প্রান্তিক মানুষের জীবন সংগ্রাম: প্রসঙ্গ স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ছোটগল্প

এই সময়ের একজন সার্থক ছোটগল্পকার স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তিনি সমাজের প্রান্তিক, উপেক্ষিত, অবহেলিত, অন্ত্যজ এবং অন্তেবাসী মানুষদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে অপূর্ব দক্ষতায় ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ছোটগল্পে স্থান পেয়েছে অত্যন্ত সাধারণ, তুচ্ছ মানুষের নিত্যদিনের সুখ, দুঃখ, হাসিকান্না, ব্যথা বেদনা। এবং সেইসব অপাংক্তেয় মানুষের কথাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে সর্বসাধারণ মানুষের কথা। তাঁর দেখা অতি রূঢ় কঠিন কঠোর বাস্তবতা ধরা পড়েছে সৃষ্টিকর্মতে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে ওঠে। সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এছাড়া প্রাচীনকালে বিভিন্ন নদী, হ্রদ, জলাশয়ের তীরে মানুষ সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। প্রযুক্তিবিদ্যার কলাকৌশলে এইসব মানুষ ছিল উন্নত এবং প্রগতিশীল। স্বপ্নময় চক্রবর্তী সমাজ সচেতন লেখক। তাই তাঁর রচনায় বিশেষত ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’ গল্পে সেইজন্য প্রকৃতির কথা, নদীর কথা এবং দ্বীপে বসবাসকারী মানুষের কথা উঠে এসেছে। গর্ডন চাইলড খাদ্য সংগ্রাহকের অবস্থা থেকে খাদ্য উৎপাদকের অবস্থায় মানুষের উন্নীত হবার ঘটনাকে বৈপ্লবাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন। পশু ও মৎস্য শিকারের দ্বারা ও তার ফাঁকে ফাঁকে বনের ফলমূল কুড়িয়ে যখন মানুষের দিন কাটছিল, তখন একমাত্র খাদ্য সংগ্রহ করা ছাড়া তার আর কিছু করার ফুরসৎ ছিলই না। শিকারের পিছনে ছুটে বেড়ানোর জন্য স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন হয়নি। দলবদ্ধভাবে বিচরণ করলেও এই অবস্থায় গ্রাম ও সমাজজীবন গঠন করা সম্ভব ছিল না। শিকার পর্যায় অতিক্রম করে কৃষি আবিষ্কারের ফলে মানুষ নিজেই খাদ্য উৎপাদন করতে শিখেছে কালের নিয়মে। মধ্যপ্রাচ্যের নিওলিথিক কৃষিজীবীরা সাধারণত, মাটির ঘরে বাস করত। আর মৎস্য শিকার করত যারা তারা হ্রদের উপর বা জলাশয়ের উপরে ঘর তৈরি করে বসবাস করত। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তারা জলাশয়ের তীরবর্তী অঞ্চলে ঘর বানায় এবং তখন তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’ গল্পটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাদাবন ও বাদাবনের ভূমিপুত্র এবং জম্বুদ্বীপের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত হয়েছে। এবং এই গল্পটি একটি অসামান্য সুন্দর নিটোল গল্প হিসাবে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। বিবৃত গল্পটিতে বনবিবির ভরসায় দুই বাংলার কিছু মৎস্যজীবী মাছ ধরে, মধু সংগ্রহ করে, মাছ শুকিয়ে শুঁটকী মাছ তৈরি করে বাজারে চালান দেয়। আবার কেউ কেউ সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কলকাতায়ও চালান দেয়। এইভাবে তারা প্রচুর টাকা উপার্জন করে। গল্পটিতে কয়েকটি চরিত্রের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে ঘটনার পরম্পরায় কাহিনী আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়েছে। গোবিন্দ ও পরানের বাক্যালাপে কাহিনীর শুরু। পরানের বাবা সুন্দর বনে মাছ ধরতে যেত। পরানের বাবাকে বাঘে খেয়েছে। বিমর্ষ জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এইসব মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়। পরান আর তাই সুন্দরবনে যেতে চায় না। এরা সমাজে কুলগোত্রহীন অপাংক্তেয়, অন্তেবাসী, উপেক্ষিত, অবহেলিত—তাই তাদের জীবন সংগ্রামের সৌন্দর্য অপার রহস্যময়। তাদের জীবন সংগ্রামে যে সৌন্দর্যচেতনা ধরা দেয় তাকে ugly beauty বলে। যার প্রবক্তা হলেন ইতালির Vico। পরান জানায় যে বাঘের পেটে সে আর যেতে রাজি নয়। তার বাবা গেছে। তাই সে বাদাবন ছেড়েছে। এই অন্তেবাসী মানুষের মুখের ভাষা আলাদা, বুলিও ভিন্ন; আঞ্চলিক ভাষায় তারা কথা বলে এবং হুবহু সেই ভাষাকেই লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ব্যবহার করেছেন। পরানের বাবাকে বাঘে খেয়েছে। তাই পরান বাদাবন ছেড়েছে। গোবিন্দ কিন্তু মাছের কারবার ছাড়তে নারাজ। তাই সে বলে, ‘আমি চাইস মাছ ছাড়ুম না।‘ পরান উত্তরে জানায়। ‘কিন্তু মাছ একদিন তুকে ছাড়বে। বলতিছি ক্যানো। মোদের ইচ্ছায় কি মোদের জীবন চলে?’

আঞ্চলিক ভাষায় চরিত্রের জীবন সংগ্রামের গাঁথাকে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন লেখক। তাঁর বর্ণনায়, ‘চাঁদের আলো মাছধরার জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে আছে। পিছনের হাওয়ায় শুকোচ্ছে লটে, শংকর, ফ্যাঁসা, চিংড়ি, চাঁ আরও কত মাছ। ঐ মাছের গন্ধকে চাপা দিয়েছে একটু দূরে পচতে থাকা একটা বিরাট সামুদ্রিক কচ্ছপের পচা গন্ধ।’

লেখক আরও জানিয়েছেন ‘কয়েক বছর আগেও ঐ দ্বীপ নিঃসঙ্গ ছিল। পয়সার ধান্ধায় যারা এপারে চলে আসা নোয়াখালি আর চট্টগ্রাম জেলার কিছু লোকের নজরে পড়ল এই দ্বীপ। তারপরই শুরু হয় মাছের ব্যবসা। আসে মহাজন, দাদনদার, পাইকার, ফড়ে কারবার চলে।’

বাদাবন অঞ্চল বিপদ সংকুল। ভয়ঙ্কর অরণ্য, শ্বাপদ-সংকুল, বাঘ, কুমির,বিষাক্ত সাপের উৎপাত তা সত্ত্বেও মানুষজন জীবন-জীবিকার তাগিদে এই ঘোর বাদাবনে পড়ে থাকে। বছরের পর বছর তারা এইভাবে কাটিয়ে দেয়। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, জীবনে কঠোর কঠিন সংগ্রাম করে চলেছে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে।

এখানে লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী মাছ রপ্তানির একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে জীবন যে ক্রমশ নগর-কেন্দ্রিক হতে চলেছে, এই বাদাবনে বসবাসকারী মানুষ এবং ব্যবসা বাণিজ্য করা মানুষদের জীবনের চালচিত্র বদলের আভাস তিনি সুন্দরভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
‘মাছ শুকোবার কারবারিরা দ্বীপের মধ্যে কিছুটা এলাকা বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়ে মাছ শুকোয়, ঝুপড়ি বেঁধে থাকে। একেই বলে ‘খুঁটি’। জম্বুদ্বীপের খুঁটিগুলো থেকে নামখানা বা কাকদ্বীপ হয়ে কলকাতা চলে যায় মাছ।’
মহাদেব দাসের খুঁটি আছে। আর সেই খুঁটিতে কাজ করে পরান আর গোবিন্দ।

সুন্দরবন বা বাদাবনে অধিকাংশ অঞ্চল বর্তমানে বাংলাদেশে। এখানে লেখক পশ্চিমবাংলার বাদাবনের প্রেক্ষাপটে জনজীবনের ঘোরতর সংকটের এক জীবন্ত গীতিআলেখ্য রচনা করেছেন। তিনি পর্যবেক্ষক। তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তিতে ধরা পড়েছে বাদাবনের অসহায় মানুষদের জীবনযন্ত্রণার কথা। ছোটো ছোটো সংলাপ ও প্রকৃষ্ট প্রজ্ঞাত বিবৃতিতে লেখক ভাসিত করেন অসহায় মানুষদের করুণ কাহিনী; যা পাঠক হৃদয়ে ঝড় তোলে। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের উত্তুঙ্গ মনের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য মানুষ যে মানুষের দ্বারা দলিত পীড়িত হয়, তাও লেখক তাঁর গল্পে দেখিয়েছেন। আর এক শ্রেণির কথা না বললেই নয়। এরা হল ‘বাওলে’। বাওলে দু’রকম। ‘বাওলে’ মানে গুণিন যারা বাঘের মুখ বেঁধে রাখে, খিলেন করে এবং জ্বালান করে।

কয়েদখালনরি বর্ণনা লেখক দিয়েছেন। এখানে বেশি বিধবা। অধিকাংশ বিধবাদের স্বামী বাঘের পেটে গেছে। লোকায়ত জীবনে লৌকিক দেবী বনবিবি বাঘের এবং সুন্দরবনের দেবী। তাঁর আরাধনা করে সমগ্র বাদাবন অঞ্চলের মানুষ। দক্ষিণ রায় দক্ষিণবঙ্গের ব্যাঘ্রদেবতা, বাঁকুড়া রায় বাঁকুড়ার ব্যাঘ্রদেবতা। উত্তর রায়, রূপা রায় উত্তরবঙ্গের ব্যাঘ্রদেবতা। এদের নিয়ে রয়েছে অসংখ্য লোককথা এবং মিথ। বর্তমান গল্পের আলোচনার প্রেক্ষাপটের কেন্দ্রে রয়েছে দক্ষিম চব্বিশ পরগণার বাদাবন অঞ্চলের ব্যাঘ্রদেবতা এবং জনজীবনের দৈনন্দিন যাপনের ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাতময় লড়াইয়ের কথা লেখক সুনিপুণ দক্ষ শিল্পীর মতো পুঙ্কানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’ গল্পে প্রান্তিক মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা এবং গ্রামীণ জনজীবন কীভাবে শহুরে বা নাগরিক জীবনে রূপান্তরিত হতে চলেছে অর্থাৎ বিশ্বায়নে মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে যন্ত্রনির্ভর সে কথা লেখক অতি নিপুণতার সঙ্গে দেখিয়েছেন। পাঠককে গল্পের মধ্য দিয়ে বর্তমান সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটকে উন্মোচিত করে পরিচিত করিয়েছেন। এ যুগে নারীরা অসহায়; শুধু অবস্থা, পরিবেশ ভিন্ন। এ কথা লেখক বিবৃত করেছেন এভাবে ‘কয়েদখালির মেয়েমানুষদের মধ্যে বেধবাদের সংখ্যা অনেক।
‘‘‘চল্লামারে ঝ্যানো ফিরে আসি, বনবিবির দহায়’’ বলে যারা জঙ্গলে যায়, তাদের অনেকেই ফেরে না।’

পরানের মা ‘হোটেল বালুকাবেলা’-তে কাজ করে। এই হোটেলই একদিন খুঁটির মালিক মহাদেব দাস ভাত খেতে এসে বলে ‘‘মাছ-বাত-জল্‌দি’’ তারপর বেঞ্চিতে বসেই চেঁচায় ‘‘টেবিলে হাইগ্যা থুইছে, উচ্ছিষ্ট নিব কেডা?’’ রান্নাঘর থেকে পরানের মা বেড়িয়ে এসে সাফাই করে। কম বয়সি বলিষ্ঠ দোহারা চেহারা দেখে মহাদেব দাসের মনে বক্রগতিতে আদিমরক্ত খেলা করে; সে পরানের মায়ের উন্মুক্ত হাত দেখে লোলুপ দৃষ্টিতে যেন দেখতে পেল টেবিলের উপরে একটা আড় মাছ লুটোপুটি খাচ্ছে। এখানে ফ্রয়েডিয় যৌনচেতনা মহাদেব দাসের মনে অবচেতনে কাজ করে। সে পয়সার লোভ দেখিয়ে পরানকে নিজের খুঁজিতে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায়। মহাদেব দাসের অনেক টাকা। সে টাকার জোরে, লোভের বশে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে পরান ও পরানের মা-কে খুঁটিতে নিয়ে যেতে চায়। পরানকে মাসিক কুড়ি টাকা মাইনেতে কাজ করতে বলে আর বলে,
‘হ-হ বিশ ক্যান, ভাল কইর্যা কাম কইরলে আর দুই টাকা বেশি দিমুনে। তর মারে চল্লিশ দিমু, আহা রে হুটেলে কী রকম খাইট্যা খাইট্যা সোনার অঙ্গ কালি করে আইচ্ছা পাচ্চল্লিশ্ দিমু রাজি করা।’

লেখক এখানে পটভূমি হিসাবে যেহেতু বাদাবনকে কেন্দ্র করেছেন। তাই কাহিনীর স্বাভাবিকতা বজায় রাখার তাগিদ ও সাযুজ্য রক্ষার প্রয়োজনে বনবিবির উপাখ্যানও বিবৃত হয়েছে। রাধারমম কয়াল বনবিবির গান গাইছে।
‘ধনা মৌলে মনা মৌলে দুই ভাই। উরা বেরোলেক। ধনা মৌলে মন করল জঙ্গলে যাবে মধু আনতে। উর লৌকা আছে। মনা বলে দাদা, ট্যাকাতো অনেক আছে, আর জঙ্গল করার দরকার কী? ধনা মৌলে উকথায় কান দেয় না।
মধু আনিবারে যাবে লৌকা সাজায়।
একজন লোক তার কম পড়ে যায়
ধনা মৌলে তারপর লোক খোঁজে যায়।
ধনা দেখে দুখে মাঠে ছাগল চরায়
কী রে দুখে ভাল আছিস? কী করিস তুই? ধনা মৌলে শুধাল। দুখে ভাবল, কত বোরোলোকে তার খপর নিতেছে, দুখে আনন্দে গলে যায়।
কী আর করব, লোকের গরু-ছাগল চরাই।
আহারে, তুই ছাগল চরাস, চ’ মোর সাথে, তোর বাপ মরার সময় কোয়ে গেছিল তুদের খোঁজ খপর করতে। একটা ভাল কথা বলি, মোর সাথে জঙ্গলে চ। তুই শুধু বইসে থাক্‌বি। ফিরে আসেই তোর বিয়া দুব।
… ধনা মৌলে দুখের মাকে বলল
কোনো চিন্তা নাই তব, থাকিবে সে সুখে।
ঝ্যাতক্ষণ আমি আছি ত্যাতক্ষণ দুখে
… অনেক মধু পেল, আট কুড়ি আর পাঁচ ঘড়া মধু হল। কিন্তু ফেরার সোময় দখিন রায় স্বপন দিল মধু লিয়ে যাচ্ছ ভাল কথা, মোকে কী দিলি?
ধনা মৌলে বলল তবে তুমি দুখেকেই লিয়ে যাও
… দুখে কুড়ুল হাতে ঝ্যাকনি নামল, ধনা মৌলে, ‘‘বাবা দখিন রায় তোমার সেবার লাগে হে’’ বলেই লৌকো দিল ছেড়ে আর দখিন রায় বাঘের রূপ ধরে হাজির হলেন দুখেকে খাবার জন্য, ত্যাখন দুখে দুহাত জোড় করে ডাকল ও গো মা বনবিবি, রক্ষা কর রক্ষা কর… রক্ষা কর…।’

বাদাবন থেকে নাগরিক জীবনে পা দেয় পরান। তার জীবনচক্র আবর্তিত বিবর্তিত হয় সমাজতন্ত্রের বিবর্তনের রীতি মেনে। সে বাদাবন থেকে বেড়িয়ে আসে কালের ও সময়ের নিয়মে। নিয়মের নিগড়ে বাঁধা এ জগৎ, এ জীবন। পরানও তার ব্যতিক্রম নয়। সে বাদাড় জীবন অতিক্রম করে পাড়ি দেয় নাগরিক, বিত্তশালী, কৃত্রিম, যান্ত্রিক জীবনে। এই গল্পে স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডাক্তার দিদিমণির চরিত্র চিত্রায়ণ করেছেন। তার ভাষ্যে দিদিমণি বলেন,
‘তোর দুঃখ বুঝি রে পরান, তাইতো বলছি মাছের ঐ পচা কাজ ছেড়ে কলকাতা চল আমার সাথে। আমার বাড়িতেই থাকবি, আমার গাড়িটা পরিষ্কার রাখবি, ঘরদোর পরিষ্কার রাখবি, বাজারটা করবি, কাজ কিছু না। সন্ধ্যের পর টি-ভি, মানে একটা বাক্সের মধ্যে তাকিয়ে নাচ গান দেখবি। খুব আরামে থাকবি। তোর মাকে ডাক, তোর মার সাথে কথা বলছি।’

কী অদ্ভুত আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা। কারবারির দল সর্বত্র। বনবাদাড় গ্রামগঞ্জ, শহর, নগর সর্বত্র সর্পিল মানুষের চেহারা এক। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। আর এই শিক্ষার, চেতনার, বিপ্লবের পরিপন্থী সকলে। কেউই ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়ে মানুষকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা দিতে চায় না। চায় না শিক্ষার প্রসার ও প্রচার ঘটাতে। পরানকে তাই শিক্ষা জগতে নয়; দাসত্বের জীবনেই প্রবেশ করাতে চায় শহুরে ডাক্তার দিদিমণি। বেশিরভাগ মানুষ এ যুগে চায় মানুষকে দাস, শূদ্র, শৃঙ্খলিত, পদদলিত করে রাখতে।

শেষপর্যন্ত গল্পের যবনিকা পতনের পর্বেও বাদানের সরীসৃপ, নাগরিক নয়নলোভা নারী চরিত্রের প্রভু মালকিনের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নবিত্ত মানুষদের দমিয়ে রাখা যে একটা সামাজিক ব্যাধি তা এই ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’ গল্পে পরিস্ফুট হয়েছে। এ-যুগেও সামাজিক প্রগতির পথে খুঁটির মালিক, মৌলে, ডাক্তার দিদিমণি যেন এক পঙ্‌ক্তিতে বসে যায়।

‘ভাল করে পড়গা ইশকুলে’ গল্পে প্রান্তিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা ব্যক্ত হয়েছে। এখানে রাঢ়বঙ্গের উপেক্ষিত, অবহেলিত দলিত, প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘মাথায় বোঝা চাপিয়ে যে ছেলে দুটি অজয়ের বালি ভেঙে আসছিল, তারা নিকটতর হল। আমি ওদের চিনতে পারলাম। হারান কার্তিক। আমার স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র। ওরাও আমাকে দেখতে পেয়েছিল, ওরা বেঁকে দূরে সরে যাচ্ছিল, আমি ওদের ডাকলাম।
‘এসব কী তোদের বস্তায়?
গাট্টি কচু বটে। 
কোত্থেকে আনলি?
ওপারে পেলাম স্যার, পঞ্চাশ পয়সা কিলো, আসানসুলে নে যাব, সেথা আশি পয়সা কিলো।
ইস্কুলে যাসনা কেন?
এখুন যে গাট্টি কচুর জো সার, এখুন ইস্কুলে গিলে বাবা ঠেঙান দিবে সার।
তা আসানসোল যাবি কী করে?
কেনে, পীচ রাস্তা ঠেঙে বাসে ওঠা করব। আমি আমার বন্ধুকে বললাম পীচ রাস্তা মানে জি টি রোড, এখান থেকে ছ-মাইল দূর।’

দারিদ্র্য মানুষের সবকিছু কেড়ে নেয়। মানুষ নীচে নেমে যায়। চরিত্রের স্খলন ঘটে। গরিব মানুষ বড়ো অসহায়। কথক তার মেয়েকে বলে,
‘আমাদের দেশের মানুষেরা কত গরিব, ছেলে দুটো তোমারই বয়সী, অথচ দ্যাখো, তুমি ছবি আঁকছ আর ওরা পয়সা রোজগারের জন্য এখনই কীরকম ইয়ে করছে।’

আরেকটি এই ছোটোগল্পের চরিত্র হাবু। সে বাগালি করে। অর্থাৎ গরিব হওয়ার কারণে মাঠে রাখালের কাজ করে। আর আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরাতন, আদিম অধিবাসী তারা আজকের মার্জিত তথাকথিত সভ্য সমাজে খাবার খুঁজছে। মাঠে ঘাটে ইঁদুরের গর্ত থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে তাই দিয়ে উদরপূর্তি করছে। এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে,
‘ঐ মাঠে হারিকেন নিয়ে বাচ্চাগুলো কী করছে?
ইঁদুর খুঁজছে। ওখানে ইঁদুরের গর্ত আছে, বোধহয় ওরা সাঁওতাল, ওরা ওদের খাবার খুঁজছে।’

আবার লেখক অন্যত্র লিখেছেন যে, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষ কায়িকশ্রমের দ্বারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের যেন উচ্চশিক্ষার অধিকার নেই। প্রান্তিক কৃষিজীবী, সর্বহারা মানুষ যেন সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষিত, অবহেলিত, তাদের জন্য লেখাপড়ার মতো মৌলিক অধিকারও যেন নেই; নেই আজ ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। লেখকের বর্ণনায়,
‘বড়লোকের ছেলেমেয়েরাই আছে এখন স্কুলে। একটা লোক এল। একটা প্রার্থনা আছে মাস্টার। আমার বেটা গন্‌শাকে একটু ডেকে দেন। গণেশকে পাঠালাম। ক্লাসের বের হতেই গণেশের ঘাড় চেপে ধরল ওর বাপ। শুয়ারের পো, বাবু হবার শক পোঁদে ঢুইক্যে দিব। হাত থেকে শ্লেট কেড়ে নিয়ে পায়ে মাড়িয়ে দিল। রোজ রোজ বইলছি মাঠ থে ধানগুলো বাবুবাড়ি পৌঁছে দে আয়, আমি এই গুষ্টি গিলবু, আর বেট্টা বাবু হঁন্‌ছে অ্যাঁড় ছিনছে দুব।’

সাধারণ শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষ চিরকাল শোষিত, উপেক্ষিত, তারা সমাজে অন্তেবাসী, সর্বহারা কিন্তু তবু তারা আশাবাদী। তারা বাঁচার জন্য লড়াই করে, স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়, এগিয়ে যাবার জন্য মানসিকভাবে লড়াই করে ভিতরে মনের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে।

প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি, তাদের সন্তানকে যখন ইস্কুলের মাস্টার পড়া ধরে, তার উত্তর হয় জীবনমুখী, কর্কশ রুক্ষ, নির্মম বাস্তবধর্মী। কথক জিজ্ঞাসা করলেন,
‘… বিষ্টি পড়লে কী ইচ্ছে করে?
মাছ নাপিয়ে আসে নাবালে, কৈ, শিঙি, পোল্যো দে ধরতে ইচ্ছে যায়, একজন বলল, বিষ্টি পড়লে খড়ের ঘরে জল পড়ে, ভালো লাগে না তকুন। মায়ের কোলে বসে থাকতে ভালোলাগে না? আমি জিজ্ঞাসা করি।
মা তৈড়ে দেয় মাস্টার, মা বলে জল হইয়েছে, গেঁড়ি-গুগলি খুঁজ্যে নে আয়।’

এই রূঢ় বাস্তবের কষাঘাতে, নির্ঘুম অস্থির সময়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনবেদে বিবক্ষ্যমাণ হয় দারিদ্র্যতার মতন ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগ, যা সমাজকে একেবারে বিলীন করতে চায়। দু মুঠো খাবার জোগাড় করা এই প্রান্তিক সমাজের স্বপ্ন; লেখাপড়া যেন শৌখিন মজদুরি। এহেন সমাজব্যবস্থার পরিকাঠামোর আদল পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে জোরালো ছোটো গল্পকার স্বপ্নময় চক্রবর্তী। তিনি আজকের এই ভ্রষ্ট সময়ের গর্ভে দাঁড়িয়েও স্বপ্ন দেখেন সুন্দর পৃথিবীর, সুস্থ সমাজের, মলিন সম্পর্কে সুষমান্বিত একটি অপার্থিব জগতের। তাই অবশেষে বলতেই হয় স্বপ্নময় চক্রবর্তী একজন দক্ষ কথাকার, সমাজের চিত্রকর; তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন সফল গল্পকার এবং সফল সামাজিক ব্যক্তিত্ব।

তথ্যসূত্র:
১।চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: ‘সর্ষে ছোলা ময়দা আটা’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, জুন, ২০১৭, পৃ. ৯
২। তদেব, পৃ. ৯
৩।তদেব, পৃ. ৯
৪।তদেব, পৃ. ৯
৫।তদেব, পৃ. ১০
৬।তদেব, পৃ. ১০
৭।তদেব, পৃ. ১০
৮।তদেব, পৃ. ১১
৯। তদেব, পৃ. ১৩
১০। তদেব, পৃ. ১৫
১১।চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: ‘ভালো করে পড়গা ইশকুলে’, শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, জুন, ২০১৭, পৃ. ১৮।
১২।তদেব, পৃ. ১৮
১৩।তদেব, পৃ. ২১
১৪।তদেব, পৃ. ২১
১৫।তদেব, পৃ. ২২

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!