সমরেশ বসু: বিতর্কিত উপন্যাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নারী

সমরেশ বসুর সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস হিসেবে ‘বিবর’(১৯৬৫) এবং ‘প্রজাপতি’ (১৯৬৭)। উভয় উপন্যাসই অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং বিশেষত ‘প্রজাপতি’বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও নান্দনিক বিতর্কের সূত্রপাত করে।

১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘বিবর’ উপন্যাসে কলকাতার নগরজীবনে বেড়ে ওঠা একদল যুবকের মানসিক সংকট, হতাশা, যৌন বিভ্রান্তি এবং মূল্যবোধের ভাঙন চিত্রিত হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী দ্রুত নগরায়ন, মধ্যবিত্ত জীবনের শূন্যতা ও নৈতিক দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। সমাজের শ্রেণি-বৈষম্য, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নারী-অবস্থানের সূক্ষ্ম কিন্তু নির্মম চিত্রণ সমকালীন পাঠকের একাংশের কাছে অস্বস্তিকর বলে বিবেচিত হয়। যদিও ‘বিবর’-এর বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি, তবু এর সাহসী ভাষা ও বিষয়বস্তুর জন্য এটি তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়।

‘প্রজাপতি’প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায়। উপন্যাসটি এক কিশোর-তরুণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যৌন কৌতূহল ও সামাজিক বাস্তবতার সংঘাতে গঠিত আত্মকথনমূলক রচনা।

এই উপন্যাসে ব্যবহৃত অশ্লীল বলে বিবেচিত ভাষা, নগ্ন যৌন বাস্তবতার বর্ণনা এবং সমাজের ভণ্ডামিকে উন্মোচনের প্রবণতা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।

অমল মিত্র নামে এক তরুণ আইনজীবী ‘প্রজাপতি’র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি ক্রমে উচ্চ আদালত পেরিয়ে ১৯৬৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিচার প্রক্রিয়ায় সাহিত্যিক স্বাধীনতা বনাম সামাজিক নৈতিকতা—এই দ্বন্দ্ব জাতীয় স্তরে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। ফলে ‘প্রজাপতি’ কেবল একটি উপন্যাস নয়, বরং ভারতীয় সাহিত্যে শিল্পস্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্তে পরিণত হয়।

এই দুটি উপন্যাস ছাড়াও সমরেশ বসুর আরও কিছু রচনা— যেমন ‘উত্তরঙ্গ’ এবং ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লেখা ‘শম্ভু’— সমকালীন পাঠ ও সমালোচনায় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তবে সাহিত্যিক ও সামাজিক প্রভাবের দিক থেকে ‘বিবর’ ও ‘প্রজাপতি’উপন্যাস সর্বাধিক আলোচিত ও সমালোচিত রচনা হিসেবে স্বীকৃত।

বিবর: আধুনিক শহুরে পুরুষমানসের পোস্টমর্টেম
মনস্তত্ত্ব,যৌনতা–ক্ষমতার রাজনীতি, নারীদেহের প্রতিভাষা, ভণ্ড নৈতিকতা ও আধুনিক নগর–মানস—বিবর উপন্যাসে প্রকাশিত।

বর্ণনাভঙ্গি ও আত্মস্বীকারোক্তিমূলক মনোলগ:
মূলত প্রথম পুরুষে আত্মকথনধর্মী মনোলগ ব্যবহার দেখা যায় বিবরে। বর্ণনাকারীর কণ্ঠে কোনো নৈতিক ভারসাম্য নেই—বরং আছে আত্মবিদ্রুপ, আত্মপক্ষসমর্থন ও আত্মপ্রবঞ্চনার সমান্তরাল স্রোত। সমরেশ বসু এখানে “বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারী” নির্মাণ করেন না; বরং তিনি তৈরি করেন morally compromised narrator, যার বক্তব্য পাঠককে ক্রমাগত সন্দেহে রাখে।

মানুষ নিজের অপরাধকে কীভাবে যুক্তি দিয়ে ঢেকে ফেলে, দেখান। আত্মসমালোচনা ও আত্মঅজুহাত একসঙ্গে সহাবস্থান সত্ত্বেও যেখানে চিন্তা, স্মৃতি, কামনা, ভয় ও দর্শন একাকার।

রুবি দত্ত: দেহ নয়, ক্ষমতার প্রতিভা
উপন্যাসে রুবি দত্ত ক্ষমতা, যৌনতার ”নতুন সংজ্ঞা রুবি দত্ত চরিত্রটি কেবল দেহ নয়, ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বর্ণনাকারী তাকে সরাসরি দেবী, কালী, কলকাতেশ্বরী বলে আখ্যা দেয়—এ একধরনের ব্যঙ্গাত্মক দেবীকরণ।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— ‘প্রতিভা’ শব্দটির পুনঃসংজ্ঞা নির্মাণ।প্রতিভা অর্থে শিল্প, মেধা বা নৈতিক উৎকর্ষ নয়, ক্ষমতাবান পুরুষদের আয়ত্তে রাখার দক্ষতা হল প্রতিভা।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দ্বিচারিতার উন্মোচন হয় উপন্যাসে—পুরুষ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে সে “সফল”।নারী ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে সে “জাঁহাবাজ”।সমরেশ বসু এই দ্বৈত মানসিকতাকে বিদ্রুপ করেন।

৩. নীতার মৃতদেহ: কাম, অপরাধ ও নৈতিক শূন্যতা 
‘বিবর’ উপন্যাসে সবচেয়ে তীব্র ও অস্বস্তিকর স্তর!—নীতার মৃতদেহের সঙ্গে বর্ণনাকারীর শারীরিক সংস্পর্শ ও পর্যবেক্ষণ আরও দুঃখজনক।

এখানে লক্ষ্যণীয়—কামনামিশ্রিত নির্লিপ্ততায় শরীরকে অনুভূতির বস্তু হিসেবে দেখা হয়, সম্পর্কের নয়। মৃতদেহও এখানে “অন্য” নয়—বরং পূর্ববর্তী ভোগের ধারাবাহিকতার সাক্ষ্য দেয়।এটি সমরেশ বসুর সাহিত্যে এক পরিচিত কৌশল—যেখানে যৌনতা মানবিক সংযোগ নয়, বরং ক্ষমতা ও অভ্যাসের ফল।

নীতা জীবিত অবস্থায়ও বর্ণনাকারীর কাছে ব্যক্তি ছিল না; মৃত অবস্থায়ও নয়। মৃত্যু এখানে নৈতিক ধাক্কা তৈরি করে না—বরং বর্ণনাকারীর শূন্যতাকে আরও নগ্ন করে তোলে ।

পবিত্রতার ভণ্ড দর্শন ও হীরেনের পুরুষতন্ত্র
হীরেন চরিত্রটিকে সমরেশ বসু অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আক্রমণ করেন—পুরুষের “পবিত্র নারী”-র ধারণা, শিল্পী–বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক ভণ্ডামি হীরেন চরিত্রটি তার প্রতীক।

যে নারীকে দেবী ভাবে, কিন্তু সেই দেবীত্বে সামান্য চিড় ধরলেই আতঙ্কিত হয়। এখানে “কিউরেট”, “পাপ”, “ভেজাল”—এই শব্দগুলো নারীর শরীরকে নৈতিক পরীক্ষাগার বানিয়ে তোলে। সমরেশ বসু দেখান, পবিত্রতা আসলে নারীর গুণ নয়—পুরুষের আরোপিত কল্পনা।

৫. স্বাধীনতা বনাম পরাধীনতা: আধুনিক মানুষের সংকট
“স্বাধীনতাকে সবাই আগুনের মতো ভয় করে”-এই সংলাপ যৌনতা, সম্পর্ক, চাকরি, শিল্প—সবকিছু মিলিয়ে একটি কথাই উঠে আসে—মানুষ স্বাধীন নয়, মানুষ স্বাধীনতার ভান করে পরাধীনতাকে বেছে নেয়। নীতা, রুবি দত্ত, ইতি—কেউই মুক্ত নয়। পুরুষও নয়। সবাই একে অপরের কামনা, ভয় ও সুবিধার জালে বন্দি।

৬. সমরেশ বসুর সাহিত্যিক সাফল্য:
এই অনুচ্ছেদ সমরেশ বসুর কথাসাহিত্যের একটি চরম উদাহরণ, যেখানে—কোনো নৈতিক উপদেশ নেই।কোনো আদর্শ নারী–পুরুষ নেই, আছে কেবল নগ্ন সত্য, যা অস্বস্তিকর। তিনি পাঠককে বিচারক হতে দেন, কিন্তু সহজ বিচার সম্ভব করেন না।
আধুনিক শহুরে মধ্যবিত্ত পুরুষ মানসিকতার পোস্টমর্টেমে দেখান লেখক। দেখান নারী ভালোবাসার বিষয় নয়, ক্ষমতা ও ভোগের ক্ষেত্র আর পুরুষ নিজেই নিজের কাছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী।

সমরেশ বসু এই লেখায় দেখান—নৈতিকতার ভাষা যত উন্নত হয়, ভণ্ডামিও তত সূক্ষ্ম হয়।সমরেশ বসুর কথাসাহিত্যের বাস্তবতাবাদ, পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক নৈতিকতার ভণ্ডামির প্রেক্ষিতে নির্মিত।

বিবর’ এক গভীর অন্তর্মুখী, প্রায় আমত্মকথনধর্মী উপন্যাস। এখানে নারী কোনো স্থির চরিত্র নয়; বরং পুরুষচেতনার সংকটকে উন্মোচনের এক আয়না। তবু নারী নিছক প্রতিফলন নয়—সে প্রশ্ন তোলে, প্রত্যাখ্যান করে, নিজের অস্তিত্ব দাবি করে। পুরুষের সৃজনসংকট, যৌন দ্বন্দ্ব ও নৈতিক ভাঙনের ভেতর নারী এক অনিবার্য সত্য, যাকে অস্বীকার করা যায় না।

প্রজাপতি: অশ্লীলতার মামলায় বন্দি এক সাহিত্যিক সত্য
সমরেশ বসুর কথাসাহিত্যে নারী চরিত্র কখনোই কেবল নায়িকা বা সহানুভূতির বস্তু হয়ে ওঠে না; বরং তারা সমাজের নির্মম বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি প্রশ্নচিহ্ন। এই উপন্যাসের যে ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে, তা মূলত সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি—যেখানে নারীকে তার আচরণ, শরীর ও সামাজিক সম্পর্কের নিরিখে বিচার করা হয়, অথচ সেই বিচারের নৈতিক ভিত্তি নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ। শিখা ও বেলা—এই দুই নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ভাষ্য আসলে সমাজের দ্বিচারিতা, ভণ্ড নৈতিকতা এবং ক্ষমতার রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ।

নারী সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ধৃতাংশের সূচনাতেই দেখা যায়—
“এই মেয়েগুলো কী। তারা সব রকম করবে, অথচ, বেশ্যা না।”
এই বাক্যটি নারী সম্পর্কে সমাজের গভীরতম অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। —এই অস্পষ্ট অথচ অভিযুক্তিমূলক বাক্যবন্ধ নারীর স্বাধীন আচরণ বা সামাজিক মেলামেশাকেই যৌনতার সঙ্গে একাকার করে দেখে। অথচ ‘বেশ্যা না’—এই সংযোজন বোঝায়, সমাজ নারীকে দুটি চরম মেরুতেই দেখতে অভ্যস্ত: হয় সে ‘শালীন’, নয়তো ‘পতিতা’। এর মধ্যবর্তী কোনো মানবিক পরিচয় সমাজ স্বীকার করে না। শিখা ও বেলার ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট।

শিখা:সমাজের চোখে নারী মানেই অভিযুক্ত
জন্ম, পরিবার ও কলঙ্কের উত্তরাধিকার শিখা চরিত্রটি, সরাসরি খুব বেশি কর্মরত অবস্থায় উপস্থিত না হলেও, তার পরিচয় নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণভাবে তার পিতার মাধ্যমে। শিখার বাবা—একজন “ ফেরেববাজ”, যিনি দাঙ্গার সময় মুসলমানের বাড়ি দখল করে, পরে নানা কৌশলে ‘মৌরসী দলিল’ করে নেন। এই বর্ণনার মাধ্যমে সমাজের এক বিশেষ শ্রেণির উত্থান চিহ্নিত হয়—যারা রাজনৈতিক অস্থিরতা, দাঙ্গা ও আইনের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে সম্পত্তি ও ক্ষমতার মালিক হয়।

এই অপরাধমূলক বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় যেন অদৃশ্যভাবে এসে পড়ে শিখার ওপর। সমাজ শিখাকে একজন স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে না দেখে দেখে “ফেরেববাজের মেয়ে” হিসেবে। অর্থাৎ এখানে নারী নিজের পরিচয় নির্মাণ করতে পারে না; তাকে উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করতে হয় পিতার পাপ ও কলঙ্ক। শিখার চরিত্র তাই ব্যক্তিমানুষ হিসেবে নয়, বরং সামাজিক সন্দেহের আধার হিসেবে উপস্থিত।

বেলা: বিচ্ছিন্নতা, স্বাধীনতা ও গুজবের রাজনীতি
বেলা চরিত্রটি তুলনামূলকভাবে বেশি দৃশ্যমান ও বিতর্কিত। তার বিয়ে ভেঙে গেছে—কিন্তু “কার দোষ” তা জানা নেই। তবু সমাজের বিচারে দোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসে পড়ে নারীর ওপরেই। বিচ্ছিন্ন নারী মানেই চরিত্রহীন—এই সহজ সমীকরণেই বেলার সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত।

অন্য আর একটি সংলাপ, “বেলা তো এখন বাড়িতেই বেশ আসর জমিয়ে তুলেছে…”
এই ‘আসর’ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে পুরুষদের আগমন, সামাজিক মেলামেশা, কথাবার্তা—সবকিছুকে ইঙ্গিতপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। ডাক্তার, ব্যবসাদার, প্রভাবশালী পুরুষেরা বেলার বাড়িতে আসে—কিন্তু প্রশ্ন তোলা হয় না তাদের চরিত্র নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে কেবল বেলার ‘বিশেষ’হওয়া নিয়ে।

দ্বিচারিতার সমাজ : পুরুষ নির্দোষ, নারী অভিযুক্ত বেলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তার কাছে যারা আসে, তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত পুরুষ। অথচ সামাজিক নিন্দা তাদের নয়; নিন্দা কেবল নারীর। এই দ্বিচারিতাই সমরেশ বসুর লেখার কেন্দ্রীয় সুর। নারী যদি পুরুষের সামাজিক চাহিদা পূরণ করে, তবে সে ‘বিশেষ’; আর পুরুষ সেই একই সম্পর্কে থেকেও ‘ভদ্রলোক’।

এখানে নারী শরীর এক ধরনের সামাজিক পণ্যে পরিণত হয়—যার মাধ্যমে পুরুষ তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও ভোগ নিশ্চিত করে। কিন্তু সেই লেনদেনের নৈতিক বোঝা বইতে হয় একমাত্র নারীকে।

ভাষার নির্মমতা ও সামাজিক মানসিকতা উদ্ধৃতাংশে ব্যবহৃত ভাষা—খচ্চর-রাজ, ফেরেববাজ, বেশ্যা—এই শব্দগুলো কেবল চরিত্র নয়, সমাজের মনস্তত্ত্বও নির্মাণ করে। নারী সম্পর্কে এই ভাষা সমাজের গভীরে প্রোথিত বিদ্বেষ ও ভয়ের প্রকাশ। স্বাধীন নারী মানেই বিপজ্জনক—এই ধারণাই ভাষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিখা ও বেলা—এই দুই নারী চরিত্র সমরেশ বসুর কথাসাহিত্যে কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সামাজিক অবস্থানের প্রতীক। তারা এমন এক সমাজে বাস করে যেখানে নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষের দৃষ্টিতে, পুরুষের ভাষায়, পুরুষের নৈতিকতায়। তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা আসলে দেখতে পাই—নারী কী করেছে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে সমাজ তাকে কীভাবে দেখতে চায়।

প্রজাপতি’ উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলি মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেয়। টুকি, শিখা, কিংবা অন্যান্য নারী—তারা ‘পতিতা’ নয়, আবার ‘সতী’ও নয়। তারা সম্পর্ক গড়ে তোলে নিজের ইচ্ছায়, নিজের শরীর ও আবেগের অধিকার নিয়ে। এই স্বেচ্ছাচারী নির্বাচনই তাদের বিপজ্জনক করে তোলে। সমরেশ বসু এখানে নারীর কামনাকে স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন—যা তৎকালীন সমাজে ছিল অগ্রহণযোগ্য।

সমরেশ বসুর বিতর্কিত উপন্যাসে নারী কোনো ‘সমস্যা’ নয়; নারীই সমস্যার ভাষ্যকার। সমাজ যাকে অশ্লীলতা বলে দাগিয়ে দিতে চায়, সমরেশ বসু তাকেই সাহিত্যিক সত্যে রূপ দেন। ফলে তাঁর নারী চরিত্রেরা কেবল সাহসী নয়—তারা অনিবার্য, প্রশ্নবিদ্ধ এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলা সাহিত্যে বিতর্কিত নারীচরিত্রের ইতিহাসে সমরেশ বসু তাই একক ও অনন্য।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!