উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
।। প্রথম পর্ব ।।
দেরিতে বাড়িতে ফিরে লিজার কাছে একমাত্র ছেলের খারাপ খবর শুনে মিস্টার শাহিন ভিতরের তীব্র তাড়নায় সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। এও কী সম্ভব? তানুস্যার শিক্ষক হয়ে তার ছেলেকে এত বড়ো শাস্তি দিতে পারলেন? এত দিনের সম্পর্ক। তা অবলীলায় অস্বীকার করলেন? শিক্ষক-ধর্ম পালন করা কী তানুস্যারের কাছে কিছুই নয়? তাঁর সম্পর্কে তাহলে কী বছরের পর বছর মিথ্যে ধারণা পোষণ করে আসছেন? বিদ্যালয়ের মতো দ্বিতীয় গৃহে শিক্ষকের কাছে ছাত্র-ছাত্রীরা সন্তানতুল্য। কেউ কোনো অপরাধ করলে ক্ষমা করে দেওয়াই একমাত্র আদর্শ। তা কী তানুস্যারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? নাকি তাকে টার্গেট করেই ঠিক বিপরীত কাজটা করে ফেললেন?
রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে এবং ছেলের জন্যে চরম দুর্ভাবনায় মিস্টার শাহিন নতুন দিনের শুভ সকালকেও অভিবাদন জানাতে পারলেন না। মর্ণিং শোস দা ডে’ এটা যেন তাঁর কাছে কিছুই নয়। একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাব ক্রমে বড়ো হয়ে উঠছে। এত বড়ো স্পর্ধা মেনে নিলে তো…।
সকাল আটটা। তখনও নিজের ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছেন মিস্টার শাহিন। লিজা টিফিনের প্লেট হাতে সামনে এসে বলল, অত ভেবো না গো, রাতে কিছু খাও নি। অন্তত টিফিনটুকু খেয়ে নাও, নিজের শরীর টিকিয়ে রেখে যা খুশি করো।
ওসব নিয়ে যাও লিজা। তানুস্যারের বাড়ি থেকে ঘুরে না আসা পর্যন্ত মুখে কিছুই তুলব না। জানো লিজা, জীবনে এই প্রথম সারা রাত জেগে কাটাতে হল। ওই স্যার যে আমাকে এত জোর ধাক্কা দিতে পারেন, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। এখন দেখছি, জীবন থেকে মানবিক সম্পর্কের ঢেউগুলো ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তা না হলে তো তানুস্যার এভাবে আচরণ করতে পারতেন না।
এভাবে ভাবতে নেই গো। তানুস্যার ফারদিনের শিক্ষক।
মিস্টার শাহিন গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমাকে কতদিন বলেছি, ছেলেকে শুধু শুভদিন বলে ডাকতে। একমাত্র ছেলে। ‘শুভ’ শব্দটা ওর নামের সঙ্গে জুড়ে গেলে তবেই তো ভাবতে পারবে, ওর জন্যে কত বড়ো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছ তুমি। জীবনে স্বপ্ন না থাকলে বড়ো হওয়া যায় না লিজা।
বেশ তো, বলছ যখন এখন থেকে শুধু ওই নামেই ডাকব। বলছি কী, তানুস্যারকে নিয়ে এত বেশি দুর্ভাবনায় জড়ানো ঠিক হচ্ছে না। কী হয়েছে, তা না জেনে শুধু শুধু…।
মিস্টার শাহিন মাথা দোলাতে লাগলেন। —একটা কথা মনে রেখো লিজা, সুসম্পর্ক ধরে রাখার জন্যে দু’পক্ষের মধ্যে সমান তাগিদ থাকা উচিত। সেই শর্ত কী তানুস্যার রক্ষা করতে পারলেন? আমি যদি তাঁকে মনে রাখতে পারি, আমাকে তিনি মনে রাখতে পারলেন না কেন? জীবন এভাবে একতরফা চলতে পারে না লিজা। দেখছি, সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নতুন করে ভাবার দিন এসে গেছে।
একটা ঘটনা নিয়ে এত গভীর ভাবনা ঠিক নয়। সময়কালে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুভদিন প্রায় দিন টিউশন সেরে বাড়িতে ফিরে এসে বলেছে, তানুস্যার তাকে ভীষণ ভালোবাসেন! এসব নিয়ে ভাববে না?
আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ লিজা? কোন্ বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিতে হবে, এতদিনে তা কী শিখি নি?
লিজা আর বাক্য বিনিময় করতে সাহস পেল না। থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটা এমনিই। মনের মধ্যে একটা কিছু পেয়ে বসলে সেই অনুসঙ্গে একটানা লেগে থাকে, তার বাইরে যে অনেক বড়ো জগৎ থাকতে পারে, সেই চিন্তা কিছুতেই মাথায় নিতে চায় না। সংসার জীবনেও তাই। নিজস্ব সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তির মানদন্ড দিয়ে সংসারযাত্রা চালানোকেই সে একমাত্র সত্য হিসেবে ভাবে। এসবের কোনো মানে হয় না বলেই লিজা এক চিলতে ভেবে নিল।
মিস্টার শাহিন ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে দ্রুত পায়ে উঠোনে নেমে লাল দু’চোখ নিয়ে পিছনে তাকিয়ে শুধু বললেন, তানুস্যারের বাড়িতে যাচ্ছি, ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। হিসাবের খাতাটা আরেকবার পরখ করে দেখতে হবে বই কী। এভাবে শুধু শুধু তানুস্যারের কাছে হেরে যাওয়া ঠিক হবে না।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তানুস্যার খুব জনপ্রিয়। প্রকৃত নাম তানবির। শিক্ষকতা করে বীরত্ব দেখানো তাঁর মজ্জাগত অধিকার। সকলের কাছে সাদরে গৃহীত হতে হতে তাদের মূল্যায়নে প্রিয় তানুস্যার হয়ে উঠেছেন। এসব মিস্টার শাহিন এর কাছে এতটুকু অজানা ছিল না।
এতদিনের সংসারযাত্রা সামলে লিজা খুব ভালো করেই জেনে ফেলেছিল যে মনের গভীরে কোনো ইচ্ছা একবার পেয়ে বসলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লোকটা ভীষণ দোলাচলে থাকে। দূর পথে হাঁটতে হলেও কোনো ক্লান্তি অনুভব করে না, বরং মনের গোঁ’তে পড়ে থাকতে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা জীবনকে কত বেশি নাকাল করে তুলতে পারে, এখনও তার পক্ষে তা শেখা সম্ভয় হয় নি। মূল সমস্যা সেখানেই। লিজা এসব বেশ বুঝতে পারে কিন্তু কিছু করার নেই বলেই চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়।
মিস্টার শাহিন অত্যন্ত গম্ভীর মুখে পায়ে পায়ে সামনের রাস্তা অতিক্রম করছেন। তখনও আটটা বাজে নি কিন্তু রোদের উত্তাপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাতাসে বিশ্রী গুমোট আদ্রতা। প্রকৃতির ভাবচেতনা মিস্টার শাহিনের ভিতরের দুরাবস্তা প্রকাশ করে দিচ্ছিল। বিক্ষিপ্ত চলমান মেঘের ফাঁক গলে মাঝে মাঝে রোদের প্রহেলিকা মাটির বুকে ছিটকে পড়ছে। মিস্টার শাহিনের একটাই ভাবনা, তানুস্যারের মন থাকলে বুঝত, এ ঘটনায় তিনি কতটা বিচলিত হয়ে উঠেছেন। ব্যস্ততা কখনো কখনো মানুষের জীবনে ক্লান্তির মূল কারণ হয়ে ওঠে। গম্ভীর শাহিন হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলেন। রাস্তার ধারে প্রাচীন বটগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বয়সে এত পুরনো যে কবে মূল শিকড়গুলো হারিয়ে ফেলেছে, নিজেই তা জানে না। শাখা প্রশাখা থেকে নেমে এসেছে অসংখ্য ঝুরি যেগুলো মাটির ভিতরে ঢুকে বটগাছটাকে শিকড়ের শক্তি যোগান দিয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষের হালফিল ধারণা, সেগুলিই ওই গাছের প্রধান শিকড় বাকড়। একটা ইতিহাস থেকে অন্য ইতিহাসের জন্ম হয় সেভাবেই কিংবা খন্ড খন্ড ছোটো ছোটো ইতিহাসপঞ্জী নিয়ে একটা মস্ত বড়ো ইতিহাস বেঁচে থাকে মানুষের সমাজে।
মিস্টার শাহিন বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছেন। ডান হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে কাছের ঝুরিটাকে সজোরে জাপটে ধরলেন, চলমান সমাজের কলেবরে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রাচীন বটগাছ বলে ভাবতে এতটুকু কুণ্ঠা করলেন না। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজন তাঁর কাছে ঠিক যেন ঝুরির মতো। তাদের উপর নির্ভর করে এতদিন সমাজের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াতে সক্ষম হয়েছেন। কোনো বাড়তি চিন্তার চাপ নিতে হয়নি তাঁকে। মূল শিকড় না থাকা শতাব্দী প্রাচীন ঝুরিনির্ভর বটগাছের মতো তিনিও প্রিয় সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে দিন পার করে আসছেন। তাঁকে তো তানুস্যারকে নিয়ে কোনো প্রয়োজন অনুভব করতে হয় নি?
রূপক ভাবনার জেরে মিস্টার শাহিন ডান হাতের কবজির জোরে সরু ঝুরিটা নাড়াতে শুরু করলেন। বেশ বুঝতে পারলেন, সবেমাত্র মাটি ধরেছে বলেই তত জোর নেই। হ্যাচকা টান দিতেই ঝুরিটা মাটির ভিতর থেকে দিব্যি উঠে এল। নিজস্ব ভাবনায় সাগরতুল্য শাহিনের মুখে এক চিলতে হাসি। যেন খুব সহজেই সমাজের বুকে তানুস্যারের শক্তিটুকু বুঝে নিতে পারলেন। ঠিক সরু ঝুরির মতো দুর্বল অথচ তিনিই তার একমাত্র পুত্র শুভদিনকে এভাবে ক্ষতি করে দিতে পারলেন? একটা কঠিন সিদ্ধান্তে দুলতে লাগল তাঁর মন। চলমান সমাজে দাপটের সঙ্গে চলতে গেলে অন্তত তানুস্যারের কোনো সাহায্য যে লাগবে না, তাও আরেকবার ভেবে নিলেন।
অসময়ে সব মানুষ এভাবে নিজের মতো করে পথ খুঁজে পেতে চায়। শুধু বুদ্ধিতে নয়, নিজের উপলব্ধির শিকড় বাস্তবের মাটির কতটা গভীরে রয়েছে, তা একবারও ভেবে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে না। মনের অন্ধ গলিপথ ধরে হেঁটে চলাকেই একমাত্র পাথেয় হিসেবে ভাবে। সেই উপলব্ধির জোরে মিস্টার শাহিন লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে চলেছেন। তাঁকে আজ সব খুলে বলতে হবে তানুস্যারকে। উনি কী এভাবে অতীতের সব উপকার ভুলে যেতে পারেন? সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধটুকুও নেই। ছাত্রছাত্রীদের জীবনে শিক্ষকরা সব সময় অনুসরণীয় মডেল, পুজ্য দেবতা, তাদের কল্পিত জগতের মস্ত বড়ো কাট-আউট। তানুস্যার কী সে সব ভুলে গিয়েছেন? কোনো অফিসে চাকরি করছেন বলে কী ভাবছেন? চাকরের কাজকে চাকরি বলে। শাহিনের ভাবনায়, শিক্ষকের সেবা ধর্মে শুধুমাত্র চাকরির সাধারণ মানদন্ড থাকতে পারে না, তার ভিতরে আরও অনেক বড়ো কিছু রয়েছে। নিঃস্বার্থ সেবা, সহনশীলতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা নিয়েই শিক্ষক জীবন। শিক্ষককে সেই কারণে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়ে থাকে। তানুস্যার কী সে সব ভাবতে পারছেন না?
মনে মনে শাহিন এত বিরক্ত হয়ে উঠেছেন যে সাধারণ সৌজন্য হারিয়ে সরাসরি তানুস্যারের বারান্দায় উঠে ফিজাকে সামনে পেয়ে বললেন, তোর বাপি কী বাড়িতে নেই?
ওই চেয়ারে বসুন। ভিতরে ঢুকে বাপিকে ডেকে আনি।
বসতে আসি নি রে, তোর বাপির সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।
বাপি তো খুব অসুস্থ, গায়ে ভীষণ জ্বর, ঘরের ভিতরে শুয়ে আছে।
এসব কী বলছিস তুই? দু’দিন পরে পরীক্ষার ফল বের হবে, আর তোর বাপি অসুস্থতার ভান করে ঘরে শুয়ে আছেন?
সত্যি সত্যি খুব জ্বর, ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন।
তানুস্যার শরীরের কম্পন উপেক্ষা করে বিছানার উপর উঠে বসলেন। —ভিতরে আসুন শাহিনদা। মেয়ে ফিজাকে বললেন, তোর কাকুর জন্যে চেয়ারটা সরিয়ে দে মা।
ফিজা জানে, কাকু যে বিদ্যালয়ের সম্পাদক, তার বাপি সেই স্কুলের শিক্ষক। আগেও বেশ কয়েকবার তাদের বাড়িতে আসতে দেখেছে। বাপির সঙ্গে কথা শুরু হতেই লিজা পাশের বাড়িতে চলে গেল।
তানুস্যার বললেন, তারপর কী মনে করে এসেছেন বলুন?
কারণটা জিজ্ঞেস করে কী আমাকে সামনাসামনি আরও ছোটো করে দিতে চাচ্ছেন? শিক্ষকতা পেয়ে সবার আগে আমাকেই ভুলে গেলেন? আমার স্বর্গীয় পিতা কীভাবে আপনার পাশে ছিলেন, তাও একবার স্মরণ করতে পারলেন না? শুধু ভাবছি, এসব মনে থাকলে আমার ছেলের উপর এত বড়ো কোপ মারতে পারতেন না।
এসব কী বলছেন শাহিনদা?
কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানেন না। আমার ছেলে আপনার কী এমন ক্ষতি করেছে যে নিজের হাতে এত বড়ো শাস্তি দিতে পারলেন? আপনি শিক্ষক, বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আপনার কাছে ছেলেমেয়ের মতো। কেবল আমার ছেলেকে সেভাবে ভাবতে পারেন নি? এ্যাপয়েন্টমেন্ট হাতে পেয়ে নিজে থেকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাও ভুলে গেলেন? শিক্ষকতার একটা নিজস্ব আবগে রয়েছে যেখানে ছাত্র-শিক্ষক মিলে পিতা-পুত্রের মতোই। তা ভুলে মিলিটারি কমান্ডার হয়ে গেলেন?
আপনি বিদ্যালয়ের মাননীয় সম্পাদক। সুচারু মনোভাব নিয়ে এতদিন যেভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করছি। যা নিয়ে বলতে এসেছেন, সেই উদ্ভুত বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার অনুরোধ করতে পারি কী? আমার কী মনে হয়েছে জানেন? আপনার ছেলেকে ভবিষ্যৎ সর্বনাশ থেকে বাঁচাতে পেরেছি বলেই বেশ গর্ব অনুভব করছি। ফারদিন সবে তো…।
প্লিজ, ওই নামে ডাকবেন না, শুভদিন বলুন।
তা না হয় বললাম। ও তো সবে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। এখন থেকে নকল করে পাশ করার অভ্যেস গড়ে উঠলে ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকবে না। এসব নিয়ে একবারও ভাববেন না ?
সেই সুযোগটুকু দিলেন কোথায়? তার আগেই তো সব ভাবনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
আমাকে নিয়ে এত বড়ো মূল্যায়ন কেউ করে নি শাহিনদা। নিজের ছেলের জন্যে নির্মম সত্যটুকু নিজের মুখে বলে দিতে পারলেন, সেজন্যে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে দ্বিতীয় গৃহ যেখানে আমরা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকি। সেই অর্থে তাদের ভালোমন্দ নিয়ে ভেবে দেখার অধিকার নিশ্চয় আমাদের আছে।
তাই ভেবে কী শুভদিনের বাংলা খাতা এভাবে কেড়ে নিতে পারলেন? তাতেই খুশি হতে না পেরে মারধর করে শুভদিনকে পরীক্ষার হল থেকে বের করেও দিতে পেরেছেন? এসব কী একজন সহশিক্ষকের অধিকারের মধ্যে পড়ে? আমার কী মনে হয় জানেন? আজকাল টিভিতে রেডিওতে খবরের কাগজে ছাত্র পিটিয়ে শিক্ষকদের জেলে যাবার যেসব খবর শুনছি তার ভিতরে একটা সামাজিক সত্য লুকিয়ে রয়েছে।
শাহিনদা, এটুকু জেনে এত খুশি হতে পারলেন? কেন এসব ঘটেছে, তা নিয়ে এতটুকু ভাববেন না? মুখ বাদ দিয়ে এ তো শুধু মুখোশ নিয়ে টানাটানির খেলা। পিছনে অন্য প্রসঙ্গ লুকিয়ে রয়েছে। সেই মূল প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাববেন না?
কী বলতে চাচ্ছেন আপনি?
একটা অন্য পরিসংখ্যান শোনাচ্ছি আপনাকে। টিভিতে, খবরের কাগজে আরেকটা অভিনব খবর জেনে আমরা কী বিচলিত হতে পারি না? চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা এত বাড়ছে কেন, তা নিয়েই তো ভাবতে হবে।
তার সঙ্গে শুভদিনকে পেটানোর কী সম্পর্ক আছে?
আছে বই কী ? যে বাবা-মা ছেলেদের উচ্চশিক্ষার জন্যে এত কিছু করছেন, তারাই শেষ পর্যন্ত পিতা-মাতাকে দেখছে না। আন্তরিক নির্যাস দিয়ে গড়ে তোলার অন্তরাল বেয়ে এ কুফল নিয়ে ভাববেন না? তাই বিনীত অনুরোধ, শুভদিনকে এখন থেকে প্রকৃত সংবেদনশীলতা শেখাতে আপনাকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
থামুন মশাই, লম্বা চওড়া কথা বলে শুধু শুধু নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করবেন না।
তানুস্যার হতভম্বের মতো চেয়ে থাকলেন সম্পাদক শাহিনের দিকে। হঠাৎ রেগে যাওয়ার সংগত কারণ খুঁজে পেলেন না। পাবেন কী করে? দু’জনের পথ যে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সম্পাদক শাহিন আধুনিক বাঙালি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। রাজনীতি করেন। যথেষ্ট লোকবল রয়েছে। তাই তানুস্যারের সংবেদনশীল কথাবার্তা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। মেনে নেওয়া কী এতই সহজ? এদেশে ব্যক্তিগত প্রভুত্বের মধ্যে দ্রুত গণতান্ত্রিক বোধ হারিয়ে যায়, গড়ে ওঠে একনায়কতন্ত্রের অদ্ভুত একগুঁয়েমি। ইতিমধ্যে শাহিনের তা অর্জন করা হয়ে গিয়েছিল। রাগে গর গর করতে করতে বললেন, আপনার সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করতে আসি নি স্যার। মানলাম, আমার ছেলে নকল করেছে বলেই আপনি তার খাতা কেড়ে নিয়েছেন। তার পরেও শুভদিনের গায়ে হাত তুললেন কেন? এটাও কী মেনে নিতে হবে? ছাত্র পেটানোতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে পরীক্ষার হলে সেই লোভ সামলাতে পারলেন না। ভাবছেন কী, মাস্টারমশাইরা স্কুলে যাবেন স্রেফ ছাত্র পেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে? তাদের মধ্যে অন্য কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না?
ভুল ব্যাখ্যা করছেন শাহিনদা। কোনো ছাত্রকে প্রহার করে বাড়িতে ফিরলে সেই শিক্ষকের মনের অবস্থা কেমন হয় জানেন? ভিতরে ভিতরে দুঃখের বন্যায় ভেসে যেতে থাকেন, নতুন করে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন। পরের দিন স্কুলে যাবার পর থেকেই সেই রূপায়ণ শুরু হয়ে যায়। ক্রমপর্যায়ে বড়ো করে তোলার স্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠতে থাকে। তখন নিজের ফেমিলির কথাও মনে থাকে না। জীবন গড়ার কারিগরের ভূমিকায় আরও বেশি করে সঁপে দিতে হয় নিজেকে।
শাহিনের হতবাক প্রশ্ন, আবেগে ভেসে একটা উদ্ভট প্রসঙ্গ বেশ তো সামনে আনতে পারলেন।
উদ্ভট বলছেন?
তাহলে তো সব ভুলে আমার ছেলের জন্যে একটা ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হয়।
আপনার মতো অভিভাবকদের জন্যে আজকাল যত্রতত্র মূল পদ্ধতির অপপ্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে শাহিনদা। অকারণে জোর করে স্কুলে ঢুকে পাড়ার দাদা, কাকা আর উঠতি মাস্তানরা শিক্ষক জীবনে গড়ে তোলার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। কোথাও দেখছি, শিক্ষককে হেনস্থা করা হচ্ছে নিজেদের প্রতিবাদি ইমেজকে বড়ো করে তোলার জন্যে। এমন কী শিক্ষকের বিরুদ্ধে থানা ফাড়ি করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। আপনিই বলুন, একজন শিক্ষকের মানবিকতাকে এভাবে আইন দিয়ে কী বেঁধে রাখা যায়? ছাত্রের মারের আঘাত গুরুতর না হলেও তা গুরুতর করে তুলতে টাকার বিনিময়ে ডাক্তারের ভুয়ো সার্টিফিকেট পেতেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এসব ডাক্তাররা কী শিক্ষকদের কাছে পড়েন নি? এমনি এমনি ডাক্তারি বিদ্যে শিখে ফেলেছেন? এতে কী হচ্ছে জানেন? ছাত্র-শিক্ষকের কোমল নরম সম্পর্ক দিন দিন কঠিন, দুর্গম আর বিকৃত হয়ে উঠছে।
শাহিনের মুখে বিচিত্র হাসি, মৃদুস্বরে বললেন, আপনি যে এভাবে নাটক করতে জানেন, তা আমার জানা ছিল না।
মোরালিটির উপর কথাগুলোকে নাটক বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন? মনে রাখবেন, তার ভিতরে জীবনের বাস্তব সংলাপ লুকিয়ে রয়েছে। চলার পথে এইসব নির্মম সত্য উঠে এসেছে। এগুলো বাদ দিয়ে জীবনকে শুধু শরীর নির্ভর করে তোলা কী সুবিবেচনার হবে?
কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? জীবনযুদ্ধের অনুভূতিগুলো কেবল আপনিই বোঝেন, আমরা সে সবের কিছুই বুঝি না?
যদি মনে করেন, কিছুই বোঝেন না, সেটা আপনার নিজস্ব অনুভূতি, ব্যক্তিগত উপলব্ধি। তাতে যেমন আমার আপত্তি থাকতে পারে না, তেমন সমর্থনও করতে পারি না। তবে একটা প্রসঙ্গ ভুলে যাবেন না, হাটে বাজারে আলু পেঁয়াজ পটলের মতো শিক্ষা বিক্রি হতে পারে না। গভীর অধ্যবসায় আর অনুশীলন দিয়ে তা অর্জন করতে হয়। এ প্রক্রিয়া চলে সারা জীবন ধরে। পর্বে পর্বে শিক্ষার তাৎপর্য নতুন রূপে ধরা পড়ে, আমরা তখন চারপাশের মানুষকে নতুন করে জানতে পারি যা অন্যদেরকেও জানিয়ে স্বস্তি অনুভব করা যায়। যেমন আজ আপনি এসেছেন আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে নতুন করে পূর্ণ করে দিতে। এখন শুধু ভাবছি, আপনার কাছ থেকে আরও অনেক কিছু শেখার আছে।
সম্পাদক শাহিন আর রাগ সামলাতে পারলেন না। বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার ছেলে যে আপনার ছাত্র, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না কিন্তু তাই বলে আমাকে ছাত্র হিসেবে ভাবছেন নাকি? যদি তা ভেবে থাকেন, তার চেয়ে বড়ো ভুল আর কিছুই হতে পারে না। যদি না ভেবে থাকেন, এসব ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলে আমাকে ছোটো করতে চাচ্ছেন কেন? সম্পাদক সহশিক্ষকের সম্পৰ্কটুকু ভুলে গেলেন?
প্লিজ, এভাবে রেগে যাবেন না। যদি মনে করে থাকেন, আমার কথায় কিছু শেখার আছে, তা না হয় খুব মনোযোগ দিয়ে শিখে নিলেন। যত দিন বাঁচি, তত দিন শিখি—এ সূত্র গ্রহণ করে যে কোনো মানুষ আরও বাড়তি জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন। অবশ্য এ প্রবাদ বাক্য প্রথম কে আবিষ্কার করেছিলেন, তার নাম আমি আজও জানি নে। জানা থাকলে আমাকে বলে সাহায্য করতে পারেন, সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। যিনি শেখার মতো কিছু বলেন, তিনিই তো গুরু। সেই গুরুত্বকে জীবনে কোনো দিন অস্বীকার করতে শিখি নি।
আমার সামনে এত বড়ো বড়ো কথা বলতে ভয় করছে না আপনার? দু’জনের পারস্পরিক সম্পর্কটুকু ভুলে যান নি তো?
তা ভুলতে পারি কী? আপনার পিতামহের টাকায় এ বিদ্যালয় প্রথম গড়ে উঠেছিল। আপনার পিতার হাত থেকে এ্যাপোয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। হয়তো সেই কারণে আপনি খুব করে আশা করেছিলেন, আপনার কথা মেনে চলা আমার উচিত কাজ হবে কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না বলেই নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।
বেশ নাটুকে কথা বলতে শিখেছেন স্যার। আপনিই আমার ছেলের চরম ক্ষতি করে দিয়েছেন, তার পরেও নাটক করে ক্ষমার প্রসঙ্গ টেনে আনছেন? ভিতরে ভিতরে এত বড়ো খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন? আপনাকে তিনটে শর্ত দিয়ে যাচ্ছি, কেবলমাত্র সেই পথে নিজের সমাধানসূত্রটুকু খুঁজে পেতে পারেন।
বলুন, অন্তত শুনে নিতে তো কোনো অসুবিধা নেই।
আপনিই শুভদিনের খাতা নিজের হাতে কেড়ে নিয়েছেন, সেই হাত দিয়ে আমার ছেলেকে পাশ করানোর সব দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। আমি জানি, আপনি তা পারবেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আপনার উপর কত বেশি নির্ভরশীল, তাও আমার অজানা নয়। আশা করি, আপনি অনুরোধ করলে উনি না করতে পারবেন না। এখনও চাচ্ছি, এ পথে আমাদের দু’জনের পূর্ব সম্পর্ক নতুন করে গড়ে উঠুক। তাই গভীর প্রত্যাশা, স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে সেই লক্ষ্য থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হতে যাবেন না। দ্বিতীয় বিনীত অনুরোধ, বেড়ে ওঠার পথে শুভদিন আবার কোনো অন্যায় করলে ওর গায়ে হাত তুলবেন না। আপনার মতো যশস্বী শিক্ষকের এসব না করাই ভালো। তাছাড়া ও যদি কিছু করে থাকে, সে বিচার আমিই করব, আপনি নন। শিক্ষক বিচারক হতে চাইলে আইন জানার ঘরে যে গ্যাপ থেকে যায়, তা নিয়েও জেনে দেখতে অনুরোধ করছি।
তৃতীয় প্রস্তাব আপনার পক্ষে মেনে নেওয়া আরও সুলভ। দোকানের হিসেবের খাতা বলছে, আজ পর্যন্ত আমার দোকানে আপনার নামে ত্রিশ হাজার টাকা বাকি পড়েছে। এসব সম্পূর্ণ মকুব করে দেব যদি শুভদিনকে শুধুমাত্র পাশ করিয়ে দিতে পারেন।
শেষে একটাই অনুরোধ, সব জেনে-শুনে উল্টো দিক খেলতে যাবেন না।। আমিও তো মানুষ, ভিতরে যেমন দয়া-মায়া রয়েছে, তেমনি রাগও থাকতে পারে। আমাকে অকারণে রাগ করতে সাহায্য করবেন না। ভুলে যাবেন না, বিদ্যালয়ের শাঁসালো সম্পাদক হিসেবে আমিও অনেক কিছুই করতে পারি যদি তা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্লিজ, আমাকে বাড়তি পরিশ্রমের পথে ঠেলে দেবেন না স্যার।
আমার মতো তুচ্ছ মানুষের উত্তর শোনার জন্যে এত সময় নষ্ট করতে যাবেন না শাহিনদা।
তাহলে কী এখনিই জানিয়ে দেবেন?
একটু ওয়েট করুন, আমাকে শুধু দু’কলম লিখতে দিন।
আমার প্রস্তাব নিয়ে পরে ভেবে দেখতে পারতেন।
ওসব ভাবা হয়ে গেছে শাহিনদা। সেটাই আপনাকে লিখে জানাতে চাচ্ছি। কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করতেই হবে, প্লিজ।
সম্পাদক শাহিন কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলেন। ভাবলেন, তানুস্যার ক্ষেপে গেলেন না তো? এখনিই উত্তর দিতে হবে, সেই মাথার দিব্যি তো ওঁকে দিইনি। মানতেই হবে, তানুস্যার বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রভূত জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাহলে কী নিজেই ভুল করে ফেললাম? চিন্তার স্রোতে জট পাকানো বিপরীত ভাবনার ঢেউ এদিক সেদিক করতে লাগল।
তানুস্যার টেবিল থেকে পেন নিয়ে লিখতে শুরু করলেন—
মাননীয় সম্পাদক
বনবিবি উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক)
মহাশয়,
আজও ভুলে যাই নি, আপনার পিতা প্রথম আমার হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়েছিলেন। তা কোনোদিন অস্বীকার করতে পারব না। এটাই কঠোর বাস্তব যে চাকরি পাওয়ার সূত্রে এতগুলো বছর বেশ স্বাচ্ছন্দে দিন অতিবাহিত করতে পেরেছি কিন্তু একবারও ভেবে দেখিনি যে পিতার উপকারকে সামনে এনে একটা তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাকে এভাবে বাধ্য করানোর জন্যে উদ্যোগ নিতে পারেন। যা কখনো ভাবি নি, বাস্তব ঘটনা স্রোত সেদিকেই এগিয়ে চলেছে। ফলে নিজস্ব শিক্ষক সত্তা এবং আপনার চাহিদার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। ভুলে যাবেন না, আমি একান্তভাবেই একজন শিক্ষক। আপনার দাবি মেনে নিলে পরবর্তী সময়ে পঠন-পাঠনের উপর কতটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে, তা বেশ বুঝতে পারছি। একটা না সূচক প্রচলন শুরু হলে আগামি দিনে তা চরম বিপদের হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃত সত্য বাদ দিয়ে অভিভাবকরা সেই দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করতে চাইবে। তাই শুভদিনকে নিয়ে কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারলুম না। হয়তো ভাবছেন, একটা ঘটনায় একটু নরম হলে কী এমন অসুবিধা হত। শিক্ষা এবং শিক্ষাঙ্গনের স্বার্থে সেই মনোভাবও মেনে নেওয়া সম্ভব হল না। একটু কঠোর কঠিন হতেই হল।
একটাই সান্ত্বনা, যতদিন বিদ্যালয়ে ছিলাম, কোনো আপস না করে একটা নির্দিষ্ট মানদন্ড ধরে রাখতে পেরেছি। এতে যে আপনার যথেষ্ট বদান্যতা ছিল, তাও কিছুতেই অস্বীকার করতে পারি না। সেই ঋণ আমি উদাত্ত চিত্তে স্বীকার করছি। এতদিনের ভালবাসা ও ভাললাগার কর্মস্থল ছেড়ে আসতে কষ্ট হলেও কেবল আপনাকে যথেষ্ট মূল্য দিতে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম। একটা সত্যি মনে রাখবেন, শুভদিন আমার প্রিয় ছাত্র, তাকে শাসন করে জীবনের প্রকৃত অভিযোজনে এখন থেকে অভ্যস্ত করে তুলতে চেয়েছি কিন্তু আপনি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই স্বাধীনতা আপনার আছে বলে মনে করি কিন্তু নিজের শিক্ষক জীবনের স্বাধীনতা ত্যাগ করে আপনার ইচ্ছাধীন স্বাধীনতাকে গ্রহণ করা কিছুতেই সম্ভব হল না। শেষে আপনার প্রতি ঋণ স্বীকার করে এবং শুভদিনকে প্রাণভরা আশীর্বাদ দিয়ে কলম থামিয়ে দিলাম।
বিনীত—
মির্জা তানবির, সহশিক্ষক,
বনবিবি উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক)
দাম্ভিক সম্পাদক শাহিন পত্রটা হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে স্তম্ভিত না হয়ে পারলেন না। তানুস্যার অবলীলায় এতটা সাহস দেখাতে পারলেন? এতদিন দু’জনের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল, তা নিয়ে এতটুকু ভাবার অবকাশ পেলেন না? তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন? আসার সময় সরু ঝুরিটা উপড়ে ফেলার মধ্যে যে আনন্দ পেয়েছিলেন, তাও নিরর্থক বলে মনে হতে থাকল। মনে মনে একবার ভাবলেন, তানুস্যারের জন্যে যে বিদ্যালয়ের সুনাম যথেষ্ট বেড়েছে, তা কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না কিন্তু তাই বলে কী তিনি নিজেকে বিকল্পহীন ভাবতে পারেন? কেবলমাত্র সেই জোরেই কী পদত্যাগ করে বসলেন? আবেগে পদত্যাগ করার পরে আর্থিক অনটনের ধাক্কা নিয়ে একবারও ভাবতে পারলেন না কেন? একটা জটপাকানো অবস্থান শাহিনের মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেতে লাগল। তো তো করে বললেন, পরবর্তী সময়ে কীভাবে দিন চলবে, তা নিয়ে কী ভেবে দেখেছেন?
স্থির সিদ্ধান্ত নিতে কোনো ভুল করি নি শাহিনদা। মানছি, আপনার পিতা নিয়োগপত্র দিয়ে আমাকে ঋণজালে জড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু সেই কারণকে সামনে এনে আপনি কী পারেন কেবলমাত্র নিজের ছেলেকে বাঁচাতে সুদে আসলে সব কিছু আদায় করে নিতে? শিক্ষকদের একটা নিজস্ব জীবনবোধ রয়েছে যেখানে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা আপনার অধিকারের মধ্যে পড়েনা, তা নিয়ে একবারও ভেবে দেখেছেন কী? দোকান বাকি পরিশোধের জন্যে যে সস্তা পথ বাতলে দিয়েছেন, তা কী একজন আদর্শ শিক্ষকের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? আমাকে এতটাই দুর্বল ভাবছেন? সমাজের দুর্বলতম ব্যক্তিরা তো দায়ে পড়লে নিজেদের ঋণভার থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তাহলে আমি পারব না কেন? কথা দিচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সমস্ত দোকান বাকি পরিশোধ করে দেব।
আপনি যে খুব স্বনামধন্য শিক্ষক, তা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। সেই শক্তি নিয়ে কী আপনি বিদ্যালয়ের সম্পাদককে শৃঙ্খলিত করতে চাচ্ছেন? শুনে রাখুন স্যার, একমাসের মধ্যে আপনার শূন্যপদে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করব। এও জানিয়ে রাখছি, শুভদিনের পড়াশোনার দায়িত্ব আর আপনাকে নিতে হবে না। এতদিন আপনি ছিলেন শুভদিনের গৃহ শিক্ষক, সেই দায়িত্ব নিশ্চয় আর আপনার উপর ছেড়ে দিতে পারি না। আপনার শূন্য পদে যিনি আসবেন, শুভকে বড়ো করার দায়িত্ব তাকেই অর্পণ করব, তারপরেও একটা বড়ো প্রশ্ন থেকে যায়। পরীক্ষার হলে বসে যে ছাত্র এত বড়ো ভুল করল, তার জন্যে শিক্ষক হিসেবে আপনি কোনো দায়িত্ব নেবেন না? এগারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত শুভদিন আপনাদের তত্ত্বাবধানে থেকেছে। তার মধ্যে যদি কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়ে, ভাবতেই হবে, আপনাদের শিক্ষাদানের ফাঁক গলে তা সম্ভব হয়েছে। জানি, পরীক্ষার হলে টুকলি করার প্রবণতা বেড়ে গেলে তার পরোক্ষ দায় সম্পাদকের উপর এসে পড়বে। ঠিকমতো বিদ্যালয় চালাতে পারছি নে, সেই অভিযোগও উঠবে। সেজন্যে শুভদিনকে বড়ো করে তোলার জন্যে অন্য ব্যবস্থার কথা ভেবে ফেলেছি স্যার। কথা দিয়ে যাচ্ছি, প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হলে আপনাকে অবশ্যই মিষ্টি খাইয়ে যাব।
এ তো পরম আনন্দের খবর শাহিনদা, বিশেষ করে আমার কাছে। নদীর নিজস্ব স্রোত বুকে জড়িয়ে নানা কিছু নিয়ে এগিয়ে চলে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জীবনও সমান তালে এগিয়ে চলে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা স্বপ্ন বুকে নিয়ে। তাদের শ্রীবৃদ্ধি, সংশোধন, পরিবর্জন—সবেতেই শিক্ষকের কল্যাণ-ইচ্ছা জড়িয়ে থাকে। পরম করুণাময়ের কাছে কামনা করি, শুভদিন প্রতি বছর পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করুক। এজন্যে অবশ্য কষ্ট করে আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে আসতে হবে না। শুধু খবরটুকু জানতে পারলে খুব গর্বিত হব। আরেকটা কথা শুনে নিন, একজন ছাত্রের নকল করা নিয়ে যেভাবে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে দায়ি করলেন, আদপে তা কিন্তু বাস্তব নয়। ভুলে যাবেন না, শিক্ষকরা শুধু গড়তে পারেন, এতটুকু ভাঙতে পারেন না।
স্যার, সুযোগ পেয়ে আমাকে কী ছাত্র বানিয়ে ফেললেন? অনেক বড়ো বড়ো কথা শুনতে হচ্ছে আমাকে। এতটাই দুর্বল ভাবছেন? এ বিদ্যালয় গড়ে তুলেছি আমরা অথচ সুযোগ পেয়ে কেবল শুভদিনের জন্যে আমাকে যথেষ্ট ভৎর্সনা করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। আর রাগ সামলাতে পারলেন না সম্পাদক শাহিন। দাঁতের উপর দাঁত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, সুযোগ পেলে আপনার বিষদাঁতগুলো যদি ভাঙতে না পারি তো আমার নাম…।
শাহিনদা, এভাবে ক্রোধ প্রকাশ করবেন না। আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন না তো? রাজনীতিকরা এসব করে থাকেন। আপনিও সেই সূত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। যথেষ্ট লোকবল রয়েছে। কেবলমাত্র সেই কারণে আপনার মধ্যে যখন তখন যথেষ্ট ক্রোধ প্রকাশ পেতে পারে, এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। আই মিন, মাঝে মাঝে নিজেকে সান শাহিন করে তোলার জন্যে এসব করতেই পারেন। তাহলে শাহিন নামের সঙ্গে বৈশিষ্ট্যটুকু বেশ মিলে যেতে পারে আর কী। শেষে একটা প্রবাদবাক্য আপনাকে শোনাই— সব ভালো যার শেষ ভালো। যে প্রস্তাব নিয়ে আমার বাড়ি পর্যন্ত এসেছেন, রাত গভীর হলে একা একা একটু ভাববেন, দেখবেন, নতুন পথ পেয়ে গিয়েছেন।
তানুস্যার যে এভাবে উদ্যত হয়ে কথা বলতে পারেন, তা বোধ হয় সম্পাদক শাহিনের মাথায় ছিল না। একটা চরম প্রতিহিংসা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন কিন্তু বিপরীত ফলাফল দেখে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, মনের পটে মাত্র একটাই বাক্য লেখা হতে থাকল, তার ছেলের জন্যে এটুকু করলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? এক অদ্ভুত প্রকৃতির শিক্ষকের পাল্লায় পড়তে হল তাঁকে। বিদ্যালয় সম্পাদকের সম্মান রক্ষার জন্যে এতটুকু তাগিদ নেই ভিতরে।
তানুস্যার বারান্দার এক ধারে নিথর পায়ে দাঁড়িয়ে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকলেন উদ্যত শাহিনের দিকে। সম্পাদকের পদটা কী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল? শিক্ষকদেরকে এত সস্তা হিসেবে ভাবতে পারছেন উনি? একমাত্র মেয়ে ফিজা এতক্ষণ পাশের বাড়ির উঠোনে প্রিয় সঙ্গীর সঙ্গে পুতুলপুতুল খেলছিল। তানুস্যার শুধু ভাবতে পারলেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কখনো কখনো অকারণে পুতুল খেলার মতো হয়ে ওঠে। মাননীয় সম্পাদক যেন সেটাই প্রমাণ করে দিতে পারলেন। শুভদিনকে নিয়ে তার মধ্যে স্বচ্ছ চিন্তার এতটুকু ঘাটতি ছিল না, তবুও সম্পাদক শাহিন সেটাকেই ঘুর পথে গ্রহণ করলেন। আর ভাবতে পারলেন না তানুস্যার। ফিজা এসে দাঁড়ালো তানুস্যারের সামনে—খুব খিদে পেয়েছে বাপি। খাতাটা দিলে শুভদের দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে আনতে পারতুম।
তানুস্যারের মধ্যে তখন অন্য হিসেব তরতরিয়ে বাড়ছে। গম্ভীর হয়ে বললেন, আর কোনোদিন ওই দোকানে যাবি নে। বাকি করে এটা-ওটা কেনার কী দরকার আছে শুনি? পরাধীনতার গ্লানিতে আর ডুবে যেতে ভালো লাগে না রে। বলতে বলতে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন।
ফিজা ভেবে পেল না, তার বাপি এভাবে কাঁদছে কেন? বিদ্যালয়ের সম্পাদকের সঙ্গে কী কোনো ঝগড়াঝাটি হয়ে গেল?
ফেরার পথে দাম্ভিক সম্পাদকের বুকে তখন এক অদ্ভুত মিশ্র ধারণা বার বার আছড়ে পড়ছে। চলতে চলতে আরও কিছু পরে পুরনো বটগাছের ছায়ায় এসে আবার থমকে দাঁড়ালেন। আসলে অসফলতার ঢেউ ভিতরে এত প্রবল হয়ে উঠেছে যে তাতেই নিজেকে বেশ বিবর্ণ লাগছে। বার বার ভাবছেন, হঠাৎ রাগে এভাবে পদত্যাগ করে তানুস্যার কী ঠিক কাজ করলেন? শুভদিনের জন্যে কোনো সুরক্ষা হল না, অথচ সেই টানাপোড়েনে তানুস্যারের মতো স্বনামধন্য শিক্ষককে হারাতে হল। পাশাপাশি আরেকটা সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গ বুদ্ধির ঘরে কয়েকবার ছ্যাকা দিয়ে গেল। তাহলে কী তানুস্যার অত্যন্ত সুকৌশলে পদত্যাগ করলেন তাঁর মাথা নত করে দিতে? ভাবছেন কী, সেই দুর্বলতায় তাঁর পদত্যাগ পত্র আমি গ্রহণ করতে পারব না? ভিতরে রাজনীতির খেলায় এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছেন? এতদিন যারা তাঁকে কেবলমাত্র কর্মদক্ষতার কারণে সাগর বলে ডেকে আসছে, তাদের সেই ধারণা মিথ্যে হয়ে যাবে?
সম্পাদক সাগর শাহিন বড়ো বটগাছের ঝাঁকড়া মাথার দিকে তাকিয়ে আনমনে একটু হাসলেন। যাবার পথে উপড়ে ফেলা সরু ঝুরিটা আবার হাতের মুঠোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। এত বড়ো গাছের জীবন থেকে একটা সরু ঝুরি উপড়ে ফেললে কিছু এসে যাবে না। আরও অনেক মোটা ঝুরি রয়েছে, যেগুলোর শিকড় মাটির অনেক গভীরে। ভিতরে ভিতরে সম্পাদকের রাগ বাড়ছে তলে তলে। কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখলেন। দু’হাতের দশ আঙুল দিয়ে মাত্র কয়েকটা মোচড়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেললেন সরু ঝুরিটাকে। ভাবলেন তাঁকে বড়ো বটগাছের মতো চলতে হবে সমাজের বুকে। মানুষের জীবনে প্রতিরূপের সংলাপ কী এমনিই হয়? তানুস্যার তো সমাজের বুকে সরু ঝুরি ছাড়া কিছুই নয়। একজন দাপুটে সম্পাদকের সামনে এভাবে তেজ দেখানোর কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কী তাঁর? কেবলমাত্র মানসিক উদারতার কথা মনে রেখে স্থানীয় অনুগামিরা তাকে সাগরদা বলে সম্বোধন করে। সেই বোধটুকু বোঝার ক্ষমতাও তানুস্যারের নেই। সমাজের সরু ঝুরি হয়ে ভাবছেন, সকলকে তার উপর নির্ভর করে চলতে হবে। যত সব…। শুধু শুধু বক্ বক্ করতে শিখেছেন। তারপর মুখটা বাঘের মতো করে বিড় বিড় করে বললেন, কী ভেবেছেন উনি? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন অতলান্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন বলেই। তার ভিতরেও রয়েছে বৈচিত্র্যের সীমাহীন বিস্তার। সব মিলিয়ে হাজার গন্ডা বিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র তিনিই সান সাইন সম্পাদক।
[চলবে…]