বিবর্ণ অভিযোজন: পর্ব ৯

উপন্যাসিক মুসা আলি’র ‘বিবর্ণ অভিযোজন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। এই উপন্যাসে শিক্ষকের পিতৃত্ব একজন ছাত্রের জীবনকে কত বেশি উদ্বেলিত করে তুলতে পারে, সেই অনুভূতির বিস্তার ঘটেছে এ উপন্যাসের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। পড়তে পড়তে আপনি আপনার প্রিয় শিক্ষককে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।

।। নবম পর্ব ।।

পরের সপ্তাহে সোমবার। তানুস্যার বাড়িতে ছিলেন না। খবরের কাগজ দিতে বের হয়েছিলেন। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে ফিজা পুতুল হাতে নিয়ে একনিষ্ট মনে গানের তালে তালে নাচছিল। শুভদিন আবেগের আতিশয্যে দৌড়ে ঢুকতে গিয়ে ফিজার সঙ্গে শরীরী ধাক্কায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল, ফলে ফিজার হাতের পুতুল মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। তার তাৎক্ষণিক প্রশ্ন, এমন ভাবে ধাক্কা দিলে যে…
শুভদিন হতচকিত হয়ে কিছু সময় থমকে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রথম দিন যে এভাবে অঘটন ঘটবে তা ভাবতেই পারে নি। চাপা স্বরে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে ফিজা। কালকে সন্ধেয় তোমাকে একটা পুতুল কিনে এনে দেব। আর মন খারাপ করো না, প্লিজ।
ফিজা খুশি হয়ে বলল, তাহলে কিনে এনে দেবে তো?
কথা যখন দিয়েছি, যেখান থেকে পারি, সংগ্রহ করে আনব।
তানুস্যার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে বলল, কখন এসেছ শুভদিন?
এই তো একটু আগে।
মা কী এগিয়ে দিয়ে গেল?
মা বলল, তুই তো স্যারের বাড়ি চিনিস। আমিও চলে এলুম। প্রথম দিনে একটা বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছি স্যার। যেন বকে দেবেন না।
কী ব্যাপার শুনি?
আমার ধাক্কায় ফিজার হাতের পুতুল মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে।
মাটির পুতুল যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে শুভদিন। এজন্যে মন খারাপের কী আছে?
স্যার, আমি ফিজার জন্যে আরেকটা পুতুল কিনে এনে দেব বলেছি।
তাহলে এমন একটা শক্ত পোক্ত পুতুল কিনে আনবে, যেটা দিয়ে ফিজা শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও খেলতে পারবে।
লজ্জা পেয়ে ফিজা তানুস্যারকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাপি।
বুঝেছি, আমার কথায় খুব লজ্জা পেয়েছিস, তাহলে এই প্রসঙ্গ এখানে থেমে যাক। দু’জনে পড়তে বসো। শুভদিনকে বললেন, নিশ্চয় তোমার মা অন্য দিনেও তোমাকে সন্ধের সময় আসতে বলে দিয়েছে।
শুভদিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। পড়তে বসে বার বার বিজয়স্যারের কথা মনে পড়ছিল তার। এত সংক্ষিপ্ত সাজেশন দিতে পেরেছিলেন বলেই তার পক্ষে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সম্ভব হয়েছে। তানুস্যার কী সেভাবেই পড়াবেন? কুঞ্চিত মুখ নিয়ে বলল, স্যার, এখন থেকে পরীক্ষায় কী কী পড়বে, তা জানিয়ে দিলে ভালো করে মুখস্ত করে ফেলতে পারতুম। তাতে পড়ার চাপটা অনেকখানি কমে যেত।
তানুস্যার অবাক হয়ে শুভদিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এসব কী বলছে ছেলেটা? অল্প পড়াশোনা, পরীক্ষায় বাড়তি ভালো ফলাফল—এসব জানল কী করে? নিজেই নিজের সংকোচে কিছু সময় আটকে থাকলেন। তারপর বললেন, গত বছর কী তুমি এভাবে সাজেশন নির্ভর করে পরীক্ষা দিয়েছিলে?
বিজয়স্যার খুব ভালো সাজেশন দিতে পেরেছিলেন। সবগুলো আমার ব্যাগে আছে, দেখবেন স্যার?
দেখাও দেখি।
শুভদিন খুশি মনে সাজেশনগুলো বের করে তানুস্যারের হাতে দিল।
তানুস্যার একটু দেখে নিয়ে বললেন, এগুলো কী সব পরীক্ষায় পড়েছিল?
শুভদিন চুপ করে থাকল।
দেখ শুভদিন, জানা থাকলে আমাকে পরিস্কার করে জানাতে হবে। এতে সংকোচের কিছু থাকতে পারে না।
সবগুলো পড়েছিল স্যার।
আমি কিন্তু এভাবে পড়াতে পারব না।
কেন স্যার?
শিক্ষার বিষয় বাজারে বিক্রি হওয়া আলু পটলের মতো হতে পারে না। বিষয় সম্পর্কে যাতে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে পারো, সেটাই শেখানো আমার মূল কাজ। আমি তোমাকে বিষয়ের গভীরে নিয়ে গিয়ে ধরে ধরে সব কিছু শেখাতে চাচ্ছি। আগে বিষয়টা ভালো করে শেখো, পরে প্রশ্ন অনুসারে সেগুলোর উত্তর নিজের ভাষায় দেওয়ার অনুশীলন রপ্ত করতে হবে।
বুঝতে পেরেছি স্যার। এরপর থেকে আপনি যেমন বলবেন, সেভাবেই চলব।
তাহলে এখনিই আমার একটা নির্দেশ পালন করো।
শুভদিন দু’চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল তানুস্যারের দিকে।
দেশলাইয়ের আগুনে ওই সাজেশনগুলো পুড়িয়ে ফেলো। আমার খুব ইচ্ছে, তুমি পড়াশোনা করে ডাক্তারি পাশ করো। নিজের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে হলে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে শুভদিন।
আর এতটুকু সময় বিলম্ব না করে সাজেশনগুলো পুড়িয়ে ফেলল শুভদিন। বলল, স্যার, আপনি আশির্বাদ করুন যাতে আগামি দিনে আপনার ইচ্ছে পূরণ করতে পারি।
কিন্তু অন্য একটি ভয়ে তানুস্যারের বুক ওঠানামা করতে শুরু করল। সম্পাদক সাগর জানতে পারলে সব প্রত্যাশা একেবারে বিপরীতমুখি হয়ে উঠবে। তা রোধ করার ক্ষমতা তার নেই, লিজার পক্ষেও সম্ভব নয়।

সময় কারুর জন্যে থেমে থাকে না। তানুস্যারের পক্ষেও তা থেমে ছিল না। নতুন বছরের মাসগুলো পরপর শেষ হতে হতে একেবারে প্রান্তে এসে হাজির হল। তানুস্যার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন দু’জনকে গড়ে তুলতে। কদিন পরে বার্ষিক পরীক্ষা। ফল বের হলে বুঝতে পারবেন, তার পড়ানো কতটা কাজে এল।
পরের দিন ফিজা স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল, বাপি, পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।
বেশ তো আরো মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো। শুভদিন এলে, তাকেও সে কথা বলে দেব।
ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন। নোটিশ দিয়ে তা ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তানুস্যার বিকেলে চেয়ারে বসে ভিতরে ভিতরে কম্পিত হচ্ছেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু শুভদিন পারবে কি আশানুরূপ ফলাফল করতে? তার পরিবর্তিত ফলাফল নিয়ে লিজা কী ভাবতে পারে, তাও চকিত চিন্তায় মনের খাতায় একবার ছবি হয়ে ভেসে উঠল।
তানুস্যারের মধ্যে অনেক পুরনো স্মৃতি নতুন করে ভেসে উঠছে। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন রেজাল্ট আউটের পরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তাঁর বাড়িতে আসত আশির্বাদ গ্রহণ করতে। এখন আর সেসব দায় নেই। কেবলমাত্র শুভদিনকে নিয়ে বিশেষ চিন্তা।
বিকেল পাঁচটা। তানুস্যার ভাবছেন, ফিজা রেজাল্ট নিয়ে এখনও ফিরল না কেন? এত দেরি হওয়ার কোনো কারণ দেখতে পেলেন না। মানসিক উৎকণ্ঠায় সময় কাটানো সব চেয়ে বেশি কষ্টের। তানুস্যার তেমনি উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে উদগ্রিব হয়ে থাকলেন। একবার শুষ্ক হাসি হেসে নিজেকে সান্ত্বনায় ডুবিয়ে দিলেন। সময় বদলে গেলে জীবনের রুটিন কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, তা বেশ বুঝতে পারছেন। মেয়ে ফিজার ভালো ফলাফল নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকলেন। ফিজা তাকে কথা দিয়েছিল, সে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করে পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করে দেখাতে পারবে। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারবে কী?
ফিজা এসে বাড়িতে ঢুকল। তানুস্যারের উৎকণ্ঠা নতুন মাত্রায় চলে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, খবর কিরে মা?
তুমি আগে অনুমান করো।
থার্ড হয়েছিস?
ভুল বললে বাপি।
তাহলে কী ফোর্থ?
তোমার সব অনুমান ভুল।
তাহলে নিশ্চয়ই পাঁচে হয়েছিস।
তোমাকে একটা কথা বলব বাপি?
বলো মা শুনি।
তিন থেকে শুরু করলে কেন? তিনের আগে তো দুটো সংখ্যা রয়েছে। তা কী আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?
হেয়ালি না করে কী হয়েছে আগে সেটাই শোনা। ভিতরের উৎকণ্ঠা খুব বেড়ে গেছে রে।
আমি প্রথম হয়েছি।
তানুস্যার মেয়ের কথাকে ঠিকমতো বিশ্বাস করতে পারলেন না। এও কী সম্ভব? নিজে যা ভাবতে পারেন নি, ফিজা সেটাই করে দেখাতে পারল। তাহলে মাঝে মাঝে জীবনে এমনি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে? তারপর থেমে থেমে বললেন, তুই আমার ব্যক্তিগত সম্মানকে অনেকটাই উঁচুতে তুলে ধরতে পারলি রে। তুই আমার শেষতম স্বপ্ন, আমার সমস্ত প্রত্যাশার নির্যাস। প্রতি বছর এই একটা দিন অপেক্ষা করে থাকব তোর হাসি মুখ দেখার জন্যে। এমনি করে একটা ভালো খবর দিবি, আর আমি চমকে উঠে অতীতের সব স্মৃতি ভুলে যেতে চেষ্টা করব।
ফিজা আরও কী বলতে চাচ্ছিল, সাগরকাকুকে দেখে কেমন যেন থমকে যেতে বাধ্য হল।
শুরু করলেন মিষ্টার সাগর, শুধু মেয়েকে নিয়ে ভাবতে যাবেন না, আমার শুভদিনকে নিয়েও একটু ভাবতে হবে। ভুলে যাবেন না, ও একদিন আপনার ছাত্র ছিল। আপনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে শুভদিন ভালো ফলাফল করলে খুব গর্বিত হবেন। তাই জানাতে এলাম। একসময় ভাবনা হয়েছিল, আপনি সাহায্য না করলে আমার শুভদিন অতলে তলিয়ে যাবে কিন্তু তা হয়নি। বিজয়স্যার সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিতে পেরেছেন। জেনে রাখুন, এ বছর শুভদিন ক্লাসে দুশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ফোর্থ স্ট্যান্ড করেছে। ওর মুখে শুনেছি, প্রথম যে হয়েছে, তার সঙ্গে নম্বরের বেশি পার্থক্য নেই। আমি আপনার কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তাও ভুলে যাইনি। সেজন্যে মিষ্টি খাওয়াতে এসেছি। ধরুন ধরুন, মিষ্টির পাত্রটা হাতে নিন, নিজে খান, মেয়েকে দুটো খেতে দিন। জানিয়ে রেখে গেলাম, এমনি দিনে আসছে বছর আবার আসব। আপনি না থাকলেও স্কুল যে কেমন গড়গড়িয়ে চলে, তা শুভদিনের ফলাফল জানিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেলাম। মিষ্টার সাগরের মনে পড়ল বিরাট বটগাছের সেই সরু ঝুরিটার কথা যেটাকে তিনি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলতে পেরেছিলেন।
তানুস্যার অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, শুভদিনের সুখবরে খুব গর্বিত হতে পেরেছি। ও এত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে এভাবে ফোর্থ হতে পারবে, তা আমি ভাবতে পারিনি।
ভুলে যাবেন না, শুভদিন গত বছর ফার্স্ট হয়েছিল। আপনার উচিত ছিল এত বড়ো সত্য ভুলে না যাওয়া।
সাগর চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আসলে মনের প্রতিহিংসাটুকু আজও ভুলতে পারেন নি। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, অতীত স্মৃতিকে এভাবে পুষে রাখবেন না। যাকে নিয়ে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছেন, রক্তের সম্পর্কে সে তো আপনার কেউ নয়, শুভদিন কিন্তু আমার নিজের সন্তান। চলি স্যার, আরো কিছু বাড়িতে যেতে হবে, যারা সব সময় শুভদিনের মঙ্গল কামনা করে। কাইন্ডলি, শুভদিনের জন্যে আর পুরনো শাপ-শাপান্ত পুষে রাখবেন না। ভুলে যাবেন না, আপনি এক সময় যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, শুভদিন সেই স্কুলের ছাত্র।
প্রত্যুত্তর না দিয়ে তানুস্যার চুপ করে থাকলেন, শুধুমাত্র লিজার কথা ভেবে। কিন্তু ফিজা বাপির এ অপমান মেনে নিতে পারল না। শুভদিন তো তার সঙ্গে বাপির কাছে পড়েছে, সেটুকু বলতে পারলেই তো সম্পাদকের মুখ শুকিয়ে যেত। সরল বাস্তব সত্য কেন যে তার বাপি প্রকাশ করতে পারল না। তানুস্যারের অবস্থা তখন ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো। মৃত্যুর আগে যিশুর একটাই প্রার্থনা ছিল, হে প্রভু, তুমি ওদের ক্ষমা করে দিও।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!