বুড়িগঙ্গার নদীর ওপারে গ্রামটি। বর্তমানে গ্রাম বললে ভুল বলা হবে। বুড়িগঙ্গার উপরে ব্রিজটি চালু হওয়ার পর সেই গ্রামটিকে এখন ছোট খাটো শহর বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। নাম তার হাসনাবাদ। সেখানে অত্যাধুনিক একটি হাসপাতাল রয়েছে, নাম “রিভার ভিউ ক্লিনিক।”
কবির তার অসুস্থ মা’কে সেই হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে। তার মায়ের নাম জেবুন্নেসা- দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিসের উপর নির্ভর করে এখনও জীবন চলছে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা শুধু ওই সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
মা’কে যে ওয়ার্ডে রাখা হলো, সে ওয়ার্ডের সংলগ্ন একটি ওয়ার্ড থেকে এক রোগীর আর্তচিৎকারে কবির রীতিমতো চমকে উঠলো। ক্ষণে ক্ষণে রোগী আকাশ পাতাল ভেদ করে হাউ মাও করে কেঁদে উঠছে আর বলে চলছে, “ডাক্তার, আমাকে মেরে ফেলো, আমি আর বাঁচতে চাইনা। এ ব্যথা কি যে ব্যথা আমি তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। এ ব্যথা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা, আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলো।”
“জীবন -মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে, আমরা আপনার ব্যথা উপশমের জন্য মরফিন ইনজেকশন দিয়েছি, এর বেশী আমাদের আর কিছু করণীয় নেই।”- সহানুভূতির স্বরে বললেন ডাক্তার।
– তাহলে মরফিন ইঞ্জেকশনের মাত্রা বাড়িয়ে দাও।
– তা হয় না!
– কেন হবে না।
– মাত্রা বাড়িয়ে দিলে আপনি মারা যাবেন।
– আমি তো মরতে চাই!
– এটা করা অপরাধ। আইনের চোখে এ কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ। আমরা ডাক্তার হয়ে এই কাজ করতে পারিনা। আমাদের কাজ হলো মানুষকে বাঁচানো, মারা নয়। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন, আমাদের চিকিৎসাবিদ্যায় যতটুকু করা সম্ভব, তাই করে যাচ্ছি।
রোগী হামিদ চৌধুরী লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। রোগ সমস্ত শরীর ছড়িয়ে গেছে। এখন ফুসফুসে এসে বাসা বেঁধেছে। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করারও সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় রোগীর অসহ্য ব্যথাকে কন্ট্রোল করে তাকে যতদূর সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা যায় তারই চিকিৎসা চলছে।
কবির মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাসায় ফিরলো। আজকের হাসপাতালের সেই করুণ চিৎকার তার মনের গহীনে তোলপাড় শুরু করে দিলো। কেমন যেন এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করলো। মানুষের জীবনে কেন বিধাতা এতো কষ্ট দেয়? মনে হয় যেন স্বর্গ-নরক এই পৃথিবীতেই… এর চেয়ে কষ্ট নরকে আর কি হতে পারে! মৃত্যুর পর কে স্বর্গে যাবে আর কে নরকে যাবে এ কথা আমরা কেউ জানিনা। আমরা সবাই কি সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্পাপ! পাপ মুক্ত হয়ে দুদিন নিশ্চিন্ত মনে আরাম আয়েসে পৃথিবীতে থাকা যাবে- এমন চিন্তা কি আমরা করতে পারি! তা হতে পারে না, কারণ দিন কাল যা পড়েছে প্রতি পদে পদে আমরা পাপ কাজে পতিত হচ্ছি, আমাদের পাপের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকের ক্ষুধার জ্বালায় পেট পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে, বিনা চিকিৎসায় অসহ্য বেদনায় শরীরের সর্বাঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে চলছে। তবুও আমরা সান্তনার সুরে বলে চলি, “যেখানে দুঃখ নেই, সেখানে সুখ কখনো থাকেনা। জীবন শুরু হয় শুন্য থেকে, শেষ হয় শুন্য দিয়ে।”
পরদিন কবির বিকেলে তার মা’কে দেখতে হাসপাতালে গেলো। মায়ের শয্যার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো সে। আবারও পাশের ওয়ার্ড থেকে আর্তনাদ, তার সাথে সেই করুণ সুর শুনতে পেল, “ডাক্তার আমাকে মেরে ফেলো।”
কিছুটা কৌতূহলবশত সে কবির পাশের ওয়ার্ডে ওই রোগীর কাছে গেল। দেখতে পেলো, রোগাক্রান্ত ভদ্রলোকের মাথায় একজন যুবতী হাত বুলিয়ে যাচ্ছে, আর বলছে, “বাবা তুমি অস্থির হলে চলবেনা। এতে অসুখ আরো জটিলতায় মুখোমুখি হতে পারে। ডাক্তাররা যতদূর সম্ভব তাদের চেস্টার কোনো ত্রুটি করছেনা। শান্ত হও বাবা।”
যুবতী মাথা তুলে কবিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার পরিচয়?”
– আমার নাম কবির, পাশের ওয়ার্ডে আমার মা একজন অসুস্থ রোগী। আপনাদের ওয়ার্ড থেকে করুণ আর্তনাদের চিৎকার শুনতে পেয়েছি, তাই দেখতে এলাম। মনে করবেন না যে আমি কোন কমপ্লেইন নিয়ে এসেছি। শুধু এসেছি মানুষটিকে এক নজরে দেখতে, যিনি কিনা এমন অসহ্য ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন।
– যুবতী মেয়েটি বলল, ”আমার নাম মমতা। বিছানায় যে ব্যক্তিটি অসহ্য বেদনায় কাতরাচ্ছেন উনি আমার বাবা।”
– ”কি আশ্চর্য মিল আমাদের দুজনার। আপনার বাবা আর আমার মা, একই পথের পথিক। মনে হয় যেন হাসপাতালের বাগানে গাড়ি নিয়ে বসে আছে যমদূত, তাদের জীবন নেয়ার জন্য। অপরদিকে হাসপাতালের ডাক্তাররা যমদূতের সাথে লড়াই করে রোগীর জীবনটাকে এক্সটেনশন করে নিচ্ছে। ক’দিন এক্সটেন্সানে থাকে, কে জানে!” বলল কবির।
-আমি তো আমার বাবার এত কষ্ট দেখে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিনা।
– আমরা মানুষেরা এর চেয়ে বেশী কি বা করতে পারি! এ সময়ে আমাদের ধৈর্যের সাথে মানসিক শক্তির জোরালো করার বিকল্প নাই। আমাদের মনকে শক্ত করতে হবে। চিকিৎসার ফলাফল যাই হোক না কেন, আমাদের প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসার আবেগকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিজেকে সামলে রাখতে হবে। এর থেকে কোনো মুক্তি নেই।
– আচ্ছা, আপনি কি দর্শন শাস্ত্রে লেখা পড়া করেছেন? জিজ্ঞাসা করল মমতা।
– উত্তরে কবির বলল, নাহ। যা কিছু জেনেছি, শিখেছি সবই এ জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাত প্রতিঘাত থেকে।
-আপনি তো আজব লোক। যদি কিছু না মনে করেন, জানতে পারি কি আপনি কি করেন?
-এরপরে কবির বলতে শুরু করে, ‘আমি একটি NGO তে কাজ করি। শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম, দুর্বল শিশু ও কিশোরদের সাথে সময় কাটিয়ে দিই। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। লেখাপড়া করেছি, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। কাজ করছি মোটামুটি যা আয়-রোজগার করি তাতে আজকের দিনে বেশ সচ্ছল বলা যায়। বলতে পারেন আমাদের পারিবারিক অবস্থা নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যেবিত্তে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাবলাম, টাকা পয়সা দিয়ে ওই সমস্ত প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েদেরকে নিয়মিত সাহায্য করা তো আমার পক্ষে অসম্ভব, তাই শ্রম দিয়ে যদি ওদের মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি তাহলেই আমার শ্রম সার্থক।”
– মমতা বলল, ভেরি ইন্টারেষ্টিং!! আপনার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন কি?
– তাহলে শুনুন। একনাগারে বলতে শুরু করল কবির- ‘আমাদের মাঝে রয়েছে, অটিজম আক্রান্ত শিশুকিশোর। (তারা মনে করে পৃথিবীটা হচ্ছে একটা জনাকীর্ণ স্থান। যেখানকার লোকজন, ঘটনাবলী — এ গুলো তারা বুঝে উঠতে পারে না, এর ফলে তারা এক ধরণের উৎকণ্ঠায় ভুগে )। সেরিব্রাল পালসী (জন্মের আগে, ভূমিষ্ট হওয়ার কালে বা ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কোনো কারনে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা অস্বাভাবিক ধরণে এর বিকাশ ঘটলে এই অবস্থায় পরিণত হতে পারে), ডাউন সিনড্রোম (এটি যাদের আছে, একই বয়সী অন্য শিশুর মত শিক্ষালাভের সক্ষমতা তাদের থাকেনা। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মাত্রা শিক্ষার দুর্বলতা থাকে), বুদ্ধিবৃত্তি অথবা বিচারশক্তির দুর্বলতায় ভোগা (এতে যারা ভুগেন, শেখার ব্যাপারে তাদের তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী সময় লাগে।) আসলে এগুলো কোনো মানসিক রোগ নয়। উপযুক্ত শিক্ষা পেলে তাদের বেশীরভাগই স্বাধীন জীবন যাপন করতে সক্ষম হতে পারে। মোটামুটি এই ধরণের সিন্ড্রোমে আক্রান্ত বাচ্চাদের নিয়েই আমাদের কাজ।”
– সত্যিই, আপনারা সমাজের মহৎ কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।
– আমাদের এই কাজগুলি সম্পূর্ণভাবে আমাদের পৃষ্ঠপোষকদের উদারতায় চলে। যদি কেউ আমাদের এই কর্মধারার সাথে একমত থাকেন, তাহলে তাদের দেয়া অনুদান আমরা গ্রহণ করে থাকি।
অবশ্য কেউ কেউ সাহায্য করার আগে প্রথমে আমাদের কাজকর্মগুলি পর্যবেক্ষণ করেন, তারপর সন্তুষ্ট হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এ ভাবেই আমাদের সংস্থাটি চলছে।
– আমি মানে আমরা যদি আপনাদের সংস্থাকে টাকা পয়সা দিয়ে কোনো উপকারে আসতে পারি তাহলে সেটা গ্রহণ করবেন কি? জিজ্ঞাসা করল মমতা।
– তা আর বলতে। নিশ্চয় গ্রহণ করা হবে।
– মমতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ”জানিনা কোন পাপের ফলে আমার বাবাকে এই অমানুষিক যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে! আমাদের প্রচুর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। একমাত্র আমিই ওই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আমি সেগুলি দান করে যেতে চাই। কি হবে ওই সমস্ত সম্পত্তি রেখে! যেখানে আমাদের জীবনের কোনো সুখ নেই। দান করে যদি ওই হতভাগ্য বাচ্চাদের জীবনকে উন্নত করা যায়- তাহলে হয়তোবা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের মনকে সান্তনা দেয়া যাবে, অভাগা মানুষদেরকে ভালোবাসতে শিখেছি। ভালোবাসা দিয়েই তো ভালোবাসা পাওয়া যায়, হয়তোবা এভাবেই নরকের যন্ত্রনা থেকে মুক্ত হলেও হওয়া যেতে পারে।”
– হয়তোবা! কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? আমার তো মনে হয় এ পৃথিবীটাই হলো পাপ পুণ্যের জায়গা। যে যার ভালো মন্দ কাজের পুরস্কার অথবা শাস্তি এখানেই ভোগ করে। যদিও এটা নির্ভর করে যার যার নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর।
– আপনি আমাকে এক নতুন জগতের পথ দেখালেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। কবিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আবেগ মিশ্ৰিত স্বরে বলল মমতা।
কবির এবার মমতাকে বলল, মার্কিন ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েনকে এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “স্বর্গ এবং নরক সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ”দুদিকেই আমার বন্ধুরা আছেন। তাই এ বিষয়ে আমার মত প্রকাশ করা উচিত হবে না।”♦