উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
।। পঞ্চম পর্ব ।।
রাত আটটা। সম্পাদক সাগর তখনও ঘরে ফেরেন নি। শুভদিন পাশের ঘরে মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক কষায় ব্যস্ত। বেডরুমে লিজা একা, সময় গুণছে আনমনে। মনের পটে পর পর ভেসে উঠছে অনেক পুরানো স্মৃতি। সবগুলো যে ঝাপসা হয়ে গেছে, এমন বলা যাবে না। গাছের পাতা ঝরে গেলে সামনে থেকে মনে হয়, গাছটাই মরে গেছে কিন্তু কঠোর বাস্তব অন্য কথা বলে। সময়ের টানে দেখা যায়, শাখা প্রশাখাগুলো সবুজ পাতায় ভরে উঠেছে। নতুন সৌন্দৰ্য্যশ্রীতে গাছটা তখন অভিনব বাহার লাভ করে। জানিয়ে দেয়, নতুন সবুজ পাতার মধ্যে তার লুকিয়ে থাকা জীবনবোধকে। মানুষের জীবনের পুরনো স্মৃতিগুলো সময়ের বিড়ম্বনা পেরিয়ে নতুন সময়ের টানে সবুজ পাতার মতো হয়ে ওঠে। তা শুধু পুরনো স্মৃতিকে উসকে দেয় না, নতুন রোমন্থনে জীবনের অভিনব প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে।
খুব বাল্য বয়সে লিজা বাবা-মাকে হারিয়ে ফেললেও মাম্মু মাম্মির স্নেহ যত্নে দিব্যি বড়ো হয়ে উঠতে পেরেছিল। কোনো অসুবিধা হয়নি। মাম্মি রিক্তা লিজার জীবনে সত্যিকারের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। লিজার উপরে তাঁর যথেষ্ট জোর ছিল।
চৈত্র মাসের শেষ রবিবার। গরমের সময়। সকাল দশটার মধ্যে সূর্যের তেজ সত্যি সত্যি গনগনে হয়ে উঠেছে। বারান্দার একাধারে বসে লিজার মাম্মি বকবক করেই চলল। আদর পেতে পেতে মেয়েটা যেন মাথায় উঠে গেছে। কল থেকে জল আনতে এত সময় লাগে নাকি? যাবার সময় পই পই করে বলে দিয়েছি, পথে এতটুকু দেরি করবি নে। শুনল আমার কথা? বললুম তো, এখন জল আনতে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। দুপুরে ভিড়ভাট্টা থাকে না, তখন গেলে দিব্যি জল নিয়ে অল্প সময়ে ফিরে আসা সম্ভব। কথাগুলো কানেই তুলল না।
মাম্মির বকবকানি বেড়েই চলেছে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বলল, ওকে আর বাড়তে দেওয়া যায় না। আদর পেতে পেতে মগডালে উঠে গেছে। লিজাকে বেশি করে কথা শোনাতে ভয় করে রিক্তার। মাম্মুকে ঠিক কব্জায় রাখতে পেরেছে মেয়েটা, লিজার হয়ে কথা ধরবেই। আজ বাড়িতে ফিরুক, দু কথা না শুনিয়ে ছাড়ব না।
তানিস বাড়িতে ঢুকে খুব সহজেই বুঝে গেল, রিক্তার ভিতরের ঝাঁকুনি আছড়ে পড়ছে লিজার উপর। কোনো কোনো দিন বেশি ক্ষেপে গেলে রিক্তা এমনি আচরণ করে থাকে। এ অভিজ্ঞতা তানিসের অনেক পুরানো। এখনই যে তাকে সামাল দিতে হবে, তাও এক পলক ভেবে নিল। বলল, কার উপর এভাবে ঝঙ্কার দিতে শুরু করলে?
লিজার কথা বলছি গো।
ও আবার কী করল?
আজও বুঝলে না, তোমার আবদার পেতে পেতে কতটা ধিঙ্গি হয়ে উঠেছে মেয়েটা। সব যন্ত্রণা আমাকে সহে নিতে হচ্ছে। ওকে নিয়ে কী করবে করো।
মাম্মু তানিস পুরানো দোয়ার্কি শুরু করল। তুমি ওর বয়সটা বুঝবেনা, মা-বাপ নেই। আমাদের কাছে থাকে। একটু বাড়তি আদরে না রাখলে চলে নাকি? একটা প্রসঙ্গ খুব করে মনে রেখো, লিজা শ্বশুর বাড়িতে চলে গেলে তুমিই সবচেয়ে বেশি শূন্যতা অনুভব করবে। সেই খেদ বলেও শেষ করতে পারবে না। এখনকার কষ্টের চেয়ে সেই কষ্ট অনেক বেশি মন ছুঁয়ে যাবে। কেবল মনে হবে, লিজা নেই, বকে দিই কাকে?
আবার পুরানো গাজন শুরু করলে? একথা শুনতে শুনতে কান দুটো পচে গেছে গো, ওসব কেচ্ছা রেখে আগে বলো, লিজার জন্যে যে ছেলেটা দেখতে গিয়েছিলে, সে কেমন? পছন্দ হয়েছে কিনা? পড়াশোনা কতদুর করেছে? চাকরি করে, নাকি বেকার ?
তানিস মুখ ভার করে বসে থাকল রিক্তার দিকে দু’চোখ স্থির করে।
অমন চেয়ে থাকলে যে?
ছেলে তেমন সুবিধের নয়। চাকরি তো করেই না, উপরন্তু নানা উপসর্গ সঙ্গে নিয়ে দিন চলে। পিছন থেকে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, ছেলেটা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশা-ভাঙও করে। সুযোগ পেলে জুয়ার আসরে বসে। এত কিছু জানার পরে লিজাকে ওখানে দিই কী করে বলো তো?
লিজার জন্যে বেশ তো ডানা মেলে আকাশে উড়তে শিখেছ? ওর জন্যে কী নতুন একটা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির খুঁজে আনতে হবে নাকি? যুগের যন্ত্রণা বড়ো কঠিন গো। নিজের ভাবনার সঙ্গে মিল করে কী ছেলে খুঁজে পাবে তুমি?
শোনো রিক্তা, আমরা লিজাকে নিয়ে আগেভাগে হেরে যেতে পারি না। ভিতরের ইচ্ছা সদর্থক হলে স্বয়ং ঈশ্বর সাহায্যের জন্যে মানুষের পাশে দাঁড়ান। এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই না সূচক মনোভাব গ্রহণ করতে পারি না। তুমি তো লিজার মাকে দেখেছ। মরার আগে লিজাকে আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে গেছে। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, লিজার ভালোর জন্যে পরম করুণাময়ের উপর বিশ্বাস রাখো, দেখবে লিজার কপালে ভালো ছেলে জুটে যাবে।
শুধু শুধু দুরাশায় পড়ে থেকো না গো। কদিন ধরে তোমার কাছে একই কথা বার বার বলে যাচ্ছি। পাশের গ্রামের ছেলে বলে এভাবে অবহেলা করা কী ঠিক হচ্ছে? আমার প্রস্তাব আরেকবার ভেবে দেখতে পারো না?
তুমি কী তানবিরের কথা বলছ?
এখন বেকার বলে ওকে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছ কেন? জানো, তানু খুব ভালো ছেলে। আমার স্থির বিশ্বাস, ও একদিন চাকরি পাবেই। সে কথা ভেবে আমরা দিব্যি তানুর হাতে লিজাকে তুলে দিতে পারি। রাতের পরে দিন আসে। মানুষের জীবনে সেই চালচিত্র নতুন কোনো ঘটনা নয়। রাত শেষ হলে নতুন সকাল আসবেই।
তোমার সব কথা মানছি রিক্তা, কিন্তু ছেলের বর্তমান দুরাবস্থা দেখে তো ওর হাতে লিজাকে তুলে দেওয়া যায় না। অন্তত বর্তমানটুকু দেখে নিতে হবে তো। মা নেই মেয়েটার, মাম্মু হিসেবে আমি তার বাপ, তার মা। এসব ভুলি কী করে? সম্পর্ক খারাপ জায়গায় হলে লোকে কী বলবে জানো? নিজের মেয়ে হলে এত অবহেলা করতে পারতুম না।।
রিক্তা রুষ্ট না হয়ে পারল না। তুমি কী ভাবছ বলোতো? লিজার জন্যে পাত্র দেখতে গিয়ে সব গাঁ উজাড় করে দেবে? এতো একেবারে নতুন ধরনের সখ। বছরের পর বছর শুধু ছেলে দেখে যাবে? সম্মন্ধ ভেঙে দেওয়ার সখ ঘাড়ে চেপে বসে নি তো? একটা কথা মনে রেখো, লিজার বয়স নেহাৎ কম হয়নি। যত দিন যাচ্ছে, লিজার কারণে একটা দুর্ভাবনা ক্রমে মাথার উপর বোঝা হয়ে চেপে বসছে। এ নিয়ে এখন থেকে তোমাকে আরও বেশি করে ভাবতে হবে। কিন্তু দু’জনের কথা আর বেশি দূর এগোলো না।।
শুধু একবার উঁকি মেরে সোজা বাড়ির ভিতরে ঢুকে সাগর ডাকতে শুরু করল— ও মাসিমা, বাড়িতে আছেন?
রিক্তা ঘর থেকে বারান্দায় এসে বলল, এসো বাবা সাগর, তারপর কী মনে করে? মুখ ঘুরিয়ে তানিসকে বলল, তুমি কী এখন বাজারে যাবে? তাহলে যাও, আমি ততক্ষণ সাগরের সঙ্গে কথা বলি। ছেলেটা স্থানীয় রাজনীতিতে উঠতি মুখ, গ্রামে গেলে ওর কথা বেশ শুনতে পাই।।
কিন্তু কিন্তু করে সাগর আবার বলল, লিজাকে দেখছি না যে?
ও কলে গিয়েছে, সকাল থেকে কলসিটা শূন্য হয়ে আছে।
শাহিন সাগর না হেসে পারল না।
অমন হাসছ যে?
মাসিমা, লিজা এখন পৌরাণিক রাধার মতো নানা ছলাকলা শিখে ফেলেছে। রাধার ছিল কৃষ্ণ, লিজার কাছে তানু কৃষ্ণের মতোই। নিশ্চয় এত সাত সকালে দু’জনে পাশাপাশি বসে গল্পে মেতে উঠেছে। নদীর ধারে দু’জনের প্রতিদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। এ নিয়ে গ্রামের মানুষের ভাবনা ভীষণ খারাপ দিকে চলে গেছে। ছি ছি করতে কেউ কুণ্ঠা করছে না। রসিকতার আসরে লিজার নাম বার বার উঠে আসছে। মেয়েটার চোখে তানু কলির কেষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। এভাবে চললে তো সব বদনাম শেষ পর্যন্ত আপনাদের গায়ে লেপ্টে যাবে।
রিক্তা বিরক্ত না হয়ে পারল না। এও ভাবল যে সাগর এত বড়ো মিথ্যে কথা বলতে পারে না। আমরা তো ওকে নিয়ে খুব নিশ্চিন্তে ছিলুম, এখন দেখছি…।
সাগর বেশ বুঝে গেল, তার কথাগুলো রিক্তা মাসিমা দিব্যি মনে মনে গ্রহণ করে ফেলেছে। ভাবনা জারিত মুখ সে কথাই প্রমাণ করছে। নীচু জায়গায় যে জল আগে জমে, এ নিয়ে সাগরের মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না। সুযোগ বুঝে আবার বলতে শুরু করল, তানুস্যারের আক্কেলটা একবার ভেবে দেখুন মাসিমা। আমার পিতার সৌজন্যে সবেমাত্র চাকরি পেয়েছে। শিক্ষকতার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে তো? নামে জাতির মেরুদন্ড হয়ে থাকলে চলবে? একটু রেখে ঢেকে এসব করলে তো এত কানাকানির প্রসঙ্গ আসত না। তা না করে এভাবে প্রকাশ্যে? জানাজানির পরেই আমরা নিজেরাও খুব অসম্মান বোধ করছি।
রিক্তা শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ল। সাগর ভেবে পেল না, হঠাৎ করে এভাবে উদাসীন হয়ে পড়ল কেন? কুণ্ঠিত মুখে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল উঠোনের মাঝে।
লিজার মাম্মি কঠোর বাস্তবে ফিরে বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করল, তাহলে তানবির শেষ পর্যন্ত চাকরি পেয়ে গেল? আর দেরি করা চলে না সাগর। বদনাম বাড়তে দিয়ে লাভ কী, তানুর সঙ্গে লিজার চার-হাত এক করে দিতে পারলেই আমরাও ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারি। টেনে টেনে আর পারছি নে। তুমি তো বললে, লিজার চোখে তানু কৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। পালের এ হাওয়া নষ্ট হতে দেওয়া যায় না বাবা।
সাগর এসেছিল সঠিক খবর দিয়ে অন্য সূত্র লাভ করতে কিন্তু তা হাতছাড়া হতে চলেছে জেনেই তালমিল করতে বলল, মাসিমা, তানু ছাত্র হিসেবে খুব ভালো, সেইজন্যে তো স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা পেয়ে গেল।
শুধু তানুকে এত প্রশংসা করছ কেন বাবা, তুমিও তো খুব ভালো ছেলে। আমি তোমাকেই সেভাবে চিনি। সুহৃদ বলেই তো এত সব খবর মন খুলে আমাদেরকে জানাতে পারলে।
মাসিমা, আমাকে ভালো ছেলে হিসেবে ভাববেন না, বরং অন্য কিছু…।
কী যে বলো বাবা, খুব ভালো বলেই তো নিজেকে জাহির করতে চাও না। এটুকু বেশ বুঝতে পারি সাগর।
তানিস বাজার থেকে ফিরে সাগরকে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, এ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন বাবা? বারান্দায় উঠে বসো। আমি তো তোমাকে খুব আপন করে ভাবি।
সাগর যে খবর দিতে এসেছে, তা শুনলে তোমারও খুব ভালো লাগবে। রিক্তার মুখে বিচিত্র হাসি। চাপা স্বরে বলল, তানু স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে।
কী করে সম্ভব হল, তা বলবে সাগর ?
শিক্ষিত ছেলে, পাশ করে বসেছিল। ভালো পড়ায়, টিউশনির ছাত্র-ছাত্রীরা তা বাজারে চাউর করে দিয়েছিল। স্কুলের মঙ্গলের জন্যে ওকে ডেকে হাতে এ্যাপয়েন্টমেন্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বেশ বেশ, একটা ভালো খবর দিতে পারলে বাবা।
তানিসের মুখে সাফল্যের হাসি। মনে মনে ভেবে নিল, রিক্তা মন্দ প্রস্তাব দেয়নি। বরং তার ভাবনা কঠোর বাস্তবে মিলে গেছে। শেষ পর্যন্ত লিজাকে যে একজন সাকারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হবে, তা ভেবে উৎফুল্ল না হয়ে পারল না, যেন তার আন্তরিক ভাবনার প্রতি পরমেশ্বর সন্তুষ্ট হয়ে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। মরার সময় লিজার মা তার হাত ধরে বলেছিল, ওকে মন খুলে দেখিস রে। নিজের মেয়ে হিসেবে ভাবিস।
ভাবনার ফাঁক গলে তানিসের দু’চোখ জলে ভরে উঠল। বিড় বিড় করে বলল, যার কেউ নেই, তাকে দেখার জন্যে পরমেশ্বর আছেন।
সাগর সহজে বুঝে গেল, লিজার মাম্মুমাম্মি তানুর দিকে সম্পূর্ণ ঢলে পড়েছে। তাকে নতুন পথ খুঁজে পেতেই হবে। কখনো হেরে যেতে শেখে নি সে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল, লিজাকে কোনোক্রমে তানুর হাতে তুলে দেওয়া যায় না। একটা কঠিন দুর্বলতা গভীর জলে ভারী পাথরের মতো সরতে সরতে সাগরের ভেতরটা খাঁ খাঁ করতে থাকল লিজার ভাবনায়। সমাজের কেউ জানতে পারল না, সে কত বেশি করে লিজাকে পেতে চায়।
চলবে…
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ পর্ব -৪