উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
।। সপ্তম পর্ব ।।
সময়ের টান শেষ হতে হতে তানুর বিয়ের দিন এসে গেল। এতদিন লিজার কাছে কোনো খবর ছিল না। প্রতিদিন নতুন সকালে সূর্য উঠেছে পূবের আকাশে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, সন্ধে এসেছে সময় মেনে কিন্তু তানুর কাছে কোনো কিছুই আপন বলে মনে হয় নি। সে যেন এক অচেনা নিরুদ্দেশ পথের যাত্রী হয়ে উঠেছে যেখানে সে ছাড়া কেউ নেই। ব্লাড ক্যানসার তার একমাত্র সঙ্গী, নির্দিষ্ট দিনে প্রহর পেরোতে পেরোতে দুপুর একটায় আগত রেজিস্টার রুবেল বিরক্ত হয়ে বললেন, আর তো অপেক্ষা করা চলে না, পিছনে কোনো গড়বড় নেই তো? থাকলে তা আপনারা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। আমার চেম্বারে এতক্ষণ কেউ কেউ এসে অপেক্ষায় রয়েছে। সব কাজ সুনির্দিষ্ট সময়ে শেষ হলে ভালো লাগে।
তানিস হাতজোড় করে বলল, প্লিজ, আরেকটু অপেক্ষা করুন, তানু তো ওই ধরনের ছেলে নয়। অসুখ বিশুখ করে নি তো?
আগের দিন এসব খোঁজ নিতে হয়।
গিয়েছিলুম কিন্তু দেখতে পাই নে। ক’দিন স্কুলে পর্যন্ত যায় নি। আমিও চিন্তায় রয়েছি।
রেজিস্টার গজগজ করতে করতে বললেন, আর কী অপেক্ষা করা যায়?
রিক্তা দু’চোখ ভিজিয়ে রেজিস্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। —হয়তো কোনো কারণে দেরি হচ্ছে। আমি জানি, ও আসবেই। সেই বিশ্বাস কিছুতেই ফেলে দিতে পারছি নে। ছেলেটা বড়ো ভালো।
রেজিস্টার রুবেল গলার স্বর নামিয়ে বললেন, আপনাদের অনুরোধে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই পারি কিন্তু তাতে কী অবস্থান পাল্টাবে? উদ্ভূত পরিস্থিতি দেখে কেমন যেন ভয় পাচ্ছি।
তানিসকে তাগিদ দিল রিক্তা, এখনিই কাউকে পাঠাও, যত সময় পার হচ্ছে, ভিতরে নতুন নতুন ভয় ঢুকছে হুড়মুড় করে।
তোমার কী মনে হয়, তানু অন্য কিছু ভাবতে পারে?
এখন তাই মনে হচ্ছে।
তানিসও আর ধৈর্য ধরতে পারল না। বাড়ি থেকে বের হবার সময় লিজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, অত ভাবিস নে, একটা ব্যবস্থা ঠিক হবেই হবে।
লিজা কান্না ভেজা দু’চোখ নিয়ে শুধু একবার মাম্মুর দিকে দু’চোখ রেখে চুপ করে থাকল। প্রত্যেক নারী যে দিনটার জন্যে মনে মনে স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের মুখোমুখি লিজাকে এক অনিশ্চিত বিড়ম্বনায় দুলতে হচ্ছে। নদীর ধারে বসে সন্ধের পরে গল্প করার স্মৃতি লিজাকে বার বার উসকে দিচ্ছে কিন্তু অবরুদ্ধ হয়ে থাকা ছাড়া তার জীবনে আর কোনো তাৎক্ষণিক অবস্থান নেই।
মিনিট দশেক পরে তানিস আবার বাড়িতে ঢুকল সাগরকে সঙ্গে নিয়ে। রিক্তাকে শুনিয়ে বলল, সাগর ঠিক ধরে আনতে পারবে তানুকে।
বাড়ির সকলে, বিশেষ করে লিজা নতুন করে সচল সবুজ হতে শুরু করল। তার জীবনে সময়ের টান এত গভীর হয়ে উঠেছে যে সেই টানে ভিতরের সমুদ্রে জোয়ারের স্রোত বইতে শুরু করেছে। প্রতিটা মুহূর্ত যেন লিজার ইচ্ছার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকতে চাচ্ছে।
সাগর বাইরে বের হয়ে তানুর খোঁজে এদিক ওদিক করতে শুরু করল। ছেলেটা গেল কোথায় ? এক চিলতে হাসি ফোটালো দু’ঠোটের ফাঁকে। নদীর ধারে বসে সময় ব্যয় করতে শুরু করল। সেকেন্ড মিনিট করে সেভাবেই আধ ঘন্টা অতিবাহিত হল। তারপর মন্থর গমনে সামনে এগিয়ে চলল। বাড়িতে ঢুকতেই মাম্মু তানিসের প্রশ্ন, কোনো খবর পেলে বাবা?
তানু বাড়িতে নেই। কখন বের হয়েছে, একে ওকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে বারান্দার একধারে ও নিজের হাতে লেখা একটা পত্র রেখে গেছে, সেটাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
তানিসের কৌতুহলী প্রশ্ন—কী লিখেছে তানু?
আমি তো তা খুলে পড়তে পারিনা, ভালো খবর থাকলে তা লিজার জন্যেই।
বাবা সাগর, আর সময় নষ্ট না করে পত্রটা পড়ে আমাদের সকলকে শোনাও। একটু ভাবনামুক্ত হই।
সাগর পত্রটা পড়তে শুরু করল—
লিজা,
আমাকে ক্ষমা করা ছাড়া তোমার সামনে দ্বিতীয় পথ আছে বলে মনে করি না। বিশেষ কারণে বিয়ের আসরে উপস্থিত হতে পারলুম না, আমি তো কোনোক্রমে তোমাকে ঠকাতে পারি না। কেন যেতে পারি নি, তা জানলে আমার চেয়ে তুমি অনেক বেশি দুঃখ পেতে, তুমিও এ বিয়েতে রাজি হতে পারতে না, কপাল আর নিয়তি নিয়ে মানুষের জীবন, তার বাইরে যাবার ক্ষমতা আমাদের কারুর নেই।
ইতি—
তানু
তানিসের চাপা স্বর, এর মানে কী সাগর ?
ভয়ে পালিয়ে গেছে।
অন্তত গতকাল বিকেল পর্যন্ত তো আমাদেরকে সব জানাতে পারত।
অত সামাজিক জ্ঞান ওর আছে নাকি?
তা একপ্রকার ঠিক কথা।
রিক্তা সামনে এসে কাঁদু কাঁদু হয়ে বলল, একটা উপায় বলো না বাবা।
আমি আসছি মাসিমা।
এত বড়ো দুঃখের সময় আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?
আপনিই তানুকে বেশি করে মাথায় তুলেছিলেন।
ঠিক কথা বলেছ বাবা।
এখন আপনিই বলুন, কী করতে চাচ্ছেন?
মাথায় যে কিছু আসছে না।
মাথায় যখন কিছু আসবে তখন তানুকে দরকার। মাথায় না এলে সাগরকে চাই। ভারি অদ্ভুত মানসিকতা।
তানিস দু’চোখ ভিজিয়ে চেয়ে থাকল সাগরের দিকে। একটাই মিনতি, কিছু ব্যবস্থা করতে পারো না বাবা?
ঘরের ভিতরে অবরুদ্ধ লিজা আর সহ্য করতে পারছিল না। বারান্দায় এসে বলল, ওই বেইমানটার কথা ভাবছ কেন মাম্মু। ওকে মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়েছি। তোমার পছন্দের যে কোনো ছেলেকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।
সাগরের মতো বুদ্ধিমান পারে খুব সহজে পরিস্থিতির ভিতরে ঢুকে নিজস্ব সুবিধা আদায় করে নিতে। চেয়ে থাকল তানিসের দিকে। লিজার মাম্মুর চোখের ভাষা সে ঠিকমতো বুঝে নিতে চাচ্ছে।
তানিস এসে সাগরের পাশে দাঁড়ালো। ডান হাতের পাঁচ আঙুল সাগরের কাঁধের উপর। স্নেহের বিস্তার শুরু হয়েছে। সাগর বিহ্বল হতে শুরু করলেন।
তানিসের চাপা প্রশ্ন, একটা কিছু করতে পারো না সাগর?
এ কী করে সম্ভব? কিন্তু মনে মনে খুব করে এমনি একটা ট্রামকার্ড চাচ্ছিলেন। থেমে থেমে বললেন, তানু শুনলে কি ভাববে, তা একবার ভেবে দেখেছেন? লিজা কি ভাবছে, তা না জেনে আমাকে এভাবে বলছেন কেন?
লিজাকে কী তোমার যোগ্য ভাবতে পারছ না?
এ প্রসঙ্গ আসছে কেন?
রিক্তার ছোট্ট মন্তব্য, তুমি রাজি থাকলে লিজাকে বলে দেখতে পারি।
আমার উপর এভাবে চাপ তৈরি করবেন না মাসিমা।
সাগর যেন বিনয়ের অবতার। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করলেন, আমি এতদিন লিজাকে অন্য চোখে দেখে এসেছি। তাকেই আজ আপনাদের কথায় নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারি কী? অন্তত আমি জানি, লিজা মনে মনে কেবল তানুকে চায়। আমিও চাই, তানুর সঙ্গে লিজার জীবনযাত্রা শুরু হোক।
তানিস আর ভিতরের কান্না চেপে রাখতে পারছে না। লিজা ততক্ষণে বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। বলল, আমার জন্যে ওকে অনুরোধ করে নিজেদেরকে ছোটো করতে যেও না মাম্মি। যা কপালে আছে, তাই হবে। বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে চলে যেতে উদ্যত হল।
সাগর সরে এসে বললেন, দাঁড়াও লিজা, আমি তোমাকে বঞ্চিত করে পরম করুণাময়ের কাছে অপরাধী হতে পারি না, তবে কয়েকটা শর্ত তোমাকে মানতে হবে।
রিক্তা নত হয়ে বলল, বলো না বাবা তোমার শর্তগুলো। লিজা শুনুক, আমরাও শুনি।
শুভদিনকে ফেলে রেখে গতবছর আমার স্ত্রী পরলোকে চলে গেছে। চলে যাবার আগে আমি তার কাছে শপথ করেছিলাম, শুভদিনকে বড়ো করে তোলার জন্যে ভবিষ্যতে বিয়েই করব না। লিজা কী পারবে আমার দুটো শর্ত পূরণ করতে?
আবেগে কম্পিত হতে হতে তানিস সাগরের দু’হাত চেপে ধরে বলল, তোমার মনের কথাগুলো বলো না বাবা, লিজা তো রাজি হয়ে যেতে পারে।
সাগর থেমে থেমে বললেন, কেবলমাত্র শুভদিনের মুখ চেয়ে লিজা আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। আমার দ্বিতীয় শর্ত, শুভদিনকে নিজের ছেলে ভেবে কোলে তুলে নিতে হবে।
তানিস হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। —এ কী শর্ত আরোপ করলে সাগর ? লিজা মা হতে না পারলে ওর জীবনে কী থাকল? মাম্মু হিসেবে আমি কী ওকে চোখের সামনে এত বড়ো সর্বনাশের মধ্যে ফেলে দিতে পারি?
লিজা থেমে থেমে বলল, এসব কী ভাবছ মাম্মু, বিয়ে না হলে তো সারা জীবন অবাঞ্ছিত হয়ে থেকে যেতুম। তার চেয়ে অনেক ভালো, শুভদিনকে বুকে জড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া।।
সাগরের মধ্যে তখন দাবা খেলায় জয়লাভের আনন্দ এসে ভর করতে শুরু করেছে। ভাবতে পারলেন যে ঠিকমতো ঘুটি সাজাতে পারলে কত না সহজে জিতে যাওয়া যায়। সেই বিজয়ের সম্মান লাভ করা তার পক্ষে সম্ভবও হয়েছে। মনে মনে পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিড় বিড় করে বললেন, তুমি সহায় ছিলে বলেই এভাবে সাফল্য লাভ করা সম্ভব হল।
লিজাকে হারিয়ে তানুর শূন্য জীবনে আত্মধিক্কার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্মৃতির বুকে পালতোলা নৌকায় বসে সে যেন নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে একা একাই ভেসে চলেছে। বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। অনুশোচনার যে আকাশ মাথার উপর ছেয়ে রয়েছে, তা থেকে বের হওয়ার শক্তিও তার নেই। দিন শেষ হলে সন্ধের অন্ধকারে নদীর ধারে পৌঁছে কেবল ভাবতে লাগল, এখানে বসেই সে অনেকটা সময় ব্যয় করেছিল লিজার সঙ্গে। সবই এখন স্মৃতিতর্পণ ছাড়া কিছুই নয়। কয়েকদিন আগেকার জীবনের সঙ্গে তুলনা করে তানু আরও বেশি করে অবাক হতে থাকল। যে লিজাকে জীবনসঙ্গী করে সুখে বাঁচতে চেয়েছিল সে, সেই লিজাকে ছেড়ে ক্যানসারের কারণে তাকে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আগেই শুনেছিল, ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়লে জীবন ফুরিয়ে যেতে মাত্র কয়েকমাস লাগে। অকাল মৃত্যুর মধ্যে বিশ্লেষণের আলোয় একটা কঠোর সত্য বুঝে গেল, লিজা ছাড়া তার জীবনের এতটুকু মূল্য নেই। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের সরল পাটিগণিত দু’চোখের সামনে ভাসছে। তাহলেই তো সারা জীবনের জন্যে বন্ধন মুক্তির স্বপ্নকে সার্থক করে তোলা যায়।
আত্মধিক্কারের চরম অবস্থান এর মুখোমুখি তানু। উঠে দাঁড়ালো, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল জলের দিকে। সবেমাত্র জোয়ার শুরু হয়েছে। পূর্ণতা পেতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। জীবনের অপূর্ণতা নিয়ে পূর্ণ জোয়ারে ভেসে মরতে তানু মরিয়া হয়ে উঠল। ধূসর ঝাপসা ছবির মতো লিজার স্মৃতিও একসময় তার জীবন থেকে ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে উঠল। তার চেয়ে ঢের ভালো হবে আত্মহননের মধ্য দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে পারলে। পায়ে পায়ে তানু আরও এগিয়ে চলল।।
পাশ থেকে একটা ছোটো শিশুর কান্না ভেসে আসছে কানে। সন্ধের অন্ধকারে এখানে কান্না শুনছি কেন? কেউ কী তাকে ফেলে রেখে চলে গেছে? তানুর মধ্যে কৌতুহলের বন্যা। দ্রুত পা ফেলে বামপাশে সরে গিয়ে দেখল, দুর্বল শরীর নিয়ে একটা শিশু মাটিতে পড়ে আছে। শিশুটার কান্না ক্রমেই বাড়ছে। তানু হাঁটু গেড়ে বসল শিশুটার পাশে। একটা অচেনা মমতা তাকে বার বার আন্দোলিত করছে। সে তো মরবেই কিন্তু তার আগে একটা শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে দিতে পারলে একটা স্মরণীয় স্মৃতি জুড়ে থাকতে পারে তার অকাল মৃত্যুর সঙ্গে। জোয়ারে জল দ্রুত বাড়ছে। কয়েক মিনিট পরে শিশুটা ভেসে যাবে জলের প্রবল তোড়ে। অসহায় শিশুর অকাল মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য তানুর চোখে মুখে। দু’হাতের দশ আঙুল দিয়ে শিশুটাকে কোলে তুলে নিল। পায়ে পায়ে বাউন্ডারির দিকে এগিয়ে চলল। ভুলে গেল নিজের আত্মহননের প্রসঙ্গ। শিশুটার জীবন বাঁচানোকে প্রথম কাজ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারল না। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। খিদে পেয়েছে বলেই বোধ হয় এত বেশি কাঁদছে।।
তানু আর দেরি করল না। রাস্তার উপরে এসে পথচলতি ভ্যানে শিশুটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তার জলিলের ডিসপেন্সারির দিকে এগিয়ে চলল। ডিসপেন্সারির সামনে উপস্থিত হয়ে ডাকল, ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু…।
ডাঃ জলিল বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন, সেদিনের তানু একটা ক্রন্দনরত শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা বললেন না, বরং পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা না করে সেদিন এভাবে চলে গিয়েছিলেন কেন?
ডাক্তারবাবু, আগে বাচ্চাটাকে দেখুন, মনে হচ্ছে স্যালাইন দিতে হবে।
ডাক্তার জলিল প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ সেরে নিয়ে বললেন, শিশুটাকে বাঁচাতে গেলে এখনই ও-নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। এক ঘন্টার মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে, না হলে বিপদ আরও বাড়তে পারে।
কিন্তু ডাক্তারবাবু।
যা প্রয়োজন, সেটাই বললাম।
এখন পাবো কোত্থেকে?
এ নিয়ে ভাবছেন কেন? আপনার রক্তের গ্রুপ তো ও-নেগেটিভ, সেদিন রক্ত পরীক্ষার পরে সেটাই ধরা পড়েছিল। ইচ্ছা করলেই আপনি নিজেই রক্ত দিয়ে শিশুটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন।
তানু ভিতরের শঙ্কায় আঁৎকে না উঠে পারল না। ডাক্তারবাবু তো সব কিছু জানেন। তারপরেও এ প্রস্তাব দিলেন কি করে? তানু আর নিজেকে সামলাতে পারল না। রোষ সমন্বিত স্বরে বলল, সব জেনে শুনে শিশুটাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন?
এ কথা কেন বলছেন?
আপনি ভালো করেই জানেন, আমি ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছি।
প্লিজ আমার কথা শুনুন। সেদিন শুভ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে যে ব্লাড রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।
কী করে তা জানলেন?
চটপট উত্তর দিতে পারলেন না ডাঃ জলিল। তানুর বিয়ে নিয়ে যে অদ্ভুত বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছিল, সেই ছক মাথার ভিতরে ঘুরছে। তানু চেয়ে থাকল ডাঃ জলিলের দিকে। বুকের মধ্যে অভিনব কম্পন শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে বিয়ের সময় পার হয়ে গেছে। এখন সন্ধে। আরেকটু পরে ফুলশয্যার সময় শুরু হবে। লিজা নিশ্চয় বাধ্য হয়ে অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখন ডাক্তারবাবু এসব কী বলছেন? যদি ডাক্তারবাবুর কথা সত্যি হয়, তাহলে তা কী অর্থে? হয়তো এর ফলে তার জীবন বেঁচে যাবে কিন্তু লিজাকে আর কোনোদিন জীবনসঙ্গী হিসেবে কাছে পাওয়া সম্ভব হবে না। বিবর্ণ মুখ নিয়ে তানুর বিনম্র অনুরোধ, ডাক্তারবাবু, ব্লাড রিপোর্ট নিয়ে একটু খুলে বলবেন কী ?
আপনি তো সেদিন কম্পাউন্ডারের কথা শুনে চলে গিয়েছিলেন। রিপোর্ট দেখেই আমার মধ্যে কেমন যেন সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যে নেওয়া রক্তের নমুনা কলকাতার একটা বিখ্যাত ল্যাবে পাঠাতে বাধ্য হই। সেখান থেকে যে বিপরীত রিপোর্ট আসে, তা দেখে নিজেও ভীষণ হতচকিত হয়েছি। এর পিছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো?
তানু আত্মগ্লানির গভীর ক্ষত বুকে জড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। তাহলে তার ক্যান্সার হয়নি? ল্যাব থেকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এমনি মিথ্যে রিপোর্ট করে দেওয়া হয়েছে? মিষ্টার সাগর এতখানি নিষ্ঠুর? লিজাকে হারানোর যন্ত্রণা তানুর বুকের গভীরে বোশেখি ঝড় তুলে দিল। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা তার মধ্যে খুব বেশি সময় স্থায়ি হল না। বরং নতুন প্রশ্নে দুলতে লাগল। তাহলে সে পারবে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে শিশুটাকে বাঁচিয়ে তুলতে? ডাঃ জলিলকে বলল, আর দেরি করবেন না ডাক্তারবাবু। কী করে দ্রুত রক্ত বিনিময় পর্ব শুরু হতে পারে, সেই এ্যারেঞ্জমেন্ট করুন।
আশা কুহকিনী। তা মরেও মরতে চায় না। একটা অদৃশ্য জীবনী শক্তি রয়েছে তার মধ্যে। তানুর কেবল মনে হতে থাকল, সাগর ল্যাবে বসে এত কিছু করেছে তাকে বঞ্চিত করতেই। কিন্তু বিয়ের আসরে বঞ্চিত হয়ে লিজা শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নিল, তা জানার জন্যে তানু ভিতরে ভিতরে অস্থির হতে থাকল। অনেক রাত তার জীবন থেকে পার হয়ে গেছে কিন্তু এ রাতের গুরুত্ব তার জীবনে সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার। একটা শিশু কন্যা লাভ করা সম্ভব হলেও লিজাকে হয়তো হারাতে হবে সারা জীবনের জন্যে। সঠিক উত্তর পাবার জন্যে হৃদয়ের উত্তাপে উদ্বেলিত হতে থাকল তানু।
চলবে…