বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন ৩

ইতালির রেনেসাঁসে দেখা গিয়েছিল গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পুনঃচর্চার ঐতিহ্য, যা প্রায় হাজার বছরের পুরোনো ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সমর্থ হয়। মধুসূদনও গ্রিক ভাষা শিখে গ্রিসের মহাকবি হোমারের লেখা আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হন। হোমারের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে ‘হেক্টর বধ’-এর ভূমিকায়। মাইকেলের মতে, ইউরোপীয় মহাকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে হোমারই শ্রেষ্ঠ। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’টিকে তিনি নিজেই মূল্যায়ন করেছিলেন Three-fourth Greek বলে। তাঁর ইচ্ছা ছিল এই কাব্যটিকে তিনি সেভাবেই লিখবেন, যেটা একজন গ্রিসবাসী (এক্ষেত্রে হোমার) লিখে থাকতেন। তার ‘পদ্মাবতী’ নাটকের কাহিনি তিনি ধার করেছিলেন গ্রিক কাহিনি ‘Apple of Discord’ থেকে। গ্রিক ভাষার মতো ল্যাটিন ভাষাতেও সুপণ্ডিত ছিলেন মধুসূদন। ওভিদের লেখা পত্রকাব্য ‘The Heroides’ তাঁকে ভীষণভাবে উজ্জীবিত করে। যার আদর্শে তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম পত্রকাব্য ”বীরাঙ্গনা’’ রচনা করেন। ইতালীয় কবি ভার্জিল (Virgil)-এর ‘ইনিড’ (Aeneid) কাব্যের ভাষার সাংগীতিক মূর্ছনা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনায় এই কবি দ্বারা স্থানে স্থানে প্রভাবিতও হয়েছিলেন। এছাড়া প্রভাব পড়েছিল টরকুয়েতো ট্যাসোর ‘জেরুজালেম লিবার্তা’-র। আর বাংলার চতুর্দশপদী কবিতা রচনার ক্ষেত্রে মধুসূদনের আদর্শ ছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রথমপর্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি ফ্রান্সিসকো পেত্রার্কার, যিনি সনেট লিখে মূলত বিখ্যাত হন। মাইকেল মিল ও ভাবগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে পেত্রার্কাকেই বেশি অনুসরণ করেছিলেন।

বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে গ্রিক কিংবা ল্যাটিন ভাষা নয়, বাহক হয়ে দেখা দিয়েছিল ইংরেজি ভাষা— যেহেতু ইংরেজরাই ছিল তখন এদেশের শাসক। পাশ্চাত্যের যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য- ইতিহাস-অর্থনীতির চর্চা হয়েছিল, তার মাধ্যম ছিল এই ইংরেজি। মধুসূদন যখন থেকে শিক্ষালাভ করতে শুরু করেন তার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতসচিব ব্যাবিংটন মেকলের ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষার মাধ্যম পাকাপাকিভাবে হয়ে যায় ইংরেজি। মাইকেল তাঁর তারুণ্য ও যৌবনে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নেন হিন্দু কলেজে ডি. এল. রিচার্ডসনের কাছে। শেক্সপিয়রীয় সাহিত্যে এই শিক্ষকের অদ্ভুত পাণ্ডিত্য ছিল। মধুসূদনও প্রথম থেকে আকৃষ্ট ছিলেন শেক্সপিয়রের নাটকে। কাব্যের জগতে তাঁকে টানত সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি মিলটন। মিলটনের ‘Paradise lost’ ও ‘Paradise Regained’ তাঁর কাছে শুধু ভাবগত দিক থেকে প্রেরণা জোগায়নি, ছন্দ ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। মিলটনের ব্লাঙ্ক ভার্স অনুসরণে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে ছন্দের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন আমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করে। এর চরণ পূর্বেকার পয়ারের চোদ্দ মাত্রার সীমাবদ্ধ থাকলেও মিলহীনতা ও প্রবহমানতা এবং ভাবযতি অনুযায়ী ছেদ ও বিষয়-প্রসঙ্গ পরিবর্তনে অনুচ্ছেদের ব্যবহার সম্পূর্ণ অভিনব আঙ্গিক হিসেবে বাঙালি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

মধুসূদনের মনোলোক কেবল ইউরোপীয় ভাবনায় উদ্বেলিত ছিল না, আশৈশব তিনি ভারতীয় সাহিত্যের নানান কাহিনি ও তাদের রসে নিমজ্জিত ছিলেন। প্রথম জীবনে মায়ের কাছে মাতৃভাষায়, পরে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করে ও কিছুটা ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম অবলম্বন হল ধর্ম। জন্মসূত্রে মধুসূদন ছিলেন হিন্দু। বিশেষ ভাবনায় ভাবিত হয়ে পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তাঁর কাছে হিন্দুত্ব বা ধর্ম গ্রহণের পর খ্রিস্টত্ব কখনই বড়ো হয়ে দেখা দেয়নি। বাণীর বরপুত্র মধুসূদন ছিলেন এ সবের ঊর্ধ্বে। এমনকি তিনি জীবনের শেষপর্বে মহরমের মতো ইসলামি বিষয় নিয়েও কিছু লেখার কথা ভেবেছিলেন। এ থেকে তাঁর ধর্ম-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সাহিত্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর তিনি তাঁর সারস্বত সাধনার মাধ্যম বদল করলেন। পরভাষা ইংরেজি ছেড়ে ধরলেন মাতৃভাষা বাংলা। এর পিছনে তাঁর বন্ধু গৌরদাস বসাক ও জে. ই. ডি. বেথুনের সবিশেষ ভূমিকা ছিল। মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে তিনি মূলত আঁকড়ে ধরলেন ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণগুলিকে। শর্মিষ্ঠা নাটক, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য কিংবা বীরাঙ্গনা কাব্যের বিষয়বস্তু ও চরিত্র তিনি গ্রহণ করেছেন ভারতীয় ধ্রুপদি সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু অবিকৃতভাবে তিনি তা পরিবেশন করেননি। সেক্ষেত্রে কোথাও তিনি মূল ভাবনায় ঘটিয়েছেন রূপান্তর, কিংবা চরিত্রে এনেছেন দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন, অথবা আঙ্গিকগত দিক থেকে সূচনা করেছেন অভিনবত্বের। ইতালীয় রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে এটাই দেখা গিয়েছিল গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের বেলায়। ভাব, চরিত্র ও আঙ্গিকগত এই প্রাতিস্বিকতাই আধুনিকতার পতাকাবাহী। আর সে আধুনিকতাকে প্রসব করেছিল নবজাগরণ। উনিশ শতকে বাংলায় রেনেসাঁস না ঘটলে (তা যতই এলিট ক্লাস ও মেট্রোপলিটন-ভিত্তিক হোক না কেন) মধ্যযুগ অবসিত হয়ে আধুনিক যুগের সূচনাই হত না। তাই নবজাগরণকে সবাই যুগবিভাজক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে নবযুগের প্রথম নকিব ছিলেন মধুসূদন। এটা ঘটনা যে সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার, শিক্ষা সংস্কারে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো কোনো বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেননি মধুসূদন, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে নবজাগরণের বাণীসমূহকে তিনি যেভাবে অনুস্যূত করে দিয়েছিলেন তার দরুন তাঁকে প্রথম ভাববিপ্লবী বলা যায়। ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হিসেবে রামচন্দ্রকে আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষ, ধর্মনিষ্ঠ বাঙালি যে- চোখে দেখে এসেছে, মধুসূদনের হাতে পড়ে তার আমূল বদল ঘটল। তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ দেখা দিলেন দৈবাশ্রিত এক পুরুষ রূপে, যিনি নিজ পত্মী উদ্ধারে সমগ্র লঙ্কা ছারখার করে দিতেও প্রস্তুত। ছল ও অপকৌশল দাশরথিদের জয়লাভের একমাত্র পথ। অন্যদিকে রাবণ চরিত্রের নির্মাণে তিনি তীব্র আলোক প্রক্ষেপণ করলেন রক্ষোরাজের বিপুল কর্মোদ্যোগ ও গভীর ট্রাজিক বেদনার দিকে। রাবণ-পুত্র মেঘনাদই হলেন তাঁর চোখে নায়ক ও প্রিয়ব্যক্তি। অন্তিমে বুঝিয়ে দিলেন দৈবশক্তির তুলনায় আপন পৌরুষ বলে বলীয়ান মানুষই মনুষ্যত্বের গৌরবে শ্রেষ্ঠ। এইজন্যই তো শিল্পী মধুসূদনের চোখে ‘…he (Ravana) was a grand fellow.’ এই জীবনবোধের পরিচয় বাল্মীকি কিংবা কৃত্তিবাসের রামায়ণে নেই। মধুসূদন সম্ভবত এটি পেয়েছিলেন হোমারের কাব্যানুশীলনে, যিনি বিশ্বাস করতেন- ‘A man owed great actions to an ideal of man-hood.’ এছাড়া জৈন রামায়ণে রামের তুলনায় বেশি আলোকিত হয়ে উঠেছিল রাবণ, যা দক্ষিণ ভারতে প্রশংসিত হয়ে থাকে এবং মধুসূদন এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলেন মাদ্রাজে বসবাসকালে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এই চিহ্ন ছড়িয়ে আছে মধুসূদনের সব লেখাতে। নাটকের ক্ষেত্রে শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী চরিত্রে, বিলাসবতীতে, মদনিকায়, প্রহসনে হরকামিনী কিংবা হানিফ চরিত্রে। বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি পত্রে প্রেমে, অনুরাগে, ক্রোধে নারীর কণ্ঠস্বর যেভাবে গম্ভীর নাদে বেজে উঠেছে তা তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিত্বেরই অভিজ্ঞান। বাদ পড়ে না ‘ব্রজাঙ্গনা’ও। মধুসূদন বৈষ্ণব কাব্যের চিরাচরিত তত্ত্বভাষ্য থেকে এ রাধাকে সংগ্রহ করেননি, কেবল নামটি গ্রহণ করেছেন, আর তার ভাবনায়, ভাষায় ভরে দিয়েছেন শিক্ষিতা আধুনিক নারীর চেতনা ও ব্যক্তিত্ব।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!