পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর পর্ব- ৫

।।পাঁচ।।

পুরুষতন্ত্রের পূর্ববর্তী ইতিহাস যে চিত্র তুলে ধরে তা থেকে বোঝা যায় যে সে সময়ে স্ত্রী ও পুরুষে কোন ভেদাভেদ ছিল না। শ্রমবিভাজন যেটুকু ঘটেছিল তার মধ্যে বৈষম্যবোধ, শোষক-শোষিত সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি। প্রাথমিক দিকে শিকারেও নারী-পুরুষ সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করত। হয়ত বা গর্ভাবস্থার কোন এক সময়ে বা সন্তানকে প্রতিপালনের কারণে স্ত্রীজাতি সাময়িক ভাবে শিকারে বিরত থেকেছে। ক্রমশঃ এই বিরতির ভিতর দিয়ে শিকারের কাজ আর ঘরের কাজের মধ্যে শ্রমবিভাঙ্গন ঘটে থাকতে পারে, যে শ্রমবিভাজন নারীকে সভ্যতার ঊষাকালের মূল স্থপতি হিসাবে গড়ে তোলে কৃষি-শিল্প-বয়নের আবিষ্কারের ভূমিকার মধ্য দিয়ে।
মেয়েদের ভূমিকা মানব সমাজ গঠনের শুরুতে কতকগুলো মৌলিক অবদানে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

মনুষ্য সদৃশ প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টির পিছনে যে শ্রমের ভূমিকা ছিল অপরিসীম সেই শ্রমের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং সম্ভবতঃ শ্রমে হাত লাগানো সর্বপ্রথম শুরু করতে হবে মানব স্ত্রী জাতির ক্ষেত্রে। সহজাত যে মাতৃত্বের স্বাভাবিক তাগাদায় মা সন্তানকে প্রতিপালন করতে চায়, সেই মাতৃত্বই পৃথিবীতে প্রথম শ্রমে নিয়োজিত করেছিল নারী জাতিকে। সন্তান ধারণ আর সন্তান পালনের তাগাদায় নারী জাতি পুরুষ থেকে শ্রম বিভাজনে পৃথক ক্ষেত্রে নিয়োজিত হয়। শিকারে পুরুষের বেরিয়ে পড়া আর সন্তান নিয়ে মেয়েদের আশ্রয়ে থাকার পরিস্থিতি মেয়েদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের সুযোগ এনে দেয়।

আরও পড়ুন: পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর (পর্ব- ৪) 

পুরুষেরা যখন শিকার করে, পশুপক্ষী সংগ্রহ করে; মেয়েরা তখন ফলমূল-শস্য ও খাদ্য সংগ্রহ করে। এই একটি জায়গা বাদ দিলে দেখা যায় যে উদ্ভিদই ছিল মানুষের প্রধান খাদ্য উপকরন।

ছোটখাটো পশুপক্ষী বশ করে মেয়েরাই একাধারে যেমন মাংস খাওয়া শুরু করেছিলেন তেমনি পশুপালন করতেও শুরু করেছিলেন। গবেষণায় উঠে এসেছে মেয়েরাই প্রথম কৃষি আবিস্কার করেছিল। আগুনের আবিষ্কারের পর ঝলসিয়ে মাংস খাওয়ার প্রক্রিয়া তারাই শুরু করেছিল। তাদের হাত ধরেই রন্ধন শিল্প সমগ্র পৃথিবীতে রাজ করছে। কুমোরের কাজ, বয়নের কাজ প্রভৃতিও মেয়েদেরই আবিষ্কার। আসলে শিকারে নিয়োজিত পুরুষের জীবন যখন অন্য কোন ভাবনা ও ভাবনার প্রয়োগের সম্ভাবনা গড়ে তোলে নি, তখন গৃহভিত্তিক স্থিতধী জীবনে নারী, মানষিক চর্চা ও প্রয়োগের সুযোগে বলতে গেলে, মানুষ হয়ে ওঠা, সভ্য হয়ে ওঠার পথে প্রায় সব কিছুরই সূচনা করে। আর তার ভিতর দিয়েই সেই সমাজে নারী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ে যে শ্রমবিভাজন ছিল তা ছিল নিতান্তই নারী ও পুরুষের ভিতরকার শ্রমবিভাজন। এটা সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কজনিত শ্রেণীভিত্তিক শ্রমবিভাজন নয়। ফলে এই শ্রমবিভাজন শোষণ করার জন্ম সৃষ্টি করেনি শ্রেণী, গড়ে তোলে নি শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক।

যৌন পার্থক্যজনিত স্ত্রী-পুরুষ ভেদ, সন্তানধারণকে কেন্দ্র করে শ্রম-বিভাজন, কৃষিকার্য, গৃহস্থালী এমন কি যুদ্ধ বিগ্রহের কাজকে কেন্দ্র করেও যে শ্রমবিভাজন- তা ছিল সমমর্যাদার, সমগুরুত্বের কাজের নিছক বন্টন। যেখানে শোষক শোষিত, পীড়ক ও পীড়িতের কোন স্থান ছিল না। অর্থাৎ সভ্যতার আদি ভাস্বর হিসাবে স্ত্রীজাতি সেদিন প্রাধান্য পেয়ে থাকলেও, এমন কি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কারণে নারী জাতি এগিয়ে থাকলেও নারী-পুরুষ সম্পর্ক তখনো বিরোধমূলক রূপ নেয় নি। শ্রেণীশোষণ ও শ্রেণী আধিপত্য পিতৃতন্ত্রের আগে দেখা দেয় নি।

এক পতিপন্থী বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের হাতে নারীর যে নিপীড়ন শুরু হয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হয়ে পুরুষের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা যখন থেকে একেন্দ্রীভূত হতে থাকে তখনই শ্রনি আধিপত্য ও শ্রেনি শোষণের সূত্রপাত ঘটে। পুরুষ জাতির মধ্যে পাশাপাশি উদ্ভুত হয় পুরুষ মালিক ও পুরুষ দাস, অন্যদিকে পুরুষ মালিক ও গোটা স্ত্রীজাতি কার্যত দাসে পরিণত হয়। কিন্তু তখনো স্ত্রীজাতি দীর্ঘদিনে্র নিপীড়নে নুজব্য ও ক্লীব সত্ত্বায় পরিণত হয় নি। ফলে সমস্ত প্রাচীন ইতিহাসে নারী জাতিকে খুঁজে পাওয়া যায় পুরুষের পাশে। পুরুষতন্ত্রের শক্ত নিগড় স্থাপিত হবার পর নারী জাতি হারিয়ে যায়- সে পরিণত হয় সন্তান উৎপাদক গৃহশ্রমিকে।

মানব সমাজের ইতিহাসে যেমন একদিন ছিল না শ্রেনি দ্বন্দ্ব, শ্রেণী-শোষণ, শ্রেণী-আধিপত্য তেমনি ছিল না নারীর শোষণ ও নিপীড়নকারী পুরুষতন্ত্র। শ্রেণী- দ্বন্দ্ব, শ্রেণী:-শোষণ, শ্রেণী-আধিপত্য না থাকলে নারী কর্তৃক পুরুষের উপর আধিপত্যের জন্য মাতৃতন্ত্র থাকতে পারে না।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!