গারো পাহাড়ের চিঠি: মিঠুন রাকসামের জ্যোৎস্নার দেমাক

বৃষ্টি বাতাসের দাপটে অনেক দূর সরে গেছে। শাল গজারির সিনা টান করা মাথার উপর দিয়ে মেঘও দূরবাসিনী। শেষ বিকেলের হলুদ কমলা রঙের আলোর দাগে একটু একটু করো ফুটে উঠছে কালোর আঁচড়। ফ্যাকাশে নীল আকাশে হলুদে আর কমলার সাথে কালোর মিশ্রণে মনের গভীরে একধরণের আহ্লাদ যেমন জাগে তেমনি জাগে বুকের খুব গভীরে কী যেন কীসের টান বুক খালি করা গভীর শূন্যতা। অনুভূত হয় বটে, শব্দে তোমাকে সাজিয়ে দিতে পারব না।

যে ভাবেই তোমার কাছে খোলাসা করি কেন, মনে হবে বাক্যের ভেতর আঁশ নেই- প্রাণ নেই। এ কেবলই বোবা বাক্য। যে বাক্য কথা বলে না সে বাক্য- সেই ফাঁকা বাক্য তোমাকে কী করে পাঠাই বলো? তুমি যে আমার weeping hole— আমার মানসিক আশ্রয়।

তখনো থেমে যাওয়া বৃষ্টির জল ধরে রেখেছে গারো টিলার ছোট বড় গাছের পাতা আর গাছে জড়িয়ে থাকা লকলকে পাতার নানা গুল্মলতা। আলগা পটকা ঘন জলের মিহিদানা বাতাসের একটু দুলুনিতে আছড়ে পড়ছে চুলে মুখে চোখের পাতায় আর লোমশ বুকের পাটাতনে- ভিজিয়ে দিচ্ছে সব কিছু।

মিহিদানা জলে ভেজা অভেজা নিয়ে বেশ খানিকটা ঘুর পথে ফিরে এলাম বাবলা নকরেকের ঘরে। পুরো গারো পাড়া স্নাত আর স্নিগ্ধতা মাখামাখি করে আছে। জলের তোড় ঢাল বেয়ে সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েছে গারো পাড়ায় গারো উঠানে উঠানে। পিচ্ছিল কাঁকর বিছানো পথের ছোট ছোট কাঁকরদের যেন চোখ ফুটেছে। সাদা–ফ্যাকাশে সাদা, কালো–মিচমিচে কালো, হালকা হলদেটে গোল চৌকো তেকোনা ছোট্ট ছোট্ট পাথর বৃষ্টির জলে চোখ ফুটেছে মুখ ফুটেছে। যেন কেউ একজন পথের মাঝে এলেই পাথরের মুখে বোল ফুটবে সদ্য কথা বলা শিশুর মতো। আমি অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম কাঁকর বিছানো পথের ধারে— সদ্য স্নাত কাঁকড়দের দিকে তাকিয়ে।

আমার সাথে কেউ কথা বলে নি। কত কত দূর থেকে এই এই নুড়িপাথর সব নদী পাহাড় ঝোড়া পেরিয়ে পেরিয়ে এসেছে গারো টিলায়– আরো দূর বহুদূূর যাবে হয় তো। কত কথাই না জমে আছে ওদের বুকের গভীরে! আমার সাথে কোন পাথরই কথা বলল না। হয় তো আমি তেমন বিশ্বাসী শ্রোতা নই। হয় তো পাথরের কথা পাথরের মতো করে বুঝবো না।

একটু ঘুর পথে তাই বাবলা নকরেকের ঘরে ফিরে এসেছি। তুমি শুনে অবাক হবে গারো টিলার কোন কাঁকর বিছানো পথই আমি বাকি রাখি নি। কেউ আমাকে বিশ্বাসই করলো না! আমার যেমন কথা জমে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে— পাথরের তো নানা মাটি জলের সাথে মিশে মিশে নানা কথার ফুলঝুরি ওঠে— সে তবে কার কাছে উগড়ে দেয় তার কথামালা? যেমনটি তোমার কাছে উজাড় করে ঢেলে দেই আমার যত কথা আমার যত ব্যথা।

বাবলা নকরেকের ডাকে ঘুম ভাঙল। আজ চার দিন হয়ে গেলো তাঁর প্রযত্নে আছি। চোখে মুখে একটু জলের ছিটা দিয়ে সবে বসেছি গাতিমব্রায়। গাতিমব্রা কী নিশ্চয়ই তুমি জানো না। আমিও জানতাম না।এখানে থেকেই জেনেছি আমরা যাকে ঘরের দহলিজ বা ঘরের দাওয়া বলি গারোরা তাকে চিহ্নিত করেছে গাতিমব্রা নামে।

চারদিকে আতপচাল ধোয়া জলের মতো ফ্যাকাশে রঙের সাদা চাদর একটু একটু করে সবিস্তরে ছড়িয়ে পড়ে সরিয়ে দিচ্ছিল কালচে সন্ধ্যার আবরণ। তাঁর মাঝ দিয়ে শালের মাথায় চোখ মেলে তাকাচ্ছিল শুক্লপক্ষের চতুর্দশী। ভরাযৌবনের শরীর– আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে জড়িয়ে ধরছে গারো টিলার ঝোপ ঝোপ কালো অন্ধকারের অন্দরমহল।

কালো অন্ধকারে সবুজের ভেতর বাহির মুখরিত চাঁদের আলোয়। জলে ধোয়া ফকফকা কালোজিরা আতপের মতো সাদা— গন্ধময় জ্যোৎস্না আমাকেও বাবলা নকরেকের মতো নিশ্চলতার ঘণ মূর্তী বানিয়ে তুলল শুক্লা চতুর্দশী।

মিঠুন রাকসাম এই তল্লাটেরই কবি। এমন কস্তুরি সুগন্ধি জ্যোৎস্নাকে দেখেই হয়তো লিখেছেন ‘জ্যোৎস্নার দেমাক’–আচিক মান্দি ভাষায় বলে ‘জাজংনি রাসং।’ তোমাকে একটু নোক্তা দিয়ে রাখি মিঠুন রাকসাম গারো পাহাড়ে বেড়ে ওঠা কবি।

এই তল্লাট জল জমি জঙ্গলের- এই তল্লাটের অন্ধকার- ‘বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকার’ কিংবা ঝরঝর বাদল দিনে কেঁপে ওঠা পাতায় জলের বুটিদানা অথবা জ্যোৎস্না- একেক রঙে একেক সময় মেলে ধরে নিজেকে।মিঠুন এই দেমাকি জ্যোৎস্না ছবি এঁকেছেন তার বইতে। আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। দেমাকি জ্যোৎস্নার ভেতর রূপ রস গন্ধ মেখে আমি আর বাবলা নকরেক বসে আছি গাতিমব্রায়।

মিঠুন এই জ্যোৎস্নাকে বলেন ‘ফডফডা জ্যোৎস্না’। এই জ্যোৎস্নায় তিনি ‘মাছ ধরার খেলা খেলি’ করেন। তা ধরুক। সেটা তার খেলা অথবা জীবিকা। সেটা আমার বিষয় না। তিনি জ্যোৎস্নার ভেতর আরো আরো কত কিছু করলেন বা বললেন সেটা পরে বলছি। তিনি যেটি জ্যোৎস্নাকে ‘জ্যোৎস্নার দেমাক’ আছে।

এই তল্লাটে এতো এতো জ্যোৎস্নার ভেতর জল জমিন জঙ্গলে হেঁটেছি- কখনো জ্যোৎস্নার দেমাক দেখিনি। এখানেই কবির দেখার চোখ। মিঠুন রাকসাম জ্যোৎস্নার দেমাক শুধু নিজে দেখেন নি আমাদেরও দেখিয়ে দিলেন। আমি আর বাবলা নকরেক তুষের আগুনে পোড়া শালুকের তপ্ত কালো খোলশ ছাড়াতে দেখছিলাম ফডফডা জ্যোৎস্না। কস্তুরি গন্ধের জ্যোৎস্না।

বইটি আচিক ও বাংলা দুটি ভাষায় পরপর সাজানো। মিঠুন আমার পড়শি।সে আচিক ভাষাও জানো- জানো বাংলাও। আমি শুধু বাংলা। পড়শীর ভাব ভাবনা ভাষা রপ্ত করিনি। মিঠুনরা করেছে এমনকি যুগল কোচেরা- নিজ ভাষার পাশে বাংলা শিখেছে। আমি সংখ্যাধিক্যের অহংকারে আচিক জানি না। কোচ জানি না।

সেই যাই হোক মিঠুনের চোখ দিয়ে আসুন জ্যোৎস্নার দেমাক দেখি।জ্যোৎস্নার ভেতর নানা কিসিমের কায়কারবার দেখি। কবির যাপন দেখি। জ্যোৎস্না কবিকে শুধু প্রলুদ্ধ করে না- টাটায়। টাটায় শব্দটির ব্যবহার চমৎকার লেগেছে।


জ্যোৎস্না রাত
মুঠোর কাছে পাখি এসেও সুরুৎ করে উড়ে গেছে


গারো নারী
তুমি নাকি রাঙাজ্যোৎস্না!

মান্দী মিচিক
জাজংগিদা নিথিয়ানা


মাঝে মাঝে অদ্ভুত জ্যোৎস্না ওঠে
যার রঙ সোনালু ফুলের মত
ঘ্রাণহীন অথচ দূর থেকেই প্রলুদ্ধ করে- টাটায়।


জ্যোৎস্না
ওফ হোয়াইট ঘাগড়া পরা নারী
যে তার ঘাগড়া ছড়িয়ে বসে আছে
প্রণয়ের প্রত্যাশায়


আমাকে চোখ মারত হালিমা
রত্না যে জ্যোৎস্না দেখাবে বলে দাঁড়িয়ে রাখলো নারিকেল তলায়
জ্যোৎস্না কই?
দেখিয়েছিল বুক- ওফ হোয়াইট বুক


কোন দিন জ্যোৎস্না ওঠে- ‘অপূর্ব
চিতই পিঠার মত
গোল গোল পোড়া পোড়া- অসংখ্য ফুটা’


জ্যোৎস্না ছিল সতীন
খিস্তি করতো
লুঙি তুলে বলতো- চ্যাট খা! চ্যাট খা!


জলে জ্যোৎস্না অস্থির
যেমন পুঁটি মাছ


রোকিয়ার কথা মনে পড়ে
চোখ টেপার কথা মনে পড়ে

অদ্ভুত আভা
জ্যোৎস্না নাকি রোকিয়ার?


‘মদালু জ্যোৎস্নায় মজা করেছে শেখের পো তালেব। যেমন করে রোকেয়া। অথচ রোকেয়ার বুকের ভেতর জ্যোৎস্না ঝলমল করে, যেখানে ওম পায় মিঠুন রাকসামের পাহাড়ি হৃদয়।

মদালু জ্যোৎস্নায় ভাবছি, শেখের পো তালেব, জ্যোৎস্না রাতে গারোকে গারোই লাগে শেখ কিংবা ভৌমিক লাগে না। রাঙাজ্যোৎস্না মিঠুন রাকসামকে মিঠুন আলি কিংবা ভৌমিক বানাতে পারে না।’

জ্যোৎস্নার ভেতর নানা কিছু দেখেছেন মিঠুন। জ্যোৎস্না তার ল্যান্স–সমাজ প্রকৃতি সময় জীবন প্রেম আর ঘৃনা ফুটে ওঠে জ্যোৎস্নার রাতে।

তবুও জাজংনি রাসং

কুপির আলোতে যখন মিঠুন রাকসামের কবিতা পড়ছিলাম, জানো, মমতা নকরেকও হাসছিল; তার বেশি অবাক করা হাসি হেসেছিল বাবলা নকরেক। তাঁর হাসি সব সময় মৃদু উপরন্তু গোপনে- কিছুটা লজ্জায় যেন তাঁর হাসি কেউ দেখে ফেলবে। জিজ্ঞেস করতে ‘জাজংনি রাসং- জাজংনি রাসং- জাজংনি রাসং- জাজংনি রাসং’ হাসতে হাসতে বলল আর বলতে বলতে হাসল একবার আমার দিকে চেয়ে আরেক বার মমতার মুখের দিকে চেয়ে তারপর উঠে গেলেন আটালায়- ফডফডা জ্যোৎস্নায় নেচে ওঠা এঁটেল মাটির আটালায়…

‘কোন দিন জ্যোৎস্না ওঠে- ‘অপূর্ব
চিতই পিঠার মত
গোল গোল পোড়া পোড়া–অসংখ্য ফুটা’

তুষের আগুনের হল্কায় মমতা নকরেক শালুক বাঁশের চিমটি দিয়ে ধরে উল্টে পাল্টে ঢেকে দিচ্ছিল তুষের আগুনের তলায়। তখনই দেখলাম কাঁসার বাসনের মতো রঙ করা মুখটি নিমেষে শালুকের কালো খোলশের মতো হয়ে গেলে। পোড়া পোড়া। তুষের আগুনে পোড়া মমতা নকরেকের মুখ পোড়া শালুকের মতো মুখ।

চলবে…

ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!