হাজার পাঁচেক টাকা ধার হিসাবে দিবি ভাই। কিছুদিনের মধ্যে দিয়ে দেব।আসলে আমার শরীরটা খুব খারাপ। চিকিৎসা করাতে হবে কিন্তু হাতে মোটে টাকা কড়ি নেই। এদিকে চিকিৎসা না করাতে পারলে…
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফুলবাগিচা গ্রামের ভুবন সরদারl অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ। চোখে স্থির প্রতীক্ষা। কৌতূহল মেখে আছে সে চাহনিতে। হালকা হাওয়ায় কলাপাতার দোলনে সকালের চিলতে রোদ মুখের উপর ওঠা নামা করছেl পাশের বড়ো তালগাছটা তাকিয়ে আছে ছোট গাছটার দিকে অধীর প্রতীক্ষায়। হালকা হওয়ায় পাতা কাঁপছে থেকে থেকে।
ভুবনের কথাটা শোনার পর অমল এক মুহূর্তও ভাবেনিl মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, হ্যাঁ দাদা ও নিয়ে আপনি একটু ও ভাববেন না। আমি থাকতে আমার সামনে আমার দাদা অসুস্থ থাকবে আর আমি তাকে সাহায্য করবোনা তা কখনো হয়! টাকাটা কবে লাগবে বলুন? আপনার বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসবো। কথাটার মধ্যে যে এক রাশ আবেগ লুকিয়ে আছে তা আর চাপা থাকেনা ওর কণ্ঠস্বরেl যেন ভুবনকে সাহায্য করতে পারলে তার আনন্দl একটা আন্তরিক সহযোগিতার তাগিদ বেরিয়ে আসে তার থেকেl পুকুরের জলের ছোট ছোট ঢেউয়ের উপর রোদের ঝিলিক খেলে যায়l যেন পুলকে খিলখিলিয়ে আসছে। হালকা দখিনা বাতাসে উৎকট গুমোট ভাবটা কেটে যায় কিছুটাl একটু প্রশান্তি নেমে আসে প্রকৃতির বুকে।
না না তোকে এতটা কষ্ট করে আসতে হবেনা। বাজারে আসার পথে আমি তোর বাড়ি একবার হয়ে আসবো। টাকাটা আমি কিছু দিনের মধ্যে শোধ দিয়ে দেব। বেশি দেরি করবনা। ভুবন আস্তে আস্তে বলে। কথাটার মধ্যে একটা ইতঃস্তত ভাব। যেন ভরসার তল পাচ্ছেনাl
ওকে এভাবে সংকোচ করতে দেখে আমলের খারাপ লাগে। সেই পরিস্থিতি কাটাতে অমল বলে, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না দাদাl আগে আপনার সমস্যাটা তো মেটান।বাকি কথা পরে ভাবা যাবে l
জৈষ্ঠ্য মাসের শেষl মাঝে মাঝে কোনো কোনো দিন বৃষ্টি নামছেl খালি পুকুরগুলোর বুক এখন কানায় কানায় ভরাট যেন পূর্ণ যৌবনা যুবতী। কিন্তু সেই ভ্যাপসা গরমটা বিরহ ব্যথার মত রয়ে গেছেl
প্রত্যন্ত গ্রাম হলিদিয়ার ছেলে অমল পাশের গ্রামের ভুবন সরদারের কাছে চির কৃতজ্ঞ। কোনো প্রকার ভুবনের কাজে লাগতে পারলে সেই কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিতে পারে।
প্রকৃতি অমলকে জন্মাবার জন্য একটা নড়বড়ে পরিবার দিয়েছিল কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে বিকশিত করার মেধা দিতে কার্পণ্য করেনি। সে যেন অযত্নে বেড়ে ওঠা প্রকৃতির শোভা বাড়ানো সুগন্ধি বুনো ফুল। মনে পড়ে যায়- সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বি এ ভর্তি হয়েছে দিদির গয়না বন্ধক রাখা টাকায়, প্রয়োজনীয় বই কেনার টাকা নেই। সে এক দুশ্চিন্তার দিন গুজরান। পড়াশুনা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কাছে দূরে কোথাও কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেনা। চারদিক নিরাশায় ঢেকে গেছে। আত্মীয় বন্ধু বান্ধবরা যে যার মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তার মতো এমন হা ঘরে ছেলের থেকে সবাই গা বাঁচিয়ে দূরে দূরে থাকে। পাছে কিছু সাহায্য চেয়ে বসে। অসহায় অমলের চোখে অন্ধকার ঠেকে। কি যে করবে ভেবে পায়না। ঠিক তখন পাশের গ্রামের ভুবন সরদারের সাথে দেখা। সাক্ষাৎ দেবদূত হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিনl অনেকেই বলে ভালো কাজের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলে তার সহযোগিতা কোথাও না কোথাও থেকে জুটে যায়। আজ ওর মনে হয় কথাটা মিথ্যে নয়। ভুবন সেদিন ওর জন্য কি কঠোর পরিশ্রমই না করেছে। এখানে সেখানে ছুটো ছুটি। এর ওর কাছে হাত পেতেছে সাহায্যের জন্য। একটুও বিরক্তি প্রকাশ করেনি সে জন্য। তার নিজের অবস্থা এতটা ভালো নয় যে সে বই কিনে সাহায্য করে। তবু অমলের অবস্থা দেখে দায়সারা মন ভোলানো কথা বলে দায় এড়ায়নি সে। অমলের মধ্যে দেখেছিল এক আগুন। তার চোখে মুখে ছিল বনস্পতির সম্ভাবনা সেই ভাবি বনস্পতিকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেয়নি। তাকে সে বড়ো দেখতে চেয়েছে। এ জন্য ভুবনকে কম ছোটাছুটি করতে হয়নি। কম লোককে হাতে পায়ে ধরতে হয়নি। তবু কিছুতেই সে হতোদ্যম হয়ে পড়েনিl পিছিয়ে আসেনি। শেষমেশ তার অনুরোধে ও পৃষ্ঠপোষকতায় একটা সংস্থা অমলের ইংরেজি অনার্সের সমস্ত বই দেয়। শুরু হয় আবার পথ চলাl নতুন সংগ্রামl সেই নিশ্চলতা কাটিয়ে পথ চলা শুরু হয় আবার। সেই থেকে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক। সময় নিজের ধারায় এগিয়ে যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিপদে আপদে সমস্যায় বড় দাদার মতো সবসময় পাশে থেকেছে ভুবন। সৎ পরামর্শ দিয়েছে। সাহস যুগিয়েছে। প্রচন্ড গরমের পর প্রচন্ড বৃষ্টির জলে গ্রামের পুকুরের বাঁধ ভেঙেছে। দুটো পুকুরের জল মিলে মিশে একাকার। মাঝে একটা ব্যাঙ খুশিতে একটানা গ্যাঙর গ্যাং করে ডেকে চলেছে।
অমলকে ছুঁয়ে বাইশটা বসন্ত স্টেশন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কত ভালোলাগা খারাপলাগা রূপ রস গন্ধ বিস্মৃতির দেশে পাড়ি দিয়েছে। এলাকায় খবর হয়ে যাওয়ার মতো ফল করে বি এ পাস করে অমল। মনের মধ্যে তখন লতিয়ে বাড়ছে একটা একগুঁয়ে প্রতিজ্ঞা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। দিনরাত এক করে ফেলেছে পড়াশুনার পিছনে। লড়াই শেষে এলো শান্তি। এস এস সি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করে অমলl চোখে একরাশ স্বপ্ন। বুকে নতুন ডানায় বল পাওয়া পাখির মতো। এক মহৎ ব্রতে ব্রতী নবীন শিক্ষক সে এখন। শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়। উবে যায় জীবনকে হোঁচট খাওয়ানো আর্থিক অচলাবস্থাl ধুঁকতে থাকা স্বপ্নগুলো পাখা মেলে দেয় আকাশে। হাজার রকমের অভাব, অসুবিধা জীবনের অনেক চাহিদা ও ইচ্ছার মুখে লাগাম লাগাতl এখন তারা কোথায় পালিয়ে গেছে। এগিয়ে চলার পথ তাঁর দিকে হাট করে খোলা। সেই পথ ধরে স্বাচ্ছন্দে এগিয়ে যেতে পারে এখন লক্ষ্য পূরণের দিকে। সোনালী সকালের উন্মুক্ত আকাশ থেকে রোদ এসে পড়েছে চারা গাছটার উপরl কচি কান্ডটা তরতর করে বেড়ে উঠছে মহীরুহের লক্ষ্যে। কত কিছু মনে পড়ে আজ। কত লোকের কত অবহেলাl আত্মীয় বন্ধুদের এড়িয়ে এড়িয়ে চলা। তার মধ্যে বেশি করে মনে পড়ে ভুবনের কথা। তার উপকারের কথা। আজ সে সেই উপকারের প্রতিদান দিতে চায়। যেকোনো ভাবে।
ভুবনের চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরেছে ক’দিন হল। ঘাড়ের যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। একদিন মদন নস্করের চায়ের দোকানে ভুবনের সাথে দেখা। ভুবনের পাশে বসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, দাদা, এখন কেমন আছেন?
ভুবন একটু রসিকথা করে উত্তর দেয়, ভালো, তবে এই একটা বড় গয়না গলায় পরিয়ে দিয়েছে, এই যা। তাছাড়া সব ভালো।
অমল এবার কিছুটা বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞাসা করে, দাদা এটা কতদিন পরতে হবে?
দেখা যাক। যতদিন না পুরোপুরী সারবে ততদিন। ভুবন অনিশ্চিত ভাবে উত্তর দেয়।
এরপর অনেকটা সময় কেটে যায় গল্পে গল্পেl সূর্য এখন মাঝ মাঠে দুরন্ত ভাবে খেলছে। গল্পে গল্পে ওরা সময়ের খেয়াল করেনিl হঠাৎ বেলার দিকে নজর পড়েl ভুবন ব্যস্ত হয়ে ওঠে, যাই রে অমলl বেলা হলো; একটু কলকাতায় যেতে হবে। ভুবনের চলার ভঙ্গিতে ব্যস্ততা।
আচ্ছা দাদাl আমার ও একটু বাঁটরার সুখেন রুইদাসের বাড়ি যেতে হবে। আমি ও উঠি। দুজনেই ওঠে দুদিকের দুই পথ ধরে নিজ বাড়ি দিকে হাঁটেl দোকানে বসা বাকি লোকেরা কিছুক্ষণ ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। অমল শুনতে পায় ওদের সম্পর্কে দু’চার কথা তখনও লোকেরা বলাবলি করছে। এমন তো সব সময় হয়l সেকথা গায়ে মাখেনা কেউl মাখতে নেই। সেও মাখেনিl
অমল স্কুল, বাড়ি আর অন্যান্য হাজার রকম কাজে জড়িয়ে পড়ে। সময় এখন যেন কোথা থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে পালিয়ে গিয়ে অসীমতায় মেশে। বাজারে বসে আড্ডা দেওয়ার সময়গুলো হারিয়ে গেছে ব্যস্ততার ভিঁড়ে। তবু বাজার করতে আসা যাওয়ার পথে পাশের দোকানটাতে একটু চোখ বুলিয়ে যায়। যদি ওখানে ভুবনের সাথে দেখা হয়। চা দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে, ও মদনদা, আজকাল ভুবনদাকে দেখেছে কি…
চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে মদন ওর দিকে তাকায়। একটু থমকে বলে- না মাস্টার, অনেক দিন হলো ভুবনদা একেনে আসেনে। কোনো কাজে টাজে এটকে পোড়েচে হয়তো। মাস্টার, একোন এট্টা চা দোবো?
অমল ওর দিকে তাকিয়ে বলে- না দাদা, আজ আর সময় হবেনা। একটু তাড়া আছেl এক জায়গায় যেতে হবে।
ও রোজ যে চা খায় তেমনটা নয়l কখনও সখনো বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে বসে ইচ্ছা হলে খায়। কিন্তু মদনের সঙ্গে ওর অনেক দিনের চেনাজানা। তাছাড়া ব্যবসায়িক রীতি অনুযায়ী নিয়ম মাফিক জিজ্ঞাসা করে মদন।
ভুবন মদন নস্করের চা দোকানে আসেনা বেশ কিছুদিন হলো। এ নিয়ে অমলের একটু চিন্তা আছে। লোকটার হঠাৎ হলো কী?
ফোনে কয়েক বার কথা হয়েছে। কিন্তু তেমন ভাবে কথা হয়নি।
হ্যালো,, হ্যালো দাদা, আমি অমল বলছি।
হ্যাঁ বল…
দাদা ভালো আছেন? আপনাকে এখন তেমন একটা দেখা যায়না… বাড়ির সবাই ভালো আছেতো? বউদি আর পুচকু?
এই চলে যাচ্ছে যাহোক করে। তোরা সব ভালো আছিস তো? অমল বেশীরভাগ প্রশ্নগুলো প্রায় এক তরফা ছুঁড়ে দেয় ও। উত্তরগুলো আসে থেকে থেকেl ভুবনের কথাগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া নেই। কাঠখোট্টা শব্দগুলো ভেসে আসে ওপার থেকেl যেন কথা বলার ইচ্ছা নেই। বলতে হয় বলা।
ভুবনের কথার মধ্যে কেমন একটা শ্লেষ মেশানো ভাব,
আমরা তো তোদের মতো চাকরিদার নই। কাজ কর্ম না করে শুধু শুধু ঘুরে খেলে কি আমাদের চলে?
ভুবনের এমন সুরে কথায় অমল কিছুটা অবাক। হঠাৎ ভুবনদার মতো মানুষ এমন ভাবে কথা বলছেন কেন? এই এত বছরের জানাশোনা। অমল কোনোদিন ভুবনকে এ ভাবে কথা বলতে শোনেনি। মনে মনে কিছুটা কষ্ট পায়। ভাবে, আমি কি কোনো ভুল করলাম? হঠাৎ করে ভুবনদা এমন ব্যবহার করছেন কেন? রাস্তায় যেতে যেতে ভাবতে থাকে কি কারণে এমন হতে পারে! আরও কয়েক বার ফোন করেছিল ভুবনকেl প্রতিবারই ফোন বেজে গেছে। রিসিভড হয়নি। শেষে ফোন করা বন্ধ করে দেয়l এক প্রকার অভিমান ওর মধ্যে দানা বাঁধেl
শীতের বিকেলের সন্ধ্যাটা কাছাকাছি ওৎ পেতে থাকে। পশ্চিমের গাছ গাছালির মাঝে আবছা কুয়াশা ঘেরা লাল সূর্যটা অর্ধেক ডুবে গেছে। স্কুল থেকে ফিরছে অমল। পথে বাঁটরার সুদিনের সাথে দেখা। সুদিন বলল, জানিস অমল, সেদিন ভুবনদার সাথে দেখা হয়েছিল।
তারপর… অমল সুদিনের মুখের দিকে কৌতূহলী ভাবে তাকায়l
এ কথায় সে কথায় তোর কথায় এলো, তুই কেমন আছিস, কি করছিস- তা জিজ্ঞাসা করলো l
তুই কি বললি? গভীর কৌতুহলের সঙ্গে অমল সুদিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বললাম, ভালো আছে। চাকরি করছে। সংসার করছে। এই সব…
তারপর?
তারপর বললো যে আমি অমলের জন্য এতো করলাম কিন্তু ও আমাকে ভুলে গেল। অকৃতজ্ঞ।
অমল তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মুখে কথা নেই। কথাটা যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবু বিশ্বাস করতে হলো সুদিনের কথা বলার ভঙ্গি আর মুখের ভাব দেখে। মনের মধ্যে যন্ত্ৰণা মিশ্রিত বিস্ময়l মনে মনে হাসে মানুষের অদ্ভুত স্বভাবের কথা ভেবে। যে মানুষ তাকে এত সাহায্য করেছে, এত সুপরামর্শ দিয়েছে সেই আবার স্বার্থে ঘা লাগার সাথে সাথে কেমন বদলে কুৎসা রটাতে শুরু করেছে। মানুষ অপরকে করুণা করতে ভালোবাসেl তাকে অধীন রাখতে ভালোবাসে। কিন্তু চায়না সম পর্যায়ে উঠুক কিংবা নিজেকে ছাপিয়ে যাক।
আচ্ছা, এটা কি ওই পাঁচ হাজার টাকার জন্য? হঠাৎ প্রশ্নটা মাথায় আসে অমলের। গুরুজনেরা বলেন, সম্পর্কের মাঝে টাকা ঢুকে গেলে হয় টাকা নয় বন্ধু যেকোনো একটা যায়। এ কথাটা এতদিন সে অতটা তলিয়ে দেখেনি। আজকে এর তাৎপর্য বোঝে। কিন্তু সে তো কোনো দিন ভুবনদার কাছে টাকা চেয়ে তাগাদা দেয়নি। কোনো খারাপ কথা বলেনি। এমনকি সে সেই টাকার প্রত্যাশা ও করেনা। তবু কেন সে এমন ব্যবহার করছে! কিছুতেই সে উত্তর খুঁজে পায়না। রাতে খাওয়ার পর ঘুমের রাজ্যে প্রবেশের আগে সেই একই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুর ঘুর করে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি সেই প্রশ্নের আবর্তে। তারপর কখন ঘুমের রানী এসে নিজের রাজ্যে নিয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি।
প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। বাজারের মধ্যে ভুবনের সঙ্গে দেখা। দেখা বলতে ও দেখা পেয়েছে ভুবনের। অন্যদিকে মুখকরে বাজারের মধ্যে চলে যাচ্ছে সে। হয়তো ওকে দেখতে পায়নি। অথবা এড়িয়ে যাবার জন্য ইচ্ছাকৃত না দেখার ভান করছে। অমলও আগ বাড়িয়ে সাক্ষাৎ করেনি। কত আর সেধে সেধে, গায়ে পড়ে কথা বলা যায়! একরাশ অভিমান হঠাৎ দলা পাকিয়ে ওঠে ওর মধ্যে। যত হোক সেও একজন মানুষ। ওরও রাগ, দুঃখ, অভিমান আছে। সুদিনের মুখে শোনা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদের এটা এক নীরব প্রতিবাদ।
দূর থেকে দেখেছিল কেমন একটা হয়ে গেছে ভুবন। পোশাক আশাক চেহারায় দারিদ্রের ছাপ। কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে এই ক’দিনে। পরণের জামা প্যান্ট কেমন ময়লা। কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে। পায়ের জুতো ও ছেঁড়া। সেলাই করা। অমল বুঝেছিল কেন ভুবন দূরে দূরে সরে থেকেছে। মনে পড়ে যায় সুদিনের সেদিনের কিছু কথা, জানিস ভুবনদার কাজটা চলে গেছে। জানতে পারে লকডাউন আর আমফানের জোড়া ফলায় বেশির ভাগ খেটে খাওয়া মানুষের মতো তারও কাজ চলে গিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে ভুবনকে। সেই অসহায় অর্থনৈতিক অবস্থায় না তাগাদা দেওয়া ধারের বোঝা মনের উপর চেপে বসেছে।হীনমন্যতায় আর অপরাধ বোধে ভুগতে ভুগতে নিজেকে অমলের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে। অমলের দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় দেখেছে অপেক্ষাকৃত সহায় সম্বল সম্পন্ন আত্মীয়ের প্রতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল আত্মীয় একটা চাপা অভিমান থাকে। সামান্য কারণ পেলে তা প্রকট হয়ে ওঠে। তখন সম্পন্ন ব্যক্তিটিকে নিজে গিয়ে সেই অভিমান ভাঙাতে হয়l নাহলে সারাজীবন সে দূরত্ব থেকে যায়।।ভুবনের এই খারাপ অবস্থা দেখে তার খুব কষ্ট হয়।
আজ ভুবনের ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়। উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে আসেl অবাক কাণ্ড! এ কাকে দেখছে! সোজা দাওয়ার উপর অমল। হাতে দু’ব্যাগ ভর্তি বাজার- মশলাপাতি চাল ডাল আর বেশ কিছু নতুন দামি জামা কাপড়l তাকে দেখে হঠাৎ বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। এই সকাল বেলা অমল কেন তার বাড়িতে? তাহলে কি টাকাটার জন্যে? হয়তো করাবেগের হাটে গিয়েছিল। খালপাড় ধরে ফেরার পথে তাগাদা দিতে এসেছে। কতকগুলো প্রশ্ন মনের মধ্যে দুলতে থাকেl কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো কি যেন ভাবে অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে।
আরে দাদা, শুধু শুধু মুখের দিকে কি তাকিয়ে থাকবে না বসতে টসতে বলবে! অমল একটু হালকা চালে বলে। এতক্ষনে ভুবনের সম্বিৎ ফেরে।
এভাবে এত সকালে অমলকে দেখবে সে নিজে কখনো ভাবেনি।
আরে অমল, এতো সকালে?
-কেন, আসতে নেই! বলল অমল।
-না, তা নয় কিন্তু…
ভুবনের কৌতুহলটা থেকেই যায। মনের মধ্যে একটা ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। তার এই অভাবের সময় অমল কি সুন্দর বিলাসী ভাবে বাজার করেছে। নতুন নতুন তরি-তরকারি, কত দামী দামী পোশাক-আশাক। ভাগ্যের কি পরিহাস! অমল এখন কত পাল্টে গেছে। তার এমন দুঃসময়ে এমন ভাবে পরিহাস করতে এসেছে। ভাবতে ভাবতে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
দাদা, কি এত ভাবছো? খুব ক্ষিদে পেয়েছে কিছু খেতে দাও তো। আমি ততক্ষণ হাত পা ধুয়ে আসি। অমল অনুনয়ের সাথে বলে।
যা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আয়l আমি ততক্ষণ কিছু খাবারের ব্যবস্থা করি। বলতে বলতে ভুবন শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। এমন একটা সময় অমলকে কি খাওয়াবে? দুশ্চিন্তায় ভ্রূ কুঁচকে যায়। তার সঙ্গে মনের মধ্যে খছখচানিটা তখনও পিটুলির মতো লেগে আছে। খুব গভীরভাবে ভাবতে থাকে। কিছুতেই যেন হিসাব মেলেনা।
একটু দূরে পুকুর। অমল জামার আস্তিন গুটাতে গুটাতে হাতমুখ ধুতে যায়l ভুবন খাবারের ব্যবস্থা করতে থাকে। মনের মধ্যে অমলের কাণ্ড কারখানাকে অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসাবে গেঁথে নেয়। অভুক্ত মানুষের সামনে সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে খাবারের স্বাদ জানতে চাওয়ার মত অমানবিক পরিহাস বলে মনে হয়।
ইতিমধ্যে অমল পুকুর থেকে ফিরে এসেছে।
একটা তালপাতার চাটাই অমলের জন্য পেতে দেয় ভুবন।
বস এখানে।
টাঙানো দাড়ি থেকে একটা ছেঁড়া গামছা টেনে নিয়ে অমলকে দেয়। হাত মুখটা মুছে নেয় অমল। ততক্ষণে কাপে করে চা আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসে ভুবন। অমল হাত মুখ মুছে চ্যাটাইয়ে বসে।
দাও দাও খুব খিদে পেয়েছে।
ভুবনের দিকে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ আর বিস্কুট ক’টা নেয় অমল।
ভুবন ওর হাতে চা বিস্কুট তুলে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বলে, গরীব দাদার বাড়ি এলি। এই সামান্য চা বিস্কুটই খা। এর থেকে তো আর আমার বেশি সাধ্য নেই রে, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে…
অমল চা খেতে খেতে বাড়ির চারদিকে চোখ বুলায়। এখানে সেখানে ছোপ ছোপ দারিদ্রের দাগ। চা খাওয়া শেষ করে কাপটা দাওয়ায় নামিয়ে রাখে।
আজ তবে আসি দাদা। চ্যাটাই থেকে উঠতে উঠতে অমল বলে।
আচ্ছা আবার আসবি…
ভুবনের কথার মধ্যে যেন হালকা অভিমানের ছোঁয়া।
অমল উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নেয়।
ভুবন ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে।
দাদা… অমলের ডাকে ভুবন পিছন ফেরে। প্রশ্ন মাখা চোখে অমলের দিকে তাকায়।
অমল বাজারের ব্যাগ দুটো ভুবনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, দাদা ব্যাগ দুটো রাখো। এগুলো আপনার জন্য। আজ আপনার জন্য আপনার কাছে এলাম। টাকা আমাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য বিভেদের পাঁচিল তুলেছে তা আমি জানি। আজ তা ভাঙতে এলাম। ঐ পাঁচ হাজার টাকা আর দিতে হবেনা। ওটা দাদার পায়ে ভাইয়ের প্রণামী। শুধু চাই দাদার মুখের হাসি। আর নতুন বছরে বড় দাদার প্রতি ছোট ভাইয়ের এটা ছোট উপহারl গ্রহণ করে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধবেন, এটা আমার প্রার্থনা। ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে নিরাশ করবেন না দাদা।
এক রাশ বাতাস সামনের পাতাহীন আমরা গাছটার শাখা দুলিয়ে যায়।
অদ্ভুত এক অনুভূতি ভুবনের মনে তরঙ্গ খেলে যায় হঠাৎ। অজান্তে দুফোঁটা চোখের জল টপ টপ করে ঝরে পড়ে উপহারের উপরl ঝিকমিকিয়ে হেসে ওঠে নতুন সকালের মিষ্টি আলো।♣