মিরিক বা অগ্নিদগ্ধ স্থান

অগ্নিদগ্ধ স্থান! একটু চমক লাগল তো! প্রথম তো আমারও সেই অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু এই জায়গায় একবার যিনি পৌঁছেছেন, তারপর কতবার যে নিজের অজান্তেই সেখানে পৌঁছে গেছেন, তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত ছবির মত সুন্দর একটি পর্যটন কেন্দ্র মিরিক। এই মিরিক নামটি এসেছে লেপচা কথা মির-ইওক থেকে যার অর্থ “অগ্নিদগ্ধ স্থান”।

ভ্রমণ পিপাসুদের হৃদয়ে মিরিক একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে তার আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং যাতায়াতের সুব্যবস্থার জন্য। মিরিকের প্রধান আকর্ষণ সুমেন্দু লেক, যার একদিক বাগান এবং অন্যদিক পাইন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। এই দুটিকে একসঙ্গে যুক্ত করেছে পায়ে হাঁটা খিলান সাঁকো ইন্দ্রেনি পুল। লেকটিকে ঘিরে থাকা সাড়ে তিন কিমি লম্বা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সূদূর দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ ভ্রমণার্থীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। লেকের জলে মনের আনন্দে নৌকো করে ঘোরা যায় এবং ঘোড়ায় চেপে লেকের চারপাশ প্রদক্ষিণ করার মধ্যেও আছে এক অনাবিল আনন্দ।

মিরিক বাজার, আশেপাশের গ্রাম ও চা বাগানের মানুষদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাবেচার জন্য প্রাথমিকভাবে একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে যেখানে লেকটি আছে সেই অঞ্চল আগে বচ দিয়ে ঢাকা জলাভূমি ছিল। বচ অর্থাৎ Acorus calamus, স্থানীয় নাম বোজো। এখন যেখানে বাগান রয়েছে সেই এলাকায় আগে একটি মাঠ ছিল যেখানে ব্রিটিশ আধিকারিকরা পোলো খেলত। ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তর পার্শ্ববর্তী থুর্বো চা বাগানের ৩৩৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই অঞ্চলটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় ১৯৭৪ সাল থেকে যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। নবনির্মিত লেকটি এবং কাছেই অবস্থিত রেস্তোরাঁ “ডে সেন্টার” সহ এই পর্যটন কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ১৯৭৯-এর এপ্রিলে। পর্যটনের বিকাশের সাথে সাথে সুমেন্দু লেকের অপরপ্রান্তে কৃষ্ণনগর গড়ে ওঠে যেখানে অনেকগুলি হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে।

মিরিকের দূরত্ব শিলিগুড়ি থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৫২ কিমি এবং দার্জিলিং থেকে ৪৯ কিমি। এখানকার জলবায়ু সারাবছরই মনোরম থাকে। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০° সেলসিয়াস এবং শীতে সর্বোনিম্ন ১° সেলসিয়াস।

ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্যানুসারে মিরিক নগর পঞ্চায়েত এলাকায় জনসংখ্যা ১১৫১৩। এর মধ্যে ৫৬৮৮ জন পুরুষ এবং ৫৮২৫ জন মহিলা। মিরিক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মোট জনসংখ্যা ৪৬৩৭৪ যার মধ্যে পুরুষ ২৩৩৯৪ এবং মহিলা ২২৯৮০।

ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে মিরিক শহরের জনসংখ্যা হল ৯১৭৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫০% এবং নারী ৫০%। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৪%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮২% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৬৫%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে মিরিক এর সাক্ষরতার হার বেশি।
এই শহরের জনসংখ্যার ৯% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।

মিরিকের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর বাগডোগরার দূরত্ব ৫২ কিমি এবং শিলিগুড়ি সন্নিহিত নিউ জলপাইগুড়ি- সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন।

মিরিক থেকে অল্পসংখ্যক বাস শিলিগুড়ি ও দার্জিলিং যাতায়াত করে। মিরিক থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত শেয়ার টাক্সি চালু আছে। দার্জিলিং মোটর স্টান্ড থেকে মিরিকের কৃষ্ণনগর পর্যন্ত শেয়ার টাক্সি চালু আছে। এটি মিরিক ট্যুর ও ট্রাভেলস দ্বারা পরিচালিত। মিরিকের মধ্যেও ভ্রমণ করার জন্য শেয়ার টাক্সি চালু আছে মিরিক লেক থেকে মিরিক বাজার পর্যন্ত যায়।

আরও পড়ুন: বড় মাংওয়া

দর্শণীয় স্থান —
সুমেন্দু হ্রদ– মিরিকের প্রধান আকর্ষণ ‘সুমেন্দু লেক’। এই লেকটির উপর একটি ৮০ ফুট দীর্ঘ সাঁকো রয়েছে। লেকের জলে নৌকো করে ঘোরার আনন্দই আলাদা এবং ঘোড়ায় চেপে লেকের চারপাশ ঘোরার ব্যবস্থা রয়েছে।
রামিতে দারা– শহরের কাছেই অবস্থিত একটি ভিউ পয়েন্ট যেখান থেকে চারপাশের পাহাড় ও বিস্তর্ণ সমভূমি অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়।
বোকার গুম্ফা– এটি বৌদ্ধধর্ম চর্চার কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত যেটি রামিতে দারা যাওয়ার পথে পড়ে।
রাই ধাপ— মিরিকের পানীয় জলের প্রধান উৎস ও পিকনিক স্পট।
দেবীস্থান– সুমেন্দু লেকের কাছেই টিলার উপর অবস্থিত হিন্দু দেবীর মন্দির।
টিংলিং ভিউপয়েন্ট– এখান থেকে চা-বাগানগুলির ৩৬০ডিগ্রী প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়।

চা বাগান— মিরিকে এবং এর চারপাশে অনেকগুলি চা বাগানে বিখ্যাত ‘দার্জিলিং চা’ এর চাষ হয়।
কমলালেবুর বাগিচা– মিরিকে খুব উচ্চমানের কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। মিরিক বস্তি, মুরমা ও সৌরেনি বস্তি অঞ্চলে কমলালেবুর ফলন হয়।
অর্কিড– আন্তর্জাতিক ফুলের বাজারের অন্যতম দামি অর্কিড সিমবিডিয়াম চাষের জন্য মিরিকের জলবায়ু খুবই উপযোগী। মিরিকের রাতো মেট-এ এরকমই একটি সিমবিডিয়াম অর্কিডের বাগান রয়েছে যার নাম “দার্জিলিং গার্ডেন্স প্রাইভেট লিমিটেড”।
বানকুলুং(জয়ন্তী নগর)– এই অঞ্চলে ইকোট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। অনেকগুলি হোমস্টেও রয়েছে।
পশুপতিনগর– এটি নেপাল সীমান্তবর্তী একটি জামাকাপড়, ইলেকট্রনিক্স এবং ঘরোয়া সামগ্রীর বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
ডন বসকো চার্চ, মিরিক- ডন বসকো স্কুলের কাছেই অবস্থিত এটি দার্জিলিং জেলার অন্যতম সুন্দর এবং বড় ক্যাথলিক চার্চ।
সুইস কটেজ যা মোটেল নামেও পরিচিত — শহরের ভিড় থেকে দূরে মিরিকের সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থিত একটি খুবই সুন্দর লজ।

ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!