বছর কয়েক আগে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম। ফেরার পথে এক মাঠের ধারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল আমাদের গাড়িটা৷ নির্জন জায়গা৷ লোকজন কেউ নেই৷ কেবল একটি নিচু ঢালু জায়গায় অনেক গাছ৷ তারা সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে৷ দামাল হাওয়া প্ররোচনা দিচ্ছিল৷ ভিড়ে গেলাম গাছেদের দলে৷ কী জোর জোর হাওয়া বইছিল রে বাবা৷
গাছগুলো দুলছিল একই কাতে৷ গাছে গাছে ঢেউ৷ ঢেউয়ের টুকরোগুলো দেখতে দেখতে তীব্র এক বাসনা জন্মাচ্ছিল আমার নদীমানবী হওয়ার৷ চারদিকে একবার দেখে নিয়ে চুপিচুপি হাওয়ায় হাত দু’টোকে দোলাতে লাগলাম৷ যেন বাতাসের বয়ে যাওয়াটাকেই হাত দিয়ে কেটে কেটে চলছি৷ পাড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই কোন।
অথচ দেখুন- কী আশ্চর্য! কোথাও একটা ডোবা পুকুর অব্দি নেই! কেবল গাছ আর গাছ! বেগবান এক গাছনদী! একটি মাছরাঙা পাখির অপেক্ষা শুধু৷ তাহলেই আমার উটকো কল্পনানাচের ষোলকলা পূরণ৷ মাঝে মাঝে এমন হয় আমার৷ যা আমার ধারে-পাশে আগে-পিছে কোথাও নেই, ভেবে মরি তাকেই৷ আকাশ অব্দি লম্বা করে ভাবি৷ মাঠের মত চওড়া করে ভাবি৷
আরও পড়ুন: ভালবাসার মানুষ টনি মরিসন ১
আর একবার ভয়ানক গরম৷ জঙ্গলে ঘুরছি তার মধ্যেই৷ রোদ জায়গায় জায়গায় বলয়ের মতো ঘুরছে আর ড্যাবা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ চারদিকে মজুর শ্রেণির মায়েরা কাঠ কাটছে ঠকঠক৷ গা পিঠ ভর্তি শ্রমের জল৷ এহেন জঙ্গলের মাঝে একপাশে পড়ে একটি আধভাঙা নৌকো৷ কাছেপিঠে কোনো নদী কোনোদিন ছিল বলে মনে হল না৷ যাঁরা কাঠ কাটছিলেন, তারা বললেন- ‘অনেকদিন ধরে নৌকাটা অমন স্থির পড়েই আছে৷’ একসময় গোধূলি চক্কর দিল মাথায়৷ দেখলাম আলো ছায়ার একটা কাঁপা ভাব জাগছে নৌকোর পাটাতনে৷ আমার কেমন মনে হল-নৌকোটা এবার চলবে৷ …চলবে এবার তৃষ্ণার্ত শ্রমিকগুলোকে নিয়ে৷ তাদের কাঠকাটার পেশাটির সমাপ্তি ঘটিয়ে জলপদ্ম তোলার আরাম দেবে এ নৌকো৷ জলীয় হাওয়ায় তাদের হা-ক্লান্ত শরীরে কাম জাগবে টগবগ করে৷ শুকনো জঙ্গলটাকে এবার বহমান নদী করে দেবে পরিত্যক্ত জলযান৷ অনেকদিন চলেনি সে৷ তাই বয়ে যাবার ভয়ানক বাসনায় থরথর কাঁপছে যে নৌকোটা৷ ক্যাচ শব্দ উঠছে৷ সাথীরা ফ্যাকফ্যাক হাসছিলেন- কাঠকাটা মা মেয়ে ঠোঁট ওল্টাচ্ছিলেন আমার কথা শুনে৷ তবু মানতে পারিনি- নিভু সূর্যের আলো ও জংলী হাওয়া আমার দৃষ্টি ও শব্দবিভ্রম ঘটিয়েছিল৷
না– নৌকো চলেনি৷ শান্তিনিকেতনের মাঠ বা পাথর ভরা জঙ্গল নদী হয়নি৷ হয়ত মা ধরিত্রী শেষমেশ মরু হয়ে যাবে এই ভয়েই বয়নি আমার কল্পনার জল কিংবা জলযান৷
আমার এই এত দ্রুত পজিটিভ থেকে নেগেটিভ-এ চলে যাওয়া দেখে সক্রেটিস হাসেন- ওহে ভাই কখনো না কখনো যা ছিল এই ধরায় তাই তো কল্পনায় বুনবে তুমি! এ বিশ্বে যা কোনোদিনও নেই, কোনদিন হবেও না, কেমন করে তা কল্পনায় আসবে তোমার? কল্পনা যখন করেছ তখন কোথাও না কোথাও আছে তোমার জলস্রোত- জলযান- জলের ফুল! তুমি কেবল মন দিয়ে তোমার ইচ্ছেটাকে চেন৷ তারপর তোমার কল্পইচ্ছায় গড়ে নাও এক মেছো মেয়ে৷ কামনা কর- সন্ধ্যাবেলায় গৃহস্থ যখন কাজ শেষে খাদ্য নিয়ে ঘরে যায়, তখন সে যেন তার আধা মাছের শরীর নিয়ে আহল্লাদে ঝাপট খায়৷
আরও পড়ুন: মধ্যযুগের বাংলাকাব্য: মধ্যযুগের কবিদের চোখে ১
দুই
কাণ্ড বলে কাণ্ড! সারাদিন দেশটায় সূর্য খেলে যায়৷ চারখানা সমুদ্দুরে তখন সোনার জল ঢেউ দেয়! আকাশের পাখি বলে- দ্যাখ রে ভূমিবাসী আমি সোনার হয়ে গেছি! রাতের চাঁদে পাঁচ পাহাড়ে রূপোর বাতাস বয়৷ হাওয়ায় ভাসা টুকরো আলো নাকি লোকে দেখেওছে কত রাত! গাছের পাখি রুপোর পুতুল হয়ে নাক ডাকে! দেশটায় আলোয় আলো৷ তবু এক দার্শনিক হ্যারিকেনের আলোয় মানুষ খুঁজে বেড়ায়৷ সূর্য চাঁদে ভরসা নেই তাঁর৷ ভরসা কেবল নিজের হাতে তেল ভরা এই হ্যারিকেনটার ওপর৷ হাজার মানুষ ভাবে- একবার যদি ব্যাটার হ্যারিকেনের আলোয় নিজের ‘মানুষ মানুষ’ মুখটুকু দেখাতে পারি, একবার যদি প্রমাণ হয়ে যায় আমিই মানুষ- তাহলে লাথি দিয়ে দূর করব বাকি কটাকে৷ কী আশ্চর্য! দার্শনিকও তাই ভাবে৷ একবার যদি একটাকে মানুষ মনে হয় বাকিগুলোকে দেশ থেকে হটাই৷ তারপর আমি আর আমার পাওয়া মানুষ বংশ বাড়িয়ে দেশটাকে পুণ্যভূমি করি!
একদিন লক্ষ লোকের লাইন পড়েছে৷ রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটে গেছে৷ হ্যারিকেন তবু জ্বলছে৷ উফ! আজ যে এত মানুষের লাইন পড়বে কে জানত! জানলে হ্যারিকেনের জন্য বাড়তি তেল ডিব্বায় আনা যেত! গজগজ করতে থাকেন দার্শনিক! আর এই লোকগুলোও হয়েছে তেমনি হ্যাংলা৷ দেখছে- হ্যারিকেন এখনই নিভে যাবে তবু লাইন ছাড়বে না কেউ৷ পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করা নেই৷
ও কে! এক নগ্ন মানুষ তার সর্বাঙ্গে সূর্য মাখছে৷ গোপনাঙ্গ বলে কিছু রাখবে না নাকি লোকটা!
…এই অসভ্য, এই বদ, শিগগির পোশাক পর৷ দেখছিস আমার হাতের এই হ্যারিকেনটা! দাঁড়িয়ে যা এর সামনে৷ আজকের মতো তুই হ আমার খোঁজা পথের শেষ মানুষ!
আরে! লোকটা তবু জামাকাপড় ছুঁড়ে ফেলে উল্লাস নাচ করছে! দেশের শ্রেষ্ঠ দার্শনিককে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না৷ নিজেকে মানুষ প্রমাণ করার তাগিদ নেই গা খোলা পাগলাটার৷
হ্যারিকেন দোলাতে দোলাতে লোকটার সামনে এলেন৷
…শেষবারের মতো বলছি৷ আয় একবার আমার আলোর সামনে৷ হয়ত এতদিন পর মানুষ বলে প্রমাণিত হবি তুইই…৷
…প্রিয় দার্শনিক৷ আলোটি তোমার হাতে৷ তা বলে সে কি তোমার! তুমি কি চাইলে সে আলো বিস্তৃত বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে! একই সঙ্গে মানুষের হাত পা মুখ নখ দেখতে পাবে কি? কিন্তু দেখো আমার শরীরের হাড় গোনা যাবে৷ আবার দেখো- তোমার গল্প রোজ এক৷ শুরু এক শেষ এক৷ কিন্তু আমার মনের সুতোগুলো জোড়া দিয়ে বিচিত্র সব সগল্প বানানো যাবে৷
দ্রুত হাতে হ্যারিকেন নেভালেন দার্শনিক৷
ততক্ষণে লোকটা সমুদ্দুরে ধিতাং ধিতাং করছে৷ তার চুল থেকে জল ঝরছে৷ ভুরু থেকেও টপটপ…
গোনা যাচ্ছে! হ্যাঁ- ওই তো এক- দুই- ওই তো চার নম্বর টুপটুপ ঝরে পড়ল ভরা সমুদ্দুরে৷
লোকটার থাই দুটো লাফাচ্ছে৷
দার্শনিক দেখছেন- ঘোড়া সমুদ্দুর পেরিয়ে নতুন দেশে যাচ্ছে!
পুষ্ট যৌনাঙ্গে রোদ৷
ধানের শীষগুলো এবার বড় হবে গো!
দার্শনিক মুখ তুললেন৷
সূর্য হাসলেন৷
পণ্ডিত এদ্দিনে মানুষ হয়েছে৷