে খ্যাত আইনজীবীরাও এই ইস্যুতে তর্কে লিপ্ত হবেন। এখানে আরেকটা ঘটনার কথা বলি, একটা জেলা শহরের একজন নারী আইনজীবী যিনি নারী ও শিশু ট্রাইব্যূনালের সহকারী কৌঁসুলিও বটে, একদিন আমাকে বললেন, নারী শিশু কোর্টের জজ স্যার একদিন আমাকে উনার বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি উনার বাসাতে গিয়েছি, কিন্তু না খেয়ে চলে এসেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? উত্তরে তিনি বললেন, উনি তো মানাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। আমি জানতে চাইলাম কিভাবে? উনি বললেন, আমি উনার বাসায় ঢুকেই দেখি উনার শাশুড়ি হিন্দু। তার মানে উনি একজন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আমি বললাম, কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত উনি জোরপূর্বক বিয়ে করেছেন নাকি উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে হয়েছে? উনার উত্তর হল, যেভাবেই হোক, উনি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। এখন কথা হল, যারা মানবাধিকারের চর্চা করছেন, তাদের কাছেও মানবাধিকারের ধারণা কতটা সু-স্পষ্ট সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে যখন র্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) গঠন করা হয় এবং তারা ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা শুরু করে, তখন আমার জানামতে বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংগঠন প্রকাশ্যে এটার বিরোধিতা করেছিল, প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্ত এর বিপরীতে আমাদের কথিত শিক্ষিতজনেরা, বিজ্ঞজনেরা এই বিনা বিচারে মানুষ হত্যাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, মানুষ হত্যার খবরে মিষ্টি বিতরণেরও ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে। অবশ্য হত্যার শিকার ব্যক্তি তাদের কাছে তখন মানুষ হিসাবে বিবেচিত হয় নাই, বিবেচিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এবং কথিত গণমাধ্যমের দেওয়া অভিধা মুরগি মকছেদ, পিচ্চি পবন কিংবা অন্য কোনো কথিত ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসাবে। একজন মানুষকে এভাবে উপস্থাপনও যে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন, সেই ধারণাটুকুও আমাদের কথিত গণমাধ্যম কর্মীদের মনে ও মাথায় আসেনি। কারণ, সেইটা তাদের ভাবনাতেই নাই। রাষ্ট্রীয় বাহিনী র্যাবের ক্রসফায়ারকে সমর্থন জানানোদের অনেকেই আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলেছেন। আবার ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার অভূত্থানের সময় পুলিশের উপর গুলি চালানোকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বললেও ৫ আগস্টের পর বিচারিক আদালতে কথিত অপরাধীদের পক্ষে কোনো আইনজীবী লড়বেন না, সেটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার মানুষকে কথা বলতে দেন না, দেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে গলা ফাটানো মানুষেরাই আবার বিরুদ্ধ মতের, ভিন্ন মতের মানুষদেরকে ধমকের সুরে বলছেন এতদিন কোথায় ছিলেন? কাজেই আমার স্বার্থের পক্ষে গেলে ঠিক আছে, বিপরীতে গেলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়টা তো এমন নয়। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাকে যদি আমরা কেন্দ্রে রেখে চর্চা অব্যাহত রাখি, তাহলে সমাজে যেমন কথিত মিলনরা মুরগি মিলন কিংবা হান্নানরা পিচ্চি হান্নান হয়ে উঠবে না, মিডিয়াও তাদেরকে সেভাবে উপস্থাপন করবে না। একইভাবে দেশে কোনো সরকার প্রধান কিংবা রাষ্ট্রনায়কও স্বৈরচার হয়ে উঠবার সুযোগ পাবে না।
তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়, মানবাধিকার রক্ষা দায়িত্ব রাস্ট্রেরই। তাই কারো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার দায় বর্তায় রাষ্ট্রের উপরেই। রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে কি’না সেটা তদারকি করবে নাগরিকেরাই কিংবা নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসাবে কোনো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। সেজন্য দরকার আমাদের নাগরিক হয়ে উঠা। শুধু নিজের অধিকার নয়; মানবাধিকারের সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে মানবাধিকারবোধ সম্পন্ন নাগরিক হয়ে উঠা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সেসবের বালাই নেই। তাই এবারের দাবীর সাথে গলা মিলিয়ে বলি, আমাদের অধিকারই, আমাদের ভবিষ্যৎ, সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এখনই। তার আগে নিশ্চিত করতে হবে নাগরিকদেরকে অধিকার, মানবাধিকারের সু-স্পষ্ট প্রদান। আমাদের আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে মানবাধিকারবোধ সম্পন্ন সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে। কারণ আমরা যেমন, আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা তো তেমনি হবেন। তাহলে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় মানবাধিকারবোধ সম্পন্ন সংবেদনশীল নাগরিকের কি কোনো বিকল্প আছে? কোন প্রক্রিয়ায়, কোন পদ্ধতিতে সেটা সম্ভব, সেই আলোচনা শুরু করতে হবে আজই, এখনই।#