স্বীকারোক্তি

সদ্য তখন ব্রিটিশ মুক্ত ভারত হয়েছে। স্বামীহারা রমলাদেবী দুই পুত্র সন্তান এবং তিন কন্যা সন্তানকে নিয়ে বরিশালের ছোট্ট সরই গ্রামের ভিটেমাটি আঁকড়ে পরে আছেন। গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবার তখন তারা। একান্নবর্তী সংসার। দেওর, জা, বিধবা ননদ, তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তখন হৈ হৈ ব্যাপার। নিজেদের জমিতে মুসলমান প্রজারা চাষ করে, পুকুরের মাছ ধরে, আম, জাম, সুপুরি, নারকেলের সমাহারে বারো মাসে তেরো পার্বন লেগেই থাকে।
রমলা সারাদিন পুজো পাঠ নিয়েই থাকে। বাড়িতে তিনখানা মন্দির। শীতলা, কালি আর মনসা। সংসার সামলায় দুই জা শোভা আর বুলবুল। সারাবছর বাড়িতে আইসোজন, বইসোজন লেগেই থাকে। রেডিওতে খবর আসে। দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছে। বাতাসে গুঞ্জন ভাসে দেশ নাকি ভাগ হয়েছে। এই ঘর বাড়ি এখন আর তাঁদের থাকবে না। এটা নাকি এখন পূর্ব পাকিস্তান। এটা এখন মুসলমানদের দেশ। হিন্দুদের ভারতে যেতে হবে। রমলার কানে সব খবরই আসে। রমলার বড় ছেলে সতীশ তখন বি এ পাস করে একটা স্কুলে শিক্ষক হয়েছে। ছোট ছেলে মনীশ আই এ পড়ে। মেয়েরা সবাই বাড়িতে বরদার কাছে পড়াশুনো করে। ছোট দুই দেওর এসে জানায় তারা সপরিবারে ভারত চলে যাবে। সতীশকে বলে, তুইও বৌঠানকে নিয়ে চল।
সতীশ জোর গলায় বলে, তোমরা যাচ্ছ যাও। আমরা কোত্থাও যাব না। এই দেশ আমারও। আমরা এখানেই থাকবো।
বাক্স পেটরা গুছিয়ে চোখের জলে বিদায় নিল।
সতীশের দুই কাকা। দাওয়ায় বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইল রমলা আর তার বিধবা ননদ খুকুমণি। এত বছর সংসারে সব দায়িত্ব সামলিয়েছে তার দুই জা। এবার তাকে সংসারের হাল ধরতে হবে। সবার ছোট মেয়ে পূর্ণিমা এসে রমলাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগলো, মা বেলু, খুকু, মনু, তপন সবাই চলে গেল। আমি কাদের সঙ্গে খেলবো। রমলা বললেন, কদিন বাদেই ওরা সবাই চলে আসবে।
— সত্যি তো মা।
রমলা মেয়ের মাথায় হাত দিলেন। মাসখানেক যেতেই খবর এল হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা বেধেছে। গ্রামের যে মুসলমান প্রজারা চোখে চোখ রেখে কথা বলতো না। তাদের কথাবার্তার মধ্যেও এখন ঔদ্ধত্যের সুর। রমলা বেশ বুঝতে পারলেন চারিদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো নয়।। সতীশ আর মনীশকে ডেকে বললেন, বাবারা এবার আস্তে আস্তে তৈরি হও ভারতে যাবার জন্য।
দুই ভাই চুপ করে রইল। সেদিন বরিশাল টাউন থেকে স্টিমারে করে যখন গ্রামে ফিরছিল তখন রাস্তায় লাঠি সোটা হাতে মাথায় টুপি পরা এক সময় তাদের বাল্য বন্ধুরা বিশ্রী ভাষায় বলে উঠেছিল, মালাউনের বাচ্চারা দেশ ছাড়বি কবে?
বড় অপরিচিত লাগছিল সেদিন ওদের। ওদের সঙ্গেই পুকুর পাড়ে আম, জাম পেড়েছে। ঈদে,পুজোয় পাত পেড়ে খেয়েছে। পৌষ পার্বণে নতুন চালে পিঠেপুলি পায়েসের উৎসবে মেতেছে।তাদের সহজ সরল মুখখানা এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তোফায়েল সেই সময় ওখান থেকে আসছিল। সে সতীশের সঙ্গে স্কুল থেকে বিএ পর্যন্ত পড়েছে। তোফায়েল পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল, ওদের যেতে দে। তোফায়েলের আব্বা ছিলেন মসজিদের ইমাম। তাই আর কেউ কিছু বলার সাহস পেল না। দুই ভাই সেদিন শক্ত করে নিজেদের হাত ধরে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকেছিল। বাড়িতে কিছুই জানায়নি। পাছে মা আর পিসিমা ভয় পান।
কিন্তু চুপ করে থেকেও কোন সুরাহা হলো না। যে মুসলমান প্রজা রমলা দেবীর বাড়িতে চাষের কাজ করে তাকে দুপুরবেলা ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল বাড়ির মেয়েদের স্নান করার পুকুরের পাশে। বড় মেয়ে সুশীলা ভিজে কাপড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে মাকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। রমলা সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করলেন না। দুই ছেলেকে ডেকে সব বললেন। সতীশ বলল মা তুমি সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাও। আমি ক’দিন বাদে যাব। কারণ জানতে চাইলে সতীশ বলল, অফিসিয়াল কিছু কাগজ স্কুল থেকে নিতে হবে। যাতে ও দেশে গিয়ে না খেতে পেয়ে মরতে না হয়।
সতীশ তোফায়েলকে গিয়ে সব জানালো। তোফায়েল বলল, চিন্তা করিস না; আমি তোদের বাড়ির সবাইকে বর্ডার পর্যন্ত নিয়ে যাব। যাতে কেউ কিছু করতে না পারে।
জিনিসপত্র সব অল্পবিস্তর বাধাছ্যাদা করে সন্ধ্যের মুখে তোফায়েল সতীশ ছাড়া অন্য সবাইকে নিয়ে বর্ডারের দিকে রওনা দিল।
চারিদিক থেকে খবর আসতে লাগলো হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা বেধেছে, ছেড়ে যাওয়া হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ হচ্ছে, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। বাকরুদ্ধ সতীশ। হায়রে স্বাধীনতা। বাবা মারা গিয়েছেন। এখন সংসারের সব দায়িত্ব তার। আগে ভারতে গিয়ে পেটের অন্ন জোগাড় করতে হবে। তারপর স্বাধীনতার কথা ভাববে। সকাল হতেই তোফায়েল এসে খবর দিল ওরা বর্ডার পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে গেছে। সতীশ তড়িঘড়ি স্কুলে রওনা দিল।
অফিসের হেড ক্লার্কের ঘর থেকে ওর সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিল। তারপর কোনরকমে একটা কাপড়ের ব্যাগে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে দর্শনা স্টেশনের দিকে রওনা দিল। প্রতিদিন কাতারে কাতারে মানুষ ওপার থেকে এপারে আসছে আর এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। প্রত্যেকের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
৪৭ এর ভয়াবহতা কেটে গিয়েছে আজ অনেক কাল হলো। গড়িয়ার বাড়িতে দোতলার বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভারতের বহুল প্রচারিত দৈনিকের পাতার এক কোণে একটি লেখা তার নজরে এলো। শীর্ষক স্বীকারোক্তি। যদি কারুর মনে কোন রকম বিবেক দংশন হয় বা আত্মগ্লানি কাজ করে তাহলে সে ঘটনাটি পত্রিকার অফিসে পাঠাতে পারেন। রবিবার করে সেই ঘটনাটি পত্রিকার পাতায় ছাপা হবে।
মনের কোণে তখন তার দর্শনা স্টেশনের ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। যা তিনি আজও ভুলতে পারেননি। এখনও মাঝ রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলে ভেসে ওঠে সেই রক্তাক্ত হিন্দু কিশোরীর মুখ। এই ঘটনার কথা তিনি কাউকে বলতে পারেননি।
অপরাধের গ্লানি আজও তাকে কুরে কুরে খায়।
সেদিন দর্শনা স্টেশনে ষোল বছরের একটি মেয়ে, যার নাম মিতা তার কাছে এসে বলেছিল, “আমারে একটু ভারতে নিয়া যাইবা। আমারে দুইডা খাইতে দিও তাহলেই হইবে।”
কিন্তু হঠাৎ করেই লুঠেরা বাহিনী এসে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ বাদে যখন ট্রেন আসে সতীশ ট্রেনে উঠে পরে । ট্রেনে উঠেই উনি জানলা দিয়ে দেখতে পান। মেয়েটিকে নগ্ন করে রক্তাক্ত অবস্থায় প্লাটফর্মে ওরা ফেলে দিয়ে গিয়েছে।
তারপর উনি শিয়ালদা এসে রিফিউজি ক্যাম্প থেকে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং পরে প্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু আজ জীবন সায়াহ্ণে এসে তার একটাই গ্লানি এখনও কুরে কুরে খায়, সেদিনের সেই মেয়েটিকে তিনি বাঁচাতে পারেননি।
তিনি ‘আমাকে ক্ষমা করো মিতা’ শীর্ষক নাম দিয়ে বিশদে ঘটনাটি দৈনিকের দপ্তরে পাঠিয়ে দেন।
কদিন বাদেই দৈনিকের অফিসে একটি খামে করে চিঠি আসে। সেই চিঠির লেখাটি কদিন পরে দৈনিকের পাতায় স্থান পায়। তাতে লেখা আছে
সতীশদা আমি মরি নাই। আমাকে মৃত ভেবে একটা লাশবাহী মালগাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। যেখান থেকে আমি পৌঁছাই রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে। ওখানে থেকে আমি সুস্থ হই। পরে আমার বিয়েও হয়। কিন্তু সেদিনের সেই অত্যাচারের জন্য আমার শরীরের গর্ভধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়ার জন্য আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করে আবার বিবাহ করে। আমি এখন প্রৌঢ়া, থাকি এক বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা তোমাকে দেব না। তোমাকে গ্লানি থেকে মুক্তি দিলাম। জানিয়ে দিলাম আমি এখনও বেঁচে আছি।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!