সুপ্ত বাসনা

আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের প্রধান কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে উডসাইড শহরতলিতে প্রচুর অভিবাসী বাস করে। এর কারণ হলো নিউ ইয়র্ক শহরে চাকরী বাকরীর অভাব নেই কিন্তু বাড়ী ভাড়া এবং দৈনিক জীবন যাত্রার খরচপত্র আকাশচুম্বি হওয়ায় এশিয়ান এবং বাংলাদেশী অভিবাসীরা নিউইয়র্কে চাকুরী করলেও আর বসবাসের জন্য বেছে নেয় শহরের অদূরে আশেপাশের শহরতলি। প্রথম ধাপের অভিবাসীদের মধ্যে শওকত সাহেব তার শিক্ষাগত যোগ্যতানুযায়ী চাকরী পাননি। তাই বলে তিনি বসে থাকার লোক নন। কে কি বলবে সে সমস্ত আলোচনাকে তোয়াক্কা না করে নিউইয়র্ক শহরে একটা পেট্রোলপাম্প (গ্যাসোলিন ) ফোরকোর্টে চাকরী জোগাড় করে নেন। উডসাইডে এক পাতানো বাঙালি বন্ধুর সাথে একটা রুম শেয়ার করে থাকেন। এ ভাবেই তিনি জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন। এতে উনার কোনো হাঁ-হুতাশ নেই। কারণ তিনি মানসিক দিক থেকে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়েই দেশ ছেড়েছিলেন। কয়েক বছর পর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দৃঢ় মনোবলের প্রচেষ্টায় নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে নিউজার্সি শহরে নিজের জমানো মূলধন এবং ব্যাঙ্ক থেকে যৎসামান্য লোন নিয়ে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম’ কোম্পানীর Franchise কিনে পেট্রল পাম্পের ব্যবসা শুরু করে দেন। ব্যবসা রীতিমতো ভালোই চলছে, যার ফলে বাড়ী কেনার জন্য মর্টগেজ পেতে উনার কোনো বেগ পেতে হলোনা। বেশ সুন্দর এবং বড়সড় একটা বাড়ি এই নিউজার্সি শহরে কিনে ফেললেন।
শওকত সাহেবের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। তার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী এক বয়স্ক ভারতীয় গুজরাটি দম্পতি। তাদের এক মাত্র ছেলে হারুন আলী ইনফরমেশন টেকনোলজি ইঞ্জিনিয়ার। ডরোথি নামে এক শেতাঙ্গ মেক্সিকান-মার্কিন মেয়েকে বিয়ে করে হারুন বাবা মার্ সাথেই বসবাস করছে। তাদের দেড় বছেরর একটি ছেলে আছে, নাম তার হায়দার আলী। মিক্সড ম্যারেজ এই দম্পতির পুত্র হায়দার দেখতে বেশ সুদর্শন। শওকত সাহেব নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এই ভেবে যে সুদূর বিদেশে জানাশুনা একজন এশিয়ান আশেপাশে থাকলে একে অপরের বিপদে আপদে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভবনা আশা করা যেতে পারে। তিনি বর্ণবাদী নন, তবুও মনে করেন শেতাঙ্গ এবং আফ্রিকান লোকদের তুলনায় বাংলাদেশী কালচারের সাথে ভারতীয় কালচারে অনেক মিল রয়েছে ।
এদিকে শওকত সাহেবের জীবনে সচ্ছলতা এসেছে। এখন ভাবছেন ,একাকিত্ব জীবনের অবসান হয় দরকার! অবশেষে বন্ধু-বান্ধবদের পরমর্শে দেশে গিয়ে এক নারীকে বিয়ে করে আনলেন এবং সংসার জীবন শুরু করলেন। প্রতিবেশী গুজরাটি ভদ্রলোক নওয়াব আলী সাহেব খুবই মিশুক প্রকৃতির মানুষ। তিনি পথেঘাটে কিংবা বাড়ীর পিছনের বাগানে শওকত সাহেবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা নিয়ে প্রায়শ আলাপ আলোচনায় মেতে উঠেন। বয়সের দিক থেকে নওয়াব সাহেব শওকত সাহেবের পিতার সমান, তবুও তারা একে অন্যের সাথে নিজেদের মনের কথা অকপটে বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। যেদিন নওয়াব সাহেবের সাথে শওকত সাহেবের নুতন বৌকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, সেদিন নওয়াব সাহেব বললেন, ‘আমি মনে প্রাণে দোয়া করছি, তোমরা সংসার জীবনে সুখী হও। শওকত, তুমি একটা ভালো ছেলে, আমার ছেলের বয়সী। আমার ছেলে হারুনের মতো তোমার যেন ভাগ্য না হয়। আমার একটি মাত্র ছেলে কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি তাদের জীবনের চলাফেরার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য দেখতে পাই না। বাচ্চা নাতিটার প্রতি তাদের কোনো খেয়ালই নেই। ছেলেটি সবসময় উদাস মনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। কেন জানি আমার ভয় হয় ওদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে। হয়তো বা আমার এই সমস্ত ধারণা অমূলক। হয়তোবা! সে যাই হউক, আল্লাহ যেন তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখে শান্তিতে রাখেন, আমি এই কামনা করি।’
কয়েক বছর কেটে গেলো, প্রায় বছর ছয়েক তো হবেই। ফুটন্ত ফুলের মতো শওকত সাহেবের পরপর তিনটি মেয়ে সন্তান- আবেদা ,মাজেদা এবং ফরিদা জন্মগ্রহণ করল। প্রত্যেকটি মেয়েই মায়ের মতো সুন্দরী হয়েছে। বিশেষ করে ছোট মেয়ে ফরিদা অতুলনীয় সৌন্দের্যের অধিকারী হয়েছে। দেখলে মনে হয় সে যেন রূপের শ্রেষ্ঠতম জায়গায় নিজেকে আসন করে নিয়েছে। ফরিদা এতো সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও বিধাতা কেন জানি তার প্রতি অবিচার করেছেন। তার হৎপিন্ডে একটা ছিদ্র দেখা দিয়েছে। যার ফলে সে সর্বদা শারীরিক ভাবে দুর্বল এবং ক্লান্তি অনুভব করে। ডাক্তারের নির্দেশ, সে যেন খুব সাবধানে চলাফেরা করে এবং শরীরের প্রতি যত্নবান থাকে। স্বভাবতই এমন একটা বিষন্ন খবর জানার পর থেকে শওকত সাহেব এবং তার স্ত্রীর সুখী জীবন যাত্রা রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো।
এদিকে হায়দারের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা তার বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য এক শেতাঙ্গ ছেলেকে সাথী করে। সে নিজেকে একাকী ভাবে। ওর দাদা- দাদী বুড়ো বয়সে বেশী সময় দিতে পারেনা। আর হারুন ছেলের বাবা হয়েও নিজের কাজকর্মের ব্যস্ততার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলের প্রতি যথাযোগ্য নজর বা সময় দিতে পারছেনা। মানুষের জীবনে বাবা-মা হওয়াটা একটা চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ সঠিকভাবে তাকে দেখা শুনা করা হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে সজাগ থাকা একান্ত দরকার, পরিণামে এর প্রতি মুহূর্ত অকৃত্রিম আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকে। হায়দারের বেলায় তাই হলো। মাকে হারিয়ে সে দিশাহারা। হায়দারের মনমেজাজ সব সময় উরু উরু থাকে। ভাগ্য দোষে সে মার স্নেহ এবং ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। সব সময়ে তার মন চায় মাতৃত্বের স্নেহ- ভালোবাসা, একটু আদর, একটু যত্ন- এর বেশি কিছু নয়!
মাঝে মাঝে হায়দার তাদের পিছনের বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে শওকত সাহেবের বাসায় তার তিন মেয়ের খেলার সাথী হয়ে যায়। শওকত সাহেবের স্ত্রীও মা হারা ছেলেটিকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে এবং স্নেহ করে। হায়দার সারাদিন শওকত সাহেবের বাসায় খেলাধুলা করে সময় কাটিয়ে দেয়। পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অনেকে মনে করে শওকত সাহেবের এক ছেলে তিন মেয়ে, এমনি বন্ধন ওদের মধ্যে।
সময় বয়ে যায়। ছেলে মেয়েগুলা এখন সবাই প্রাপ্ত বয়স্ক। হায়দার ফার্মাসিতে ডিগ্রী করে একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে চাকরী করছে। আবেদা এবং মাজেদা বিয়ে করে নিজেদের ঘর সংসার সামাল দিচ্ছে। আবেদা থাকে মিসৌরিতে আর মাজেদা থাকে টেক্সসাসে। ওরা সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছে। ওর সময় পেলেই নিউজার্সিতে মা বাবার সাথে দেখা করে যায়। তাছাড়া রীতিমতো ফোন আলাপ তো রয়েছেই।
শওকত সাহেবদের সুখী জীবনের বাঁধ সাধলো ফরিদার বেলায়। অতুলনীয় সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং মার্জিত ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও ফরিদার বিয়ে হচ্ছেনা। যখন বর পক্ষের লোকরা জানতে পারে মেয়ের হৎপিন্ডে ছিদ্র আছে এবং সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা কম, তখনই তারা পিছুটান দেয়। যদিও সন্তান হওয়ার সম্ভবনা আছে তবুও গর্ভবতী না হওয়ায় শ্রেয়। সেটা ডাক্তারের উপদেশ। কারণটা হলো প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্ত চাপে রোগী মারা যেতে পারে। জীবন -মৃত্যুর ব্যাপার, তাই রিস্ক নেয়া ঠিক হবেনা। ফরিদা অবসাদ এবং উদ্দামহীনতায় ভুগছে, সময় কাটায় ওর আপন ভুবনে- সাহিত্যচর্চা- লেখালেখি আর সুই-সুতোয় ফুটিয়ে তোলে অপূর্ব কারুকাজ। সূচিশিল্পী হিসেবে অনেক কদর রয়েছে তার। এই কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়েই দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায় ফরিদার।
ক্রমাগতভাবে এরকম ঘটনা চলার ফলে হায়দারের মনে দুঃখ লাগে। এতো ভালো এবং সুন্দরী মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা। সে মনে মনে ফরিদাকে ভালোবাসে। কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছেনা। মনে মনে ভাবে, যদি সে ফরিদাকে বিয়ে করতে চায়, তাহলে শওকত সাহেব কি রাজি হবেন? সে তো খৃস্টান মা আর মুসলমান বাবার সন্তান! যদি তার প্রস্তাব উনি ফিরিয়ে দেন তাহলে বিষয়টি লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়াবে। এ সমস্ত কথা ভাবলে হায়দার মানসিক কষ্ট পায়, মুষড়ে পরে। ও নিজের জীবনটাকে
ধিক্কার দেয় এই বলে যে হাঁয়রে আমার ভাগ্য! আমি এমন একজন হতভাগা যে সুখের মুখ আমার জীবন থেকে সর্বদা পালিয়ে বেড়ায়।
শওকত সাহেবরা ফরিদার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক চিন্তিত এই ভেবে যে তাদের অবর্তমানে ফরিদার সারাটা জীবন কিভাবে কাটবে? এরই মধ্যে শওকত সাহেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়লো। রোগটি একেবারে শেষ পর্যায়ে। ডাক্তার রায় দিয়ে দিলেন যে উনি যে কোন সময়ে মারা যেতে পারেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। যদিও প্রথমে তিনি হাসপাতালে যেতে চাননি কিন্তু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে তিনি রাজি হলেন। শওকত সাহেবের গুরুতর অসুস্থতার সংবাদ শুনে জানাশুনা সকলেই সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করতে আসেন হাসপাতালে। অনুরুপভাবে, একদিন নবাব আলী সাহেব তার পুরো পরিবার নিয়ে শওকত সাহেব কে দেখতে এলেন। হায়দার, শওকত সাহেবের মাথার কাছে বসে উনার শারীরিক খবরাখবর নিচ্ছে। এক পর্যায়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে শওকত সাহেব হায়দারকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা হায়দার তুমি কি ফরিদাকে বিয়ে করবে?
কথাটি শুনে হায়দার নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে এ কি শুনছে! এ যে তার ধ্যান -ধারণা, ফরিদাকে সে আজীবন শয়নে স্বপনে ধরে রেখেছে। একমূহর্ত সময় নষ্ট না করে হায়দার উত্তর দিলো, জ্বী আঙ্কেল, আমি রাজী।
মেয়ে ফরিদা চাচ্ছে তার বিয়ের সময়ে তার বাবা উপস্থিত থাকুক। হায়দার ও একই মত পোষণ করছে। কিন্তু সময় কম ,বেশী দেরি করা যাবেনা। কারণ কনের বাবা মৃত্যু পথযাত্রী। হাসপাতালের বাইরে শওকত সাহেবকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। তাই তাদের বিয়েটা এর ভেতরেই করাতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে বিয়ে হওয়াটা খুব সাধারণ বিষয় নয়। তবুও ফরিদা আশা করছে বাবা, আমার হাত ধরে হায়দারের হাতে আমাকে সমর্পন করবে, সেটাই আমার কাছে বিবেচ্য বিষয়। কোথায়, কোন জায়গায় আমার বিয়ে হচ্ছে ,সেটা মূল কথা নয়। আমার বিয়েতে বাবা আমার পাশে থাকবে এবং সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া হবে।
হাসপাতালের ম্যানেজমেন্টের কাছে তাদের বিয়ের ব্যাপারে আলাপ হলো। ম্যানেজমেন্ট শুধু অনুমতি দিলেন না, সাথে আরো জানালো যে তাদের এই বিয়েতে শরীক হতে পারবে বলে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছেন। শওকত সাহেব নিশ্চিত ছিলেন না তিনি মেয়ের বিয়ে দেখে যেতে পারবেন কিনা। বিয়ের দিন ক্ষণ ধার্য হলো। মৌলভী সাহেব বিয়ে পরালেন। মেয়ের হাতে হাত ধরে হায়দারের কাছে এসে বললেন, তোমার হাতে ফরিদাকে শপে দিলাম, আমার বিশ্বাস তুমি ওকে প্রেম ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে।
বিয়ের বিশেষ মুহূর্তগুলি ক্যামেরায় বন্দী করা হলো। চির কৃতজ্ঞ ফরিদা হাসপাতলের পরিচালক মিস্টার ডেভিড মিলারকে বললো, আমার বাবার জন্য আপনারা যা উৎসাহ এবং সাপোর্ট দিলেন তা ভাষায় বলা কঠিন। সে জন্য আমি এবং আমার স্বামী আমাদের হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রতি উত্তরে মিস্টার মিলার জানালেন, ফরিদা এবং হায়দারের বিয়েতে এমন সুন্দর একটা উৎসবে আমরাও সহযোগিতা করতে পেরেছি বলে নিজেদেরকে সম্মানিত এবং গর্বিত মনে করছি।
বিচিত্র এই পৃথিবী! কন্যা ফরিদার বিয়ের পরদিনই শওকত সাহেব মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!