গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের চূড়ান্ত রূপের বহিঃপ্রকাশ বর্বর যুদ্ধ অব্যাহত আছে। এই যুদ্ধ, হিংস্রতায় বিপণ্ন হচ্ছে মানব জীবন। সাধারণ মানুষ কি যুদ্ধ চায়? বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ ত্রাসের ক্রীড়ানক হয়ে উঠেছে তাদের তাবেদার গোষ্ঠী, তৃতীয় বিশ্বের দেশের সরকার প্রধান ও তাদের দলগত অনুসারীরা। এই সব যুদ্ধের সাথে কোন সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ জড়িত নয়। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতায় যারা অপ্রত্যাশিত মৃত্যুবরণ করছে, তাদের অপরাধ কি? রাষ্ট্রের সরকারে যারা আছেন, তাদের দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো রক্তাক্ত অধ্যায় সৃষ্টি করে চলছে। এমন বিধ্বস্ত সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৪তম জন্মদিন স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি। আরো শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, সেই সব সাধারণ মানুষকে, যাঁদের যুদ্ধে কোন ভূমিকা নেই, অথচ যুদ্ধের কারণে জীবন বিপণ্ন হয়েছে।
কবিগুরু সাহিত্য সাধক, কিন্তু বিশ্বের বিপণ্ন মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটি বৃহৎ সর্বজাতিক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছেন। ‘সর্বজাতীয় রাষ্ট্রিক সমবায় জাতির প্রকৃত স্বার্থসাধন সম্ভব’— তাঁর এই ভাবনায় বিশ্বের সাম্য সম্প্রীতি ও শান্তির বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বের সংকট উত্তরণের জন্য তিনি যেসব বিশ্লেষণ ও ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন, তা সত্যি কালকে অতিক্রম করে। কবির উপলব্ধি, “য়ুরোপীয় সভ্যতা প্রথম থেকেই নগর সংহত হবার পথ খুঁজছে। নগরে মানুষের সুযোগ হয় বড়ো, সম্বন্ধ হয় খাটো। নগর অতিবৃহৎ, মানুষ সেখানে বিক্ষিপ্ত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য একান্ত, প্রতিযোগিতায় মথন প্রবল। ঐশ্বর্য সেখানে ধনী-নির্ধনের বিভাগকে বাড়িয়ে তোলে এবং চ্যারিটির দ্বারা যেটুকু যোগসাধন হয় তাতে সান্ত্বনা নেই, সম্মান নেই। সেখানে যারা ধনের অধিকারীএবং যারা ধনের বাহন, তাদের মধ্যে আর্থিক যোগ আছে, সামাজিক সম্বন্ধ বিকৃত অথবা বিচ্ছিন্ন।”
বিশ্বের পরিস্থিতিতে কবিগুরু পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। স্পেনের ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর বিরূদ্ধে (১৯৩৭), জাপানি নৃশংসতার বিরূদ্ধে (১৯৩৭) প্রতিবাদস্বরূপ খোলা চিঠি ও বিভিন্ন লেখা লিখেছেন। সেইসব লেখাগুলো যেমন– আত্মশক্তি, স্বদেশী সমাজ, ভারতবর্ষ, রাজাপ্রজা, রাশিয়ার চিঠি, কালান্তর ইত্যাদি গ্রন্থে পাওয়া যায়। এছাড়াও বহু কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে, গল্পে পাওয়া যায়। রাজনৈতিক ভাবনা ফুটে উঠেছে গোরা, ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে, কালের যাত্রা’ নাটকে পাওয়া যাবে। কবির মানস ভাবনায় বিশ্ব মানবের জয়গান বার বার উঠে এসেছে। আর তাইতো দেখতে পাই–
“ধনের ধর্মই অসাম্য।
তাই ধনের বৈষম্য লইয়া যখন সমাজে পার্থক্য ঘটে তখন ধনীর দল সে পার্থক্যকে সমূলে ঘুচাইতে ইচ্ছা করে না।’
বিশ্বযুদ্ধের নগ্ন নৃশংসতায় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বেপরোয়া হামলার বিরূদ্ধে কবিগুরু বিশ্ব মানবের বিপর্যয় হিসেবে দেখেছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। এবিষয়ে লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধে আলোকপাত করেছেন।
প্রগতিশীল লেখকদের সাথে সম্মিলিত আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ১৯১৯ সালে রমাঁ রলাঁ-র মানব মৈত্রীর চিন্তার স্বাধীনতায় এবং একই বছর ‘ক্লার্তে’র ঘোষণা পত্রে’ স্বাক্ষর করে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৩২ সালে জাপানের চীন আক্রমণ, ১৯৩৫ সালে ইতালির আগ্রাসন, ১৯৩৭ সালে স্পেনের বর্বরতার প্রতিবাদে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৩৫ সালে ” বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের’ সদস্য হন। সকল বর্বরতার বিরদ্ধে এবং বিশ্বের ফ্যাসীবাদ, সাম্রাজ্যবাদের নির্মমতার প্রতিবাদ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সকল প্রকার যুদ্ধ থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষার জন্য কবির আহবান সত্যিসত্যিই বিস্ময়কর। তাঁর দৃঢ়তার পরিপূর্ণ রূপ লেখার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। কবি বিশ্বের মানবিক বিপর্যয় তথা ভয়াবহ নৃশংসতার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে বিশ্ব মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জনজীবনের পথ নির্দশনা করেছেন। কবিগুরুর সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ব মানবের ন্যায্যতার পক্ষে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন পাই।
কবিগুরু জীবনের নানা পর্যায়ে সকল নির্যাতন হিংস্রতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। হিজলী বন্দী নিবাসে বর্বরতার প্রতিবাদে কলকাতা বিশাল জনসভায় বক্তব্য (১৯৩১), জালিওয়ানওয়ালাবাগে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও স্যার, নাইটহুড’ উপাধি বর্জন (১৯১৯), আন্দামানে নির্বাসিতদের উপর নৃশংসতার বিরূদ্ধে প্রতিবাদ (১৯৩৩), এরকম বহুদৃষ্টান্ত দেয়া যাবে। হিজলী’র ঘটনায় কবিগুরু বলেন, “যাদের হাতে সৈন্যবল ও রাজপ্রতাপ অথবা যারা এই শক্তির প্রশ্রয়ে পালিত তারা বিচার এড়িয়ে এবং বলপূর্বক সাধারণের কণ্ঠরোধ করে ব্যাপকভাবে এবং গোপন প্রণালীতে দুবৃত্ততার চূড়ান্ত যেতে কুণ্ঠিত হয় নি। কিন্তু মানুষের সৌভাগ্যক্রমে এরূপ নীতি শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না।”
বিশ্বের চরম নৃশংসতার সাথে দেশের চিত্র গুরুদেব উপস্থাপন করছেন, তা কোন একটা দেশের সীমানায় আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক দেশের সংকট নৈরাশা প্রতিনিয়ত সামাজিক জীবনে যে নিদারুণ ভয়াবহ জীবন সংকট সৃষ্টি করছে, তারই যেন প্রতিফলন।
“এমন অবস্থায় যন্ত্রযুগ এল, লাভের অঙ্ক বেড়ে চলল অসম্ভব পরিমাণে। এই লাভের মহামারি সমস্ত পৃথিবীতে যখন ছড়াতে লাগল তখন যারা দূরবাসী অনাত্মীয়, যারা নির্ধন, তাদের আর উপায় রইলো না—চীনকে খেতে হল আফিম, ভারতকে উজাড় করতে হল তার নিজস্ব; আফ্রিকা চিরদিন পীড়িত, তার পীড়া বেড়ে চলল।” (রাশিয়ার চিঠি)
কবির ভাবনা কত স্বচ্ছ ও সুদূরপ্রসারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইতিহাসে দেখি, যুগ যুগ ধরে বঙ্গশ্চ অঞ্চলে আধিপত্যবাদ চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। তার সঠিক অনুধাবন ও উপলব্ধি প্রথম পরিপূর্ণভাবে করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বেদের অনুবাদের মাধ্যমে জাতি বর্ণভেদের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করে বাঙালির বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কবিগুরু তাইতো বলেন, ‘আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি।’ কবিগুরুর পিতামহ থেকে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজের ভাবনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। কবিগুরুও একই পথের পথিক হলেন। মহাপুরুষদের যে পথ, সেই পথের পথিক হলেন তিনি। ফলে তাঁর ভাবনা ও কর্মের মধ্যে মহর্ষির প্রভাব নানাভাবে লক্ষ্য করা যায়। অনায়াসে বলতে পারেন,
‘অহঙ্কার চূর্ণ করো, প্রেমে মন পূর্ণ করো,
হৃদয় মন হরণ করি রাখো তব সাথে হে।’
কবিগুরু তপোবনের সাধনায় বিশ্বকে বাঙালির বিশ্বভাবনায় শান্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। অনায়াসে কবি বলতে পারেন, ‘হে অনন্ত বিশ্বসংসারের পরম এক পরমাত্মন, তুমি আমার সমস্ত চিত্তকে গ্রহণ করো তুমি সমস্ত জগতের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও পূর্ণ করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছ, তোমার সেই পূর্ণতা আমার দেহে-মনে, অন্তরে-বাহিরে, জ্ঞানে-কর্মে ভাবে যেন প্রত্যক্ষ করতে পারি। আমি আপনাকে সর্বতোভাবে তোমার দ্বারা আবৃত রাখিয়া নীরবে নিরভিমানে তোমার কর্ম করিতে চাই।’ এই অনুভব কবির।
বিশ্বের দেশে দেশে কত হানাহানি রক্তপাত, মানবিক বিপর্যয়।
‘সেখানে বিজ্ঞান আছে, বাহুবল আছে, অর্থবল আছে, বুদ্ধিবল আছে, কিন্তু তার দ্বারা মানুষ রক্ষা পায় না। স্বাজাত্যর শিখরের উপর চড়ে বিশ্বগ্রাসী লোভ যখন মনুষ্যত্বকে খর্ব করতে স্পর্ধা করে, রাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ঠুরতা ও ছলনার সীমা থাকে না, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা এবং সংশয় যখন নিদারুণ হিংস্রতায় শান দিতে বসে, তখন মানবের ধর্ম আঘাত পায় এবং মানবের ধর্মই মানুষকে ফিরে আঘাত করে।’ (মানুষের ধর্ম)
বিশ্বে দিকে যদি আমরা দৃষ্টিনিবদ্ধ করি, তাহলে একই চিত্রের নৃশংসতা, মানবিকতার উপর চরম আঘাতের ঘটনা দেখতে পাই। এই হিংস্রতার বিরূদ্ধে কবি বিশ্বমানবমনের ঐক্য চেয়েছেন।
‘মানবসত্য’ প্রবন্ধে কবি বলেন,
‘আমাদের জন্মভূমি তিনটি, তিনটিই একত্র জড়িত। প্রথম পৃথিবী। মানুষের বাসস্থান সর্বত্র।’… মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। অতীতকাল থেকে পূর্বপুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড় সে তৈরী করেছে।.. স্মৃতিলোকে সকল মানুষের মিলন। বিশ্বমানবের বাসস্থান–এক দিকে পৃথিবী আর-এক দিকে সমস্ত মানুষের স্মৃতিলোক।… আর তৃতীয় বাসস্থান আত্মিকলোক। সেটাকে বলা যেতে পারে সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ। অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যোগের ক্ষেত্র এই চিত্তলোক।’
কবিগুরুর ভাবনার ভেতর মহামানবের চিরায়ত বাণী প্রবাহিত হয়েছে।
কবি অনুভব করেছেন ‘সর্বজনীন জনশিক্ষায়’। জনগণের ঐক্য মিলনে, সত্য প্রেমে। কবি যখন দেখেন নৃশংসতা, তখন বলে ওঠেন, ‘পৃথিবীতে প্রচণ্ডের মধ্যে, সংঘাতের মধ্যে, শান্তির যে অভ্যুদয় দেখি আদিযুগে, তাই দেখি মানুষের ইতিহাসেও। উদ্দাম নিষ্ঠুরতা আজ ভীষণাকার মৃত্যুকে জাগিয়ে তুলছে সমুদ্রের তীরে তীরে; দৈত্যরা জেগে উঠছে মানুষের সমাজে, মানুষের প্রাণ যেন তাদের খেলার জিনিস। মানুষের ইতিহাসে এই দানবিকতাই কি শেষ কথা? মানুষের মধ্যে এই-যে অসুর এই কি সত্য?’
মানবিক বিপর্যয়ের দিনেও কবি অনুভব করেছেন মহাপুরুষের, যিনি শান্তির বাণী নিয়ে কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করতে পারেন। কবি সত্যের পথে থেকেছেন, অন্যায়ের বিপক্ষে শক্তিশালীরূপে অবস্থান নিয়েছেন। কবিগুরুর ভাবনা শান্তির, যা মহাকালের পথে অগ্রসর হয়। কবি দার্শনিক প্রজ্ঞায় সর্বমানবকে সত্য জ্ঞানে অনন্তরূপে মিলনবন্ধনে আবদ্ধ করতেই চেয়েছেন। এ এক দার্শনিক অভিব্যক্তি।
কবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবিক বিপর্যয়, ভয়াবহ হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করছেন। সেই বিপর্যয়ের মধ্যে কবি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
“আমাদের দেশে আমাদের পল্লীতে পল্লীতে ধন-উৎপাদন ও পরিচালনার কাজে সমবায় নীতির জয় হোক, এই কামনা করি।”
কবি পল্লীর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের উপায় বলেছেন,
“আমাদের দেশের গ্রামগুলি বেঁচে উঠুক…। বর্তমান যুগের বিদ্যা ও বুদ্ধির ভূমিকা বিশ্বব্যাপী, যদিও তার হৃদয়ের অনুবেদনা সম্পূর্ণ সে পরিমাণে ব্যাপক হয়নি। গ্রামের মধ্যে সেই প্রাণ আনতে হবে যে প্রাণের উপাদান তুচ্ছ ও সংকীর্ণ নয়, যার দ্বারা মানব প্রকৃতিকে কোন দিকে খর্ব ও তিমিরাবৃত না রাখা হয়।” (রাশিয়ার চিঠি)
কবি পল্লী উন্নয়নে যে পথের নির্দেশনা দিয়েছেন, তা দেশের পল্লী সমবায় ভাবনায় নতুন উদ্ভাবন বলে মনে করা যায়। “সমবায় প্রণালীতে ঋণ দিয়ে নয়, একত্র কর্ম করিয়ে পল্লীবাসীর চিত্তকে ঐক্যপ্রবণ করে তুলে তবে আমরা পল্লীকে বাঁচাতে পারব।”
কবির ভাবনা যুগের আলো বহন করছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থলগ্নী ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, সেই ঋণের দ্বারা দরিদ্র জনজীবনের মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বরং বিদ্যমান সংকট ও শোষণ প্রক্রিয়াকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে।
কবি রাষ্ট্রের উন্নয়নে পথ দেখিয়েছেন, নৃশংসতার বিরূদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন।
বিশ্ব মানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কোন দেশের সীমায় তিনি আবদ্ধ নন। তাঁর চিন্তা, ভাবনা, কর্মের প্রয়োগ হলে সকল দেশের জনজীবনে পরিবর্তন হবে।
তাইতো কবি বলেন, “যেদিন মানুষ স্পষ্ট করে বুঝবে যে, সর্বজাতীয় রাষ্ট্রিক সমবায়েই জাতির প্রকৃত স্বার্থসাধন সম্ভব, কেননা পরস্পর নির্ভরতাই মানুষের ধর্ম, সেইদিনই রাষ্ট্রনীতিও বৃহৎভাবে মানুষের সত্য সাধনায় ক্ষেত্র হবে।” রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৪, পৃ ৪০৪)
উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার লাভ করেছে। কালক্রমে উপনিবেশ পদ্ধতির অবসান হলেও সাম্রাজ্যবাদের কঠোর ব্যবস্থা, পুঁজিবাদের বিস্তার, বাণিজ্যের বাজার দখল, মুদ্রা ব্যবস্থার নীতি, যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদের চরম উত্থান কবিগুরু দেখেছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে কবিগুরু জানালেন, “সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতা কিরকম নগ্নদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।”
ফ্যাসীবাদের উদ্ভব সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তর থেকে, যা রাজনৈতিক সহিংসতা, যুদ্ধের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসক ও তার অনুগামী শ্রেণির একক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফ্যাসিস্টরা গণহত্যা, নির্বাসন, বর্ণবাদ, জাতিগত সহিংসতা, ধর্মীয় নৈরাজ্য, সামরিক অভিযান ইত্যাদির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতিতে সরকার পরিচালিত করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কর্পোরেট ব্যবস্থায় পরিণত করে। অতি ডানপন্থী ভাবনায় ধর্মীয় আধিপত্যের মাধ্যমে ভিন্ন ধর্মের সংখ্যালঘুদের উপর দাঙ্গা সংঘটিত করতে দ্বিধা করে না।
কবিগুরু সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদের বিরূদ্ধে মানবিক বিশ্বের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
‘চিরদিন ভারতবর্ষে এবং চীনদেশে সমাজতন্ত্রই প্রবল, রাষ্ট্রতন্ত্র তার নীচে। দেশ যথার্থভাবে আত্মরক্ষা করে এসেছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে।’
“মহাযুদ্ধ এসে অকস্মাৎ পাশ্চাত্য পাশ্চাত্য ইতিহাসের একটা পর্দা তুলে দিলে। যেন কোন মাতালের আব্রু গেলো ঘুচে। এত মিথ্যা, এত বীভৎস হিংস্রতা নিবিড় হয়ে বহুপূর্বেকার অন্ধযুগে ক্ষণকালের জন্যে হয়তো মাঝে মাঝে উৎপাত করেছে, কিন্তু এমন ভীষণ উদগ্র মূর্তিতে প্রকাশ করেনি।… অমানবিক নিষ্ঠুরতা দেখা দিচ্ছে বুক ফুলিয়ে।” (কালান্তর)
উন্মত্ত বর্বরতাকে কবি ফ্যাসিজম বলেছেন। কবিগুরুর আরো বলেছেন, “পলিটিকসে খুনজখম লুঠপাঠের জন্য যারা দায়ী তারা ঘৃণ্য, অপর ক্ষেত্রেও যারা দায়ী তারা কম ঘৃণ্য নয়।”…. “দণ্ডপ্রয়োগের অতিকৃত রূপকে আমি বর্বরতা বলি। আমি কোনো পক্ষেই হিংসার মূল্য হিংস্রতা দিয়ে দিতে চাই নে; কিন্তু সমাজ ও রাজার তরফ থেকে ধিক্কারের দ্বারা বিচারের প্রয়োজন আছে উভয় পক্ষেই। নির্জন কারাকক্ষবাস বা আন্দামানে নির্বাসন আমি কোনোপ্রকার অপরাধীর জন্য সমর্থন করি নে, যাঁরা দেশবাসীর প্রতিনিধির পদে উচ্চ শাসনমঞ্চে সমাসীন তাঁরা যদি করেন আমি নীচে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব।” (প্রচলিত দণ্ডনীতি)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার যে প্রতিফলন, তা এই সময়কালেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী সীমাহীন বর্বরতা, হিংস্রতার চিত্র, যে নির্মম গণহত্যা, যেসব যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখছি, তার সাথে সভ্যতার কোন সম্পর্ক নেই। সাম্রাজ্যবাদীদের নগ্ন থাবায় বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ। পুঁজির দুবৃত্তায়নের সাথে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদীদের তল্পিবাহক সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। যেসব দেশ তাদের অনুযায়ী পরিচালিত হবে না, সেখানে দুর্যোগ অবধারিত হবে। এ এক সীমাহীন বিপর্যয়। যার সাথে কোন স্বার্থ শ্রমজীবী তথা সাধারণ মানুষের নেই। যারা বিপদসংকুল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাচ্ছেন, তারাই জনগণের উপর অত্যাচার করছেন।
কবিগুরু তাঁর জীবনকালে এসব উপলব্ধি করেছেন। এই নির্মমতা থেকে বিশ্ববাসীর মুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদ মানব সভ্যতাকে উপহাস করছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাধারণ জনগণও বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের মতো নির্যাতীত হয়ে আছেন। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসীবাদের নিয়ন্ত্রকরা অবাধ পঁজি নিয়ন্ত্রণে, ব্যবহারে যেসব পন্থা ব্যবহার করছেন, তা সামরিক বলপ্রয়োগেও হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার ভয়াবহ প্রতিযোগিতায় ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, বিপণ্ণ জীব বৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি বিশ্বের সাধারণ মানুষ।
এই অবস্থা থেকে মানব সভ্যতার উত্তরণে বিশ্বের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
“জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়’
মন্দ্রি উঠিল আকাশে।”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর




