শাল্মলী ভেবে পায় না শুধু তারকাঁটার বেড়া একটা জাতির, একটা ভাষাসত্তার মানুষের সামগ্রিক আবেগকে কিভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দিতে পারে! কিভাবে একটা অখণ্ড ভূমিকে পৃথক দুটি মেরুতে পরিণত করে দিতে পারে! এ তো একটা রুটি নয় যে, ছিঁড়লে দু-খণ্ড হয়ে যাবে! ভাগ করে নেওয়া যাবে আর-একজনের সঙ্গে! শাল্মলীর যখন একটা ভাই হল, তখন তার মা হল দু-জনের। কিন্তু একটাই তো ছিল। দু-জনেই মা-র কোলে বসতো, আদর খেতো। মার হাতে ভাত খেতো। কই, তারা দু-জনে মাকে তো দুটো পৃথক সত্তায় পরিণত করতে পারেনি! তাহলে আমাদের মুখের ভাষা, পায়ের তলার জমি কিভাবে বাইরের দেশের মানুষ পৃথক করে দিতে পারে, কেড়ে নিতে পারে— ভেবে পায় না ছোট্ট শাল্মলী!
সব নাকি ইতিহাসে আছে। অথচ ইতিহাস জানে না কার জমির ওপর দিয়ে ভাগের কাঁটাতার গেছে। ইতিহাস মনে রাখেনি সেই প্রতিবাদী মানুষগুলোর মুখ, যারা কোনো কিছুর মূল্যেই মা-র ভাষা কেড়ে নিতে দেয়নি।
প্রয়োজনে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে রক্ত গঙ্গা বইতে দিয়েছে, তবু মুখের ভাষা, মাতৃ ভাষা কেড়ে নিতে দেয়নি। হায়রে ইতিহাস! হায়রে আমার দেশের মানুষ, আমার ভাই-বোনেরা!
যে বাংলা ভাষার জন্মগত অধিকার রক্ষায় একের পর এক এপার বাংলা ওপার বাংলার এতগুলো তরতাজা প্রাণের রক্ত পথের ধুলো ভিজিয়ে দিয়েছে, সেই ভাষা নিয়ে আজকের প্রজন্মের বাঙালিরাই সেই অর্থে পরিহাস করে! সেই ভাষায় সাবলীল ভাবে কথা বলতে লজ্জা পায়! অথচ এই ভাষাকে রক্ত দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে সেই ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি, উনিশে মে।
আজ উনিশে মে, বরাক উপত্যকার বুকে ঘটে গিয়েছিল সেই নারকীয় কাণ্ড। যার নেপথ্যে ছিল এই ভাষা আন্দোলনেরই গল্প। সেদিন শহীদ হয়েছিলেন কমলা আর কানাইলাল নিয়োগী, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, কুমুদরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্র দেব, বীরেন্দ্র সূত্রধর। সেই গল্প শোনায় শাল্মলীর মা। তাঁর কাছেই শুনেছে সে, আমাদের সরলতা আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে একদল মানুষরূপী হিংস্র নেকড়ে শুধু আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে ক্ষান্ত হয়নি। নির্বিচারে কেড়ে নিয়েছিল মা-বোনেদের শরীরের আব্রু, মাথার সিঁদুর, মুখের ভাষা। আর আজকের স্বাধীন যুগের ছেলেমেয়েরা স্বেচ্ছায় এড়িয়ে চলে সেই ভাষার স্বর্ণ-বিচ্ছুরণ। ফেলে দেয় আপন গরিমা লজ্জার মোড়কে মুড়ে। অর্থের মোহে আব্রু আর ইজ্জত বিকিয়ে যাচ্ছে সব। বাঙালি ক্রমেই এক অবক্ষয়ী জাতিতে পরিণত হয়ে পড়ছে। হারিয়েছ মূল্যবোধ, নীতিবোধ। মাটি আঁকড়ে ধরে থাকা মানুষগুলোর সেদিনের সেই সংগ্রামের আর কোনো মূল্যই নেই সেইসব সোহাগি বাঙালি মনের মেকি জৌলুসের অন্ধকারে। যারা আজ মরীচিকার হাতছানিকে সোনার আলো ভেবে ছুটে চলেছে নিজের মাতৃ ভাষা আর সংস্কৃতির শৌর্য্যের আলো ভুলে। একদিন তারাই এই মেকি জৌলুসহীন অথচ প্রকৃত প্রাপ্তির মাতৃক্রোড়ে ফিরে আসবে নিশ্চিত, ইতিহাসের পথেই। কিন্তু ততদিনে কি বাঙালির এই সভ্যতা আর সংস্কৃতির বিজন অনেকটাই দীন-মলিন হয়ে যাবে না!#