মোহিনী হার

একটা সময় ছিল যখন এই সমাজের বঙ্গনারী নিজেকে মূলত পুরুষের চোখে মোহিনী করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত। মূলত পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতেই ছিল তাদের এই প্রয়াস। সে নিজের স্বামীই হোক বা মনের গোপন কুঠুরিতে রাখা কোনো পুরুষই হোক। সে-সময়ের সৌন্দর্য্যশৈলী আধুনিক যুগের সৌন্দর্য্যশৈলীর থেকে ছিল একটু অন্য রকমের। তবে এটাও ঠিক, তখনকার সময়ের সব নারীর মধ্যে অবশ্য এই প্রবণতা দেখা যেত না। মূলত তুলনামূলক ভাবে যেসব মেয়েদের শ্রী আর পাঁচটা মেয়ের থেকে কিছুটা ভালো ছিল, তাদের মধ্যেই নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার দিকেই ঝোঁক থাকতো বেশি। আর যারা প্রকৃতই সুন্দরী ছিল, এবং সেইসঙ্গে আর্থিক সঙ্গতি যাদের একটু উন্নত তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল এই রকম— আরও বেশি করে কিভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়। তখনকার দিনে সুশ্রী নয় বা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মেয়েদের মধ্যে নিজেকে দেখোনদারি করে তোলার মতো বিলাসিতার প্রতি কোনো আগ্রহ খুব একটা দেখা যেত না। আজকের আধুনিক সভ্যতায় অবশ্য সেই বাছবিচারের আর কোনো ভেদ নেই। এখন সব ধরনের মেয়েরাই নিজেকে যতটা সম্ভব সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতার র‍্যামপ্যাডে নিজেকে উজাড় করে দিতে সদা তৎপর— সে ষোড়শীই হোক কী অষ্টাদশী, কিংবা বিশোর্ধ্ব-তিরিশোর্ধ্ব কোনো নারীই হোক। সকলেরই আপ্রাণ চেষ্টা নিজেকে নানা ভাবে সাজিয়ে মনমোহিনী করে তোলা।

আজকের রকেট গতির যুগে যেমন হাজারও সৌন্দর্য্য সম্ভার নিয়ে সুসজ্জিত ঝলমলে মল থেকে শুরু করে পাড়ার কসমেটিক দোকান পর্যন্ত ছেয়ে ফেলেছে নানা কর্পোরেট তকমাধারী কোম্পানিগুলি, তখন অবশ্য এসবের কোনো বলাই ছিল না। সেই অর্থে কসমেটিক শব্দটারই তখন জন্ম হয়নি। খোলা বাজারে সাধারণ ফেস পাউডার কিংবা হিমানি ক্রিম ছাড়া অন্য কিছু পাওয়াই যেত না। এর বাইরে আর যেসব মেয়েলি সৌন্দর্য্য সম্ভারের দেখা মিলতো, সে হল পাড়ায় পাড়ায় আসা মনিহারি ফিরিওয়ালাদের কাচের বাক্স। সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা মিলতো কিছু কিছু বিরল অলংকার, কিংবা কেশ-বন্ধনীর অদেখা বস্তুর।

আরও পড়ুন: অন্ন জোগায় নারী 

তখনকার যেসব মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল, তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে মনমোহিনী করে তোলার চক্করে অনেক উটকো ব্যবসায়ী দু-পয়সা কামিয়ে নিত নানা ফিকিরে। এই রকমই একসময়ে উঠেছিল ‘মোহিনী হার’— দাম চার পয়সা থেকে দশ পয়সা; যার কাছ থেকে যেমন নিলেই হল। চকচকে সোনার মতো দেখতে। আজকের বাজার ছেয়ে যাওয়া ইমিটেশন গয়নার মতো। জল না লাগলে আলো ঠিকরে চমকে দেবে মাসখানেক। আজকের জিনিসগুলি আর একটু বেশি দিন সার্ভিস দেয়, এটা ঠিক। কিন্তু তার জন্য গুনাগার দিতে হয় বেশ ভালো কড়িই।
সেই সময়ের ওই মোহিনী হারই কলকাতা এবং মফস্বলের মেয়ে-মহিলাদের একরকম মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মুড়িমুড়কির মতো সেই হার বিক্রি হতো তখন। সেই হারের প্রস্তুতি প্রক্রিয়াও এমন কিছু কঠিন ছিল না। তামার তার-কে সুতোর চরকায় টান দিয়ে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে মাপ মতো কেটে সুতো বেঁধে দিলেই হয়ে যেত মোহিনী হার। আর সেই হার যে পরবে সে হবে মনমোহিনী। কলকাতায় ব্যবসা করতে আসা বিহারি, মাড়ওয়ারি ও আরও নানা জাতের বেওসায়িরা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো। কারও সঙ্গে থাকতো তাদের বিবাহিতা মোহিনী আবার কারও সঙ্গে কিছু মাসের মোহিনী। দু-পয়সা ইনভেস্ট করে পাঁচ গুন পয়সায় মোহিনী হার বা আরও অন্য উদ্ভাবিত সামগ্রী বেচে তাদের ব্যবসাই শুধু দাঁড়িয়ে যেত তাই নয়, দেশে কিছু ক্ষেত খামারিও খরিদ করা যেত। আবার কোনো উড়নচণ্ডী বেওসায়ি আসতো এই রকম রকমারি আকর্ষণীয় জিনিস বিকিয়ে কিছু কাঁচা পয়সা কামিয়ে কলকাতার মহলে নেশাভাঙ আর ফুর্তি করতে। তাদের জীবনে সঞ্চয় বলে কিছু ছিল না।

রাহুল সাংকৃত্যায়ণের ‘আমার জীবন’ আত্মজীবনী থেকে পাওয়া যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে তাঁর দেখা দুই মোরাদাবাদি কলকাতায় এসেছিল ভাগ্য ফেরাতে। তার মধ্যে একজন মোরাদাবাদের খাবার পচালু বানাত আর একজন মোহিনী হার বানিয়ে বিক্রি করত। পচালু খুব টেস্টি হওয়ায় বিক্রি ভালো হলেও তার সব টাকা উড়ে যেত জুয়ার নেশায়। আর মোহিনী হার বিক্রেতা বাংলার সব মেলা ঘুরে ঘুরে “নকল গিনি, লে মোহিনী” হেঁকে হেঁকে সব হার বেচে ভালো লাভ করতো। আর কলকাতার বাসায় ফিরে তার মেলা ভ্রমণের কাহিনি আর মেয়েদের মন ভুলিয়ে মল বিক্রির বুদ্ধির গল্প করে সবাইকে মজিয়ে রাখত।

কেবলমাত্র মেয়েরাই যে এইসব মনিহারি বেওসায়িদের ক্রেতা ছিল তাই নয়, কলকাতা কিংবা মফস্বলের বহু পুরুষই তার মনের মানুষের মন ভালোতে কিনে নিয়ে যেত এই মোহিনী হার— যদি আরও একটু রাধিকা রূপে পাওয়া যায় তার মনের সঙ্গিনীকে!#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!