বিবর্ণ অভিযোজন: পর্ব ৩

উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।

।। তৃতীয় পর্ব ।।

বিজয় সামন্ত সম্পাদক সাগরের বাড়িতে গিয়ে অবাক না হয়ে পারলেন না। গ্রামেও এত ভালো এ্যারেঞ্জমেন্ট? সুসজ্জিত বসার ঘর। টেবিলের উপর রঙিন কাঁচ দেওয়া। জানালায় বাহারি পর্দা। টেবিলের একধারে রাখা হয়েছে ফুলদানি। তাতে লাল গোলাপ দেওয়া।
সম্পাদক সাগর কথার যাদুকর, নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে বললেন— একটু ভুল হয়ে গেছে, কিছু মনে করবেন না। ভাবছিলুম, আপনি পরের ট্রেনে আসবেন। তাই লোক পাঠানো সম্ভব হয়নি। গাবলুকে বলে রেখেছিলুম, ও যেন পরের ট্রেনটা আসার আগে স্টেশনে পৌঁছে যায়। বাইকে তো মাত্র মিনিট পাঁচেক লাগে। শেষ পর্যন্ত আপনাকে একা একা এভাবে আসতে হল। পথ চিনে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ভাবতে কেমন যেন লাগছে।
বিজয় সামন্তের মুখে মৃদু হাসি। কোনো অসুবিধা হয়নি সাগরবাবু। অবশ্য নামার পরে প্লাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেলে একটু অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল, সঙ্গে বড়ো ল্যাগেজ, স্টেশন চত্বরেও কাউকে দেখতে না পেয়ে…।
সম্পাদক সাগরের কৌতুহলী প্রশ্ন, তারপর?
অগত্যা প্লাটফর্মের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ডেকে নিলাম। কিন্তু পরে তাঁর জন্যে মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেয়েছি। অকপটে তা স্বীকারও করছি। এ কাজ করা আমার ঠিক হয়নি। আসলে তিনিও আমার মতো একজন শিক্ষক অথচ নিজের প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই তাঁকে…। একেবারে নতুন বিড়ম্বনা।
এ নিয়ে এত লজ্জা পাবেন না বিজয়বাবু। গ্রামে গঞ্জে রাস্তাঘাটে এরকম অনেককে দেখতে পাবেন। আপনার মতো ডিগ্রিধারী শিক্ষক হলে নিশ্চয় সামনাসামনি না বলে দিতেন। হয়তো বার বার ফেল মেরে পাশ করার পরে গ্রামের কয়েকজন বোখাটে ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর সুবাদে মাষ্টার শব্দটা নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন। মানে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার একটা পথ সস্তায় আবিষ্কার করতে পেরেছেন আর কী। এসব নিয়ে বিড়ম্বিত হতে যাচ্ছেন কেন?
খবরের কাগজের সাপ্লায়ার সত্যজিৎ কিন্তু অন্য কথা বলল।
ওই ফাজিলটার কথা ছাড়ুন। দু’দিন পরেই ওই আসবে খবরের কাগজ নেওয়ার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করতে।
বিজয় সামন্ত চুপ করে গেলেন। সম্পাদক সাগর ডাকতে শুরু করলেন, এই গাবলু, গেলি কোথায় রে? এখানে চা-বিস্কুট দিয়ে যা।
গাবলুর খুব বেশি দেরি হল না। ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল—আপনি কী খাবেন?
সকালে একবার খেয়েছি। তা দে আরেকবার। বিজয় সামন্তকে বললেন, খেতে শুরু করুন স্যার। গাবলু আমার বাড়ির কাজের লোক। ছেলেটা খুব ভালো। বেশ মন বুঝতে পারে। আপনার থাকার ব্যবস্থাটা ওকে করে দিতে বলেছিলাম। বোধহয় ঠিকঠাক করে দিয়েছে। হাঁরে গাবলু, স্কুলের পাশের ঘরটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছিস তো? ওখানেই আপনি আপাতত থাকবেন।
খুব সকালে গিয়ে রেডি করে দিয়েছি।
সাগরের মুখে মিষ্টি হাসি। বিজয়বাবুকে শুনিয়ে বললেন, সম্পাদকের বাড়িতে থাকতে থাকতে গাবলু দু-চারটে ইংরাজি শব্দ বেশ বলতে পারে।
বিজয় সামন্ত না হেসে পারলেন না।
গাবলুর উদ্দেশ্যে সম্পাদকের কড়া নির্দেশ, একটু পরে তোকেই যেতে হবে বিজয়বাবুর সঙ্গে। থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে আসবি। আপাতত স্কুল মেসে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি বিজয়বাবু। ইচ্ছা করলে পরে অন্য অবস্থান নিতে পারেন।
আগে শুরু হোক এভাবে।
বেশ বললেন আপনি, মর্নিং সোজ দ্যা ডে।
সদর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন কণ্ঠে কে একজন বলল, খবরের কাগজ।
গাবলু, কাগজটা এনে স্যারকে দে, কোলকাতার মানুষ, রোজকার জরুরী খবর জানতে না পারলে দিন চলে না।।
বিজয় সামন্ত বললেন, একটা ইংরেজি কাগজ নিতে হবে।
গাবলু, তাহলে কাগজওয়ালাকে ভিতরে ডাক্‌, স্টেটসম্যান নেবেন তো?
আমি ওই পেপারটাই পড়ি।
তানুস্যার গাবলুকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। বিজয় সামন্ত হতবাক না হয়ে পারলেন না। চিনতে ভুল হচ্ছে না তো? এই ভদ্রলোক তো তাঁকে সকালে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ওর ছাত্র সত্যজিৎ জানিয়েছিল, একজন আদর্শ শিক্ষক। চেহারায় হুবহু মিল রয়েছে। কিন্তু… উনি আবার খবরের কাগজ দিতে আসলেন কেন?
সম্পাদক সাগর সুচতুর মানুষ। সহজে বুঝতে পারলেন যে বিজয়বাবু তানুস্যারের গোলক ধাঁধায় পড়ে গিয়েছেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। আনমনে বললেন—ভদ্রলোককে চেনেন নাকি?
সকালেই তো উনি…
ভুল হচ্ছে না তো?
সামান্য সময়ের ব্যবধানে এত বড়ো ভুল হতে পারে?
সম্পাদক সাগর গম্ভীর হয়ে থাকলেন, তানুস্যারকে শেষ পর্যন্ত এই পথে নামতে হল?
ভয় পাবেন না সাগরদা। আপনার অভব্যতা ঢাকতে ভদ্রলোককে একটু সাহায্য করেছি মাত্র। তাতেই এত অবাক হচ্ছেন?
তাহলে তো আপনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। সাগরের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি।
ব্যঙ্গ করে হাসছেন তো? কুড়ি বছর আগেকার একটা স্মৃতি আপনাকে মনে করিয়ে দিই। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, বাঁচার প্রয়োজনে ও-নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেদিনও আমি এগিয়ে এসেছিলাম আপনার প্রাণ বাঁচাতে, কিন্তু কোনো বিনিময় দাবি করিনি। তুলনায় বিজয়বাবুকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসা অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তাতেই ধন্যবাদ না দিয়ে কৌশলে ব্যঙ্গ করতে চাচ্ছেন ?
তাহলে তো বিজয়বাবুর সামনে আমাকে আরেকটা প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই হয়।রক্ত দেওয়ার ঘটনা যখন উল্লেখ করলেন, নিজের মুখে নিজের উপকার পাওয়ার বিষয়টা বললে অন্তত আমি খুশি হতাম। আমার বাবা আপনাকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে আমাদের স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্যে আপনার হাতে এ্যাপয়েন্টমেন্ট তুলে দিয়েছিলেন। এতে কী প্রমাণ হয় না, আমরা ঋণ স্বীকার করতে জানি?
বেশ বললেন সাগরদা। রক্তদানের বিনিময় হিসাবে আমাকে মুক্তি দেওয়ার কথা বললেন তো? তারপরেও বুঝলুম না, কেন আপনি ছেলের অপকান্ড ঢাকতে আমাকে বলির পাঠা করতে চেয়েছিলেন?
নিশ্চয় মনে আছে আপনার, তিন পুরুষ ধরে আমরা ওই স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। তার মানে এই নয় যে আমরা কেবল দিয়েই যাব, আর আপনারা বিনা বাধায় তা নিতে থাকবেন।
তাহলে কী বলতে চাচ্ছেন, বিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন বলেই আমার মতো শিক্ষককে আপনার ছেলের টুকলিবাজিকেও সমর্থন করতে হবে?
প্রয়োজন হলে তা করতে হবে।
সাগরদা, শিক্ষার বিষয়ে আর্থিক জোরের প্রসঙ্গ সামনে এনে ঝুলির ভিতর থেকে বিড়ালটা বেশ তো বের করে আনতে পারলেন, এত উলঙ্গ হয়ে পড়েছেন আপনি? বিজয়বাবু, জনপ্রিয় সম্পাদকের কথাগুলো শুনুন। ওঁর ছেলে টুকলি করতে গিয়ে পরীক্ষার হলে ধরা পড়ার পরেও সাগরদা খুব করে আশা করেছিলেন, আমি উদ্যোগ নিয়ে ওঁর ছেলেকে পাশ করিয়ে দেব। এ কাজ কী কোনো শিক্ষক করতে পারেন?
দেখছি, পদত্যাগ করার পরে আপনি আকাশে ডানামেলা মুক্ত পাখির মতো হয়ে উঠেছেন। মুখে যা আসছে, তাই বলে আমাকে ছোটো করতে চাচ্ছেন। একটা নতুন প্রসঙ্গ জানতে পারি কী? সত্যজিতের পরিবর্তে হঠাৎ নিজেই কাগজ দিতে এলেন কেন?
আজ থেকে একাজ আমিই করব। সত্যজিৎ সব শোনার পরে দায়িত্বটুকু আমাকে দিয়েছে। এর সম্পূর্ণ লভ্যাংশ আমার। আপনি নিজের ছেলের জন্যে যে গুরুদক্ষিণার কথা ভাবতেই পারেন নি, সত্যজিৎ সেই বিনিময় দিয়ে জানিয়ে দিতে পেরেছে যে ছাত্র হিসেবে সেও পারে সৎ বৃহৎ হয়ে উঠতে। আর আপনি বিনিময় চাওয়ার পরেও তো খাঁটি সাগর হয়ে থাকতে চাচ্ছেন। মূল তফাৎটুকু এখানেই।
তাহলে কী আপনি আমাকে সত্যজিতের স্তরে নেমে যেতে বলছেন?
সরল করে কথা বলতে ভুলে গেছেন সাগরদা? এই পথে কী নিজেকে নতুন করে চিনিয়ে দিতে চাচ্ছেন? বিজয়বাবুর সামনে এসব বলতে লজ্জা করছে না আপনার? বিজয়বাবু বলুন, কাল থেকে কী ইংরাজি কাগজ নেবেন?
স্টেটম্যান দেবেন। অগ্রিম একশো টাকা আমার নামে জমা করুন।
আপনাকে মনে করিয়ে দিই, আপনিই এসেছেন আমার শূন্যপদে শিক্ষকতা করতে। সাগরদার প্রত্যাশা বাড়ছে চড়চড় করে। আমিও আশা করব, ভালো শিক্ষকতার মানদন্ড দিয়ে আমার জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। আপনাকে একটা ছোট্ট দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। সাগরদা ব্যবসার সঙ্গে শিক্ষকতাকে গুলিয়ে ফেলেছেন। সময় পেলে পার্থক্যটুকু একটু বুঝিয়ে বলবেন। আসছি বিজয়বাবু।
নতুন শিক্ষক বিজয় সামন্ত দু’চোখ স্থির করে তানুস্যারের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকলেন। রোমন্থনের ছবি পর পর ভেসে উঠছে স্মৃতির পাতায়। কী অদ্ভুত মানুষ এই তানুস্যার। আদর্শ রক্ষার জন্যে চাকরিও ছেড়ে দিতে পারলেন? খবরের কাগজ বিক্রি করে সংসার চালানো নিয়েও তার মধ্যে কোনো সংকোচ নেই। তাহলে কী ওর কাছে জীবনের প্রয়োজনীয় কাজে ছোটো বড়ো বলে কিছু হয় না? তানুস্যারের জীবনবোধের ধার-ভার এমনিই? সত্যজিৎ সকালে সেকথা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, কেমন যেন যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের মতো সব কিছু মিলে যাচ্ছে পর পর। নিজেও শিক্ষকতা করতে এসেছেন কিন্তু তানুস্যারের অভিনব জীবনবোধের মধ্যে বিজয় সামন্ত ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলেন।

চলবে…

আরও পড়ুন: বিবর্ণ অভিযোজন পর্ব- ২ 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!