স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা সমাজকর্মের গুরুত্ব: একটি গবেষণামূলক পর্যালোচনা

Social Work এর একটি অন্যতম শাখা হল ‘চিকিৎসা সমাজকর্ম (Medical Social Work)’- এই শাখাটি আধুনিক সমাজকর্মের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম সংযোজন। স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি,মানুষ কেবল শারীরিকভাবে নয়, সামাজিক ও মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই প্রত্যেক মানুষের শারীরিক এর পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা একান্ত প্রয়োজন। আর এদিক থেকে চিকিৎসা সমাজকর্ম মূলত আমাদের সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর জোর দিয়ে থাকে। Medical Social Work এর মাধ্যমে সমাজকর্মীরা চিকিৎসা গ্রহণকারী সমস্যাগ্রস্ত রোগীদের মনো-সামাজিক সামঞ্জস্যহীনতা, আংশিক অক্ষমতা, আবেগীয় ও মানসিক সামঞ্জস্যহীনতার প্রতিকার ও প্রতিরোধে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ এবং পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে চিকিৎসা সমাজকর্ম (Medical Social Work) বিষয়টি আসলে কী? স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এই শাখার লক্ষ্য- উদ্দেশ্য এবং গুরুত্ব কী রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এই চিকিৎসা সমাজকর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে। ১৮৮৩ সালে ইংল্যান্ডে একটি মানসিক হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা পরবর্তী দেখাশোনা করার মাধ্যমেই এই কাজকর্মের সূত্রপাত ঘটে। ১৯০৫ সালে Dr. Richard Clarke Cabot এর উদ্যোগে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বোষ্টন শহরে চিকিৎসা সমাজকর্মের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১৯১৮ সালে আমেরিকায় ‘চিকিৎসা সমাজকর্মী সমিতি’ (Medical Social Worker Association) গঠনের মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গ পেশাগত রূপ লাভ করে।

যাইহোক, বিভিন্ন তাত্ত্বিকরা এই চিকিৎসা সমাজকর্মের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এগুলি হল-
● R.A.Skidmore and M.G.Thakery তাঁদের “Introduction to Social Work” গ্রন্থে বলেছেন, “স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সমাজকর্মের (Social Work) জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ এবং পদ্ধতি প্রয়োগ করাকেই চিকিৎসা সমাজকর্ম বলা হয়।”

● আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্ম সমিতির মতে, “চিকিৎসা সমাজকর্ম হল সমাজকর্মের তত্ত্ব ও পদ্ধতির পেশাগত অনুশীলন যা মনো-সামাজিক সামঞ্জস্যহীনতা, অসমতা বা আংশিক অক্ষমতা অথবা আবেগীয় ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে প্রয়োগ করা হয়।”

সুতরাং চিকিৎসা সমাজকর্ম Medical Social Work এর এমন একটি বিশেষ শাখা, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান, কৌশল এবং পদ্ধতি প্রয়োগ করে রোগীকে তার আওতাধীন সুযোগ সুবিধার পূর্ণতম ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপনে সহায়তা করা হয়। এই চিকিৎসা সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য হল চিকিৎসাধীন রোগীর সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স সহ সংশ্লিষ্টদের কাজের সমন্বয় সাধন করে দলীয় বা Team Work এর মাধ্যমে চিকিৎসায় সহায়তা করা। চিকিৎসা সমাজকর্ম রোগীর সার্বিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালায় না। এটি শুধু সেই সব সামাজিক উপাদান বিশ্লেষণ করে, যেগুলো প্রত্যক্ষভাবে রোগীর অসুস্থতা এবং চিকিৎসার বাধা হিসেবে দেখা দেয়। এগুলিকে বলা হয় “Social Component of Illness”। যেমন যদি কোনো রুগী HIV নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং চিকিৎসকরা HIV কে নিরাময় করার জন্য বিভিন্ন ঔষধ এবং Antiretroviral therapy (ART) দিচ্ছেন, তবুও রোগীর সুস্থ হতে বিলম্বিত হচ্ছে। তারপর রোগীর HIV চিকিৎসার অনুসন্ধান করে জানা গেল যে, তিনি হাসপাতালের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তিনি তার মনের মধ্যে একটি ভাবনাকে স্থান দিয়েছেন যে, তিনি খুব শীঘ্রই মারা যাবেন আর এই রোগ হলে কেউ বেশিদিন বেঁচে থাকে না। অর্থাৎ তিনি সামাজিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তখন উনার মধ্যে একটা সেল্ফ কনফ্লিক্ট কাজ করছে। এর ফলে রুগীর মধ্যে একটি ব্রেকডাউন এর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসা সমাজকর্মীরা তার সমস্যা সমাধানে সমর্থনমূলক চিকিৎসা বা কাউন্সেলিং করে রোগীর রোগ নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা সমাজকর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সমাজকর্মী রোগীর পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যবিধানে মূলত মানসিক ও সামাজিক সমর্থন প্রদান এবং প্রয়োজনীয় বস্তুগত-অবস্তুগত সেবার মাধ্যমে রোগীকে সক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করে থাকে। চিকিৎসা সমাজকর্মের অনুশীলনে চিকিৎসকের চিকিৎসা প্রদান প্রক্রিয়া গতিশীল হয়ে থাকে। যার ফলে রোগী দ্রুত রোগ নিরাময় লাভ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।এই প্রসঙ্গে S.S.Dhooper (1998) তাঁর “Social Work in Health Care in the 21st. Century” – গ্রন্থে হাসপাতাল সমাজকর্মীর কার্যাবলী সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন।এই গুলি হল- (1)উচ্চ ঝুঁকি প্রশমন (High risk screening), (2)মনো-সামাজিক মূল্যায়ন এবং হস্তক্ষেপ (Psycho-social assessment and intervention), (3)রোগীর সমন্বিত যত্নে আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতা (Inter disciplinary collaboration for coordinated patient care), (4)ডিসচার্জ পরিকল্পনা (Discharge planning) এবং (5)ডিসচার্জ পরবর্তী অনুসরণ করা (Discharge follow up)

চিকিৎসা সমাজকর্মীরা মূলত রোগীর অসুস্থতা, শারীরিক অসুবিধা এবং চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত সামাজিক প্রয়োজন ও সমস্যা নিয়ে কাজ করে থাকেন। চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য পেশাদারদের সাথে বহুমুখী সেবার অপরিহার্য অংশ হিসেবেও তারা কাজ করেন। সমাজে বিদ্যমান চিকিৎসা ও সামজসেবার মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে তারা সংযোগকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। এই প্রসঙ্গে Dr. D.Paul Chowdhry তাঁর “A Handbook of Social Welfare” গ্রন্থে চিকিৎসা সমাজকর্মীর ১৬টি ভূমিকা উল্লেখ করেছেন তা হলো:

1. রোগীকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেবা দান।
2. স্বাস্থ্যসেবার যৌথ পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সামাজিক ও আবেগীয় বিষয়াবলী ডাক্তারের নিকট ব্যাখ্যা করা।
3. রোগের ইতিহাস বা কেস স্টাডি সহ রোগীর ব্যক্তিগত তথ্যাবলী রক্ষণাবেক্ষণ করা।
4. মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড, লাইব্রেরির সুযোগ, সখ এবং কিছু কিছু হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি প্রদান করা।
5. হাসপাতালের নিয়মকানুন এবং বিভিন্ন বিভাগের সাথে যোগাযোগ ও আবেদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে রোগীকে অবগত করতে সহায়তা করা যাতে সেবা লাভে কোনো অসুবিধা না হয়।
6. যেসব রোগী ছাড়পত্র পাচ্ছে তাদের জন্য আফটার কেয়ার সার্ভিস ও পুনর্বাসনের(Rehabilitation)ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন বিষয়ে রোগীকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সমাজে বিদ্যমান সেবার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
7. সমাজকর্মী কর্তৃক গৃহ পরিদর্শনের মাধ্যমে রোগীর সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে ডাক্তারের কাছে ব্যাখ্যা করা এবং রোগের কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পরিবারকে সহায়তা করা।
8. রোগী ও তার পরিবারের চাহিদামত আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য যেমন- যন্ত্রপাতি ও পোশাক প্রদান করা এবং সমাজস্থ কল্যাণমূলক এজেন্সীর মাধ্যমে রোগীর পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করা।
9. হাসপাতালের স্টাফ, নার্স, ডাক্তার, থেরাপিস্টসহ অন্যান্যদের ওরিয়েন্টশন, চাকুরীকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং চিকিৎসা সেবায় প্রভাব বিস্তারকারী সামাজিক এবং আবেগীয় উপাদান সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা।
10. স্বেচ্ছাসেবকদের সেবার মান সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
11. বহিঃবিভাগ ও রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে ডাক্তারকে সহায়তা করা।
12. ডাক্তারদের সাথে আলোচনা ও যৌথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং হাসপাতালের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ করা।
13. চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য কেন্দ্রসমূহের পরিচালনা ও সদ্ব্যবহার করা।
14. যথাযথভাবে সামঞ্জস্য ও পুনঃসামঞ্জস্যবিধানে রোগীর পরিবারের সাথে কাজ করা।
15. স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মসূচিতে ভূমিকা পালন করা।
16. চিকিৎসা ক্ষেত্রে সামাজিক গবেষণা পরিচালনা করা।

যাইহোক, সর্বোপরি আমরা উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে বলতে পারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা সমাজকর্মের জ্ঞান ও পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তাই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ডাক্তার,নার্স এর পাশাপাশি চিকিৎসা সমাজকর্মীরও ভূমিকা অনস্বীকার্য রয়েছে।

●সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
1) হোসেন, ড.মোঃ আনোয়ার সম্পাদিত (জানুয়ারি,2022); “সমাজকর্ম দ্বিতীয় পত্র(এইচএসসি প্রোগ্রাম)”, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা।
2)পতি, অজিত কুমার সম্পাদিত (2015,অক্টোবর); “মানুষের বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি”, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়,কলকাতা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!