জলের স্রোত টিলার উপর থেকে নামছে। কলকল করে জল নামছে। স্বচ্ছ- ঠাণ্ডা জল। আঁকাবাঁকা অগভীর ড্রেনের তল লাল বালু মাটির স্তর। সূর্য্যের আলো আর লাল মাটির মাখামাখিতে জল যেন আরো স্ফটিক রূপালি জল। জল বইছে- বইছে জল বাতাসে কেঁপে কেঁপে। লাল মাটির জমিনে জলের কম্পনে রোদ মেখে।
উপর ঢালু থেকে হাত খানেক নীচে যখন ছরছর জল পড়ছে কাঁচভাঙার মতো শব্দ করে, তখনই টের পেলাম এমন গভীর জঙ্গলে সশব্দ জলের শব্দে কেন এখানকার আবাসিক পাখিরাও চুপ- মুখে কুলুপ আঁটা চুপ।জলের তালে জলের ছন্দে সশব্দ জলের কীর্তন শোনার জন্য আমি ঝোরার পাশে কান পেতে বসে আছি।
জলের ফেনায় জলের বুদ্বুদ- জলের বুটি দানা পাক খেতে খেতে জলের ঘুর্ণিতে যখন পুরান পাতা কী সবুজ ঘাসের পাতাল ডগা হঠাৎ উড়ে আসে তখন পাকচক্রে চরকি ঘাসের পাতা ঘুরতেই থাকে জলের ফেনায় ফেনায় চক্রকারে।
এই পাকচক্র চরকি জীবনই আমাদের জীবন। জলের তোড়ে জলের মুখরতায় ঘাস পাতা ঠুকর খেতে খেতে কোথায় যে মুখ থুবড়ে পড়ছে তা কি আমি ঝোরা পাশে কান পেতে বসে থেকেও দেখেছি? না- দেখি নি। কানের প্রতি এতই এ্যাটেনশান ছিলাম যে, চোখ শুধু তাকিয়েই ছিল-অনির্দেশে; মৃত চাহনীর মতো অর্থহীনতায়।
আমার এই চরকি জীবনে কেউ কি কান পাতে কিংবা দেখে- দেখিবার মতো করে দেখা যাকে বলে অথবা উচাটন হয় করো মন? কারো প্রাণ? আমাকে দেখিবার শুনিবার ভাবিবার মানুষী পাইলাম না। জীবন কেবল পাকচক্রে চরকি জীবনই গেলো ঘুরতে ঘুরতে অর্থহীনতায়- কিংবা বলা ভাল আকাইম্মায় আকাইম্মায়…
এদিকে আগে যে আসি নি তা নয়। চলতি পথে এই জল জমি জঙ্গল ঘুরে গেছি বটে। অনাগ্রহ মন এখানে বসবার ইচ্ছা করেনি। এই উত্তর জনপদে কত জায়গায় তো হেঁটেছি। জিরোবার দরকারে ঠাঁই বসে থেকেছি এখানে দিনের পর দিন। কোন কোন জায়গা এমনও হয় মনের সূতার সাথে কী করে যেনো সেই জায়গার গাছপালা ফুল ফল অথবা চকিতে দেখা মানুষের সাথে মালা গাঁথা হয়ে যায়।
যেন কত দিনের কত জন্মের বন্ধন। এইখানে আমিই ছিলাম আরো কোন জন্মে। কত চেনা কত জানা এই জলা এই জঙ্গল এই বাড়ন্ত মাঠের সবুজ ঘাস। হাঁটতে হাঁটতেই টের পাই এই পাশে দিয়ে সরে যাই- একটু লাফ দিয়ে ঝোরা পাড় হই। এ তো চেনা পথ। এই বাড়ন্ত ভেজা ঘাসের ভেতর কিলবিল কিলবিল করছে চিনে জোঁক- সরু কাটা সূতার মতো চিনে জোঁক- গরম শরীরের গন্ধ পেলেই রাবারের মতো ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়বে গায়। এ যেন আমার কবেকার কোন জন্মে স্মৃতি। পথ চলতে চলতে আমাকে কে যেনো বলে দেয়- ‘ওপাশ দিয়ে ঘুরে যাও…’
কখনো এও দেখেছি এই বাঁকা পথ যে বেশি দূর যাই নি- দীর্ঘ পথের ইশারা দিয়েই অল্পটুকু গিয়েই পথ মিশে গেছে টিলার শরীরে। সেই পথে পা রাখবার আগেই কে যেন ভেতর থেকে বলে দেয় ‘এই পথ নয়- অন্যপথ- অন্যদিকে.’ সঙ্গীদের যখন বলি এইদিকে আর পথের বিস্তার নেই; ওরা তখন হাসে- হাসতে হাসতেই এই পথে অল্প দূরে গিয়ে আর পথ পায় না- ওরা অবাক হয় জিজ্ঞেস করে, ‘কী করে জানলে?’
আমি জানি না। এই জল জলা জমি জঙ্গলে আমি এই জন্মেই না- আরো আরো জন্মে আমি এদেরই ছিলাম। আমি চিনি এই সব গাছের নেচে ওঠা শরীরের ভঙ্গি। আমি জানি বাতাসের ভেতর বাতাসের সাথে খেলতে খেলতে যুবা গাছ ঢলে পড়ছে পাশের সঙ্গিনী গাছের শরীরে অথবা খেলছে কিশোরী লতা গুল্মের হলুদ সবুজ শরীর নিয়ে।
কী কথা বলে তখন? আমি কতবার খসখসে গাছের বাকলে রেখেছি কান।জড়িয়ে ধরেছি দুহাতের গাছের শরীর।শুনতে পাই নি। শুনতে পাই না। আমি পেতাম কী বলছে ছোকরা গাছ লকলকে শরীর দুলাতে দুলাতে- কোন এক জন্মে আমি যখন তাদের ছিলাম আমি শুনতে পেতাম- কী খুঁনসুটি করছে ছোকরা গাছ। বন্ধনের সূতা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। আমার বোধে আমিই- আমি ছাড়া যে আছে সে তো আমার মতো নয়- আমার নামে আমার রূপে নয়; সে নিশ্চয়ই ভিন্ন কিছু। সে অন্য কেউ। আমার অনুগামী।
কত দিন কত বৃক্ষের শরীরে রেখেছি কান। সোঁ সোঁ শব্দ নিয়ে বৃক্ষের গায়ে থাকা কালো পিঁপড়ে ঢুকে গেছে কানের গহবরে- অথচ একটি শব্দও এই স্থবির শতায়ু শিমূল একটি কথাও আমাকে বলল না। কতদূর থেকে এই শিমূলের ছাতার মতো ছড়ানো ডালপালা বিস্তার দেখা য়ায়। চৈত ফাগুনের রোদ মাখা বাতাস রক্ত লাল রঙে আঁকা শিমূল ফুলকে কত দূরে কত দূরে উড়িয়ে ফেলে। কী সুন্দর বাতাস কেটে কেটে চরকি মতো ঘুরতে ঘুরতে পাক খেতে খেতে মাটিতে ধপাস করে পড়ে ফেটে যায় রঙিলা শিমূল ফুল।
এই শিমূলের সাথে আমার গত জন্মেরও আগের জন্মে দেখা। এই শিমূলের গঠন দেখলেই আমি চিনি এই শিমূল সেই দীর্ঘাদেহি শিমূল। এতো বয়সী শিমুলের কতো না কথা জমে আছে শিমূলের মনে। নিজের কথা। এই তল্লাটের উত্থান পতন। এই তল্লাটের হাজঙের কথা। গারো কথা। হারিয়ে যাওয়া ডালু জনজাতির কথা।
কত জন্মের কত গভীর সম্পর্ক আমার শিমূলের সাথে। সেই তিনি আমাকে সরিয়ে দিলেন তার কাছ থেকে। না-মানুষের ভাষা কি আর সবাই অনুভব করতে পারে? না-মানুষের নিজস্ব লিপিতে রয়েছে সুর ও স্বর।সকলের সুর আছে সকলের স্বর আছে।মানুষ আমি আমার লিপিতে আর অনুবাদ করে নিতে পারছি না।
কিছুদূর এগিয়ে গেলেই ভরা বর্ষার বিল- যৈবতী কন্যা। কেবলই ছলছল টলটল করে। টানটান শরীরের মতো টানটান বিলের দেহ। যৈবতী কন্যার চোখ বুক ফোটার মতো করেই ফুটে বর্ষার বিল। আমি তখনই আসি।আসতে হয়- কী এক তাড়নায় আমাকে এখানে এই ভরা বর্ষার বিলের পাড় দাঁড় করিয়ে রাখে কামে- প্রেমে।
বাতাসে বাতাসে বিলের কালো জলে যে আকাশ উপুড় হয়ে থাকে সারাদিন সে আকাশ। আমি দেখি কম্পিত জলের আয়নায় ভাঙা ভাঙা মেঘ ভাঙা ভাঙা নীল ভাঙা ভাঙা উড়ন্ত কোন পাখির ডানার ঝাপটা।
যৈবতী বিল- কন্যার মতোই- ছোট ছোট আশা ছোট ছোট ঢেউ ছোট ছোট স্বপ্ন মনের উচাটন মন নিয়ে বাতাসে দুলে বাতাসে দুলে বাতাসের ভেতর আমাকে দোলায় শিহরনে ঘুমের ভেতর যেমন জাগরণেও দোলায়। আবার ঘুম ও জাগরণের মাঝে যে অস্পষ্ট জঙশন আছে সেখানেও আমাকে দোলায় দোলায়।
বিলের জলে আমি নামি না- ভয় আর শংকায় আর প্রত্যাখানের লজ্জায়। ভরা শরীরে নামতে চাইলেই কি নামা যায়? শরীর তো খোলস- চোখেই ঠাওর হয়; শাঁস অনুভবে অনুরনন হলেই তো শরীরে শরীর নামে নির্দ্বিধায়- সানন্দে- কুঞ্জবনে কুঞ্জতলায় জড়িয়ে ছড়িয়ে বসন উড়িয়ে টিলার মতো খোপায় কুঞ্জ ফুলের মালা গেঁথে।
আকাঙ্খার উচাটন মনে থাকে বটে- তবুও বিলের পাড়েই থাকে বিলকে দেখি- চোখবুক ফোটা বিলকে দেখি কামের চোখে প্রেমের বরাতে। বিল জল নড়ছে- নড়ছে বাতাসে; রোদে কিংবা বিলের স্বভাব দোষে। বয়সের উচাটনে।
একপাল হাঁস। এক দঙ্গল হাঁস। কী অসীম সাহসে সহজতায় নেমে গেলো বিলের নয়া বর্ষার জলে। যৈবতী বিলের শরীরে। ডুবছে ডুবছে- ভাসছে ভাসছে আবার দুই পাখনার ঝাপটে ফেলে দিচ্ছে হাঁসের শরীরে ময়লা সঙ্গমের ক্লান্তি গেরস্ত বাড়ির কাঁদা মাটি লোভ আর ক্লেশ। তবুও প্যাকপ্যাক- প্যাকপ্যাক;হলুদ ঠোঁটে পাতলা সরু জিবে প্যাকপ্যাক- কীসের প্যাকপ্যাক; ভরা শরীরে ভেসে ডুরে ভেসে সেলাই ফুঁড়ের সাঁতার দিয়েও হাঁসদের কীসের তৃষ্ণা? কীসের মনোবেদনা?
আমি জানি না। আমি ভরা বর্ষার বিলে কেবলই পাড়ে বসে থাকা কেউ একজন- অর্বাচীন কেউ একজন।
চলবে…
ছবিঋণ: জ্যোতি পোদ্দার