লোকগণিত পরিচয়: ষষ্ঠ পর্ব

নিপীড়িত (Oppressed Mathematics): নিপীড়িত গণিত লোকগণিতের অন্তর্গত। আর এই নিপীড়িত গণিত নিয়ে বিস্তৃত প্রথম আলোচনা করেন Paulus Gerdes। এছাড়া যারা এই নিপীড়িত গণিত নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হলেন Harris Department of Teacher Education and School Development Torgeif on Stand । নিপীড়িত গণিত সম্পর্কে FOLK MATHEMATICS STUDY নামক প্রবন্ধে Dr. N. C. Ghosh বলেছেন—

“There are various mathematical concepts in the oppressed people of the society and those concepts they developed of their own. These are very importants as it relates with the survival of oppressed people. Paulus Gerdes described such mathematics as oppressed mathematics. Besides commonly known formal mathematics lot of mathematical concepts prevails in the society is not only rural people, even it is the people in the urbanized area.”

অর্থাৎ সমাজের নিপীড়িত শোষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে বহু ধরনের গাণিতিক চেতনা উপ্ত আছে যাকে নিপীড়িত গণিত বলা যেতে পারে; এই নিপীড়িত মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সর্বদা প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। এরা গ্রামে যেমন বসবাস করে তেমনি শহরেও এই নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের বসবাস লক্ষণীয়। এবং এই নিপীড়িত মানুষেরাই তারা তাদের জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই সকল গাণিতিক ভাবনা-চিন্তা চেতনাকে বিবর্তিত করে উন্নততর রূপ দান করে চলেছে। এই গাণিতিক চেতনা বা নিপীড়িত গণিত চর্চা তাদের জীবনচর্চা ও জীবন সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং এই নিপীড়িত গণিত চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ওই সকল মানুষের বেঁচে থাকার মতোই। Paulus Gerdes নিপীড়িত গণিত সম্পর্কে সাধারণ গণিতের মতোই বলেছেন যে, গ্রামীণ জীবনে বসবাসকারী নিপীড়িত মানুষের জীবনচর্চাতে যেমন নিপীড়িত গণিত চর্চা হয়ে থাকে তেমনি শহুরে জীবনে বসবাসকারী বিশেষত বস্তি, পতিতাপল্লী এবং নানাভাবে উপেক্ষিত, শোষিত, নিপীড়িত মানুষের চিন্তা-চেতনা স্তরে এই নিপীড়িত গণিত ভাবনা গভীরভাবে রয়ে গেছে। নিপীড়িত মানুষের মধ্যে গাণিতিক ভাবনা চিন্তা নতুন নয়, বরং তা বহু পুরাতন। লোকসংস্কৃতির উপাদানের মধ্যে তার উদাহরণ অজস্র রয়েছে।

অপ্রামাণ্যগণিত (Nonstandard Mathematics): গতানুগতিক গাণিতিক ভাবনার বাইরে গিয়ে ১৯৭৩ সালে বসন্তকালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে Paulus Gerdes ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে গাণিতিক বিশ্লেষণ শুরু করেন। কী আমরা জানি, আর কী আমরা জানি না সে বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন, বাস্তব জীবনে অনেককিছুই আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়; তাহলে কি মেনে নিতে হবে সেইসব জিনিস সত্যি সত্যি বাস্তবে অস্তিত্বহীন। এখান থেকে তার আলোচনা শুরু। এবং এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরের কথাও এসে পড়ে। তিনি বলেন বাস্তবে অনেক সত্য আছে যে আমরা জানি না বা আমাদের অজানা। তিনি বলেছেন—
“True but unknowable? How can we talk about the content of mathematics, of all things, as true but unknowable? Robinson and Steen are not questioning whether there are mathematical relationship, theorems, or facts that are presently true but presently unknown. This would mean somethings that neither accepts, namely, that we presently know all true mathematics.” বর্তমান প্রবন্ধে গণিতকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছেন সত্যি সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে মনে হবে যে অপ্রামাণ্য। এবং এই অপ্রামাণ্য গণিতও কিন্তু যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। গণিত তো অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মতোই সংস্কৃতির অঙ্গ এবং তা মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই অপ্রামাণ্য গণিত নিয়েও চর্চা কিন্তু থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে Paulus Gerdes (1985)M. Haris (1987) প্রমুখ গণিতজ্ঞরা গণিতের এই শাখা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। তবে Granville C. Henry যে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও পিথোগোরীয়ান গণিত নিয়ে যুক্তিকে মাথায় রেখে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন—তারই মার্জিত রূপ পেল এই Paulus Gerdes M. Haris-এর হাতে পড়ে।

আরও পড়ুন: লোকগণিত পরিচয়: পঞ্চম পর্ব 

অন্তর্নিহিত গণিত (Hidden or Frozen Mathematics): আমরা লক্ষ করি অজস্র নিরক্ষর পরিবারের মহিলারা দিনের বিভিন্ন সময়ে অবকাশ পেলে কাঁথা, আসন, চাটাই এবং বাড়ির বিভিন্ন তৈজসাদিপত্র তৈরি করে থাকেন। এই তৈরি করার পদ্ধতি এ প্রণালী একেবারেই গাণিতিক নিয়ম নির্ভর। যা কিনা তারা বংশপরম্পরায় নিজেদের অজান্তে করে চলেছে। এই গাণিতিক চেতনা তাদের মানস প্রক্রিয়ারই প্রতিফলন মাত্র। এবং তা শিল্পে রূপান্তর লাভ করে কখন যে নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ হয় তা তারা নিজেরাও জানে না। কাঁথা সেলাই করার সময় মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনের দেখা বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চিত্ররূপ স্থান করে নেয় তাদের কর্মের মধ্যে। এটি তাদের মনের গাণিতিক এক পরিমাণবোধ এবং পরিমাপবোধের প্রকাশ। এছাড়া ঝুড়ি, কুলো, হাতে ঝোলানো ব্যাগ প্রভৃতি কাজের মধ্যে তাদের শিল্পনৈপুণ্যের প্রকাশভঙ্গি লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কে বা মননের যারা অতীতের স্মৃতি বংশপরম্পরায় বহন করে চলেছে তারা কিন্তু লোকসমাজেরই অন্তর্গত; সে শহরেই বসবাস করুক বা গ্রামে বসবাস করুক। Paulus Gerdes এই গণিতেরই কথা বলেছেন।

ব্যবহারিক জ্ঞান উপযোগী সাংকেতিক গণিত (Mathematics coified in knowhow): বাস্তব জীবনে মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ভাষার প্রয়োজনবোধ অনুধাবন করেছিল সেই স্মরণাতীতকাল থেকে। তারা বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে নিজেদের মনের ভাব যেমন প্রকাশ করত তেমনি নিজেদের দেহের অভিব্যক্তিকেও শৈল্পিক রূপ প্রদান করত। একগোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। এবং তাদের প্রজ্ঞা, প্রত্যয় প্রভৃতিরও বিকাশ ঘটাত। সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ যেমন শ্রেষ্ঠ সম্পদ সে তার নলেজের বা জ্ঞানের এবং বিজ্ঞানের পরিধিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। আগে মানুষ অনেক ভাব, অনেক কথা প্রকাশ করার জন্য অনেক শব্দ ব্যবহার করত। বিবর্তিত হতে হতে সমাজের মানুষ সে ভাষাকে করে তুলেছে অনেক বেশি সাংকেতিক, সহজবোধ্য ও সরল। যেমন দূরত্বের ধারণা বোঝাতে মানুষ A অথবা X, Y কিলোমিটার বলে দেয়। ছেলেমেয়েরা মানুষেরা খুব সহজেই সেটা বুঝতে পারে যদি সেটা তাদের বৌদ্ধিক জ্ঞানের মধ্যে থাকে। গণিত যে খুবই সাংকেতিক ভাষা তাই তাকে ‘Mathematics is the universal language’ বলা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে Dr. N. C. Ghosh তাঁর Folk Mathematics Studies প্রবন্ধে মতামত প্রকাশ করেছেন।

মানবতাত্ত্বিক গণিত (Anthropological Mathematics): মানুষের দেহের মধ্যেও গণিতের ক্রিয়াকর্ম সর্বদা চলতে থাকে তা বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে বোঝা যায়। সমতলভূমির মানুষ যেভাবে হাঁটে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ এবং মেরু অঞ্চলের মানুষ একইভাবে চলাফেরা করে না বা হাঁটে না। সমতলভূমির মানুষ মাথাকে সবসময় উপর দিকে রাখে ভূমির সঙ্গে উলম্ব ভাবে অবস্থান করে। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ হাঁটার সময় সামনের দিকে মাথা ঝুকিয়ে হাঁটে। পায়ের আঙুল চেপে চেপে হাঁটে তবেই তার দেহের ভারসাম্য বজায় থাকে। না হলে তার দেহ গড়িয়ে নিচের দিকে চলে আসবে। অর্থাৎ তার দেহ পর্বতের সঙ্গে একটি কৌণিক রেখা বরাবর এগিয়ে চলতে থাকে। এছাড়া মানুষের দেহের ভেতরে যে রক্ত সঞ্চালন ঘটে তাও Fluid Mechanics এর নিয়ম মেনে ঘটে। ভৌগোলিক পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের স্বরযন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন অংশের পরিবর্তনের জন্য তাদের অজান্তেই তারা স্বরের যে পরিবর্তন সাধন করে তা গণিত নির্ভর Acoustic-এর উদাহরণ। অর্থাৎ Anthropological mathematic-এর প্রয়োগ।

পড়ুন: গণিতবিজ্ঞান চেতনার কবি বিনয় মজুমদার 

আর Indigeneous People অথবা গ্রামীণ জনজীবন থেকে উঠে আসা মানুষ তারা যে সমস্ত খেলাধূলা দেখায় বিশেষ করে রাম দাও খেলা, মণিপুরি মার্শাল আর্ট, লাঠিখেলা, রণপা নৃত্য, রাইবেশে প্রভৃতির মধ্যে যে বংশগত বা জিনগত ধারাবাহিক যে প্রবণতা কাজ করে তার ফলে সে অতি সহজেই খেলাগুলি দেখাতে পারে। কারণ এইসব খেলাগুলির মধ্যে সময় এবং দৈহিক অবস্থানের যে ব্যবধান তার বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটলে ঘটে যাবে বড়ো ধরনের অঘটন। সেক্ষেত্রে ঐসব নিরক্ষর তথাকথিত লোকসমাজ থেকে উঠে আসা শিল্পীরা কি অনায়াস দক্ষতায় তাদের ক্রিয়াকৌশল প্রদর্শন করে থাকে। মানবতাত্ত্বিক গণিত বা Anthropological Mathematics সম্পর্কে For the learning of Mathematics পত্রিকায় Paulus Gerdes , How to recognise hidden geomatrical thinking a contribution to the development of Anthropological Mathematics.’

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!