১.
মধ্যরাতের অন্ধকারে ছুটে চলেছে চন্দ্রকান্ত ধনীর শ্বেতবর্ন অশ্ব। বাতাস থম ধরে আছে। আকাশে চাঁদ স্তিমিত। কোন এক গানবাড়ি থেকে ফিরে আসছেন চন্দ্র ধনী। তিনি এলাজানের বিশাল বিস্তারের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামলেন। কি বিশাল এই নদী এলাজান! এলাজান বয়ে চলেছে। তার প্রবাহের পাশে পাশে কত কত গঞ্জ, বন্দর, গা গেরাম। এলাজান শালটিয়া হাউসের ডেরা বানিয়াদহ মরা মানসাই। আর সব মিলে মিশে বড় তোর্সা।নদী মিশে যায় নদীতে। আবার নদী থেকে বেরিয়ে আসা নদী। তখন সিঙ্গিমারি বল, ধরলা বল, মানসাই বল, বুড়ি তোর্সা বল সব কেমন ভ্রম ও বিভ্রমের ভেতর ঢুকে পড়া এক মস্ত সংশয়।
২.
তখন চন্দ্র ধনীর পরদাদার জোতদারী আমল। কুচবিহার বা বেহার রাজ্যের শাসক ছিলেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ভূপ। এই এলাজান নদীর কাছেই ছিল বিশাল বন্দর রাশিডাঙ্গা। কিছু দূরেই বন্দর আক্রার হাট। বন্দর চিলকিরহাট।বন্দর গোসানী। পাট তামাক ধান ছিল প্রধান রপ্তানী পণ্য।কত কত রকমের সব ধান যে হত। হাটগুলো ছিল জমজমাট। কোন কোন হাট সারারাত ধরে চলতো।
আশেপাশে ছিল গভীর সব বনভূমি।রাজপুরুষ আর জোতদারদের মৃগয়া ক্ষেত্র। দিনের বেলায় বাঘ ডাকতো টাপুরহাটের জঙ্গলে। হাটুরেরা সশস্ত্র এবং দল বেঁধে চলাচল করতো। আবার শীতে এলাজান নদীর চরে শরবনে গুলা বাঘেরা আস্তানা গারতো। দেখা মিলত হরিণের। আর গ্রাম গঞ্জ ছুঁয়ে ছিড়ে বয়ে চলতো নদী এলাজান।
আবার কখনো শালটিয়ার বড় নৌকোর মাঝি ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে ঢুকে পড়তো এলাজান নদীর বিস্তারে। সেখানে তখন হয়তো ভাওয়াইয়া গাইতে গাইতে মাছ ধরছে সুবল দাস। কিংবা এলাজান নদীর পাড়ে পাড়ে বাদ্য ও বাজনা বাজতে থাকে। বিবাহ নাচের দেশে বয়ে চলে নদী এলাজান। নদী শালটিয়া। নদী মরা মানসাই।
৩.
কুচবিহার অধিপতি মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ কাশী যাত্রা করবেন। নদী এলাজানের পারে শুরু হয়েছে ভারি ব্যস্ততা। রাজপুরুষ আর স্থানীয় জোতদারেরা সকল প্রস্তুতি তদারকি করছেন। নদীপার্শ্বে স্থাপিত হয়েছে সারি সারি শিবিকা। এলাজান থেকে যাত্রা শুরু করে ৪৫ দিন ধরে সেই রাজকীয় নৌবহর চলবে। এলাজানের কাছে পিঠে আকুল পশারের পশারির হাট। রশিডাঙা বন্দর থেকে ব্যাপারী মহাজনের হাজারমণি সব নৌকো। জমজমাট থাকে গোটা চত্বর। এলাজানের পারে পারে গা গঞ্জের মানুষের জমায়েত। সকলেই উৎসুক হয়ে আছে কবে কখন রাজাবাহাদুর এসে হাজির হন।
এতসব ঘটে। ঘটেই চলে। আর এলাজানের স্রোত গিয়ে মিশে যেতে থাকে শালটিয়ার খোদলে। কিংবা মরা মানসাই বুঝি ঢুকে পড়তে থাকে সবেগে এলাজানের বুকের ভেতর।
৪.
চন্দ্রকান্ত ধনী তার বিভ্রম থেকে জেগে ওঠেন। একটা পুরোন কালখন্ড থেকে ফিরে এসে তিনি মস্ত হাই তোলেন আর আবার উঠে বসেন তার ঘোড়ার পিঠে।
তিনি কিন্তু এলাজানের কাছ থেকে সরে যান না। সরে যেতে পারেন না। তিনি এই নদী এলাজানের গতিপ্রবাহে জড়িয়ে থাকা অগণন মিথগুলির শরীরে হাত রেখে মিথগুলিকে পুনর্জাগরণ এনে দিতে থাকলে মধ্য নিশীথের খুব গহিন থেকে ভেসে আসতে থাকে রাতপাখিদের ডানার বিন্যাস। আর এলাজান বয়ে চলে রাশিডাঙার দিকে। কামরূপ কামতার দিকে। এলাজানে ভেসে যায় কোন গ্রাম্য যুবতীর কাঙ্খের কলস।
৫.
চর কালপানি দিয়ে মন্থর লয়ে ছুটতে শুরু করে মজনু শাহের ঘোড়াটি।বাদামি কেশর। নিভৃত আর মায়াময় চক্ষুদ্বয়। মজনু তার এই ঘোড়াটি কিনেছিল ছত্রশালের হাটে। বিবি ফুলজান ঘোড়াটির নাম রেখেছে সুমি।এই ঘোড়া নিয়ে,ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ধান পাট তামাক নিয়ে এক হাট থেকে আরো আরো দূরে কাছের হাটগুলোতে ঘুরে বেড়ায় মজনু। মজনু শাহ।ভালো বাঁশি বাজাতে পারে বলে লোকমুখে তার নাম মজনু মাস্টার। ধুবুরি শহরের এক কবি মজনু আর তার ঘোড়াটিকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিল।সেই থেকে গঞ্জ হাটে মজনুর বেশ কদর। খাতিরদারি।
মাঝে মাঝে মজনু মনের সুখে ফাঁকা রাস্তায় সুমিকে ছোটাতে ছোটাতে গলা ছেড়ে গান ধরে_
“আরে চলে রে মোর ঘোড়ার গাড়ি রে
কাদো পন্থ দিয়া
আরে নওদারি নাইওরি গুলা
দেখি থাকে চায়া রে”
আমরা দেখি মস্ত এক আবছায়ার ভিতর লীন হয়ে যাচ্ছে মজনু শাহের ঘোড়াটি।
জীবন জীবনের মতন। মরণঘেরা জন্মঘেরা হাসি আর কান্নার। জীবনের পর জীবন কেটে যায়। চাঁদের রাত পেরিয়ে মজনুর ঘোড়াটি সারারাত হেঁটে হেঁটে চলে আসে গঙ্গাধরের উজানে। সেখানে তখন ভোরের আলো আর বাতাসের ভেতর মুনসি করিমের কয়েকশো “বাথানের মহিষ” ব্যপ্ত এক সিলুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মজনুর ঘোড়াটি, বলা ভালো মজনু মাস্টারের ঘোড়াটি তখন কিছুটা দ্বিধা নিয়েই মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে থাকে আরো আরো চাঁদের রাতের দিকে। সে এক মস্ত পর্যটনের মতন হয়তো বা!
৬.
গঙ্গাধর আর গদাধর নদীর পারে পারে কত কত হাট। বড় হাট মাঝারি হাট জৌলুস হারানো কিংবা জাকজমকের হাট। এই সব হাট ঘিরে ভূমিলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকা। মানুষের জীবন ঘিরে এত এত হাটের কুহক। সে আলমগঞ্জের হাট বলো, প্রতাপগঞ্জের হাট হোক,পাগলাহাট বা কাছারিহাট যাই হোক না কেন; সব হাট ছাপিয়ে ভেসে উঠতে থাকে গৌরীপুরের হাট গোলকগঞ্জের হাট। এই আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই একবার হলেও ঢুকে পড়ে গৌরীপুর আর গোলকগঞ্জের হাটের কেন্দ্রে।
আমরা দেখে ফেলি গৌরীপুরের হাটে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরিদের। তাদের মুখের লালায় জিভের শরীরে লেগে থাকে গৌরীপুরের খিলি পান। গোলকগঞ্জের মজা গুয়া। হাটের প্রান্তে প্রান্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তাদের গান_
“নদীত ফোটে
নদীয়া হোলা”
৭.
“একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না”
মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে। কিন্তু তখন নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না। কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে। তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে। তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি। আর ভাঙা জলের সোতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে। এভাবেই জীবনের পর জীবন বাঁচে এই সব হাটপরিধী জুড়ে জুড়ে।আখ্যানের পর আখ্যানের পরিসরে তীব্র এক গঞ্জহাটের কোরাস!♦