গারো পাহাড়ের চিঠি: ভেজা পাতার আমন্ত্রণে

ভেতরে দিকে নানা বৃক্ষের সমাহার–ফুলের যেমন তেমনি ফলেরও। কাল সারারাতের বৃষ্টিতে এখনও সারি সারি বৃক্ষ জুবজুবে ভিজে আছে। টিলার ঢালে ঢালে ঘণ বনের বিস্তার বলেই দেখে শুনে যেতে হচ্ছে আমাদের।কখন পাশ কাটিয়ে কখন উবু হয়ে লতার বেষ্টনীর নীচ দিয়ে ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি মাকড়সার ছড়ানো জাল ভেঙে ভেঙে। কদিনের বৃষ্টিতেই ছড়িয়ে পড়ছে চিনাজোঁক। রাবারের মতো বেশ খানেকটা লাফ দিয়ে শরীর আঁকড়ে পড়ে রক্ত চুষবে তার ইয়াত্তা নেই। তবে এখনো জোঁকগুলো ছোট। ফ্যাকাশে সাদা।

স্যাঁতস্যাঁতে মাটি– লাল মাটি জলে ভিজে ভিজে সিঁদুর হয়ে গেছে।একদিকে বৃক্ষের বিস্তার অন্যদিকে সিঁদুরে লাল মাটি — দ্রুত এগিয়ে যাবার জু নেই। ভেজা কর্দমাক্ত সিঁদুরে মাটি দেখতে বেশ লাগে। হাতের দশ আঙুলে মাটি চটকাতে চটকাতে জানো, বারবারই মনে হচ্ছিল আমি যদি পুতুল বানাতে পারতাম; লাল মাটির টেপাপুতুল! কিন্ত আমি পুতুল বানাতে পারি না। প্রায় মনে হয়, মনের ভেতর ভাবের পুতুল নাড়াচাড়া না করলে কেউ পুতুল বানাতে পারে না। আমার ভেতর পুতুল নেই– তাই আমার আঙুলেও নেই। মাটি কচলে কচলেই শুধু হাঁটছি। পুতুলের কোন আদল নেই।

ছোপছোপ অন্ধকার চারদিকে। ছাতার মতো বৃক্ষের ছড়ানো ডালপালা আর পাতার সংসার ভেদ করে খুব কম আলোই মাটিতে পড়ে। এই সময়ে এমনই থাকে গারো পাহাড়ের টিলায় টিলায়। আর মন পাগল করা কী জানি এক মাদকতার গন্ধে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। হাতে ঠিকই লাল মাটি চটকাতে চটকাতে আরো সিঁদুর হয়ে পড়ছে। শক্ত মাটির সিঁদুর মণ্ড।

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: কার্ত্তিক পার্বণ 

সাথের সঙ্গীরা একটু এগিয়ে গেছে। আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভেজা পাতার জলে শরীর ভিজে গেছে। চশমার কাঁচে বুটিবুটি জলদানা। কাছের জিনিষকেই হাতড়ে হাতড়ে ঠাওর করতে হলে কী হবে গন্ধে মৌ মৌ করছে বাষট্টি নং সীমান্ত পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে। ভেজা বনের বুঝি এমন উগ্র মাদকের গন্ধ হয়! কোচ যৈবতী নারী যখন কাঁচের গ্লাসে দরা ঢকঢক করে ঢেলে দিলে যেমন নারীর শরীরে সুবাস আর দরার গন্ধের সৌরভ একাকার হয়ে মিশে যায় পূর্নিমা রাতে যৌথ পান ভোজনের আসরে তেমনি একটা মন্ধমুগ্ধ গন্ধে আমি বিভোর।

উঁচু টিলার এই দিকটা বাংলাদেশ। কাছার ঘেষে নেমে যাওয়া যে ঢাল সমতলে মিশেছে সেখানেই বড় একটা স্ট্যাণ্ডে উড়ছে অন্যদেশের পতাকা। দুইদিকে পাহাড়ের টিলা। তা। মাঝখানেই সীমান্ত ক্যাম্প। সবুজ ঘাসের জমি। সাদা আর লালে রঙ করা চৌচালা ক্যাম্প। খুব উঁচু ওয়াচ-টাওয়ারের জানালায় বন্দুকের নল বের করে দাঁড়িয়ে আছে একজন বিএসএফ জোয়ান।

জমি তো জমিই। নিজস্বতার গড়নেই জমিন– হোক সে উঠান কিংবা আবাদি জমি জিরাত অথবা বিস্তৃণ মাইলের পর মাইলের জল জলা জমি জঙ্গল। সবই একাকার। শুধু আমিনের শেকলে দাগ পড়লেই এ জমি আমার ও জমি তোমার। আমিনের শেকল বিভক্তির শেকল। আমাদের ভাব ভাবনার বিশ্বাস অবিশ্বাসে জমি জিরাতে আমিনের শেকলে তোমার ভাবের জমিন আর আমার ভাবের জমিনে সীমা হয়। সীমানা হয়। সীমান্ত পিলার হয়। কাঁটাতার হয়। কাঁটাতার টপকে তোমার জমিন দেখার সাধ হয়। সাধ হলেই হলো? সীমান্ত রক্ষী আছে না? ওয়াচ-টাওয়ার আছে না? তারপরও গুলি আছে। হত্যা আছে। চোরাচালান আছে। গরু পাচার আছে। পরম আত্মীয়কে দেখবার ও দেখাবার উচাটন আছে। আবার কাঁটাতারে ফ্যালানি ঝুলে থাকা লাশও উল্টো করে ঝুলে তোমার আমার জমিনের বিভক্তির লাইনে।

এক আমিনের শেকলই কত গল্প নিয়ে এলো, তাই না? শেকলে শেকলে অভেদের গল্প ভেদ হয়ে উঠে বিভেদ হয়ে ওঠে। পড়শী জন বিদেশী–পড়শীর উঠান ভিনদেশের উঠান। সুজয়ের ডাকে তড়িত তাকাতেই দেখি দলবল অনেক দুরে চলে গেছে। একটু দ্রুত এগুতেই ডান হাতের কনুইয়ের নিচটুকু কাঁটাঝোপের ডালের আঘাতে হঠাৎ করেই ছরে গেলো বেশ খানিকটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। লাল রক্ত।টকটকে তাজা রক্ত।

এমনটি কখনো হয়নি। একটু সাবধানে ঝোপঝাড় বাঁচিয়ে চলাই এখানকার নিয়ম। বাম হাতের করতল দিয়ে চেপে ধরতে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পাঁচ আঙুলের ফাঁকফোকর দিয়েও রক্ত উজিয়ে আসছে। কাঁটা ঝোপে খুব কি কেটেছে? আসলে তা নয়। শুরুতে ভয় পেলেও সামলে নিয়েছি। লাল মাটি শুকিয়ে আছে হাতের চেটোয়। বাম হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরতেই হাতের চাতাল কনুইয়ের রক্তে আর সিঁদুর মাটি মিলেমিশে লালে লালে সয়লাব হয়ে গেছিল।

ফার্স্টএইডের টুকটাক আমাদের সাথেই থাকে। ডেটলে ধুয়ে যখন ক্ষতস্থান পরখ করছিলাম তখন কানে এলো গুণগুণ হাজারো লাখোলাখো গুণগুণ। মৌমাছির গুণগুণ। মৌমাছির এমন যৌথ গুণগুণ আমি শুনি নি। কী ভীষণ উচ্চকিত গুনগুণ। কান বন্ধ হয়ে যাবার গুণগুণ। মৌচাক ঘিরে লাখোলাখো মৌমাছির যৌথতার বুননের কীর্তন। পাশের পাকুড় গাছে লম্বা মতো ডালে মস্তবড় মৌচাক ঝুলে আছে। কোথাও বেশ খানিকটা ঝুলে আছে কোথায় টানা সরু পথের মতো বিস্তার। দুপুরে সূর্য্যের আলোর ছটা মৌচাকে লেগে আলতো স্বর্ণাভ হয়ে আছে। তারই ভেতর গুণগুণ। সশব্দ গুণ। যৌথতার বুননের গুণগুণ।

ভালো থেকো।

 

ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!