বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক অবদানের কথা সকলেই অল্পবিস্তর অবহিত আছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হয়। এই মহান মহীয়সী মুুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পক্ষে সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা করেন। যা তাঁর জন্মদিনে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হলো। বৃহৎ সম্ভাবনার বাংলাদেশ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে। আর শ্রীমতীর অশেষ অবদান সম্ভব হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতার কারণে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বর্বর পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের নির্মম বিভীষিকায় বাংলার মানুষ সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের পশ্চিমববঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা সর্বত্র। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে আটক রাখা হয়। এই অবস্থায় ভারত সরকার শরণার্থীদের আশ্রয় দিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন দেন। ৩১ মার্চ ১৯৭১ লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে মিসেস গান্ধীর উত্থাপিত রেজুলেশন যখন পড়ি, তখন তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে। ‘ The houes wishes to assure them that their struggle and sacrifices will receieve the whole hearted sympathy and support of the people India. মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ভেতর আশার সঞ্চার হয়। আলোচনার সময় এরকম বহুবিষয় উঠে আসে। উঠে আসে, বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিলের ঘটনাবলি। বিএসএফের শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় শফথ অনুষ্ঠানের জন্য ১০০ টি গাড়ীর ব্যবস্থা করেন। ৫০ টি ছিল গণমাধ্যম কর্মীদের, ৫০ টি ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের জন্য। ভারতীয় সীমান্তে বিএসএফ সতর্ক অবস্থায় ছিল।
যাহোক, এই যুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিলের মধ্যে প্রবেশ ১ লাখ ১০ হাজার শরণার্থী, ২১ মের মধ্যে ৩৪ লাখের উপর, ক্রমান্বয়ে প্রায় ১ কোটি। ৮৯৬ টি শরণার্থী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা। সাতটি রাজ্য সরকার, ২৪ টু ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ১২ টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে কাজ শুরু হয়। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন কর্নেল পি এন লুথার। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় অধিকাংশ ক্যাম্প, এ ছাড়াও আসম, মেঘালয়, বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশে ক্যাম্প করা হয়। এই শরণার্থীদের বিষয়ে ৮ মে সাতটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ বৈঠকে মিলিত হন। তারাও সহযোগিতার মনোভাব নেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ জাতীয় সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করার আবেদন জানান। ভেবে দেখুন, সেই মানবেতর সময়ে সরকার কিভাবে সাহায্য করছে, সাহায্য করছে জনগণ। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বাঙালিদের জন্য এ এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। একই সময় বিহার সহ কয়েক রাজ্যে বন্যা, তারপরেও বাংলার বাঙালিদের পাশে তারা ছিল। এই সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা ও সাহায্যের জন্য শ্রীমতী গান্ধী বিভিন্ন দেশে যান। একই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করেন। তাঁর সরকারের প্রতিনিধিরা চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ৬৭ রাষ্ট্রে ১৮ টি সরকারী প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদশের পক্ষে থাকলেও ২২ সদস্যের ওআইসি-ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ও চীন বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি প্রেরণে সহায়তা দেন ভারত। আব্দুস সামাদ আজাদসহ প্রতিনিধিরা এশিয়া ও ইউরোপে যান। ১৩-১৬ মে বুদাপেস্টে বিশ্ব শান্তি সমেলনে পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী ভারতীয়রা এগিয়ে আসেন। পণ্ডিত রবি শঙ্কর উদ্যোগী হয়ে ‘ বাংলাদেশ কনসার্ট’ এর আয়োজন করেন আমেরিকার লস এঞ্জেলসে। ইউনিসেফ তহবিলে দেন দশ লক্ষ ডলার। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন, সেভ ইস্ট বেঙ্গল কমিটি, গান্ধী ওসি ফাউন্ডেশন সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিতেরর সময় শ্রীমতী লোকসভায় ভাষণ দেন।
‘… বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছে।… আমরা বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বিজয়ের মুহূর্তে অভিনন্দন জানাচ্ছি।….’
সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আশা প্রকাশ করছি ও আস্থা রাখছি যে, এ নব্য জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আপন জাতির মাঝে সঠিক অবস্থান গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তি, সমৃদ্ধি আর প্রগতির দিকে পরিচালনা করবেন। সেই সময় এসেছে যখন তারা তাদের সোনার বাংলার জন্য মিলেমিশে এক সার্থক ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করবে।’
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সমর্থনে লোকসভায় আরেকটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্বে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ে বিশেষ সহায়তা করে।
‘ মাননীয় স্পিকার স্যার, ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ তারিখে বাংলাদেশে একটা বিশাল অভ্যুত্থানের ছয় দিন পরে, আমি এ লোকসভায় সশ্রদ্ধভাবে একটা সিদ্ধান্ত আলোচনা ও মীমাংসার জন্য প্রস্তাব করেছি।
আমি তখন বলেছিলাম যে, শান্তি সম্পর্কে ভারতের স্থায়ী আগ্রহ এবং মানবাধিকার সমর্থন ও সুরক্ষার আমাদের কৃত অঙ্গীকার বাংলাদেশের নিরাপত্তাহীন জনগণকে বল প্রয়োগ ও বেপরোয়া হত্যার তাৎক্ষণিক বিরতি দাবী করেছে।….
‘ আমরা বাংলাদেশের জনগণের বিরাট অনুধাবন করতে পারি। আমি অনুপ্রেরণা ও আনন্দ ভাগ-বাটোয়ারা করে নেই।….
এটা একটা বিজয়। কিন্তু এটা এমন বিজয় যা শুধু অস্ত্রের নয় বরং আদর্শেরও বটে। মুক্তিবাহিনী এত নির্ভয়ে যুদ্ধ করতে পারত না। কিন্তু তারা পেরেছে স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের আবেগপূর্ণ অভিলাষের জন্য। আমাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী এত নির্ভীক ও অবিশ্রান্ত হতে পারত না, যদি তারা আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে না বুঝত।
(ইন্দিরা গান্ধী, বায়োগ্রাফী- পপলু জয়কর। অনুবাদ-লিয়াকত আলী খান)
বাংলাদেশ বাংলা ভাষার জনগণের স্বাধীন ভূ-খণ্ড অভ্যুদয় হলো। বঙ্গবন্ধু পাক কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হলেও পাকসরকাররা ফাঁসী কার্যকর করতে সাহস করেনি। ভারতের ব্যাপক চাপ এবং বিশ্বের বহুদেশের অনমনীয় প্রভাবে পাকসরকার বঙ্গবন্ধুকে জানুয়ারিতে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন।#




